নিত্যদিন কাজের অকাজের নানা কথায় যে কথামালা আমরা গেঁথে চলেছি অবরত সেই কথায় কথায় কথার পাহার জমে ওঠে। প্রবহমান কথার স্রোতে কত পুরানো কথাই হারিয়ে যায় নতুন কথার ভিড়ে। যে পুরানো কথাটা এক সময় মহার্ঘ মনে হত আজ তা স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে মূল্যহীন হয়ে। যে কথা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম একদিন আজ হয়ত তা গুরুত্বহীন। প্রবহমান সময়ের স্রোতে অনেক ডন্ড-পল অতিক্রম করে এসেছি, পেছন ফিরে চাইবার অবকাশ হয়নি, কিন্তু তারা আমায় একেবারে পরিত্যাগ করে নি, সমস্তটাই আমার বয়েসের অংকে যোগ হয়েছে। আজ মেঘলা আকাশের গুমোট আবহাওয়ায় আর ততধিক গুমোট সামাজিক আবহে কখনো সেই পুরোনো দিনের কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে স্মৃতি পেছনটানে। একে একে জলছবি গুলো চলচ্ছবি হয়ে ওঠে। এই যেমন গত রবিবার গেছিলাম কলকাতার উপকন্ঠের মফস্বলে আমদের পুরোনো বাড়ীতে। আমার জন্ম ও বাল্যকাল কলকাতায় কাটলেও স্কুল জীবনের একটা বড় অংশই কেটেছে সেখানে। সেদিন স্টেশন থেকে নেমেই দেখি পরিমল, ক্লাস এইটেই ও স্কুলকে ছুটি দিয়ে দিয়েছিল, একটা টেবিলে অনেক পেন, ও পেন বিক্রি করছে। আমায় খেয়াল করে নি বা করলেও কথা বলতে হয়ত ইতস্ততঃ করছিল, আমিই এগিয়ে গিয়ে সামনে দাড়ালাম। এক গাল হেসে হাতটা চেপে ধরল। মাটির ভাঁড়ে চা এনে খাওয়াল, তারপর এ কথা সে কথা। কিন্তু কথা সে রকম জমছিল না, খেই হারিয়ে যাচ্ছিল। আসলে মাঝখানের সময়ে আমাদের দুজনের জগৎ এতটাই আলাদা হয়ে গেছে যে ফ্রিকোয়েন্সি মিলছিল না। আমরা দূ’জনেই কথা শেষ করতে চাইছিলাম বোধহয়। বললাম, “আসি তাহলে, আজই আবার ফিরে যেতে হবে”। ও বলল, “আসলে আবার দেখা করিস, তুই তো চিনতে পারলি, অনেকে চিনতেই পারে না”। আবার আসব বলে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি বাড়ীর পথে চললাম। আর চলতে চলতে ছবি গুলো যেন স্পষ্ট হচ্ছিল চোখের সামনে। এই পরিমল আমাদের থেকে বয়সে খানিকটা বড়ই ছিল, আর আমরা ছিলাম ওর গুনমুগ্ধ বন্ধু। ওর থেকেই প্রথম নারী রহস্যের আবছা আভাস পাওয়া। একদিন নিয়ে এল নগ্ন নারীর ছবি। সে কি উন্মাদনা। কত কথা কত প্রশ্ন, পরিমল তখন আমাদের পরম আদরের শিক্ষক, গুরু, তাকে ভুলি কি করে।
আমি এক শ্রমণ, এক অন্তহীন পথের পথিক, মাধুকরী করতে করতে আমার এই পথ চলা। কত নদী-প্রান্তর পেরিয়ে, কত গ্রাম-কত জনপদের মধ্যে দিয়ে, মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি- আজানের সুর শুনতে শুনতে পেরিয়ে এসেছি কতটা পথ। তবুও এগিয়ে চলেছি। কিন্তু কোথায় চলেছি? কি আছে পথের শেষে? জানি না -তবুও থেমে যাওয়ার জো যে নেই। এই পথ চলতে চলতেই কত মানুষের সঙ্গে