[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

স্বপ্নওয়ালা...

স্বপ্নওয়ালা...

১৩ ই মে, ২০০৮ দুপুর ১২:১৪


খুব সম্ভব ৯০ বা ৯১ সালের কথা।
আমি তখন নিতান্তই তরুন, কিশোরও বলা চলে। সেসময় নিজের ব্যস্ত ছোটাছুটিটা জমে উঠেছে রীতিমত। বাসার ২টা ট্রাক পালা করে ট্রিপে পাঠাই, ছুটে বেড়াই আরও অন্যান্য কাজে, রাতে কড়কড়ো টাকা গুনি। বড় ভাল লাগে ময়লা টাকাগুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে। পাড়ার মোড়ে ছোট্ট একটা স্টল, সেটাতে বিকেলের সামান্য একটু অবসর কোনাভাঙা চায়ের কাচে ডুবে যেত। কদিনে চাওয়ালার সাথেও সখ্যতা হয়েছিল বেশ। দোকানের একমাত্র কর্মচারীটা বেশ ফুটফুটে, নয় কি দশ হবে মেয়েটার বয়স, আরও কম হতে পারে। লোকটার নিজের মেয়ে। উজ্জল হলুদ ফ্রকের মতই জ্বলত ওর চোখমুখ। কৌতুহলের বসে একদিন জেনে ফেলি ও পড়ত ক্লাস থ্রিতে। বই কেনার টাকা ওদের কাছে বিলাসীতা। অগত্যা বাপের কাজে সাহায্য করা। কেমন একটা বিষাদ সহসা ছেয়ে ধরে আমাকে। এত সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে যে স্বপ্নকে ধারন করে হয়ে উঠতে পারে স্বপ্নের যোগ্য ধারক সামান্য কটা টাকার জন্য....।আমার বয়ষ তখন অল্প, অথচ স্বাধ-আহ্লাদ, আকাংখা, আবেগের কমতি নেই। সেই আবেগের ছটায় মেয়েটা আবার স্কুলে ভর্তি হল, নতুন বই কিনে মুখে হাসি ফুটিয়ে টুংটাং করে পড়া শুরু করল। অবসরে অশিক্ষিক বাপের ক্যাশ সামলাল।

এরপর কাজের চাপে, অর্থের তাপে, সময়ের আবর্তে একসময় হারিয়ে যায় সবকিছু। সেই চাওয়ালা আর তার ছোট্ট স্বপ্নওয়ালা মেয়ে কোথায় জানি চলে গেছে। আর আমিও রীতিমত ভুলতে বসেছি তাদের কথা..শুধু নিজের অজান্তেই মেয়েটার মধ্যে ধারন করে ফেলেছি নিজের স্বপ্ন। মনে হত ও বেড়ে উঠুক। ওর চলা স্বাচ্ছন্দময় হোক।কেমন এক আত্মতৃপ্তির অজানা শক্তি ফুয়েলের মত এগিয়ে দিত আমাকে।

একযুগেরও বেশী কেটে গেছে, একদিন হটাৎ ওই বাপ বাসায় এসে উপস্থিত। ভুলে যাওয়া স্মৃতিটাকে ঝালাই করে নিতে একটু সময় গেলেও চিনে ফেলে একটু বিরক্তই হলাম আমি। এ কেমন লোক ওই ঘটনার পর একবারও যোগাোগ করল না। লোকটা জানায় তার লজ্জার কথা।উত্তরনের কথা।অন্য একটা শহরে তার চায়ের দোকানটা ভালই চলে। আমার দেয়া মেয়েটার পড়ার জন্য এককালীন টাকাগুলো থেকে কিছু টাকা সে দোকানটাতেও লাগিয়েছিল। মেয়েটা...তোমার মেয়েটা...? প্রশ্ন করতেই আবেগে হারায় লোকটা। চোখমুখ মুছে জানায় আবদার। সেদিনের সেই ছোট্ট খুকি আজ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখন বিকম পাস করে চাকরির আশায় আমাদের শহরের একটা বেসরকারী ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়েছে। এখন আমার একটু উদ্যোগ মেয়েটার চাকরী নিশ্চিত করতে পারে, কেননা ওই ব্যাংকের লোকেরা আমার বন্ধুস্থানীয়।

মুহুর্তে আমি পেয়ে যাই এক আশ্চর্য জগৎ, কর্মব্যস্ততায় যা কখনওই ধরা দেয়না কোন ফাকে। এক পলকেই মনে পড়ে ছোট্ট কচি মুখটার কথা।ও এতবড় হয়ে গেছে? আমার ছোট্ট একটা সুপারিশে ও ভাল একটা কাজ পেয়ে হয়ে উঠবে পরিবারের উন্নতির সিড়ি। পাল্টে যাবে ওর ভবিষ্যৎ ও ধারন করবে আমার স্বপ্ন স্বাদ। হঠাৎ কেন জানি, নিজের এইটে পড়ুয়া মেয়ের মুখের সাথে মিশে যায় মেয়েটার মুখ, আমার মনে, অস্ফুট কন্ঠে বলি আমি, 'আমার মেয়ে চাকরীটা পাবে, অবশ্যই পাবে।

বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১২

শুধু ক্ষুধার জন্য বারবনিতা আঁধার রাত

 

শুধু ক্ষুধার জন্য বারবনিতা আঁধার রাত


কিসে ভাল আর কিসে মন্দ
আমি বোধ হয় কিছুই জানি না তার
পথে দ্বারিয়ে থাকা বেশ্যা শর্বরী
নিয়ন লাইটের আলোয় ফুটায় নেশার অজগর
একটু আঁধারে কান কথা,
ঘ্রাণ নেয় ঠেসে স্তনের,
পারলে ছুঁয়ে দেখতে চায় নিতম্ব যো‍নিকাঙ্চন
ও কি ভুলে যায় পাপপূণ্য? না‍কি ক্ষুধার যৌণচার
এ যে নেশার কলঙ্ক
সোদামাটির গন্ধ সব চুষে খায়, গো-গ্রাসে গিলে ফেলে সব
যাতনা ধরার; তা’হলে মিছে পাপ-পূণ্য? যৌণ ঘ্রাণ মাখা ফুটপাতের সন্ধ্যা
যেখানে মায়ার আলো ছড়ানোর কথা ছিল
অথচ সেথানে বিকায় যৌবণঃ
শুধু ক্ষুধার জন্য শরীর,
শুধু ক্ষুধার জন্য লোলুপ ঠোঁট ছিঁড়ে খায়,
শুধু ক্ষুধার জন্য শরীর সিৎকার!
শুধু ক্ষুধার জন্য সঙ্গম ঘ্রাণ রাতভর বাতাসে ভাসে
শুধু ক্ষুধার জন্য বারবনিতা আঁধার রাত
জোনাক ছুঁয়ে বাঁচে।

কেউ লিখে তার জন্য কবিতা,

কেউ লিখে তার জন্য কবিতা,

 

কেউ লিখে তার জন্য কবিতা,
কেউ কেউ সাধে তার জন্য ছড়া গপ্পের বই
মাঘের শীতে সিদ্ধ হয় ঐ নেওটা মুখপুড়ি উদাম মেয়েটি,
হামাগুরি দিতে দিতে
যার শরীর চিটচিটে গন্ধ হিসুতে ভিজে ধুলা হয় কাদা,
তাতেই মাখা গা’তার
নরম ঠোঁট জোড়ায় দুধের বদলে বালুর প্রলেপ মাখা,
ক্ষুধার কান্নায় মায়ের শুকনা বুক চাটে।


কেউ লিখে তার জন্য কবিতা,
কেউ কেউ সাধে তার জন্য ছড়া গপ্পের বই
করুনা বিগহবল বিবেকের কাছে হয়তো একটু বাঁধে,
তাতে কি আসে যায়
পারি না খন্ডাতে সবটুকু দুঃখ,
হয়তো আমরা এমনি আমাদের আশার মত ক্ষমতা ছোট
হয়তো ঐ মেয়েটি তাই,
আকাশের কাছে অতি ক্ষুদ্র আমি আমরা সবাই।

একটি ভিন্ন ডানার পাখি

 

একটি ভিন্ন ডানার পাখি


রাতের কাপড় খুলে নগ্ন হল দিন
তার নগ্নতার খাঁজে ঝরছে শিশির
সেই আরশিতে মুখ দেখে রাজকন্যা
আবার শিশির জলে চোখে মুখে কান্না ,
কখনো ভাবছে প্রিয় ঠোঁট, তাতে ঠোঁট ছোঁয়
জলকণা জুড়ে থাকে , ঠোঁটে ছোট্ট তিল হয়
তিলের সে আকর্ষণে গ্রহগুলো ঘুরে
গ্রহান্তর থেকে উঠে এসে স্থির থাকি
তিলের মায়ায় চুলের ছায়ায়
স্থির থাকি ,

দুটো তিলে আকর্ষণ চুম্বনের চেয়ে কাছে !
এই দূরত্বের পথ , নিয়ে যায় আরো জলে
সেই তলে ডুবেতে হয় না , ভাসতে হয়
ভাসতে হয় …
বাসতে হয় …
ভালোবাসতে হয় …
এই পৃথক অবস্থা স্পর্শের চেয়েও উষ্ণ
ছেঁড়া উষ্ণতায় আমি গলে যাই
হয়তো তুমিও তাই , তোমাকেই চাই ,
জানি না তো কি বলছি কেন`ই বা বলছি
তবু ফিয়ে যাই ফিরে আসি
সহজ করেই বলি ভালোবাসি
তবে একটা ভিন্ন ডানায় ভাসি
শোন অণু শুধু তোমাতেই ভাসি …
একটি ভিন্ন ডানার পাখি।

২রা ফাল্গুন ১৪১৭ ।

[ একটি অবুঝ সময়ে অপরিপক্ক লেখা so no obligation ... ভালোবাসা দিনের শুভেচ্ছা জানাতেই হুট করে লিখা , তাই এই কবিতার সমালোচনার দায় আমি নিতে রাজি না ...]

