এই নাও বৃষ্টি তোমার চোখে রাখো কোনো এক বর্ষায় ঝরে পড়বে এই নাও লাল রঙ কোনো এক সন্ধ্যায় তোমার আকাশটাকে রাঙিয়ে দিবে এই নাও কাশফুল কোনো এক শরতে আমার জমিনের বুক ভরে ফুটে থেকো
চাইলেই হয়তো তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারতাম জানি কষ্ট হত, তবু অসম্ভব ছিল না কিন্তু বেঁচে থাকলে তো বাকিটা জীবন তোমাকে ঘৃণা করে বাঁচতে হবে ।
তোমায় এত বেশি ভালবেসেছি যে তোমাকে কখনো ঘৃণা করতে হবে... এ কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবিনি ভাববই বা কেন . . . ??? আমার ভালবাসা তো বাজে ছিল না আজ আমার এই ভালবাসাকে আমি ঘৃণার কাছে এত সহজে হেরে যেতে দেই কি করে বল . . . . . ??? তাই ঘৃণা করে বেঁচে থাকার চেয়ে তোমায় ভালবেসেই চলে যেত হল .
অরণ্য রিকশায় বসে আছে। রিকশাওয়ালা মধ্যবয়স্ক এক লোক। তাকে দেখে মনে হয় জগতের কোন কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। এক মনে রিকশা টেনে যাচ্ছে। ঘন্টা হিসেবে রিকশা নেয়া হয়েছে, সেটা কতদূর এগুবে কে জানে। ইতোমধ্যে প্রায় একঘন্টা হয়ে গিয়েছে। অরণ্যর ভাবতে অবাক লাগে গত একটা ঘন্টা ধরে নিতু তার পাশে বসে আছে। নিতু কি জন্য যে আজ অরণ্যর সাথে আসতে রাজি হয়েছে কে জানে।
... গত একঘন্টা আগে নিজেদের বাসার ছাদে বসে ছিল অরণ্য। আকাশে অনেক মেঘ, মেঘ কোথাও স্থির নেই। অবিরাম ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হলো যে নিতুকে ফোন দেয়া যায়। ফোন দিল সে, প্রায় সাথে সাথেই নিতু রিসিভ করলো। এই মেয়ে কি সবসময় মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে নাকি! অরণ্য ফোন দিলে সবসময় নিতু প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ করে ফেলে। এ কথা ও কথা বলতে বলতে অরণ্য বললো, চল্, আজকে একটু বাইরে ঘুরে আসি। নিতু জিজ্ঞেস করলো, কোথায় ঘুরবি? অরণ্য চমকিয়ে উঠলো। বাইরে ঘুরে আসার কথা অরণ্য মাঝে মাঝেই বলে, সবসময় নিতু না করে দেয়। কোথায় ঘুরবে কখনোই জিজ্ঞেস করে না। আজ কি নিতু রাজি হবে?! অরণ্য বললো, এমনি, কোথায় জানি না। তুই কি যাবি? নিতু দু'সেকেন্ড চুপ করে থাকলো। এই দু'সেকেন্ডই অরণ্যর কাছে মনে হলো অনেক সময়। নিতু চুপ করে আছে কেন? আচ্ছা যাবো, দেখি তুই কই নিয়ে যাস, নিতুর কণ্ঠ শোনা গেল। অরণ্যর মনে হলো জীবনে সে এত খুশি কখনই হয় নি, বললো, তুই বাসা থেকে নাম, আমি তোকে নিতে আসছি।
একঘন্টা ধরে দু'জনেই চুপচাপ বসে আছে। ফাঁকা রাস্তায় রিকশা চলছে। চারপাশে কোন শব্দ নেই। অরণ্যর মনে হচ্চে এই নীরবতা যেনো কাঁচের মত। কাঁচ যেমন হাত থেকে পড়লেই ভেঙে যায়, একটু কথা বললেই যেনো এই চমৎকার নীরবতা আর উপভোগ করা যাবে না। যে মেয়ে সবসময় একনাগাড়ে কথা বলে যায় সে এখন একদম নীরব। অরণ্য সামনের ফাঁকা রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে মাঝে মাঝে নিতুর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। নিতুর চুল উড়ছে বাতাসে, সেই চুল কখনো-সখনো এসে অরণ্যর মুখে এসে পড়ছে। কেমন যেনো একটা গন্ধ, মিষ্টি সেই গন্ধে ঘুম ঘুম ভাব হয়। নিতু আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অরণ্যর মনে হলো সেই মুখে হালকা একটা হাসির আভাস। কত সুন্দরই না দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে গাছের সারি, মাঝে পিচ ঢালা রাস্তা। সেই রাস্তায় রিকশা ছুটে চলেছে। দু'জন চুপচাপ বসে আছে। তারা কত পরিচিত। কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। কথা না বলেও অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়া যায়।
অরণ্যও আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে অনেক মেঘ, মেঘ কোথাও স্থির নেই। অবিরাম ছুটে যাচ্ছে। এই মেঘের মত, তারাও যদি অবিরাম ছুটে যেতে পারতো। অরণ্যর হঠাৎ মনে হলো, এমনভাবে যদি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো মন্দ হতো না। জীবনটা তো খারাপ না। অরণ্যের কাছে বেঁচে থাকাটা আনন্দময় মনে হতে থাকে, যদিও সেই আনন্দের মাঝে কোন একখানে খুব সূক্ষ্ম কষ্ট রয়ে যায়। . .
