পুবের মেঘ পশ্চিমে যায় গো উত্তরের মেঘ দক্ষিণে মাঝখানে দৃষ্টিবাণবিদ্ধ ত্রিভঙ্গত্রাহি চাতকের চোখ
উচাটন ভাবন হুতাশন ঘেরা এখন স্মৃতির সংসার
অনুগতা বৃষ্টি আমারও ছিল একদা
মক্করমগ্ন বয়ঃসন্ধি বিলাপে মেঘের কনিষ্ঠা কন্যা বৃষ্টি আকাশের বজ্রহুঙ্কারিত নিষেধ উপেক্ষা করে নাড়ির টান ছেড়ে বাড়ি পালানোর পরে ঋতুমতী বর্ষায় ফলনের বিশ্বাস বার্তায় তখন বিগলন মাটির শরীরে সুহালে গর্ভবতী হলে প্রকৃতির টানাপড়েন বন্ধ্যাকালে মফেল মচ্ছবে মাতোয়ারা পীরমাছদের মনরূপ ধন শোষণ ইচ্ছায় অনুখন চনমন হয়েছিল খুব।
এই দৃশ্যের ভিতর লুঙ্গি মাথায় বেঁধে ধেইধেই নাচতাম আমিও লোকে বলতো ল্যাংটা বাবা গভীরতর চশমার কাচ মুছে বৃষ্টিপাগল বলতো কেউ কেউ ঘরে ঘরে আলাপ-প্রলাপ সৌখিন খিচুরি পেটে বদহজম দিলে নাকচাপা দিতো হাত কানেরা শুধু কান পেতে শুনতো হেড়ে গলার গান বৃষ্টির সঙ্গে রঙ্গ করে সবুজ হতেছে সময়
বৃষ্টির হলো অভিমান; পরকীয়ায় রাতের বাতাস ছোঁয়া অপমান। আমি পাই নি টের; হালে পানি পেলে গোছাতাম আসন্ন আখের। নিজের পায়ে মারলাম কুড়াল; মাটিতে বসা পাখি দিল উড়াল। জল হয়ে বৃষ্টি ফিরে গেল মেঘে; খরতপ্ত দিনের বাষ্পীয় আবেগে।
পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ জুড়ে মেঘের আনাগোনা এখনও চুপিসারে সখ্য হয় বৃষ্টির মাটির মনে; সদৃশ সঞ্চারিত গর্ভ হলেও প্রজন্মে প্রজন্মে ধারাপাত বদলে দেয় জীবন সমীক্ষা
বহুদিন পর আজ বাতাসে বৃষ্টির আভাস সোঁদা মাটির অমৃত গন্ধ- এখনই বুঝি বৃষ্টি আসবে সবারই মনে উদ্বেগ- তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। তবু আমার মনে নেই বৃষ্টি ভেজার উদ্বেগ আমার চলায় নেই কোনো লক্ষণীয় ব্যস্ততা।
দীর্ঘ নিদাঘের পর আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির সম্ভাবনা অলক্ষ্য আনন্দ ছড়ায় আমার তপ্ত মনে - আর আমি উন্মুখ হয়ে থাকি বৃষ্টির প্রতীক্ষায় - এখনই বৃষ্টি নামুক বহুদিন পর আজ বৃষ্টি আসুক।
দীর্ঘ পথে না থাকে না থাকুক বর্ষাতি - বৃষ্টির জলে যদি ভিজে যায় আমার সর্বাঙ্গ পরিধেয় পোশাক-আশাক- তবুও বৃষ্টি আসুক - সমস্ত আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামুক বৃষ্টি নামুক মাঠ-প্রান্তর ডুবিয়ে। সে অমিতব্যয়ী বৃষ্টিজলের বন্যাধারায় তলিয়ে যায় যদি আমার ভিটেমাটি তলিয়ে যাই যদি আমি ক্ষতি নেই।
নিত্যদিন কাজের অকাজের নানা কথায় যে কথামালা আমরা গেঁথে চলেছি অবরত সেই কথায় কথায় কথার পাহার জমে ওঠে। প্রবহমান কথার স্রোতে কত পুরানো কথাই হারিয়ে যায় নতুন কথার ভিড়ে। যে পুরানো কথাটা এক সময় মহার্ঘ মনে হত আজ তা স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে মূল্যহীন হয়ে। যে কথা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম একদিন আজ হয়ত তা গুরুত্বহীন। প্রবহমান সময়ের স্রোতে অনেক ডন্ড-পল অতিক্রম করে এসেছি, পেছন ফিরে চাইবার অবকাশ হয়নি, কিন্তু তারা আমায় একেবারে পরিত্যাগ করে নি, সমস্তটাই আমার বয়েসের অংকে যোগ হয়েছে। আজ মেঘলা আকাশের গুমোট আবহাওয়ায় আর ততধিক গুমোট সামাজিক আবহে কখনো সেই পুরোনো দিনের কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে স্মৃতি পেছনটানে। একে একে জলছবি গুলো চলচ্ছবি