অনুভব-(পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)-শেষ পর্ব

গল্পঃ-অনুভব-(পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)-শেষ পর্ব

গল্পঃ-অনুভব-(পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)-শেষ পর্ব
প্রথম পর্ব

(৪)
“শাড়িটা বের করে তৈ্রি হচ্ছে মৌরি তার সাথে পাল্লা দিয়ে তৈ্রি হচ্ছে কিছু বৈরীতা।আয়নায় নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে মৌরি শুনতে থাকে দরজার বাইরের চিৎকার আর দেখতে থাকে জানালার প্রতিবিম্বে আকাশে মেঘেদের জড়ো হতে থাকা,তাদের দ্রুত কালো হতে থাকা”।-ওহ আপা কারিগর বাড়িত গেছে হঠাৎ। কাল নিয়েন।
মৌরী স্বপ্নভাঙ্গা মানুষের মত ফ্যালফ্যালে তাকাল, যেন সে কিছু বুঝতে পারছে না। যেন লোকটা দুঃস্বপ্নে তাড়া করা একটা চরিত্র। লোকটা আবার গলা খাকড়ি দিয়ে বলল,
“আপা। কাল নিয়েন”।
মৌরি আর কিছু বলতে পারল না। হতাশায় বুদ হয়ে দোকান থেকে বেরুল। তার স্বপ্নের পাশাপাশি তিনদিনের টানা পরিশ্রম পুরোটাই মাটি হয়ে গেছে। কী ঝঞ্ঝাট করেই না সে গত দুই দিন দোকানে ঘুরে ঘুরে সাদা জলছাপ শাড়িটা কিনেছে !তার উপর ঘন্টা দুই ব্লাউজের জন্য দরজি পাড়ায়-পাড়ায় হন্যে দিয়েছে। এক দিনে কেউই ডেলিভারী দিতে রাজি হচ্ছিল না। তাও যা একজন রাজি হয়েছিল আজ এসে জানতে পারল সেটাও কিনা ভেস্তে গেছে আর শাড়িটার সাদাটাও একটু ম্লান।কেনা ব্লাউজের সাথে ঠিক যাবে না। রিকশায় ফিরতে ফিরতে নিজেকে আবার নতুন করে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। তার মাপের ব্লাউজসহ শাড়ি আপাতত শুধু একটাই আছে তবে সেটাও আবার লাল। দেখা করার মিষ্টি আমেজটা এখন দুঃশ্চিন্তা হয়েই হানা দিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে তপুকে তাড়া দিয়ে কী ভুলটাই না সে করেছে।
বাসায় পৌছে কোন মতে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে শাড়িটা বের করল মৌরি। টকটকে না হলেও বেশ লাল!সন্ধ্যের পর হলে কিংবা ইন্ডোর হলে খারাপ লাগতো না। ধানমন্ডি লেকের খোলা প্রকৃতি তার উপর জুন মাসের বিকেল পাঁচটা,তার উপর তাজা রোদ সবমিলিয়ে লাল শাড়ি একেবারে খাপছাড়া লাগবে। এত বলে কয়ে সে কিনা নিজের মনের মত একটা শাড়িই পড়ে যেতে পারবে না! প্রথমদিন নিজেকে তপুর কল্পনার মত সাজিয়ে যেতে না পারার ব্যাপারটা সে কোন মতেই মেনে নিতে পারছে না। একে একে নানান ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে মনে। আনমনে সে জামার উপরই শাড়িটা জড়িয়ে নিজেকে দেখতে চায়।