ভেবেছিলাম এই বর্ষায় যাবো, যাবো তোমার কাছে দেখা হবে তোমার সঙ্গে;
এক আকাশ মেঘ এক গুচ্ছ কদম সঙ্গে করে সকালের মেঘলা রোদ নিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভেজা উদোম ছইয়ের নৌকা নিয়ে মেঘে ভিজে আমি হাজির হবো তোমার কাছে, ঘন ঘোর বর্ষায় দেখা হবে আমাদের;
ভেজা ধানের শীষ হাতে বটের ভেজা চকচকে সবুজ পাতা মেলে ধরে তাকিয়ে দেখবে তুমি উড়ে যাওয়া মেঘেদের দল আঝোরধারায় ঝরতে থাকা বৃষ্টির জল; ঘ্রান নেবে সোঁদা মাটির ভেজা কলমী লতার হিজল পাতার, দূর থেকে ভিজে যাওয়া শালিক জোড়া অবাক চোখে দেখবে তোমায়;
আর আমি দেখবো তোমার চোখের জমিনে ভেসে যাওয়া শ্রাবনের মেঘলা আকাশ, চিবুকে দুষ্ট মেঘেদের আনাগোনা;
তুমি যখন খুব কাছে এসে দাঁড়াবে আমার তোমার ভেজা বুক হতে আমি নেবো বুনো কদমের ঘ্রান;
আজকাল… নিজেকে বড্ড বেশি অচল মনে হয় ! অচল আধুলির মত! যার কোনো ঠিকানা নেই ! কোনো বন্ধু নেই ! কোনো প্রিয়জন নেই! ... কোন গন্তব্য নেই–একটু স্থির হয়ে বসার!
মূল্যহীন মনে হয় চারপাশের মানুষের মাঝে!
অথচ…
আমি কোনো পাপ করিনি কোনো দিন! কাওকে ঠকাইনি! কারও বাড়া ভাতে বালি দেই নি! আমার এই দুই হাত কারো গ্রাস কেঁড়ে নেয় নি কোনো দিন! বাবার বয়েসি কোন রিক্সাওয়ালা কে নায্য ভাড়ার জ্ঞান দিতে গিয়ে আমি কোনও দিন থাপ্পর দেইনি!
কোনো ভিখারী কে সাধ্য থাকতে ফিরিয়ে দেই নি! কোনও পথশিশু রাস্তায় দুটো টাকার জন্য হাত বাড়ালে অথবা একতোড়া ফুল নিয়ে দৌড়ে এসে দশ টাকায় বিক্রি করতে চাইলে…
আমি তাদের কাওকেই ফিরিয়ে দেই নি!
আমার বাবার স্বপ্ন পূরনের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছি! পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম দ্বারপ্রান্তে ভিখিরির মতো… মানুষের আক্রোশের থাবা থেকে নিজেকে আগলে রেখেছি! চারপাশের নোংড়া আবর্জনায় গা গুলিয়ে এসেছে! তবু সম্ভ্রম বাঁচিয়ে রেখেছি!