দেখা, ক্ষণিকের আলাপ, ঘনিষ্টতা- তারপর আবার চলা। এই পথে কত মানুষ, কেউ বা আমায় ফেলে এগিয়ে চলে গেল, কেউ বা পড়ে রইল পেছনে, কেউ গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ বা একা, কেউ বা সঙ্গিদের সঙ্গে। এখন সন্ধ্যে – সবাই পান্থশালার দ্বারে। কেউ বা সঙ্গিদের নিয়ে হুল্লড়ে ব্যস্ত। কেউ বা চাটাইয়ে উপর শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে-ওদের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। ওরা ফেলে আসা পথের স্মৃতি রোমন্থন করছে। টুকরো টুকরো সুখের ছবি পূর্ণিমার চাঁদের মতো উদ্ভাসিত করছে ওদের মুখ। আগামী পথের সুখ কল্পনায় কেউ বা বিভোর। কেউ ফেলে আসা দুঃখস্মৃতিতে কাতর, কেউ বা অনুতপ্ত, আবার কারো মুখ প্রতিহিংসার বাসনায় দৃঢ়। ওরা এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। বিশ্রাম নিচ্ছে রাতটুকুর জন্য। সূর্য্যদয়ে আবার জেগে ওঠা- আবার পথ চলা শুরু। আবার সামনের দিকে এগিয়ে চলা। এ পথ যে শুধু এগিয়ে যাওয়ার পথ। পেছনে ফেলে আসা পদচিহ্নের স্মৃতি রোমন্থন করা যায় কিন্তু সেখানে ফিরে যাওয়া যায়না কোনো মতেই। পথের অভিঙ্গতায় মাধুকরীর ঝুলি ক্রমে ক্রমে ভারি হয়ে ওঠে।
এই বাংলা ব্লগের পথে চলতে চলতে ভাই ফয়সালের সঙ্গে ওর ‘স্বপ্নময় জগৎ’ এ দেখা। ওর কথাতেই আমার মাধুকরীর ঝুলির সংগ্রহ সবাইকে ভাগ করে দেব এবার।
নতুন বছর সুখে সমৃদ্ধিতে পূর্ন হয়ে উঠুক সকলের। সকল দীনতা, মলিনতা ঘুঁচিয়ে আমরা যেন আলোর পথযাত্রী হতে পারি। পয়লা বৈশাখের প্রাসঙ্গিকতা অর্থনৈতিক দিক থেকে আর নেই সেই স্থান দখল করেছে ৩১ মার্চ, আচার অনুষ্ঠান ছাড়া বাংলা তারিখের হিসেবও আমাদের মনে থাকেনা। তবুও বাঙ্গালীরা আবেগে, সাস্কৃতিক কর্মকান্ডে পয়লা বৈশাখের উৎসব পালন করে চলেছি চলবোও। সকালের প্রভাতফেরীতে, বিকেলের গানমেলায় আমাদের পয়লা বৈশাখ। আমরা শুভেচ্ছা জানাই পরস্পরকে ভাল থাকার, আমরা শপথ নিই ভাল হওয়ার। আচ্ছা শপথটা যদি এরকম হয়-
‘মানুষের প্রিয়তম সম্পদ তার জীবন, এটা সে একবারই পায় এবং এই জীবন তাকে এমনভাবে কাটাতে হবে যাতে কেটে বছরগুলি সম্পর্কে যন্ত্রণাদায়ক দুঃখের অনুভুতি না জাগে, অতীতের হীনতা ও তুচ্ছতার লজ্জা যেন তুষের আগুনের মত না পোড়ায়, এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মরার সময় সে বলতে পারেঃ আমার গোটা জীবন, আমার সমস্ত শক্তি আমি উৎসর্গ করেছি জগতের মহত্তম লক্ষ্যে– মানব জাতির মুক্তির জন্যে– সংগ্রামের লক্ষ্যে’।
আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, রোদ্দুরে সোনার রঙ লেগেছে, প্রকৃতিও উৎসবের জন্য সেজেগুজে তৈরী। খুশির ঈদ গেল, দুর্গাপূজোও এলো বলে। দোকানে দোকানে ঝলমলে রঙিন পোষাকের প্রদর্শনী, ভিড় রাস্তা জ্যাম। আমি কেন জানি না এই ভিড়ে কিছুতেই নিজেকে মেলাতে পারি না। আমার অনেক খারাপের এটাও অবশ্যই একটা। ধর্মীয় ব্যাপারে আমার বরাবরই আগ্রহ কম। যদিও দূর্গাপূজো এখন একটা সাস্কৃতিক ইভেন্ট। কত পুজো সংখা বেরবে। কত গানের তৈরী হবে। প্যান্ডেল্গুলোও এক একটা শিল্প।কিন্তু চার পাশটা যেন কেমন যেন বিষিয়ে যাচ্ছে। রুগির আত্মীয়-স্বজন ডাক্তার পেটাচ্ছে, আবার ডাক্তাররা রুগি পেটাচ্ছে। এক ভয়াবহ অরাজক অবস্থা। বাজার অগ্নিমূল্য, সাধারণ মানুষ কি ভাবে দিন গুজরান করে সেটাই ভেবে পাই না। এথচ এটা কিন্তু কোন ইস্যু হচ্ছে না। কেজো লোকের এ নিয়ে বোধহয় বিশেষ ভাবনা নেই। আমার মতো অকেজো লোক গালে হাত দিয়ে বসে ভাবি, কিন্তু তাতেতো কোন সুরাহা হবে না। কারন সামর্থের অভাব। যদি সামর্থ থাকত অযোধ্যার ওই জায়গাটা বড় একতা বোমা মেরে বড় দিঘী বানিয়ে দিতাম। কাশ্মীর থেকে সৈন্য ফেরত নিয়ে এসে কাশ্মীরিদের বলতাম, “তোদের যা খুশী কর, আমরা চললাম।”। বিমল গুরুঙ্গএর কান ধরে বলতাম, “যা বাবা নেপালে যা, ওখানে অনেক পাহার ঠার আছে, সেখনে গিয়ে ৭৭ দিন বনধ ডাক”। এগুলো করলে তার প্রতিক্রিয়ায় কি হতো জানি না, সেটা ভাবার দরকারও নেই। কারন এগূলোতো আর আমি করতে যাচ্ছি না সত্যি সত্যি, কারন আমারতো ক্ষমতাই নেই। তবে একজনের একটা ডায়লগ ধার করে বলি, “ক্ষমতা পেলে সব দু’মিনিটে সমাধান করে দেব”।
যাই হোক সম্প্রতি আবহমান ছবিটা দেখলাম। ভালো লাগল ছবিটা। ছোট ছোট পরিমিত সংলাপ আর টুকরো টুকরো দৃশ্য সাজিয়ে গল্প দাড়িয়েছে। গল্পতো গৌণ, প্রতি পরতে একটা জীবনের যে ছবি, যে বিতর্ক, সেটা আমাদের ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। ছবির শুরুতেই একটা অসাধারন ফ্রেমে অনিকেত আর তার ছেলে, “কেন এই তো ভালো (ভিডিও মাধ্যম) পছন্দ না হলে মুছে ফেলো আবার শ্যুট করো আবার মুছে ফেলো”। আমি এটা প্রায়ই বন্ধু মহলে বলতাম, জীবনটা যদি টেপ রেকর্ডারের মত হত, মুছে ফেলে আবার রি-রেকর্ড করে নিতাম”। আমার কথাটা কে যেন ঋতুপর্ন ঘোষকে বলে দিয়েছে। আর টেপ রেকর্ডারটা পালটে ভিডিও করে চালিয়ে দিলো? সে যাই হোক সত্যিই যদি জীবনটা এরকম হত, অপছন্দের পর্যায়টা মুছে ফেলে আবার নতুন করে শ্যুট করা যেত, বেশ হত তাই না। আবার ভাবি যে কি হত? মানুষ কি এর মধ্যে দিয়ে নিখুঁত মানুষ হত বা হওয়ার চেষ্টা করত? না আরো আরো সম্পদ সৃষ্টির পথের ভুলগুলোকে সংশোধন করত? আমরা প্রাচীন কাল থেকেই দেখেছি মানুষ অত্যন্ত possessive, এটা মানুষের একটা অন্যতম রোগ, যার থেকে বিভিন্ন উপসর্গের উৎপত্তি। আমাদের আর একটা মূল সমস্যা হলো আমাদের চেনা ছকের বাইরে কাউকে থাকতে দেখলে আমাদের অস্বস্তি হয়, প্রানপণে আমরা তাকে আমাদের