-কি রে!কি করিস!
মাকে দেখে মৌরি একটু চমকে উঠে।থতমত খেয়ে বলে,
-একটু দেখছিলাম শাড়িটা ভালো লাগে কিনা?
-মানে!বুঝতে পারছি না। তুই বাইরে থেকে এসেই শাড়িতে নিজেকে দেখছিস!
-হুম। আজ বেরুবো।
মৌরির মা রেবেকা সুলতানা হাতে সরবত নিয়েই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিস্ময়ে মেয়েকে তা দিতে ভুলে গেছেন।
-তুই বেরুবি মানে? এটা কেমন খাপছাড়া কথা? কোথায় যাবি?
-ওই যে। আমরা বান্ধবীরা মিলে একসাথে বাইরে বেড়াতে যাব বিকেলে।
-এই গরমে! আর তোদের না পরীক্ষা নেক্সট ওইক এ? কে কে যাবি?
-তুমি জেড়া করছো মা!
-হ্যা করছি।
মৌরি কোন উত্তর দেয় না। মায়ের হাত থেকে সরবতটা নিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলে,”চিনি বেশি হয়ে গেছে” আরো এটা সেটা। রেবেকা সুলতানা কিছু বলেন না ,মেয়ের কথাও কিছু শুনেনও না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত নতুন করে দেখতে থাকেন মৌরিকে। সাড়া শরীর চোখ দিয়ে ময়ণাতদন্ত করে যেন বুঝতে চাইছেন মেয়ের মন। নিজের অশুভ সন্দেহের সাথে তাল রাখতে না পেরে তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে মেয়ের ঘরের টুকটাক গোছাতে লাগলেন। লাল শাড়িটা ভাজ করে হ্যাঙ্গারে টানিয়ে রাখতে রাখতে আলমারিতে নতুন সাদা শাড়িটাও এবার তার চোখে পড়ল,
“এটা!”
“আমি কিনেছি। আমার জমানো টাকা থেকে”।
তিনি এবার আর কোন প্রশ্ন করলেন না,তাকালেন না পর্যন্ত মেয়ের দিকে। তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ উলটে পালটে দেখলেন শাড়িটা তারপর বিছানায় কোনরকম ছুড়ে ফেলে বললেন,
“না মার্স্টাস পরীক্ষা ছেলেখেলা না। তুমি কোথাও যাবে না”।
রেবেকা সুলতানা তার বিস্ময়ে,জেড়াটায়, তাকানোটাতে, সব কিছুতে একটা ঘেন্নাটে ভঙ্গি রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন!আস্তে আস্তে সত্য আর সুন্দর একটি দিন কেমন পাংশু হয়ে গেল দেখে আরো হতাশ হয়ে গেল মৌরি। তার আর তপুর ভালোবাসাটা কত শুদ্ধ, কত সুন্দর!কত দীর্ঘসময়ে তিল তিল করে সাজানো! মায়ের একদিনের অমতে আর জেড়াতেই পুরো ব্যাপারটা কিনা চুরি চুরি হয়ে গেল। তাছাড়া মায়ের অমতে তার চোখের সামনে দিয়ে যাবেই বা কি করে আর না যেতে পারলে তপুকেই বা কি বলবে। তপুর মোবাইল নাম্বারটা কাল রাতেই নিয়েছে সে। চাইলে এখনি মানা করা যায় কিন্তু কোন কিছুতেই মন ঠিকঠাক সায় দিচ্ছে না।চিন্তার ভারে সারা শরীর জুড়ে আলস্য নেমে এলো তার।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ছে পড়ছে। বিকেল সাড়ে তিনটা। মৌরি বিছানায়ই শুয়ে আছে।বিছানা বরাবর ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পুব দিকের জানালা সহ আকাশ মুখ দেখছে। সেখানে মেঘেরা জড়ো হচ্ছে ধীরে ধীরে। তপুও হয়ত তৈরি হচ্ছে।মৌরি তবুও অস্থির মন নিয়ে নিশ্চল।একটা সিদ্ধান্তই যেন আজ লাগামহীন ঘোড়া সারা দুপুর এর পেছনেই ছুটেও সে ঠিক ধরতে পারছে না। কিন্তু সময়তো আর তার মনের মতো অস্থির নয় সেটা তার অবধারিত পথেই এগিয়ে চলছে এক পা এক পা করে।টিকটিক শব্দটাও তার কাছে এত জোড়ালো লাগছে যেন শেষ প্রহরের ঘন্টা ধ্বনি।
এতক্ষণ মায়ের ঘুমিয়ে পড়া নিয়ে যাও কিঞ্চিৎ আশাবাদী ছিল মৌরি কিন্তু দেখা গেলো অন্যসব ছুটির দিনের মত তার মাও আজ ঘুমাননি। থেকে থেকে ভেসে আসছে কাজের মহিলার প্রতি তার চিৎকার আর উচ্চস্বর,মৌরির ঘরের বাইরে স্যান্ডেলের অহেতুক শব্দ তুলে পায়চারী। যেন মৌড়ীকে অদৃশ্য তালা বন্দি করে রাখতে চাইছেন তিনি।কিন্তু মৌরির ভাবনায় এখন সবচেয়ে বড় কথা হলো তপুর নতুন চাকরী, গেলে ছুটির দিনই তো যেতে হবে। এই সমস্যাটার চেহারা সব সময় একি রকম থাকবে। মুখ থুবড়ে পড়া সাহসটা নিয়ে সে কি পারবে এই বিশেষ তালাটা ভাঙ্গতে।ভাবতে ভাবতেই ঘড়িটা যথারীতি ঢং করে জানালো চারটা বেজে গেছে। মৌরি উঠে বসল।পনের নাম্বার থেকে ধানমন্ডি আট খুব দুরে না হলেও রিকশা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় আর তার তৈরি হতেও কিছুটা সময় নিবে।আসলেই আর সময় নেই,খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে তার। এতদিন দেখা করার ব্যাপারটায় তার নিজের ঝোক ছিল ষোল আনা। এখন তপুকে রাজি করিয়ে “আজ যেতে পারবো না” এই কথাটা সে বলবেই বা কিভাবে আর মায়ের সাথেও এই ছোট্র যুদ্ধে তার যেতেই হবে আগে পড়ে। নিজের মনের সাথে দ্বন্দ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত দ্বিধাটা পাতলা পর্দার মত ক্ষিণ হয়ে এলো আর সেটা দুলতে দুলতে একটা চশমা পড়া মায়াবী মুখ ভেসে উঠতেই বাকিটাও মিলিয়ে গেল।
নিজের ঘরের ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিতে দিতে মৌরি শুনতে পেল রান্না ঘরে কিছু ভাঙ্গার শব্দ।
-থাকুম না।
এবার সালমার মার গলাটাও বন্ধ দরজা ভেদ করে কানে আসল। মায়ের জন্য খুব মায়া হচ্ছে তার। নিজের স্বপ্নহীন জীবনের সবচেয়ে বড় শিকার এই বাড়ির কাজের মানুষ তাই এরা দুদিনেই বিদেয় হয়। তবে আজ তার প্রতি আক্রোশটাতে রাগ হয় না মৌরি। সন্তানের ক্ষেত্রে সব মাই নিজের ইচ্ছার দাবী করার অধিকার রাখেন। আজ যাওয়ার সময় সেও হয়ত মায়ের হিংস্রতায় আহত হবে তবু চেষ্টাটা তাকে আজই করতে হবে।
ঘড়িটা চারের ঘর পার করে ফেলেছে এর মধ্যে। শাড়িটা বের করে তৈ্রি হচ্ছে মৌরি তার সাথে পাল্লা দিয়ে তৈ্রি হচ্ছে কিছু বৈরীতা।আয়নায় নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে মৌরি শুনতে থাকে দরজার বাইরের চিৎকার আর দেখতে থাকে জানালার প্রতিবিম্বে আকাশে মেঘেদের জড়ো হতে থাকা,তাদের দ্রুত কালো হতে থাকা।ব্যাগ আর মোবাইলটা নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে নিজেকে আর একবার দেখে হতাশ হয় সে,তাড়াহুড়োয় কাজলের ধারগুলো মোটা হয়ে গেছে।কিছুই আর মনের মত হলো না। তবুও এই হতাশা আপাতত চাপা পড়ে গেল বাড়ি থেকে বের হবার দুঃশ্চিন্তায়। দু-এক মূহুর্ত নিঃশ্বাস নিয়ে বুক দম নিয়ে দরজা খুলে বের হয় সে।সকাল থেকে প্রকৃতি যেন মালা গাথার মতো পর পর বাধা সাজিয়ে রাখছে তপুকে প্রথম দেখার স্নিগ্ধ আবেশটাতে।এখন করিডোর পেরোতেই সবচেয়ে প্রকট বাধার মুখোমুখি হতে হল তাকে।
রেবেকা সুলতানা ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন। তিনি ঘাড় ঘুড়িয়ে মেয়েকে দেখে বললেন,
-মৌড়ি এখানে এস বস।
-এখন না এসে কথা বলি। এখন সময় নেই।
-না।এখন।
সে জানে মার কাছে গিয়ে বসলে তার আজ আর যাওয়া হবে না। মৌরির এক হাত দরজার হাতলে আর এক হাতে মোবাইল কানে দিয়ে ব্যস্ত ভাব করল। রেবেকা সুলতানা টেবিল ছেড়ে উঠছেন মেয়েকে হয়ত ধরে ফেলবেন এই ইচ্ছায়। মৌরি ভীষণ ভয় পেল। ভয়টা তাকে বিদুৎগতিতে দরজা খুলিয়ে নিচে নিয়ে এলো। নিচে নেমেও তার হাত-পা হাল্কা কাপছে।একটা দুটো পিছুডাক সে শুনতে পেয়েছিল কিনা এখন মনে করতে পারছে না। মায়ের ভয়ে কিছু মূহুর্ত মৌরি নিশ্চল হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। ফিরতে তো তাকে হবেই, আর তখন যে কী ভয়ংকর কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে তা ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। আবার তপুর মুখটা মনে হতেই এক জীবন সাহস মাথা উঁচু করে ভাবলো,বাড়ি ফিরে মায়ের যেকোন বিচার,শারীরিক আঘাত ও সে সহ্য করতে পারবে কিন্তু তপুর চোখে স্বপ্ন একে তা ধুয়ে দিতে পারবে না।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে তবু একটু এগুতেই রিকশা পেয়ে গেলো সে।পলিথিনটি ধরিয়ে দিয়েই রিকশাওয়ালা ফাঁকা রাস্তায় হাওয়ার বেগে ছুটে চলল।বাতাসের তোড়ে কিছুটা পতপত করে উড়তে থাকলো নীল পলিথিন সাথে বৃষ্টি ধারা পতনের নানান তালের শব্দ,তবু সব শব্দ ছাপিয়ে নিজের হৃযন্ত্রের আওয়াজ ই কেবল শুনতে পাচ্ছে এখন মৌরি।আট নম্বর ব্রীজের কাছাকাছি আসতেই তার বুকের ধুকপুক টা ধরাস ধরাসে পরিণত হলো। সে ব্যাগ থেকে আয়না বের করে দেখলো আদ্রতায় তার চুলের নিচের দিকে কিছুটা ঢেউ খেলে গেছে । তাড়াহুড়ায় চুল আয়রন করা হয়নি আর সবচেয়ে বড় কথা তপুর জন্য কেনা রোলেক্সের ঘড়িটাই সে আনেনি। এবার সত্যি কান্না চলে আসলো তার। পরিকল্পনা মাফিক আর কিছুই হলো না। এত সুন্দর ভাবনাগুলো যেন বাতাসেই মিলিয়ে গেল। তার এখন মনে হলো তপু ঠিকই বলে, পৃথিবী নামক জগতে মানুষের ইচ্ছা সবসময় প্রকৃতির পায়ের তলায় প্রার্থনারত”।
(৫)
“রিকশা ঘুরাও” কথাটা তার জিবের আগায় উসখুস করতে থাকে। তবু রিকশা ধানমন্ডি লেকের দিকে এগুতে থাকে। চশমার কাঁচে পানির ফোঁটার নকশা বদলাতে থাকে। তপুর দুরুদুরু বুক থমথমে হয়ে আরো কিছু বৈরীতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। হয়তোবা মৌরি তাকে কল্পনার সাথে মিলাতে পারবে না। হয়ত সে তাকে দেখেই চলে যাবে।”
তপুকে ঘিরে গুঞ্জন বাড়ছে কমছে। সে তাকিয়ে আছে তার ছোট্র হাত আয়নাটিতে। সকালে সেভ করতে গিয়ে কেটে যাওয়া জায়গাটা বিকেল গড়াতে কালসিটে পড়ে গেছে। বেছে বেছে আজকের দিনই গাল কেটে যেতে হবে!তার দীর্ঘনিঃশ্বাসে আয়নার কাচ ঘোলা হয়ে গেল। এখনি মৌরির কথা মনে হতেই তার বুকে একশো হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে,কন্ঠনালীর লালা শুকিয়ে যাচ্ছে,হাটুর কাছে একটা দূর্বল অনুভূতি আর একটু পর সে সত্যি সত্যি দাঁড়াতে যাচ্ছে তার পাশে এটা ভাবতেই ভয়ের বৃক্ষের ঢালা-পালা গুলো আজ আবার ঝড়ো হাওয়ায় মাথা দুলাচ্ছে।
চলতে থাকা গুঞ্জন চরম আকার ধারন করে থেমে গেল। সিদ্ধান্ত হলো তপু পাঞ্জাবীর নিচে একটা ভারী হাফ হাতা গেঞ্জি পরে যাবে যাতে তাকে দেখতে এতটা হাংলা না লাগে আর বড় সাইজটা কিছুটা হলেও আড়াল করা যায়। তপুর বারনে তারা টললো না বরং আরো চেপে যুক্তি দিল।”তুই তো আর ঠকানোর জন্য কাজটা করছিস না।ভালোলাগার জন্য।এখানে দোষের কি”!।ইত্যাদি বলে তারা তপুর ঘোর লাগা মনের অবসন্ন শরীরটাকে বিয়ের বরের মত সাজিয়ে গুজিয়ে সিড়ির মুখে একরকম ঠেলে দিল।
যন্ত্রচালিতের মতো রিকশার উঠে বসে তপু। আপাদমস্তক এখন নিজেকে ভীষণ অচেনা লাগছে তার। আসলে সে কি সজ্ঞানে মৌরির কাছে যাচ্ছে!দ্বিধা আর দ্বন্ধ রিকশাওয়ালার মতই জোড়ে প্যাডেল ঘুরায় কিন্তু তাদের গতি ঘোরের সাথে পেরে উঠে না। দ্বিধা আর ভয়টুকু শুধু পাক তুলে ঘোরটাকে আরো ঘোলাটে করে যাচ্ছে। আশেপাশে কিছুই তার চোখে পড়ছে না। ঘুমে চলা বা ভূতে পাওয়া মানুষের মত তার চিন্তা জড় হয়ে আসছে। কি হতে যাচ্ছে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না সে। বুকের ধুক-পুক বন্ধ হয়ে গিয়ে এখন কেমন অসাড়-নিঃসাড় বোধ।
এর মধ্যে রোদ তাড়িয়ে কখন আকাশ মেঘের দখলে চলে গেছে কখন বৃষ্টির প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে খেয়াল করেনি তপু।এখন টুপটাপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। রিকশাওয়ালা তবু প্যাডেল টানায় ব্যস্ত। তপু তাকে পলিথিনের জন্য তাড়া দিয়ে নেমে দাড়ায়। সাথে সাথেই যেন বৃষ্টিটাও ঝমঝমে মুষলধারের রূপ নিল। হাত দিয়ে কোনাকুনি বাড়ি দিয়ে ছিট আলগাকরণ আর রিকশাওয়ালার বিরক্তমুখে পলিথিন বের করে আনতে কিছু সময় যা লাগল তাতেই তপু ভিজে চুপশে। রিকশায় উঠে বাকি পথটায় আর পলিথিনটা ধরে রাখার কোন কারন আছে কিনা সে বুঝেত পারছে না। মোবাইলটা কি আছে না শেষ তাও তার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রকৃতি তার কিছু সন্তানের সাথে বেশি বাধা-বাধা খেলে,আর সে যে তাদেরই একজন এটা অনেক আগেই সে মেনে নিয়েছে,নতুন করে আজ তাই অবাক হতে হলো না। ক্ষত-বিক্ষত শহুরে রাস্তায়, রিকশার প্রবল ঝাকুনিতেও তার মুখে পাথরের মূর্তির মত অভিব্যক্তিহীন।