নিজের লোভ সামলে চলেছি! অন্যকে ভালোবাসতে শিখেছি! মানুষ কে বিশ্বাস করতে শিখেছি! অন্যের চিন্তা এবং মতামত কে সম্মান করতে শিখেছি! ভাই বোনের জন্য ত্যাগ করতে শিখেছি! কাছের মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে শিখেছি!
নিজের! আমার পিতার! আমার পরিবারের!
আজ আমি সফল একজন! আজ আমি স্বাবলম্বী একজন! আজ আমি বাবার অপুর্ণ স্বপ্ন পূরন করতে পেরেছি এবং বাবা কে ঘিরে অন্যের সব স্বপ্ন… পূরনের পথে হাঁটি অবিরাম!
আজ আমি আমার মায়ের চোখের জল মুছে দিতে পারি আমার আঁচলে! ছোট ভাই বোনের মুখ দেখলেই বুঝে যাই, মনে কোনো কষ্ট আছে কি না! আজ আমি সবার মাঝে ভাগ হয়ে গেছি! টুকরো টুকরো আলোর কনার মতো!
অতি খুদ্র জোনাক পোকার মতো! যেখানেই যাই…আমার চারপাশ আলোকিত হয়ে যায়! চারপাশের অন্ধকার হাল্কা হয়ে আসে ! আজ আমি স্বপ্ন দেখাই… স্বপ্নভোগি মানুষদের! স্বপ্নহীন অভাগাদের! প্রানহীন, ছন্দহীন এবং দূর দৃষ্টিহীন প্রান্তিকদের!
আজ আমার স্বপ্ন… অন্যের স্বপ্নের চাকা হয়ে ঘুরে! আজ অন্যের জীবনে মেঠো পথ হয় থাকি! অচেনা ভীতু অথবা খুব সাহসী পথিকের বন্ধু হয়ে!!
তবু নিজেকে আজকাল বড্ড অচল মনে হয়! যদিও কখনও মনের সুখের জন্য কারও দরোজায় শূণ্য থালা নিয়ে দাঁড়াইনি! নিজেকে বিক্রি করে দেইনি কোনোদিন শরীরের কামনার স্রোতে! কখনো পা পিছলে গেলে… আবার উঠে দাঁড়িয়েছি! মাথা উঁচূ করে!
তবু করুনা ভিক্ষা চাইনি…প্রেমের তরে যারা ঈশ্বর হয়ে আসেন পৃথিবীতে…তাদের কাছে!
শুধু একটি চিঠি চেয়েছিলাম! ভালোবাসার রঙ এ আঁকিবুকি করা!
শুধু একটি কুন্ঠ চেয়েছিলাম… মমতা জড়ানো! শুধু একজন মানুষ চেয়েছিলাম… যে বন্ধু হবে মনের! যে ছায়া হবে প্রখর রোদে! আশ্রয় হবে…উন্মত্ত ঝরে! যে আমাকে বুঝবে … নদী যেমন বুঝে মোহনার টান! আকাশ যেমন বুঝে সাগরের চোখ!
দক্ষিন হাওয়া যেমন বুঝে বসন্তের ব্যাকুলতা!!
পৃথিবী যেমন বুঝে…মাটি আর মহাকাশের মাঝখানের শূণ্যতা!!
কিন্তূ হায়! আমি হয়তঃ ভুলেই গিয়েছিলাম… আজকাল মানুষেরা আর প্রকৃতির মতো নেই!! আমি হয়তঃ ভুলেই গিয়েছিলাম… আজকাল মানুষেরা কেবল-ই মানুষ!!