হয়ে ওঠে। এই যেমন গত রবিবার গেছিলাম কলকাতার উপকন্ঠের মফস্বলে আমদের পুরোনো বাড়ীতে। আমার জন্ম ও বাল্যকাল কলকাতায় কাটলেও স্কুল জীবনের একটা বড় অংশই কেটেছে সেখানে। সেদিন স্টেশন থেকে নেমেই দেখি পরিমল, ক্লাস এইটেই ও স্কুলকে ছুটি দিয়ে দিয়েছিল, একটা টেবিলে অনেক পেন, ও পেন বিক্রি করছে। আমায় খেয়াল করে নি বা করলেও কথা বলতে হয়ত ইতস্ততঃ করছিল, আমিই এগিয়ে গিয়ে সামনে দাড়ালাম। এক গাল হেসে হাতটা চেপে ধরল। মাটির ভাঁড়ে চা এনে খাওয়াল, তারপর এ কথা সে কথা। কিন্তু কথা সে রকম জমছিল না, খেই হারিয়ে যাচ্ছিল। আসলে মাঝখানের সময়ে আমাদের দুজনের জগৎ এতটাই আলাদা হয়ে গেছে যে ফ্রিকোয়েন্সি মিলছিল না। আমরা দূ’জনেই কথা শেষ করতে চাইছিলাম বোধহয়। বললাম, “আসি তাহলে, আজই আবার ফিরে যেতে হবে”। ও বলল, “আসলে আবার দেখা করিস, তুই তো চিনতে পারলি, অনেকে চিনতেই পারে না”। আবার আসব বলে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি বাড়ীর পথে চললাম। আর চলতে চলতে ছবি গুলো যেন স্পষ্ট হচ্ছিল চোখের সামনে। এই পরিমল আমাদের থেকে বয়সে খানিকটা বড়ই ছিল, আর আমরা ছিলাম ওর গুনমুগ্ধ বন্ধু। ওর থেকেই প্রথম নারী রহস্যের আবছা আভাস পাওয়া। একদিন নিয়ে এল নগ্ন নারীর ছবি। সে কি উন্মাদনা। কত কথা কত প্রশ্ন, পরিমল তখন আমাদের পরম আদরের শিক্ষক, গুরু, তাকে ভুলি কি করে।
আমি এক শ্রমণ, এক অন্তহীন পথের পথিক, মাধুকরী করতে করতে আমার এই পথ চলা। কত নদী-প্রান্তর পেরিয়ে, কত গ্রাম-কত জনপদের মধ্যে দিয়ে, মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি- আজানের সুর শুনতে শুনতে পেরিয়ে এসেছি কতটা পথ। তবুও এগিয়ে চলেছি। কিন্তু কোথায় চলেছি? কি আছে পথের শেষে? জানি না -তবুও থেমে যাওয়ার জো যে নেই। এই পথ চলতে চলতেই কত মানুষের সঙ্গে দেখা, ক্ষণিকের আলাপ, ঘনিষ্টতা- তারপর আবার চলা। এই পথে কত মানুষ, কেউ বা আমায় ফেলে এগিয়ে চলে গেল, কেউ বা পড়ে রইল পেছনে, কেউ গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ বা একা, কেউ বা সঙ্গিদের সঙ্গে। এখন সন্ধ্যে – সবাই পান্থশালার দ্বারে। কেউ বা সঙ্গিদের নিয়ে হুল্লড়ে ব্যস্ত। কেউ বা চাটাইয়ে উপর শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে-ওদের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। ওরা ফেলে আসা পথের স্মৃতি রোমন্থন করছে। টুকরো টুকরো সুখের ছবি পূর্ণিমার চাঁদের মতো উদ্ভাসিত করছে ওদের মুখ। আগামী পথের সুখ কল্পনায় কেউ বা বিভোর। কেউ ফেলে আসা দুঃখস্মৃতিতে কাতর, কেউ বা অনুতপ্ত, আবার কারো মুখ প্রতিহিংসার বাসনায় দৃঢ়। ওরা এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। বিশ্রাম নিচ্ছে রাতটুকুর জন্য। সূর্য্যদয়ে আবার জেগে ওঠা- আবার পথ চলা শুরু। আবার সামনের দিকে এগিয়ে চলা। এ পথ যে শুধু এগিয়ে যাওয়ার পথ। পেছনে ফেলে আসা পদচিহ্নের স্মৃতি রোমন্থন করা যায় কিন্তু সেখানে ফিরে যাওয়া যায়না কোনো মতেই। পথের অভিঙ্গতায় মাধুকরীর ঝুলি ক্রমে ক্রমে ভারি হয়ে ওঠে।
এই বাংলা ব্লগের পথে চলতে চলতে ভাই ফয়সালের সঙ্গে ওর ‘স্বপ্নময় জগৎ’ এ দেখা। ওর কথাতেই আমার মাধুকরীর ঝুলির সংগ্রহ সবাইকে ভাগ করে দেব এবার।