তাজমহল রোডের মাথায় ফুলের দোকান দেখতেই নেমে পড়ে সে। দোকানটায় নানা জাতের ফুল একান্তিক ভাবে গন্ধ ছড়াচ্ছে। মূহুর্তে তার মন ভালোলাগায় ভরে গেলো। সব রঙ্গের গোলাপ মিলিয়ে একশোটা ফুল নিল।সাথে দু-গুচ্ছ সাদা দোলনচাপা,এটা মৌরির খুব প্রিয় ফুল ।কেমন বুনো মাতাল গন্ধ,প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিল সে।পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে দেখল ফুল বিক্রেতা ছেলেটি ফিক ফিক করে হাসছে ছেলেটির চোখ অনুসরণ করে তপু নিজের দিকে তাকায়। পাঞ্জাবী ভিজে স্বচ্ছ হয়ে আছে।আর তাতে মেরুন রঙ ছাপিয়ে সাদা গেঞ্জিটা প্রকট হয়ে ফুটে আছে। নিজের প্রতি চরম মমতা বোধ করল সে। এতকিছু স্বত্তেও সে কিনা মৌরির মত মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে!এটা নিঃসন্দেহে তার দুঃসাহস। ফুল নিয়ে রিকশায় উঠতে উঠতে সে আর এক চোট ভিজল। সাদা গেঞ্জির দিকে তাকিয়ে খুব লজ্জা লাগতে লাগল এখন তার। মনে হলো প্রকৃতি যাকে এমন দিনে উপহাসের পাত্র বানায় তার এত দুঃসাহস মানায় না।তপুর ইচ্ছে হয় রিকশা ঘুরিয়ে মেসে ফিরে যায়। কিন্তু মৌরি হয়ত তাকে প্রতারক ভাববে। এবার দ্বিধাটা ভেজা রাস্তায় দ্রুত ছুটে চলা রিকশার চেয়েও জোড়ে প্যাডেল ঘুরায়। “রিকশা ঘুরাও” কথাটা তার জিবের আগায় উসখুস করতে থাকে। তবু রিকশা ধানমন্ডি লেকের দিকে এগুতে থাকে। চশমার কাঁচে পানির ফোঁটার নকশা বদলাতে থাকে। তপুর দুরুদুরু বুক থমথমে হয়ে আরো কিছু বৈরীতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। হয়তোবা মৌরি তাকে কল্পনার সাথে মিলাতে পারবে না। হয়ত সে তাকে দেখেই চলে যাবে।
একসময় রিকশা ধানমন্ডি আট নম্বর ব্রীজএ এসে থামে। ভাড়া মেটাতে মেটাতে তপুর চোখ মৌরিকে খোজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেখানটায় দুজনের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সেখানটা ফাঁকা। আর এমনিতেও বৃষ্টির কারনে খোলা জায়গাগুলোতে এখন কেউ নেই। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে সেটা নিস্পন্দ হয়ে আছে। সে অস্ফুট উচ্চারনে নিজেকে বলে ”কই যাবি গোপাল সঙ্গে যাবে তোর কপাল”।এখন তাহলে যোগাযোগের উপায় ও বন্ধ নিজের প্রতি উপহাসে ঠোট বেকে যায় তপুর। দূদার্ন্ত নাটকের শেষ অংক তেমন দূদার্ন্ত লাগছে না কেমন করুন আর ম্লান হয়ে গেছে।
বৃষ্টি একটু কমলেও এখনো ধারা চলমান। তপু আশ্রয়ের জন্য এদিক ওদিক গেল না।পাঞ্জাবীর নিচে সাদা গেঞ্জিটা নিয়ে আর ভাবিত হলো না। চশমাটা খুলে পকেটের নির্জীব মোবাইলটির পাশে রেখে দিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল।

ঠিক তখনি মৌরি আর তপুর জন্য পৃথিবী নামক জগতের এই ভীষণ বিকেলে অনুভবের জগতের দরজা খুলে গেল। সবকিছুতে অপার্থিব একটা মাত্রা যোগ হলো। ওরা যেন রাস্তায় ঝড়ে পড়া কৃষ্ণচূড়ার চেয়েও বেশি লাল আর পার্কটা যেন স্বর্গের বাগান।দুজন দুজনের হাত ছুতেই পেল প্রথম মানব-মানবী হওয়ার স্বাদ। এক মহান সঙ্গীতের কম্পন শুরু হলো সব বস্তুতে।
রিকশা ছেড়ে কৃষ্ণচূড়া গছটার দিকে তাকাতেই মৌরির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সেখানে একটা মেরুন পাঞ্জাবী পড়া ছেলে। তপুর মত আবার তপুর মত না। তাছাড়া চোখে চশমা নেই। চুল একটু ছোট। চেহারাও এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু মূহুর্ত ভেবে মৌরি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই এক দুপা করে এগিয়ে যেতে থাকে।
আর তপু দেখল লাল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মৌরির মত আবার মৌরির মত না। মৌরিকে ছবিতে যেমন দেখেছে তার চেয়ে একটু বড় চুল,মাঝারি গড়ণ,গায়ের রঙ আর একটু চাপা। চেহারা এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি তাকেই খেয়াল করছে। হয়ত এটাই মৌরি। তপুর মনে হলো পৃথিবীতে নিজের হৃপিন্ডের শব্দই সবচেয়ে প্রলয়ংকারী রূপ নিয়েছে। ফুসফুস বাতাস ধরে রাখতে পারছে না। সে জোড়ে জোড়ে শ্বাস টানতে থাকে।
তারপর দুজন সামনা-সামনি। তপুর মুখ থেকে একটা শব্দই বের হয়েছে মৌরি। আর মৌরির মুখ থেকে তপু।
মৌরি রাস্তা ছেড়ে গাছটার নিচে তপুর সমান্তরাল দাঁড়ালো। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার হাত-পা সামান্য কাঁপছে। সে শাড়ি সামলানোর ছুতায় নিচের দিকে তাকানো। আর তপু নিস্পন্দ মোবাইলটা চালু করায় ব্যস্ত। দুজনে দুজনাকে সামনে পেয়েছে ব্যাপারটা তাদের কাছে শরীরের কোথাও হঠাৎ কেটে যাওয়া জায়গার মতই সাময়িক অনুভূতিহীন।
কিছু সময় মৌরি নিজের শাড়ি,ভিজতে থাকা চুল সামলাতে ব্যস্ত থাকে আর তপু তার চশমা আর মোবাইলের কার্যহীনতার প্রতি। বেশকিছুক্ষণ পর তপুর মনে হয় ফুলগুলো সে এখনো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৌরির মুখের দিকে না তাকিয়েই নিঃশব্দে সে ফুলগুলো এগিয়ে দিল।হঠাৎ মৌরির খিলখিল হাসিতে সে অবাক হয়ে তাকায়
-এই যাও!তুমি পাঞ্জাবীর নিচে হাফ হাতা গেঞ্জি পড়েছ কেন!মাথা খারাপ ছেলে।
মৌরির নির্মল হাসি দেখে তপুও হেসে ফেলে।
তারা হাসতে থাকে,ভুলতে থাকে আজকের সব বৈ্রীতা।এই বৃষ্টি ভেজা আলো-আধারির বিকেলে লাল শাড়িতে মৌরিকে আর মাতাল-ক্ষ্যাপাটে ভালোবাসার মতই পাঞ্জাবির নিচের হাফ হাতা সার্টে তপুকে বেশ মানিয়ে গেলো।
তপু দেখতে থাকে মৌরির মুখে বৃষ্টির হিরক কুচি,ছড়ানো কাজলে পটলচেড়া চোখ,বাম গালে ছোট্র টোল, ভেজা চুল। আর মৌরি দেখতে থাকে তপুর কেটে যাওয়া গালের নীলচে কালসিটে, চশমা ছাড়া বৃষ্টি ধোয়া মুখ,থুতনির টোল আর নিস্পাপ সুন্দর হাসি।
ঠিক তখনি মৌরি আর তপুর জন্য পৃথিবী নামক জগতের এই ভীষণ বিকেলে অনুভবের জগতের দরজা খুলে গেল। সবকিছুতে অপার্থিব একটা মাত্রা যোগ হলো। ওরা যেন রাস্তায় ঝড়ে পড়া কৃষ্ণচূড়ার চেয়েও বেশি লাল আর পার্কটা যেন স্বর্গের বাগান।দুজন দুজনের হাত ছুতেই পেল প্রথম মানব-মানবী হওয়ার স্বাদ। এক মহান সঙ্গীতের কম্পন শুরু হলো সব বস্তুতে। সমস্ত প্রকৃতি সাথে কোরাস করতে লাগল,
Let me give my life to you.
Let me drown in your laughter,
Let me die in your arms.
Let me lay down beside you,
Let me always be with you.
Come let me love you,
Come love me again.