কবি কেমন আছ তুমি ? কোন নারীর বুকে এখন রেখছ তোমার হাত ? যখন বূষ্টি পরে রিমঝিম রিমঝিম , তোমার মুখ খানি ভেসে আসে আমার চোঁখে। এমন কোন এক রিমঝিম সন্ধা মুখর বর্ষায়, তুমি করেছিলে আমার নিরাবরন । বলেছিলাম কি দেখ এমন করে আমাকে তুমি ? বলেছিলে আমি নাকি এক জীবন্ত দেবী, তোমার কথার প্রেমে আমি বিলিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন , তুমি মুখ রেখেছিলে আমার ঠোঁটে, তোমার স্পর্শে আমায় হয়নি কিছুই , বলেছিলাম কি করো কবি ? ব্যথা পাই ছারো আমায় । আর তখন তুমি বলেছিলে আমার ঠোটে জোড়া কমলা লেবু, তার মাঝে হারিয়ে গিয়েছ তুমি , বিশ্বাস কর কবি তোমার এই কথা শুনে আমার জীবনে প্রথম এসেছিল যৌবন । আমি বুঝেছিলাম আমি এক নারী , আমারো বাসনা জাগে, আমারো ভালো লাগে আদর । কবি জোর করে রেখেছিলে হাত আমার বুকে , আমি বলেছিলাম কি করো কবি ভয় হয় । তুমি বলেছিলে আমার বুকে আছে সোনার আপেল , পূথিবীর সুন্দরতম সেটি । কবি এর পর আমি বলিনি তোমায় কিছু , তুমি রেখেছিলে হাত আমার বুকে । তোমার আদরে আমি সেদিন আমি বুঝেছিলাম আমিও এক নারী । কবি আমি কোনদিন তোমার প্রেমে পরিনি , আমি ভালোবেসেছি তোমার কবিতাকে । মনে আছে কবি সেদিন বিকেল বেলায় তুমি এসেছিলে আমার ঘরে । শুনিয়েছিলে তোমার বিখ্যাত সেই কবিতা ভালোবাসি ভালোবাসি । আমি মুগ্ধ হয়ে বলেছিলাম কবি কি চাও তুমি ? আজ তুমি কিছু চাও আমার কাছে । কবি জরিয়ে ধরেছিলে তখন তুমি । নিয়েছিলে টেনে বিছানায়। করেছিলে নগ্ন আমায় । কবি কিছুই বলিনি আমি , দিয়েছি তোমায় সব বিলিয়ে। কারন তুমিযে কবি , তোমাকেই সব দেওয়া যায় । তুমিযে শোনাও ভলোবাসার গান । এর পর কতবারযে তোমায় বলেছি শুনাতে নতুন কবিতা, তুমি শোনাওনি । কেন কবি তোমার কবিতার কলম কি গেছে হারিয়ে? নাকি অন্য কোন নারীর বুকে এখন হাত রেখছ তুমি ?
ঝম ঝম বৃষ্টি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ। গুরুগম্ভীর বজ্রধ্বনি। আকাশের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘোর কালো মেঘমালা বিস্তৃৃত। যেন কালোমুখী মেঘমালা মুগ্ধরূপী বাংলার সাথে অভিমান করে বেজার মুখে, ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে, ছল ছল করে তাকিয়ে আছে। আর অপ্রসন্ন মনে প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজছে। মাঝে মাঝে আবার তর্জে গর্জে হাঁকডাক দিয়ে চেঁচিয়ে তুলছে গোটা প্রকৃতিকে। এক বর্ষাঝরা প্রভাতে কেদারায় দুলে দুলে বাতায়নের পর্দা সরিয়ে অপলক নেত্রে দূরদিগন্তে আলোকপাত করছিলাম এবং অত্যন্ত আবেগ প্রবাহে আপ্লুত হয়ে ভাবালুতা, সতেজ সরল মনে কী সব ভাবছিলাম। আব্বুর মারের ভয়ে বাংলা বইখানা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে পড়ার ভান করছিলাম। প্রতিদিনের মতো আজ সকালেও আম্মা রান্না করেছেন। কেননা একটু পরে আমার ক্লাসে যেতে হবে। তবে আজকের খাবারের আয়োজনটা ছিল অন্যরকম। পদ্মার রূপালি ইলিশ ভাজি, লাউশাক দিয়ে ইলিশের মাথা রান্না, মসুরিসহ আরো হরেক রকম খাবার ছিল আজকের ডাইনিং টেবিলে। ইলিশ ভাজির ঘ্রাণটা ছিল মনমাতানো। মুহূর্তের মধ্যেই যেন ঘ্রাণে ঘ্রাণে ছেয়ে গেছে চারদিক। মুগ্ধময় গন্ধে জিভটা চোঁ চোঁ করে উঠল। অভিমানে ভারমুখী মেঘমালারও যেন ইলিশের সুঘ্রাণে আকুল হয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। বৃষ্টিরা হুম হুম করে আরো