পরিচিত ছাঁচে এনে ফেলার চেষ্টা করি। আর নিখুঁত মানুষ বলছি সেটাই বা কি জিনিষ, তার সঙ্ঘা কি? মানুষের সমাজ-অনুমোদিত যে আদর্শ আচরন বিধি সেটাতো স্থানু নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা অনেক বদলেছে-বদলাতে থাকবেও। সাধু-সন্ত, সমাজপতি কারোরই ক্ষমতা নেই তাকে আটকে রাখার। অনেক কিছু বলে ফেললাম বিচ্ছিন্নভাবে। জানি তাতে কোন নিরবিচ্ছিন্ন ছবি ফুটে উঠলো না। কি আর করা- মন বিক্ষিপ্ত থাকলে (মন কি শুধু ফয়সালেরই খারাপ হয়, আমার হতে নেই?) লেখাও সেরকমই হবে। আজ এটুকুই থাক।
বহু দূরের অসীম আকাশ আজ বনরাজিনীলা পৃথিবীর শিয়রের কাছে নত হয়ে পড়ল। কানে কানে বললে, “আমি তোমারই।”
পৃথিবী বললে, “সে কেমন করে হবে। তুমি যে অসীম, আমি যে ছোট।”
আকাশ বললে, “আমি তো চার দিকে আমার মেঘের সীমা টেনে দিয়েছি।”
পৃথিবী বললে, “তোমার যে কত জোতিষ্কের সম্পদ, আমার তো আলোর সম্পদ নেই।”
আকাশ বললে, “আজ আমি আমার চন্দ্র সূর্য তারা সব হারিয়ে ফেলে এসেছি, আজ আমার একমাত্র তুমি আছ।”
পৃথিবী বললে, আমার অশ্রুও আজ চঞ্চল হয়েছে, দেখতে কি পাও নি। আমার বক্ষ আজ শ্যামল হল তোমার ঐ শ্যামল হৃদয়টির মতো।”
সে এই বলে আকাশ-পৃথিবীর মাঝখানকার চিরবিরহটাকে চোখের জলের গান দিয়ে ভরিয়ে দিলে। কবিগুরু এভাবে বর্ষাকে দেখেছেন। আর এখন আমার দেখা–
পৃথিবী বললে, “আকাশ তোমার আলোর ঐশ্বর্য্যে আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তোমার সূর্যের আলোয় ঝলসে যাচ্ছি আমি। তোমার কি আমার ওপর একটুও করুনা হয় না।”
আকাশ বললে, “তোমার কষ্ট কেন, আমিও কি কম কষ্ট পাচ্ছি। তোমার সংগে মিলনের আঙ্খাকায় এই ঋতুর প্রতিক্ষায় আমিও বসে বসে দিন গুনি, বুঝতে কি পার না?”
পৃথিবী বললে, “আষাঢ় – শ্রাবণ গেল প্রতিক্ষায়, আমাদের মিলন বুঝি আর হলো না। আর সেই আক্রোশে আমাকে পুড়িয়ে মারার ছল করেছ বুঝি।”
আকাশ বললে, “একথা বলে আমাকে কষ্ট দাও কেন? তোমার দুঃখে আমিও নিদ্রাহীন। একটু ধৈয্য ধর প্রিয়া, মিলন আমাদের হবেই।”
পৃথিবী বললে, “তোমার আলোর উত্তাপে আমার কন্ঠ শুষ্ক, বুক শুকিয়ে ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, তবু তুমি নিশ্চেষ্ট বসে মিলনের আশ্বাস দিচ্ছ। তোমরা এরকমই নিষ্ঠুর, আমার সন্তানেরা তৃষ্ণায় হাহাকার করছে। আমি কি করে স্থির থাকি। তোমাদেরতো আর সন্তান লালন করতে হয় না।
আকাশ বললে, “আমি আজ যে অনাবৃত হয়ে গেছি। মেঘের ঢাকনা আর নেই, দেখছ না। মেঘ কে পাঠিয়েছিলাম আষাঢ়ের প্রথম দিবসে পত্র দিয়ে তোমার কাছে। কিন্তু সে তো আর ফিরে এলো না। সেই পাহাড়ের চুড়ায় বসে বৃষ্টি ঢেলে চলেছে। এই শুকনো ভাদ্রে এসো আমরা মিলনের বদলে বিরহের গান গাই। সেই গানের সুরের ধারায় যদি বরষার ধারা নামে।”