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………।।
আসলে অনুভবের জগতটা বা কল্পনার এক আলাদা ইন্দ্রিয়ও ঈশ্বর প্রদত্ত। মানুষের জীবনের কিছু কিছু দূর্লভ মূহুর্তে এই দুই জগতের মিলন হয়।আর সেটাই হয়ত মেজিক মোমেন্ট।সমস্যার বেড়াজালে আবার ভুবন পৃথক হয়ে যায়।তবুও সেই সুন্দর মূহুর্তের স্মৃতিই মানুষ সারা জীবন যত্নে লালন করে,কল্পনায় তার সাথে বার বার দৌড়ে বেড়ায়।
তপু এবং মৌরির জীবনে সামনে অনেক সমস্যা আসবে। হয়ত তাদের আর পাশাপাশি আর হাঁটা হবেনা,হয়ত আবেগ চাপা পড়ে যাবে,কিংবা হয়ত ভালোবাসা নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে ফিকে হয়ে যাবে। সেটা আর লিখতে আর ইচ্ছে হলো না।জানি পৃথিবীতে স্থির সময় বলে কিছু নেই তবু ইচ্ছে হলো গল্পে এই বিকেলটা স্থির করে দিতে।ওরা হাঁটতে থাকুক হাত ধরা ধরি করে অনুভবে পা ফেলে পৃথিবীর পথে।

অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ

গল্প-(অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)

অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ
(১)ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই জগৎ এ তপুর ইচ্ছানুযায়ি কিছুই ঘটে না তাই কংক্রিটের কঙ্কাল ঘেরা এই বৃষ্টির শহর তার কাছে শুধু আজ না সবসময়ই অনর্থক। আর শুধু এ কারণেই সে মৌরিকে অনুভব পর্যন্তই রাখতে চেয়েছিল”।

জীবনটা যদি বিজ্ঞাপনের মত হত!একটি বিশেষ টুথপেষ্ট আর নিরোগ শরীর,সবার মুখে চকচকে দাঁত শুদ্ধ হাসি, উচ্ছলতায় ভরপুর সকাল। একটি বিশেষ ইন্সট্যান্ট গুঁড়োদুধ শিশুরা সব দীর্ঘদেহী,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ….। একটি বিশেষ সীম কার্ড আর কৃষকের ফসল বিক্রির ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, তাদের গায়ের নতুন জামা,গ্রামগুলোতে শুধু মেলা আর আনন্দ,ভর-ভরান্ত গৃহস্থিতে পরবাসী স্বামীর বিরহী বধু। এক ফোটা কনডেন্সড মিল্ক হলেই সাদাকালো পৃথিবীর রঙ পালটে রঙ্গীন কিংবা একটি চায়ের ব্রান্ড মানে সতেজ দেহ,ধূমায়িত কাপ নিয়ে বৃষ্টি দেখা সুখী মনের মুখ।
কিন্তু জীবনতো আর এমন নয়!তাই তপুর হাতে ধূমায়িত এক কাপ চা থাকা স্বত্ত্বেও তার মুখ নিস্তেজ।সেও একটি বিশেষ ব্রান্ডের টূথপেষ্ট ও সীম কার্ড ব্যবহার করে কিন্তু তার চারপাশে আনন্দের কোন ঢেউ নেই। তপুর পরনে ফিকে হয়ে আসা সবুজ গেঞ্জি,একটি চেক ট্রাউজার,চোখে চশমা,মুখে দুইদিনের জমানো দাড়ি। তার চায়ের কাপেও বৃষ্টির ফোটা পড়ল আর সেও ও ঠিক বিজ্ঞাপনের মতই আকাশের দিকে তাকালো কিন্তু চোখে কোন মুগ্ধতা বা বিস্ময় নেই।
বৃষ্টির আগমনী হিসাবে আকাশ গুড় গুড় করে ডেকে ঘোষণা দিচ্ছে। এমন ডাকে মনে ভয় মিশ্রিত আনন্দ হয়,ময়ূর পাখা মেলে নাচে কিন্তু তপু তেমনি নির্বিকার। এবার বৃষ্টির একটি ফোঁটা তার চশমার কাঁচেও পড়ল আর তাতে দুনিয়ার তাবৎ চশমাওয়ালাদের মত সেও বিরক্ত হল। ঘোলা কাঁচ চোখে নিয়ে আর এখানে বসে থাকার সে কোন মানে খুঁজে না পেয়ে ছাদবারান্দা ছেড়ে ঘরে চলে এল।
শ্যামলির ছয়তলার এই মেসবাড়িতে তপু ছাদ লাগোয়া ইউনিটটির এই ঘরে আরো দুই জন রুমমেটের সাথে থাকে। ছাদের নিচে হওয়ায় প্রচন্ড গরম তাই অর্ধেকটা খোলা বারান্দা হলেও বাড়তি কোন আমেজ পাওয়া যায় না। আশেপাশে তেমন কোন গাছপালা নেই।কিছু নতুন দালান তপুর ছাদ ডিঙ্গিয়ে আরো উঁচুতে যাওয়ার ইচ্ছায় প্রতিদিন একটু একটু বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে যাওয়া বৃষ্টিতে এই সিমেন্ট রঙের কঙ্কালগুলো ভিজে চুপশে আরো ধুসর হয়ে আকাশের সাথে জোট বেধে গেল। তপু যেখানে বসে আছে সেখান থেকে ধুসর আকাশের পটভূমিতে দৃশ্যটা ওর মনের মতই ধুসরকালো দেখাচ্ছে।
নির্মাণ কাজ চলতে থাকা বামদিকের বহুতল বাড়িটার মিস্ত্রিগুলো ছাদ ছেড়ে নিচতলা গুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টি আসায় তারা মনে হয় খুশি হয়েছে। সবার মুখই হাসিহাসি। তপু বসে বসে কিছুক্ষুণ এদের খুশি মুখে চা খাওয়া দেখল তারপর তিন মাত্রার এই জগতের মাত্রা বাড়াতেই হয়ত তার পুরোনো পিসিটা চালু করল। ঘড়ঘড় শব্দ তুলে বার্ধক্য জানান দিতে দিতে সেটা চালু হলো। জন ডেনভারের “এনিস সং” গানটির অসাধারণ সুরের মূর্ছনায়, বৃদ্ধ পিসিটার সারা শরীরেও জ্বলজ্বল করছে এখন ধ্রুপদী রূপ।
পুরোনো সুরের এই ক্লাসিক গানটি তার ইদানিং খুব প্রিয় হলেও খুব কমই শুনে। কিছুদিন আগে তার করূন মুখ দেখে চারতলার মেসবাসিন্দা হিরন তাকে গানটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,

“এইটা টান ভালো লাগব”।
তপু কিছুটা বিরক্ত আর অবাক হয়ে বলেছিল,
“টানবো মানে এটা কি গাজা”!
“হা হা!তার চেয়েও মারাত্মক। কলিজায় বেশি লাগলে বন্ধ রাখবি। আবার কিছু কইরা বইস না”।
“সেড নাকি বেশি”।
“ইয়েস ম্যান”।
“নাহ! আমি নষ্টালজিক গান শুনি না”।
-“আরে ব্যাটা মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়। ডায়মন্ডস কাটস ডায়মন্ডস।বুচ্ছস।ওহ।আর একটা কথা,এক্সপেরিয়েন্স থেকে কইলাম,উৎকৃষ্ট সংগীত এইসব ব্যাপারে বিরাট ঔষধ তবে ভালো লাগলেই রিপলাই দিয়া রাখবি তাইলে শেষ। কয়দিন পর দেখবি টেষ্ট পাইতাছস না। গান কিন্তু আগের মতই আছে কিন্তু তর ব্রেইন এটার প্রতিটি ইন্সট্রুমেন্টের টুং টাং, প্রতিটা লাইনে তর ফিলিংস কপি করে ফেলছে বা ওভার রিভাইসড করে ফেলছে।ফিলিংস এর ক্ষেত্রে, যেটা ব্রেনে অলরেডি আছে সেটা আর ধরে না।বুচ্ছস।
“না”।
মানে হইলো সুন্দর বউ দেইক্ষা ঘরে আনলেই জীবন মধুময় হয় না আসলে রুপ বা গুন মুখস্থ হয়ে গেলে সেটাও আর ধরে না। ফ্লটিং এর মধ্যে থাকতে হবে আমাদের। অলয়েজ ভাসমান। হা হা।
হিরন গাজা খায়,এলাকার লিডারদের হয়ে চাঁদা তুলে।একসাথে ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স করলেও হিরনকে সবার মত সেও এড়িয়ে চলে। সবার মত সেও অস্বস্তিতে হিরনকে সেদিন তাড়াতাড়ি পাশ কাটাতে মিথ্যাসায় দিয়েছিল,যে সে বুঝতে পেরেছে। আর হিরনের প্রতি অবিশ্বাস থেকেই অনেকটা তাচ্ছিল্য নিয়েই গানটা শুনেছিল। কিন্তু প্রথমবার শুনতেই এমন ধাক্কা খেয়েছিল যে আর শোনার সাহস হয়নি কিছুদিন। শুধু মাঝে মাঝে গভীর রাতে, বৃষ্টি হলে, ছুটির দিনে, অলস দুপুরে কষ্টটা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়,যখন কষ্ট থেকেই তার মন তাকে আরো কষ্ট নেয়ার মত সাহসী করে তুলে তখনি শুনে।