প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে। বৃষ্টিদেরও যেন ইলিশের পরে লোভ লেগেছে। নিস্তব্ধ নীরব প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বর্ষাকে নিয়ে এমনি করে ভাবতে বেজায় ভাল লাগছিল আমার। দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িটা যেন আমার সাথে রেষারেষি শুরু করেছে। দ্রুতগতিতে শুধু এগিয়েই চলছে। মুহূর্তের মধ্যেই টঙ টঙ করে ক্লাসে যাওয়ার ঘণ্টা বাজাল। তড়িঘড়ি ছুটে গেলাম ডাইনং টেবিলে। প্রগাঢ় লোভে আপ্লুত হয়ে পড়লাম এবং খুব মজা করেই খেলাম। ঝটপট ইউনিফর্ম পরে স্কুলব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেশ আড়ম্বরের সাথে স্কুলের উদ্দেশে রওনা হলাম। ছাতা মাথায় প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে ঝড়োবাতাসের রুক্ষ মূর্তি, যেন মাথার ছাতা ছিনিয়ে নেবে। হাঁটছিলাম অতীব আগ্রহের সাথে স্কুলপথে। কী দারুণ মজা লাগছিল আমার! অপূর্ব দোলায় দোলায়, সুশোভিত পুষ্পের ন্যায় আনন্দে উচ্ছল হয়ে পড়ল হৃদয়-মন। ক্ষণিকের মধ্যে স্কুলে পৌঁছে গেলাম। ক্লাসে প্রবেশ করলাম। এরপর স্যার এলেন। বাংলা স্যার বর্ষাকে নিয়ে বেশ মজার মজার গল্প বললেন। তাছাড়া অন্যান্য টিচারদের মুখেও কম-বেশি গল্প গুজব, তাদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকথা শুনলাম। তখনও কিন্তু অবিরাম ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। দ্বিপ্রহর ঘনিয়ে এলো। দফতরি ছুটির ঘণ্টা বাজাল। তখন ঠিক দুপুর। আকাশের কালো কালো মেঘে চারদিক ঘোর অন্ধকার। দুপুরকে উপলব্ধিই করা যাচ্ছে না, যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। দ্বিপ্রহরের এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, মেঘের নির্মম কবলে পড়ে হয়তো, তেজোদীপ্ত সূর্যের মুখশ্রী হিম-শীতল হয়ে চির অস্তমিত হয়ে গেছে। বাড়ির দিকে ছুটলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেল। ক্ষুধার তাড়নায় পেটে হুম হুম শব্দ শুরু করে দিলো। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বাড়িতে তো আজ পিঠা-পুলির আয়োজন। আম্মাতো পিঠে তৈরি করছেন। বর্ষার দিনে পিঠে খেতে কী যে মজা! বর্ষাকে নিয়ে এখন আর ভাবতে ভাল লাগছে না। মনও বসছে না। এখন শুধু পিঠে আর ইলিশ, কখন যাব? কখন খাব? হাঁটছি তো হাঁটছিই। ডানে-বামেও ফেরা নেই, শশব্যস্ত! সহসা কে যেন পেছনে থেকে শিশুসুলভকণ্ঠে, অত্যন্ত করুণ সুরে ডাক দিল – ভাইয়া! ভাইয়া! ভাইয়া। আমি পেছনে তো ফিরে তাকালাম- ই না বরং বেশি একটা গুরুত্বের সাথে কর্ণপাত না করে হেঁটেই চললাম। কিছুক্ষণ পর অতিশয় মিনতির স্বরে ভাইয়া! ভাইয়া! বলে আবারও সম্বোধন করল। আমি অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করলাম এবং তীক্ষ দৃষ্টিতে পেছনে ফিরে তাকালাম। দেখতে পেলাম আট-নয় বছর বয়সের একটি বালক হাঁফাতে হাঁফাতে আমার কাছে দৌড়ে আসছে। বালকটি অত্যন্ত নমনীয় পদে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তখন বেশি একটা বৃষ্টি নেই, গুঁড়ি গুঁড়ি ঝরছে। বালকটি ভারাক্রান্ত হৃদয়, অসহায়ের মতো ছল ছল করে আমার মুখের পানে তাকিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে। শুকনো মুখ থেকে যেন কথা বেরোচ্ছে না। কষ্টে বুকটা খাঁ খাঁ করছে। কী এক করুণ দৃশ্য ফুটে আছে বালকটির মুখমণ্ডলে। মাথার