আজ ও গানটা শুনতে শুনতে মৌরিকে মনে পড়ার মাত্রা একশোগুণ বেড়ে গেল তার। ঘন কালো মেঘের এমন দিনে মৌরি খুব কাছে আসতো। এই কাছে আসা অবশ্য পুরোটাই কাল্পনিক। অনলাইনে অনেকের মত তাদেরও একটা ছোট্রজগত ছিল। যেখানে কথা বলতে বলতে চাঁদের বুকে হাটা যেত, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোট্র নৌকা দাড় না টেনে দিগবিদিক ভাসিয়ে দেয়া যেত,বৃষ্টি হলে নগরের সব গাড়ি-ঘোড়া উধাও করে চকচকে মসৃন পিচঢালা রাস্তার বুকে দুজনে একছাতার নিচে দাঁড়ানো যেত। পাখি এই জগতটার একটা নামও দিয়েছিল,-“অনুভব”।
ইদানিং তপুর সেই জগতের দরজাটা বন্ধ থাকায় ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই তিন মাত্রার জগতেই তাকে থাকতে হচ্ছে সার্বক্ষকণিভাবে। ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই জগতে তপুর ইচ্ছানুযায়ী কিছুই ঘটে না তাই কংক্রিটের কঙ্কাল ঘেরা এই বৃষ্টির শহর তার কাছে শুধু আজ না সবসময়ই অনর্থক। আর শুধু এ কারনেই সে মৌরীকে অনুভব পর্যন্তই রাখতে চেয়েছিল। পৃথিবী নামক জগতের জোগাড়যন্ত্রের গুণিতক এত বেশি আর অসম্ভব হয়ে ঊঠেছিলো যে সেখানে মৌরিকে বাস্তবে আশা করা করা তার কাছে পাপ বলেই মনে হত।
পৃথীবিতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাই সে মৌরিকে বলতে চাইত না। বলতে চাইত না তার মেসবাড়ির কথা,টানা টিওশনির কথা,গড় গড় করা বুড়ো পিসিটার কথা যেটা প্রায় মরি মরি করছে। কত কৌশল করে, কত কষ্ট করে সময় বাচিয়ে ব্যস্ততার দিনগুলোতে সে মৌরির সাথে চ্যাট করত সেই সব কথা। নিজেকে বড় বা ছোট করার জন্য নয় শুধু এই আড়াল ছিল অনুভবের আবেশ যাতে নষ্ট না হয়। যাতে অনুভব নামক এই জগতেও সমস্যার কথাগুলো কি বোর্ডে আঙ্গুল চেপে চেপে লেখা না হতে থাকে। কিন্তু এটাই মৌরি মানতে পারত না। সে তপুকে দুই জগতেই চাইত,রোদশুদ্ধ বৃষ্টির মত। আর এই অপূর্ণতার অভিমানে একদিন দরজাটা বন্ধ করে দিলো মৌরি, তা আজ তিন মাস হয়। এতদিন কষ্ট হলেও বেশ শক্ত ছিল সে। টাকা নামক বস্তুটা পকেটে,আর খাদ্য নামক দ্রব্যটা মুখে পুড়ার নির্লজ্জ ইচ্ছাটায় সে ভালোবাসাকে পেছনের বেঞ্চের বেয়ারা ছাত্র হিসাবেই দেখত।
এক মাস হয় তাকে অবাক করে দিয়ে তার ফুফাতো ভাই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে জুনিয়ার কেমিষ্ট হিসাবে তার চাকুরী ঠিক করে দেয়। বেতনটাও প্রথম প্রথম হিসাবে মোটা। এখন তাকে টিওশনি করতে হয় না,ক্লান্তির সাথে সময় নিয়ে দেন-দরবার করতে হয় না,লোকাল বাসের ছিট পাওয়া নিয়ে হাপিত্তেশ করতে হয় না। কিন্তু এই আর্থিক ও সময় স্বচ্ছলতার সুখ পাশাপাশি তাকে মানসিক স্বচ্ছলতার জন্য কাঙ্গাল করে তুলছে প্রতিদিন। জীবন নামক সর্বভূকের খেতে পেলে আরো ক্ষিদে বাড়ে। মানে টাকা আর সময়তো হল এবার তার ভালোবাসাটাও চাই। তবে দীর্ঘদিনের ছা পোষা জীবনে ভয়ের বীজটাইতো ডালাপালা মেলে এখন বৃক্ষ।ঘাড়ে চেপে থাকা এই ভয় নামক ভূতের পরামর্শে সে ইচ্ছেগুলো দমিয়ে রাখতে চায় প্রতিদিন। কিন্তু নিজের সাথে একলা হলে বিশেষ করে ছুটির দিনে তার ভীষণ কষ্ট হয়,কষ্ট থেকে তারও ইচ্ছে হয় সাহসী হতে, ইচ্ছে হয় ভয়এর বৃক্ষটা একেবারে উপড়ে ফেলতে।
আজও তেমনি একটি ছুটির দিন,রুম ফাকা। রুমমেট নাই তাই এয়ারফোন ছাড়াই গান চলছে। ডাইনিং এর ছেলেটি চা দিয়ে চলে গেছে একটু আগে। তপু তার ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গানটি শুনছে। তার কাছে মনে হচ্ছে গায়কের গলায় গাওয়া এটা কথামালা না,এক বুক কষ্ট। কি করুন সুরেই না সে প্রেমিকাকে ফিরে আসতে বলছে…
“You fill up my senses,
Like a night in a forest.
Like the mountains in springtime,
Like a walk in the rain.
Like a storm in the desert,
Like a sleepy blue ocean.
You fill up my senses,
Come fill me again”.

এতক্ষণ লক্ষ-লক্ষ, কোটি কোটি বা তার চেয়েও বেশি পানির ফোটায় শহরটা ঝাপসা হলেও দেখা যাচ্ছিল শুধু তার চোখে এক ফোঁটা পানি আসতেই ঝাপসা শহর পুরোটাই অদৃশ্য হয়ে গেল।
(২)“এই ছাদের পানিতে পা ডুবিয়ে সে কত কথা বলেছে তপুর সাথে,মেঘের সাথে ভেজা শরীরে আকাশের ঐ কোণায় কত উড়ে বেরিয়েছে সে! সেটা অবশ্য এই জগতের সমান্তরাল আরেকটি জগতে। যেখানে আকাশটাকে চাইলেই দু-তিনটা চাঁদ দিয়ে সাজানো যেত। যখন তখন সূর্যকে নিভিয়ে দেয়া যেত। সাদা সিফনের শাড়ী পড়ে বকুল জড়ানো যেত। শুনশান হাইওয়ের পাশে পাচিল ঘেড়া বাগান বাড়ি বানানো যেত,অন্ধকার সেই কাঠের বাড়িতে রাতভর গল্প করা যেত। ।এমন সুন্দর ভুবন অলীক হলেও তার অনুভুতিতে পুরোটাই সত্য ছিল।তা ইতো মৌরি জগতটার নাম দিয়েছিল -অনুভব”।
কয়দিন হয় বৃষ্টি হুটহাট আসা যাওয়া করছে। এমন রোদ-বিকেলে হঠাৎ আবার আকাশ ঘন কালো হয়ে গেল। এতক্ষণ মাঝখানে যা একটু নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিল তাও দ্রুতগামী কিছু মেঘের পাহাড় চট করে ঢেকে দিল।আঁধারের পিছু পিছু ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি যেন হাত ধরাধরি করেই এলো শহরে। বাইরে ঝড়ো হাওয়ার শো শো শব্দ ঘরের ভেতরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রটির মৃদু গোঙানী ছাপিয়ে কানে আসছে। বন্ধ জানালাটির পর্দা পুরোটা খুলে দিল মৌরি।চার বাই পাঁচ ফিট জানালার কাঁচে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বিন্দু বিন্দু জমা,তাদের আস্তে আস্তে ভারী হওয়া, একে অপরকে আকর্ষণ করে টপ টপ করে বেয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে দেখতে কখন তার মুগ্ধতা ভোতা হয়ে গেলো,কখন তাতে তপুর ভাবনা ভর করে পাখা মেলল সে টেরই পেলো না।
পাশের বাড়ির ছাদটিতে গরমের দিনে বৃষ্টি হলেই পানি নিষ্কাশনের নলটি কিছুদিন বন্ধ করে রাখে,। দু-তিন দিন ধরে বৃষ্টি আসায় এখন সেখানে প্রায় সাত-আট ইঞ্চি পানি জমে গেছে। সেখানে তাকিয়ে তপুর জন্য বুকের মধ্যে কেমন ছ্যাৎ করে উঠল মৌরির। এই ছাদের পানিতে পা ডুবিয়ে সে কত কথা বলেছে তপুর সাথে,মেঘের সাথে ভেজা শরীরে আকাশের ঐ কোণায় কত উড়ে বেরিয়েছে সে!
সেটা অবশ্য এই জগতের সমান্তরাল আরেকটি জগতে। যেখানে আকাশটাকে চাইলেই দু-তিনটা চাঁদ দিয়ে সাজানো যেত। যখন তখন সূর্যকে নিভিয়ে দেয়া যেত। সাদা সিফনের শাড়ী পড়ে বকুল জড়ানো যেত। শুনশান হাইওয়ের পাশে পাচিল ঘেড়া বাগান বাড়ী বানানো যেত, অন্ধকার সেই কাঠের বাড়িতে রাতভর গল্প করা যেত। এমন সুন্দর ভুবন অলীক হলেও অনুভুবে পুরোটাই সত্য। তাইতো মৌরী এর নাম দিয়েছিল “অনুভব”।

মৌরীর ভাবনায় এই দুই ভুবনের একটা যোগ ছিল। তার ইচ্ছা ছিল কখনো না কখনো দুই জগতের একটা সমন্ময় ঘটবে,সমম্বয় ঘটবে এই অনুভব আর সত্যের। কিন্তু কেন জানি তপু কথাটা শুনতেই পিছিয়ে যেত। তপু কোন অপারগতার কথা,কোন অযোগ্যতার কথা বলত না শুধু বলত “কি দরকার!এভাবেই ভালো আছি”। মৌরী শুধু শুনতে পেত তপুর অনিচ্ছা। আয়নায় দেখতে পেত তার গাল গড়ানো পানি। আস্তে আস্তে একদিন দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে সে কিংবা বন্ধ হয়ে গেছে নিজেই। এখন তপুর হাজার ডাকেও সেটা আর খুলে না সে।
বৃষ্টির থেমে গিয়ে রোদ ঊঁকি দেয়াতে সে ভাবনা থেকে কিছুটা ছিটকে এল। বড় বড় ফোটার ঝমেঝমে তাড়াহুড়ো বৃষ্টি ঝড়িয়ে, মেঘেরা আকাশ হতে পলাতক। নীল আকাশে কিছু দলছুট মেঘ শুধু ছেড়া তুলোর মত ভেসে আছে।

বৃষ্টিস্নাত বিকেল দেখতে মৌরি পেছন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ঝকঝক করছে প্রকৃতি এখন। আকাশটা যেন আরো নীল। সবকিছুতে সূর্য্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশের ছাদের জমে থাকা পানিতে রোদের বিকেলি প্রতিবিম্ব। বারান্দার কালো কালো গ্রীলগুলো চুইয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে,ঝুলন্ত পানির কনাগুলোও রোদের কিরণ লেগে হীরের মত জ্বলজ্বলে। মৌরি আঙ্গুল দিয়ে একটি হীরের টুকরো ছুয়ে দিল,সাথেসাথেই ভারী পানির বিন্দুটা মৌরির আঙ্গুল থেকে হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল।
পাখিরা কিচির-মিচির করতে করতে নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসছে। বারান্দার এক কোনে একটি চড়ুই বসে গা ঝাড়া দিচ্ছে,মৌরিকে দেখেও তার তেমন ভাবান্তর নেই। এখনো আশেপাশে সব বাসার কার্নিশ,ছাদ আর বারান্দার নলগুলো হতে পানি পড়ছে। বৃষ্টি চলে গেলেও শব্দের আবেশ এখনো বেশ জোড়ালো। টুপটাপ শব্দ আর সাদাটে হলুদ আলোর ছটায় চারপাশ ভীষণ মায়াবী লাগছে মৌরীর কাছে।কি সুন্দর!মৌরি নিজ মনে বলল।
হঠাৎ পেছন গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। অনেক ঝকঝকে সবুজ পাতা বেরিয়েছে তবে ফুলগুলো এখন আর জমকালো না। তাদের মধ্যে সন্নিবেশিত ভাবটাও আর নেই কেমন জানি ছাড়া ছাড়া আর রঙ্গটাও ম্লান। বৃষ্টির তোড়ে ফুলগুলো আরো ঝড়ে গেছে। রাস্তায় ঝরে পড়া ফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। বর্ষা ঝেকে আসলেই কৃষ্ণচূড়ারা শহর থেকে বিদায় নেয়।চাঁদের আলোয় এক বছর আবার কৃষ্ণচূড়া দেখা হবে না ভেবে আফসোস হল মৌরির।
হঠাৎ পেছনে মৌরির মা এসে দাঁড়িয়ে মেয়ের গায়ে হাত রাখেন। মৌরি চমকে ঊঠে,
-মা!
-হুম।ঘুমালি না।
-নাহ!তুমি কই যাও?
-মিতুলের কোচিং এ।আজ গারডিয়ানদের যেতে বলছে। ওকে নিয়ে একবারে বাজার করে আসব। আসতে সন্ধ্যা হবে। তুই কিছু খেয়ে নিস। আর সালমার মার দিকে খেয়াল রাখিস। নতুন বুচ্ছিস না?
-ঠীক আছে।
মৌরি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

মৌরির বাবা দেশের বাইরে থাকেন। মাঝে মাঝে নামে মাত্র দেশে আসেন। আর মা ব্যাংকে চাকুরী করেন। তিনি সপ্তাহ ভর চাকুরীতে ডুবে থাকেন আর টুকটাক ঝামেলায় ছুটির দিনেও ঘর-বাহির করেন। মৌরি তার মাকে চাকুরী ছেড়ে দিতে অনেক অনুরোধ করে কিন্তু তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,রাজি হন না। তার মতে,মানুষের সম্মান তার অর্থনৈ্তিক স্বাধীনতার সাথে জড়িত আর মৌরিও মাস্টার্স শেষ হতেই চাকুরীতে ঢুকে যাক এমনটাই তিনি চান।কিন্তু মার মত ঘোর প্যাচে জীবনটাকে ভাবতে চায় না সে। তার মতে অর্থের সাথে জীবনের যোগ থাকতেই পারে তার চেয়ে বড় যোগ ভালোবাসার।মৌরির কাছে জীবনের সংজ্ঞায় বিরাট অংশ ভালোবাসা আর ভালোবেসে মানিয়ে চলা।মায়ের শেখানো কাঠিন্য সে তাই কখনো রপ্ত করতে পারেন।
অতি সচেতন ইস্পাত ব্যক্তিত্ববোধ আর বদমেজাজের কারনে আজ শুধু মৌরির বাবা না,তার মায়ের আশেপাশে পুত্র-কন্যা ছাড়া আর কেউই নেই। মায়ের দমবন্ধ আনন্দহীন জীবনই তাকে স্বপ্ন আঁকতে শিখিয়েছে। তার ধারনা স্বপ্নগুলো যদি সে আঁকতে পারত তবে সে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সেরা চিত্রশিল্পীদের একজন হত।
মৌরি মার চলে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে আসে। দুপুরে অন করা পিসিটা স্ট্যান্ড বাই হয়ে আছে। সে পিসিটাকে স্ট্যান্ড বাই অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে অনলাইন নামক আকাশ রাজ্য ডুকে গেল। বেখায়ালি বিচরণ করে বেড়াতে থাকল এখানে-সেখানে। হঠাত অচেনা কারো মেইলের নটিফিকেশনে সে সচেতন হয়ে মেইলটা খুলে দেখে,আইডিটা অন্য কারো কিন্তু সাবজেক্টের জায়গায় লেখা,
Topu from the world onuvob
মেইলটার প্রেরকের নাম আবার যাচাই করে মৌরি। অচেনা নাম কিন্তু তপুর মেইল! তপুকে ব্লক করে রেখেছে তাই হয়তো অন্য আই ডি থেকে পাঠিয়েছে বুঝতে পেরে খুলবে না খুলেব না করেও খুলে ফেলে সে।

“come fill up my sense
Come fill m again.”
আমরা এই জগতেও আকাশে কি করে উড়ব? আমাদের পাখা নেই। তবে কি মৌরি আমাদের চার-পায়ে এক পা দু-পা করেই হাটব।
আমি তোমাকে ভয়াবহ রকম মিস করছি। তুমি ফিরে এসো,ভালোবাস আবার।–তপু”।

কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্দ বনে যায় মৌরি। নিশচল হয়ে যায় তার দেহ,সে দুহাতে তার মুখ ঢেকে ফেলে। আবেগরঙ্গা বৃষ্টির জন্য তার শরীর ও এবার কেঁপে কেঁপে উঠছে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেছে মৌরি বালিশে মুখ গুজে শুয়ে আছে। পিসিটা আবার স্ট্যান্ড বাইতে চলে গেছে,সে ঊঠে বন্ধ করে না,সন্ধ্যে নেমেছে তবু বাতি জ্বালায় না,কান্না ভেজা চোখে মুখে পানি দেয় না,মোবাইল বাজে তবু ধরে না,সালমার মা চা দিতে এসে ডেকে ডেকে ফিরে যায় মৌরি হু টাও করে না। আবেগে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে যেন তপুর সোহাগী অভিমানি বধু। বহুদিন পর তার মান ভাঙ্গার আগল অল্প অল্প করে খুলছে তাই প্রেমিকের ভালোবাসায় কিছুটা লজ্জিত,কিছুটা গর্বিত মুখ সে কাউকে দেখাতে চাচ্ছে না। মৌরি মনে মনে খুব জোরে জোরে ডাকে “তপু তপু তপু”। অনুভব নামক জগতে শব্দটা আলোর গতিতে লক্ষ লক্ষ মাইল ছুটে যায়।
(৩)
“ঈশ্বরের মত কুন বললে সেখানে সব হয়ে যায়।সেখানে জগতটা লেট দেয়ার বী লাইটের মতই সহজ। তপু আর মৌরীই সেখানে ঈশ্বর-ঈশ্বরী। ইশ!এমন একটা জগত যদি পৃথিবীটা হত”
“এক সাঈজ ছোট লাগবে মনে হয়”।
“আরে ভাই না। আপনার এক সাইজ বড়-ছোট হইলেই ফিট হবে না। ফিগার লাগে বুচ্ছেন। আপনার মত ফিগারে ভাই পাঞ্জাবি বানাইয়া পইড়েন। এইগুলা তো ফ্রি সাইজের”।
অনেকগুলো পাঞ্জাবি খুলে গায়ে দিয়ে মাপ দেয়ার পর দোকানের কম বয়সী ছেলেটি তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলল তপুকে। মালিক লোকটি হা হা করে ছুটে এলেন।
“আরে ব্যাটা ছাগল তুই কি বুঝস? ভাই আপনার পড়নের সার্টের সাইজ কত”?

কর্মচারি ছেলেটা ছাগল ডাকে খুশি হয়ে মালিককে দাঁত দেখায়। তপু বিষন্ন মুখে দেখায় সার্টের পেছনের ট্যাগ।
-“নাহ!সার্টের মাপ আর পাঞ্জাবীর মাপে তফাৎ আছে। তবে আপনিতো শুকনা মানুষ এর উপর লম্বা,ফিট ঠিকঠাক হবে না। হাতা ছোট হবে নাহয় শরীরে ফিট হবে। আবার হাতা ঠিক হলে লম্বা আর ঢিলা একটু বেশি হবে। এখন তো সব সর্ট পাঞ্জাবীর চল। অসুবিধা নাই একটু বড় ছোট পড়বেন এখন সবই স্টাইল। হা হা!”

লোকটি তার বিক্রি বাড়ানোর ধান্দায় বিভিন্ন দোকানি কথার সম্মোহন ছড়াতে থাকে আর তপু সম্মোহিত হবে না এমন ভাবতে ভাবতে দোকান থেকে বেরিয়ে বেশকিছুদুর চলে আসার পর কেবল আবিষ্কার করে, তার হাতে বড় সাইজের,মেরুন রঙের পাঞ্জাবীর একটি প্যাকেট। কিভাবে সে এটা কিনে ফেলেছে এখন কিছুই বুঝতে পারছে না। অথচ মৌরির প্রিয় রঙ কালো।
তার ইচ্ছে ছিল কালো রঙের পাঞ্জাবীই কিনবে। কিন্তু এতক্ষণ দোকনে দোকানে ঘুরে মনে হলো তার মাপের কালো পাঞ্জাবীর আকাল পড়েছে দেশে। একটা কিছু নতুন তাকে কিনতেই হত আর অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেয়ার সময় ও এখন নেই। ধুক পুক করা খুশি মনটা একটু দমে গেলো। এখন আর বদলাতে গিয়েও লাভ নেই। টাকা আর ফেরর দিবে না নিলে পন্য নিতে হবে।
তপুর কাছে মনে হচ্ছে এখন পর-পর বাকি ঘটনাগুলোই হতাশ করার মত ঘটবে। জুতোর দোকানে জুতো পাওয়া যাবে না,দেখা করার দিন হরতাল পড়ে যাবে,বা পাখি আসবে না বা আসলেও তাকে সামনা সামনি পছন্দ করবে না। বিদুৎ গতিতে সে বিয়োগাত্মক কিছু চিন্তা করে মনে মনে হয়রান হয়ে পড়ল। অফিস ছুটির ক্লান্ত শরীরেও যে জোড়টা ছিল এখন তা নিভু নিভু করছে।

মৌরির সাথে দেখা করার কথা একরকম হঠাৎ ই ঠিক হয়ে গেল। তাড়াহুড়াটা মৌরির দিক থেকেই ছিল তবে পাছে সে আবার ভুল বুঝে তাই আর দ্বিমত করে নি তপু। এখনো মাসের বেতন পায় নি সে। তবে ভাগ্যভালো যে, হিরন তাকে পুরো টাকাটা ধার দিয়েছিল।
হিরন ছাড়া টিওশনি করা,ছা পোষা চাকরী করা ছেলেগুলোর কারো কাছেই মাস শেষ না হলে টাকা থাকে না। তেমন কাছের বন্ধু না হওয়ায় ধারটা একটু কুন্ঠিত হয়েই চেয়েছিল সে। কিন্তু হিরন খুব স্বাভাবিক ভাব করেছিল,যেন সে জানতো। সে অভিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে নেড়ে বলেছিল,
“এই গানেই কাজ হবে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হইব ভাবি নাই। তোর সাহস বাড়ছে ঠিক ধরছি না?
-হুম।
হিরন তার মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে বলছিল,
-যখন টাকা হয় দিস। আরে ব্যাটা সাহসটাই সব,পকেটে টাকাটাই সব না। সাহস আছে তো তুই রাজা নাই তো ফকির। মানুষ কয় আমি গাঞ্জা খাই। আরে শালারপোরা তোগো সাহস আছে নি যে খাবি। শালা ননসেন্সের দল।

হিরন সমানে আরো কিছু বলে যাচ্ছিল। তপুর কানে আর কিছুই যাচ্ছিল না। টাকাগুলো গুনেই সে হিরনকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল আনন্দে। এক কান দু কান করে মেসের সবাই জেনে গিয়েছে তপুর কথা। যারা তপুকে তেমন পছন্দ করত না তাদের চোখেও স্নেহ, ঈর্ষা আর কৌতূহল দেখতে পেয়েছে এই কয়দিন। বেশির ভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা, মধ্যবিত্ত, জীবিকার সন্ধানে ছুটন্ত এই তরুনগুলোর কাছে চাকুরীর মত ভালোবসাও অধরা। ভালোবাসা কদর এই মেসবাড়িতে ছেলেগুলোর চোখে কতটুকু তা এই দুদিনেই তপু দেখতে পেয়েছে বেশ। এদের ভীরে লজ্জা আর খুশিতে একটু চনমনেই ছিল এই কয়দিন।
পাঞ্জাবীর প্যাকেটটি হাতে নিয়ে আজ হঠাৎ আবার বিষন্নতা তাকে পেয়ে বসলো। সে চিন্তিত মন নিয়ে জুতোর দোকানের দিকে ঢুকে পাঞ্জাবীর সাথে যায় এমন স্যান্ডেল খুজতে থাকল। পছন্দ অনুযায়ী গুলোর দাম অনেক বেশি।সে চলনসই একটা নিয়ে মনকে প্রবোধ দিল পাখি তো তাকে দেখবে, তার জুতো নয়। আর যাই হোক মেয়েটি কোন মতেই পন্যমুখী নয়। তবুও অনেক আকাঙ্গাখিত অপেক্ষার পর দেখা হবে,সবকিছু একটু সাজানোই ছিল কল্পনায়। তা একটু একটু যেন ভেস্তে যাচ্ছে দেখে তপুর আত্মবিশ্বাস আবার মাথা নোয়ালো।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে গেল। তাকে কিছু প্যাক্যাট শুদ্ধ দেখে নিচ-তলা থেকেই একজন দুজন করে পিছু নিল। ঘরে ঢুকে তপু দেখে তাকে ঘিরে রুমমেট সহ প্রায় দশ-বারো জনের একটি জটলা। এদের কেউ কেউ তার ক্লাসমেট, কেউ বন্ধুশ্রেনী। সবার সাথে তুই তোকারি সম্পর্ক। প্যাকেটদুটো পাশে রেখে তপু ক্লান্ত ভঙ্গীতে চোখবন্ধ করে লম্বা হয়ে শুলো।
চোখ বন্ধ করেই তিনতলার সোহানের জোর কন্ঠ শুনতে পেল সে,
-আরে দোস্ত তোর তো চান্নি কপাল। আয় তোর কপালে ঘসা দেই। চিকনা শইল্লেই নাইকা জুটায় ফেলছস? আমি ফিগার বানাইয়াও পারতাসি না। সবাই ফ্লেক্সি করতে কয় ভালোবাসে না!
সবাই হোহো করে হেসে উঠল। বন্ধ চোখে তপুও হাসার চেষ্টা করে, হাসিটা আসতে আসতেও কপালের চিন্তার রেখায় মিলিয়ে গেল। তার মনে পড়ল এগারোটায় মৌরীর নেটে থাকার কথা অথচ আজ কেউ সহজে ঘর ছাড়বে বলে তপুর মনে হচ্ছে না।
প্যাকেটগুলোর খোলার শব্দ হলো, কিছুক্ষন এটা সেটা মন্তব্য করে হাসাহাসি করে তারা একে একে আরো আরো যোগারের লিষ্ট শোনাতে লাগল। সে এবার চোখ মেলে ফ্যালফ্যালে তাকায় বন্দধুদের মুখে। পাশাপাশি অবসন্ন চিন্তায় কে কি বলছে তার মাথায় ঢুকছে না। শুধু শব্দগুলো কানে নিয়মমাফিক গিয়ে তার মনোযোগে নাড়া দিচ্ছে।
“হাতে টাকা রেখছিস?এই সময় টাকা রাখতে হয়”।
“সাথে কি নিয়ে যাবি মানে গিফট? ভালো কিছু নিয়ে যাস”।
“আরে না আজকাল চার-পাচ হাজার টাকা ছাড়া ভালো কিছু পাওয়া যায়? এত টাকা এখন ব্যবস্থা কিভাবে করবে তুই বরং ফুল নিয়ে যাইছ”।
“চুলটা ঠিকমত কেটে যাইস”।
“আরে না চুল আজ কাটিস নি কেন? চুল কাটলে প্রথমদিন খুব ই খারাপ দেখা যায়। মেয়েরা পছন্দ করে না”।
“তুই জানলি কেমনে তুই তো এই পর্যন্ত একটা মেয়েই যোগাড় করতে পারলি না হে হে”।
“অই শালা ফালতু কথা কবি না। আমি তো ছাগল না যে খুটি তে থাইক্কা ভে ভে করমু। আমার আইডিয়া আছে। ভালোবাসা পাই আর না পাই ডেটতো মারছি।
আবারো সম্মিলিত হাসি।

হঠাৎ হিরনকে ঘরে ঢুকতে দেখে সবাই একে একে তপুর কাছ ছাড়ে। তপুও উঠে দাঁড়ায়। হিরন তার জন্য এক প্যকেট কাচ্চি বিরিয়ানী নিয়ে এসেছে।এটা দেখে তপুর বেশ অসস্তি হয়। আডিক্টেড মানুষের স্নেহ যেমন বাড়তি থাকে,সময়ে তাদের ভুল বোঝার মাত্রাও বিরাট আকার ধারন করে আর এতে যে চরম ভোগান্তিই আনে এটা সে ভালো করেই জানে।প্যাকেটটা নিতে নিতে তার বলতে ইচ্ছে করে “কি দরকার ছিল। আমার খাবারতো দিয়েই গেছে ডাইনিং থেকে। সেটা শুধু শুধু নষ্ট হবে। এমন করে আর কিছু আনিস না”। কিন্তু সে এগুলোর কিছুই বলতে পারে না।
হিরন যেন বুঝতে পারে,মুখে কিছু বলে না। সে সিগারেটটা ঠোটে পিষে পিষে টান দিয়ে হাত উচু করে বিদায় জানায় আর ইশারায় বলে খেয়ে নিতে।
এই গরমে ফুলস্লিভ গেঞ্জি পড়ে আছে হিরন।পেছনে লেখা “মি মেড হিরো”।হিরনের চলে যাওয়া দেখতে কেন জানি খুব খারাপ লাগছে তপুর। আজ পেছন থেকে আসক্ত মানুষটিকে দেখতে পাচ্ছে না তপু,দেখছে ভালোবাসার কাঙ্গাল এতিম একটা ছেলে। কিছুবছর আগে যে কারো প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নিজের হাতের রগ কেটে ফেলেছিল। সে কোনরকম দৌড়ে গিয়ে হিরনের কাধে হাত রাখে,বলতে চায় “এত ভালোবাসা পেতে ভয় পাই রে।এমনকি মৌরির ভালোবাসাকেও”। কিন্তু এটাও বলতে পারে না সে।
হিরন এবারো কিছু না বলে একমুখ দাড়ি নিয়ে কবিদের মত হাসি দেয়। চোখ পিট পিট করে নাক-মুখ ভর্তি করে ধোয়া ছেড়ে আরো কষে টান দেয় সিগারেট।

কাপড় ছেড়ে খেতে খেতে চিন্তা নামক দৈত্যের কাছে বস হয়ে গেলো তপু। যোগাড়যন্ত্রের তালিকা বাড়ছেই। উপহারের কথাতো ভুলেই গিয়েছিল সে। আর এত টাকাওতো আর তার কাছে নেই। অথচ অনুভব জগতটা কত সহজ!মৌরির সাথে দেখা করতে হলে সেভ করতে হয় না,জুতো পর্যন্ত পড়তে হয় না,খালি পায়ে মৌরিকে নিয়ে পৃথিবী দাবড়ে বেড়ানো যায়। এক তোড়া ফুল কেন? কৃষ্ণচূড়ার পুরো একটা শহরই দেয়া যায়। জামা কাপড়ের রঙ সাইজ নিয়ে ভাবতে হয় না। ঈশ্বরের মত কুন বললে সেখানে সব হয়ে যায়।সেখানে জগতটা লেট দেয়ার বী লাইটের মতই সহজ। তপু আর মৌরীই সেখানে ঈশ্বর-ঈশ্বরী। ইশ!এমন একটা জগত যদি পৃথিবীটা হত!খাবারের নলা মুখে নিতে নিতে এমন অসম্ভব জগতের আকাঙ্খায় তপুর চোখদুটো জ্বলে উঠে।


(চলবে)...

গল্পটি একটু বড় বিধায় দুই পর্বে ভাগ করেছি।শুক্রবার শেষ পর্বটা পোষ্ট করব।
আর এনিস সং যারা শুনেন নি তাদের জন্য লিঙ্ক।