অগোছালো উসকো-খুসকো চুলগুলো ভিজে টুপটুপে হয়ে আছে। আমি ছাতাটা এগিয়ে বালকটিকে ছাতার তলে নিয়ে নিলাম। বালকটির শুষ্ক মুখের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা টেনে অত্যন্ত মোলায়েম কণ্ঠে – ভাইয়া! এতটুকু বর্ষায় ভিজলে আর কী হবে? সারা রাত সারা দিন বর্ষার মধ্যে-ই কাটাতে হয়। আমি বললাম, তাহলে কি তোমাদের বাড়িঘর নেই? বালকটি আর্ত-বিহ্বল কণ্ঠে জবাব দিল, নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর আছে ভাইয়া! বর্ষা এলে ঝুপ ঝুপ করে চালার ফাঁকা দিয়ে পানি পড়ে। অনেক কষ্টে সেখানে থাকতে হয়। আমার সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে উঠল। বালকটিকে কী যেন বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু বলতে পারলাম না। ক্ষণকাল বালকটির সঙ্কীর্ণ মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এরপর বালকটি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে চরম বিরক্তির স্বরে বলল, ভাইয়া আমি আজ দুই দিন অনাহারে, বাবা কাজ করতে পারেন না। বর্ষায় ভিজে কাজ করতে করতে অসুখ লেগেছে। বিছানায় পড়ে অসহায়ভাবে আর্তনাদ করছে। ওষুধ খেতে পারছে না। ক্ষুধা পেয়েছে অসুস্থ বাবার। কিন্তু বাবাকে দেয়ার মতো আমাদের ঘরে কিছুই নেই, আমরা সকলে অনাহারে থাকি। মা নদীতে জাল ফেলে কিছু মাছ ধরে, তা বিক্রি করে যে সামান্য পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, তাতে বর্তমানে উচ্চমূল্যের বাজার থেকে এক বেলার আহারও ক্রয় করতে পারি না। বালকটির এই হৃদয়বিদারক ভাষ্যে আমার হৃদয় বিষাদে আপ্লুত হয়ে পড়ল। আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ইতস্তত হয়ে বালকটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কী? বলল লিখন। বললাম, লিখন, তুমি এখন কোথায় যাবে? লিখন অবনত মস্তকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বলল, ভাইয়া! কোথায় আর যাব, দুটো টাকার জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম, দেবেন কি? আমি পকেটে থাকা মাত্র বিশ টাকার নোটটা লিখনের হাতে তুলে দিলাম। লিখন সাথে সাথে আমার পায়ের পরে লুটিয়ে পড়ল এবং অস্পষ্ট মৃদুকণ্ঠে বলল, ভাইয়া! আপনি এত্ত ভাল! আবেগঘন ভঙ্গির মাধ্যমে, বাহুদ্বয় প্রসারিত করে লিখনকে পা থেকে তুলে নিলাম। বুকের সাথে আলিঙ্গন করলাম। বলল ভাইয়া, আমি এখন চললাম। আমি মায়াবী মুখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম লিখনের যাওয়া পথের দিকে। নিমেষের মধ্যে লিখন অদৃশ্য হয়ে গেল। গুটি গুটি পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম এবং মনঃক্ষুন্ন হয়ে ভাবলাম, সকালে পেটপুরে মজাদার সুস্বাদু খাবার খেয়ে এলাম, ক্লাসের মাঝে আবার টিফিন করলাম। দুপুর না গড়াতেই আবার হুম হুম করে ছুটছি পিঠে আর ইলিশ! কখন যাব? কখন খাব? কিন্তু লিখন কি ওর জীবনে একবারও ইলিশ পিঠে খেতে পেরেছে?
সেই বৃষ্টিমুখর এক দুপুর থেকে আমি প্রতিদিন লিখনকে খুঁজে ফিরি, না জানি লিখন কতদিন অনাহারে আছে। বর্ষায় ভিজে পথে পথে দুটো টাকা ভিক্ষে করে ফিরছে। হৃদয়ের তারে তারে ঝঙ্কার হয়ে আজ শুধু একটি প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছে বারবার, তাহলে কি লিখনের ঐ ফুলের মতো পবিত্র জীবনটা এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে?