গীত-কবিতা: শব্দ -স্বীকৃতি (গান-(৬৫): ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা আর মিষ্টি রোদের হাঁসি অশান্ত বাতাসে দূরে কোথায় রাখাল ছেলে বাজায় বাঁশী বৃষ্টির ছন্দে নাচে মন আনন্দে মাঠ ঘাট ওঠে জল...
আমার ব্যথাগুলো আরো ব্যথা নিয়ে মেঘ হয়ে চেপে গেছে চোখে আমি ভালো নেই.....
[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]
মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২
মিলির চিঠি
মিলির চিঠি
তোমার হাতখোঁপার ভেতর যেন যাদুটোনা আছে! সে জন্যই এতো ঘাবড়ে যাই! লাল গোলাপ, তাঁতের শাড়ি আর হাতখোঁপা। সব মিলিয়ে মেরে ফেলবার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালি প্রচেষ্টা। শরীরের ঘাম ঝড়িয়ে শুধু তোমার জন্য সর্বত্তোম শাড়ি বানিয়ে দেয় অজানা তাঁতিদের দল। গাছ বেয়ে যেমন উপরে উঠতে চায় গুল্মলতা, শাড়িগুলোর কাছে তুমিও তেমনি একটি গাছ। তোমাকে পেঁচিয়ে ধরে ওরা আনন্দে আত্মহারা! ওভাবে পাগল-করা শাড়ির বাহার আর তার সাথে অযত্নে করা হাতখোঁপা। কে শিখিয়েছে এই অভ্যাস! কবে থেকে শুরু হলো এমন মেয়েলিপানা! জানার খুব ইচ্ছে রইল। যেদিন কথা হবে সেদিন ভেঙে দিও সব রহস্য। তোমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের পেছনে যদি কোন পুরুষের হাত থাকে তবে বড় দুঃখ পাব।
গোলাপের গন্ধ ছড়িয়ে যেদিন তুমি এক হাত দূর দিয়ে হেঁটে গেলে, সেদিন চমকে উঠেছিলাম! একটাই মাত্র গোলাপ, তবুও মনে হয়েছিল তুমি বুঝি আস্ত বাগান সাথে করে হেঁটে বেড়াচ্ছ। না হলে এতো ঘ্রাণ এলো কোথেকে! অনেক কষ্ট করে তোমার খোঁজ পেয়েছি। যেদিন কথা হবে সেদিন বলবো কি করে পেলাম সে খোঁজ। এবার কাজের কথায় আসি। প্রতিদিন তুমি হাতখোঁপা করে আসো, সেজন্য তোমার পুরো চুল দেখা হয় না কখনো। মা বলেন, ছেলের বউএর চুল হবে ঘন কালো। যেন কোমরের ভাজ ছুঁয়ে যায়। একটা মাত্র ছেলের বউ, দেখেশুনে বেছে নিবেন তাতো হতেই পারে! তোমাকে দেখতে এসে হয়তো চুল নিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করবেন। তাই বলে তোমাকে বলবেন না হেঁটে দেখাতে। জিজ্ঞেস করবেন না তুমি গান জানো কিনা, অর্থাত তুমি বোবা কিনা। তিনি শুধু বাছবেন ঘন কালো কেশ। অথচ দেখ, খোঁপাতে আমার কত দুর্বলতা। আবার সেটা যদি হয় হাতখোঁপা। খোপার উপর বসিয়ে রাখা ফুলের কথা আগে কখনো ভাবিনি। ওভাবে ফুলের সৌন্দর্য বোঝার জ্ঞান ছিল না। না হলে ফুল নিয়েও ভাবতাম।
চিঠিটা অনেক বড় করার ইচ্ছে নেই। তবুও হয়তো কয়েক পাতা হয়ে যাবে। এবার ছেলেপক্ষের কথা শোন। আমাদের ছোট সংসারটা মায়ের হাতে বোনা কাঁথার মতোই নক্সী করা। আমার ঘরটার কথাই ধর। জানালা থেকে তিন হাত দূরে চেরি রঙের ইটালিয়ান বেডরুম সেট। তার সাথে মিল করে রেখেছেন পড়ার টেবিল। তিন পাটের কাঠের ক্লোজেট করেছেন বাথরুমটার ঢোকার মুখে। প্রথম পাট খুললে দেখবে লম্বা করে সাজানো নানান রঙের প্যান্ট। আমি জিন্স পরতে পছন্দ করি। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা না হলে জিন্স পরতাম না। বেঁটে ছেলেদের জিন্সে মানায় না। কথাটি আমার ছোটখালার মুখে শুনেছি। তার স্বামী অর্থাত আমার ছোটখালু বেশ বেঁটে। তিনি জিন্স পরলে ছোটখালা ভীষণ রেগে জান। শুধু জিন্সের প্যান্ট নিয়েই ঝগড়া করে তিন-চারদিন কথা বলা বন্ধ করে বসে থাকে তারা। ফিরে আসি আমার বেডরুমে। ক্লোজেটের মধ্যখানের দরজা খুললে দেখতে পাবে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো নামিদামি ব্রান্ডের সার্ট। কোনটার বয়সই ছয় মাসের বেশি নয়। অথচ আমার পছন্দ নীল রঙের পাঞ্জাবি। আছে গোটা দশেক। মা সেগুলো হ্যাঙ্গারে রাখতে দেন না। ক্লোজেটের শেষ অংশে ছিল মিশ্র জিনিসপত্র। যেমন আইপড, ক্যামেরা, খাতা-কলম ইত্যাদি। এখন সেখানে ভাঁজ করা শাড়ির বাহার। গেল বছর থেকে আজেবাজে জিনিস সরিয়ে সেখানে বউ-এর জন্য কেনা শাড়ি সাজিয়ে রেখেছেন মা। বাবার মতো আমিও প্রথম প্রথম ভাবতাম এটা তার পাগলামি। বউ নেই তার আবার শাড়ি। সে ভুল মা ভেঙে দিলেন। তিনি বললেন, ছেলের বিয়ে নিয়ে ভাববো আর বউকে নিয়ে ভাববো না সে কেমন কথা! বউ আমার যেমন হয় হোক। শাড়ি দেখে যেন তার যেমন তেমন ভাব চলে যায়। জাতীয় দিনগুলোতে পরবে সূতি শাড়ি। পার্টিতে ঝকমকে কালো। বউ এর খোলা চুল হেলে দুলে শাড়ির গায়ের খেলা করবে। শাড়ি হবে বউ এর খেলনা। চুল হবে তার চাবিকাঠি। দেখবি বউ এসে বলবে তোমার মায়ের পছন্দ আছে!
আর একটা কথা খুব জরুরী। আমাদের টাকা-পয়সার কোন অভাব নেই। শুনেছি কিছু শাড়ির দাম সত্তুর থেকে আশি হাজার টাকা। লাখ টাকার শাড়িও আছে বেশ কয়েকটা। বাবার কাছে টাকা চাইলে তিনি কোন প্রশ্ন করেন না। বাবা শুধু বলেন বিকেলে নিয়ে আসবেন। বিকেল হলে বাবা ব্রিফকেস খুলে টাকার বান্ডিল তুলে দেয় মায়ের হাতে। একটা সত্যি কথা বলি? বান্ডিল বান্ডিল টাকা ছাড়া আমাদের বাসায় অনেক দিন হলো কোন খুচরা টাকা দেখা যায় না। বাবার রিটায়ারমেন্টের অনেক দেরি। তারপরেও সরকারি চাকরি বলে কথা! একদিন না একদিনতো তিনি অবসরে যাবেন। তখন কি হবে। মা হয়তো সে কথা ভাবেন না, কিন্তু বাবা ভাবেন।
আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে পড়াতে চেয়েছিল বাবা। কানাডার এক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েও যাওয়া হলো না। মা বলেছিলেন, যদি চোখের সামনে থেকে চলে যাই তিনি গলায় দড়ি দিবেন। এই নিয়ে অনেক কথা হয়েছে বাড়িতে। অনেক ক্ষুদ্র মিটিং হয়েছে। মাঝে মাঝে আত্মীয়দের কেউ কেউ এসে তাতে যোগও দিয়েছে। ছোটখালা খালুতো থাকতেনই। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শেষমেষ মায়েরই জয় হলো। তবে বাবাও বিনা শর্তে ছেড়ে দিলেন না। তিনি বলেছিলেন ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার তার নাকি খুব শখ ছিল। সেই শখ পূরণ করতে পারেননি। তাই দেশে বসে পড়াশুনা করলে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে হবে। এই শর্তেই আমাকে দেশে থাকতে হচ্ছে।
বাবা বিয়ে করেছিলেন ছাত্র অবস্থায়। আমি জন্ম নিয়েছিলাম তার ছাত্র জীবনে। মা তখন থাকতেন রাজশাহীতে তার বাবার বাড়ি। বাবা আসতেন যেতেন। এরই মাঝে আমিও এসে গেলাম। বড় হলাম নানার বাড়ি। পড়ালেখার শুরু অবৈতনিক বিদ্যালয়ে। তারপর সরকারি হাই স্কুল। বাবা এই সরকারি চাকরিটা পেয়ে গেলে আমরা ঢাকায় চলে এলাম। সংসারটা স্থায়ী হলো। কলেজ থেকে পাশ করে গত বছর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম। বাবা ছাত্রজীবনে বিয়ে করেছিলেন বলে তার উন্নতি থেমে থাকেনি। তাই মা-বাবার দুজনেরই ধারনা, ছাত্রবয়সে বিয়ে করলে আমারও কোন অসুবিধা হবে না। বাবার অঢেল ব্যবসা আছে রাজশাহীতে। ব্যবসাগুলো সব নানার নামে। খুব শিগ্রি বিদেশীদের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারে খুলতে যাচ্ছেন মিনারেল ওয়াটারের প্ল্যান্ট। সেটাও নানার নামে। আমার যে তিনটি ভাইবোন মারা গেছে, তারা বেঁচে থাকলেও কোটি টাকার মালিক হতো সকলে। এখন সব আমার একার ঘরে। টাকা-পয়সা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে। বাবা বলেছেন সেদিকে কান না দিতে। আমি যেন বিলম্ব না করে পড়ালেখা শেষ করে ফেলি। হয়তো আগামি বছরের মধ্যে আমার বিয়ে দিয়ে ছাড়বেন। ইতিমধ্যে নয়টি মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। মা হাসতে হাসতে বললেন, দরকার হলে চিরুণী অভিযান চালাবো। কথাটির মানে আমি বুঝতে পারিনি। আমি শুধু বুঝি, তোমার খোঁপা এবং খোঁপার ফুল দেখে মা বলবেন, এই মেয়েকে মোটেও বউ করে আনা যাবে না। আগেই বলেছি মা বিয়ের পরেও তার বাবার বাড়িতে থেকেছেন। ছোট বেলার অনেক কথা তিনি ভুলে গেছেন। বড়দের কাছ থেকে শেখা অনেক আচার-আচরন এখন আর মানেন না। শুধু একটা কথা ছাড়া। মা তার দাদির কাছে শুনেছিল খোঁপা করে ঘুরে বেরানো মেয়েরা পর-পুরুষের নজর কাড়তে চায়। খোঁপার উপর ফুল বসানোতো সম্পূর্ন বেলেল্লাপানা! শরিয়তের নিষেধের মতো মায়ের মগজে কথাটি গেঁথে আছে। ছোটবেলার অনেক কিছুই ভুলে গেছেন তিনি, শুধু ভুলতে পারেননি তার দাদির মুখে শোনা খোঁপার বেদাতি কথা।
তোমাকে চিঠি লিখবার এটাই একমাত্র কারণ। ফারজানার কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে তবেই এই চিঠি লিখছি। সে বলেছে, চিঠিটি তোমার হাতে পৌঁছে দেবে। এর চেয়ে বেশি আর কিছু করতে পারবে না। তোমার রুমমেট, সে জন্য বলছি না। ফারজানা তোমাকে খুব ভাল জানে। তোমার জন্য তার অনেক মায়া। তোমার খোঁপা নিয়ে সে নাকি তিনটি কবিতা লিখেছে। তুমি যে শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে পছন্দ কর, সেটা ফারজানাই আমাকে বলেছে। তোমার দূর সম্পর্কের কোন এক মামা থাকেন জিগাতলায়। রোকেয়া হল থেকে তোমরা প্রায়ই নাকি তার বাসায় চলে যাও শিং মাছের ঝোল খেতে। তোমার বাবা গ্রাম থেকে তোমাকে দেখতে এলে তিনিও সেই বাড়িতেই এসে উঠেন। তিনিও নাকি শিং মাছের ঝোল নিয়ে আসেন তোমার জন্য। আর আনেন রসে ভেজানো চিতই পিঠা। সেটাও তোমার খুব পছন্দ। ফারজানা আরো বলেছে তোমরা খুব গরীব। তুমি যে সব শাড়ি পর সেগুলো সব তোমার নিজের শাড়ি না। বেশিরভাগ হয় বান্ধবীদের কাছ থেকে ধার করা, অথবা জিগতালার মামীর।
ফারজানার কাছে কথাগুলো শোনার পর সেদিনই রাস্তার এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে বললাম, শিং মাছের ঝোল আর রসে ভেজানো চিতই পিঠা দিতে। তের চৌদ্দ বছরের একটি ছেলে ছিল সেই হোটেলের বয়। ছেলেটি হেসে বললো, আপনার বাড়ি কি ফরিদপুর স্যার? এই ঢাকা শহরে খেজুরের গাছ কই? আর গরমের দিনে রস পাইবেন কেমনে? আপনি একা না স্যার, মাঝে-মধ্যে এমন আজব আবদার করে অনেক ছাত্র। দুইদিন আগে একজন স্যার আইসা কইলো, চালতা দিয়া ডাল রান্না থাকলে তাকে দিতে। আপনাগো মায়েরা আদর কইরা কত কি খাওয়াইছে। রাস্তার পাশে হোটেলে সেইগুলা কে রান্না করবো?
বলতে পারো ছোটখাটো একটা বক্তৃতা শুনে এলাম। তাও খারাপ লাগেনি। ছেলেটির কথায় অনেক যুক্তি আছে। আমি ওকে পছন্দ করে ফেলেছি। আবার হয়তো একদিন যাব ওর হোটেলে খাবার খেতে। হয়তো তুমিও সেদিন সাথে থাকবে। ফারজানাকে কথাগুলো বলতেই সে হেসে লুটোপুটি। আমি তখন গোলাপের মত লাল হয়ে গিয়েছিলাম। চোখ বুজলেই দেখি লাল গোলাপ। দেখি গোলাপ উঁচু করে ডাকছো আমাকে। স্বপ্নে বহুবার তোমার হাতখোঁপা খুলে দিয়েছি। জানি না তোমার পক্ষে কতোটুকু সম্ভব খোঁপা না করে বাইরে আসা। তুমি চুল খুলে দিলে আমার চোখে হয়তো বন্যা বয়ে যাবে। জগত তাকিয়ে দেখবে। মাও খুশি হবেন। খোঁপার বিরুদ্ধে তার একটি অঘোষিত যুদ্ধ আছে। খোঁপাই যদি না থাকে, তাহলে শত্রুমিত্র নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না তাকে। এই হলো আমার নিবেদন। এখন তুমি যা জানতে চাও লিখে পাঠাও। যা বলতে চাও তাও লিখে দিও। তোমার সাথে যেদিন প্রথম কথা বলবো সেদিনটি স্মরণীয় করে রাখতে আমি এক মন লাল গোলাপ কিনে পানিতে ভাসিয়ে দেবো। খুব দেরি করো না। সামনেই একটি শুভ দিন। মার্চের চার তারিখে আমার জন্মদিন। সেদিন যেন আমাদের প্রথম কথা হয়!
হুমায়ুনের চিঠির উওর দিতে বেশি দেরি করলো না মিলি। খুব উজ্জল একটি দিন ছিল সেদিন। নোনাধরা গরমের বদলে হাল্কা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল চারিপাশে। ফুলঝরি একটি অনুভূতি। সামান্য মেঘ থাকলে আকাশটা আরো ভাল লাগতো। ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল উপরের জগত। গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল হুমায়ুন। একটি সাদা খামের ভেতর মিলির চিঠি নিয়ে এল ফারজানা। চিঠিটা হাত দিয়েই বললো তার কাজ আছে। ফারজানা চলে গেলে মিলির চিঠি নিয়ে হুমায়ুন গাড়িতে গিয়ে বসলো। প্রথমে উলটে-পালটে দেখলো কতোক্ষন তারপর চিঠিটাকে পাশের সিটে রেখে গাড়ি স্টার্ট দিল। সোজা চলে এল আরিচার পথে। অতিরিক্ত স্পিডে চলছে গাড়ি। হাই ভলিউমে বাজছে বাউল আব্দুল করিমের গান। একবার চোখ সরিয়ে দেখে, সাদা খাম আবার চোখ রাখে হাইওয়ের দিকে। এভাবেই চলতে থাকে তার শহর ছেড়ে আসা। হুমায়ুন ধরেই নিয়েছে নতুন কেনা সাদা শাড়ি পরে মিলি বসে আছে তার পাশের সিটে। ওটাই মিলি। মিলির চিঠি না। তাই মাঝে মাঝে চিঠির সাথে দু’চারটা কথাও বলছে তাকিয়ে।
মানিকগঞ্জ পেরিয়ে এলে ছোট্ট একটা নদী। হয়তো নদী নয় তবুও নদীর মতই দেখতে। জায়গাটি হুমায়ুনের বেশ পছন্দ! একবার রাজশাহী থেকে ফেরার পথে এই জায়গাটাকে দেখেছিল সে। নদীটা বেশ বেঁকে গেছে এক জায়গাতে এসে। সেই বাঁক খাওয়া জায়গাতে একটি বটগাছ। মনে হয়ে একশো বছরের পুরানো। হুমায়ুন ঠিক করে রেখেছিল যেদিন সে খুব খুশি হবে, সেদিন এখানে এসে কিছুক্ষণ একা-একা বসে থাকবে। তাই আজ মিলির চিঠি নিয়ে এদিকে চলে আসা। হটাত তার ফুলের কথাও মনে পড়ে গেল। চিঠি খুললেই মিলি কথা বলবে। শব্দ হবে না তবে চোখও ফিরবে না সহজে। নীরব কথা আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির মতো। ডানা-ঝাপটা শোনা যায় না। দেখেতে গেলে পলকও পড়ে না। পথের মধ্যে তাই ফুল খুঁজতে লাগল হুমায়ুন। কপাল ভাল তার। হটাত দেখতে পেল একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে চাকা বদলাচ্ছে। হয়তো চাকা পাংচার। সেই ট্রাক বোঝাই ফুল! উত্তরবঙ্গের কোন ফুল ব্যবসায়ীর ট্রাক হবে। হুমায়ুন তার গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে যায় উল্টো দিকের ট্রাকের কাছে। ফুল নিয়ে কি সব প্রশ্ন করে সে। ট্রাক ড্রাইভার তার মোবাইল ফোনে কার সাথে যেন আলাপ করতে থাকে। ফোনের কানেকশন কেটে গেলে সে আবার নম্বর টিপে। এক সময় ড্রাইভারটি তার ফোন এগিয়ে দেয় হুমায়ুনের হাতে। হুমায়ুনও কথা বলে। কিছুটা দেন-দরবার হলো। তারপর কথা ফাইনাল। ড্রাইভার হুমায়ুনের পিছে পিছে তার ট্রাক নিয়ে যাবে সেই বটগাছের কাছে। সেখানে গিয়ে ট্রাকের ডালা খুলে সব ফুল গড়িয়ে দেবে নাম-না-জানা একটি নদীর পানিতে। টাকা-পয়সার হিসেবটা জানা হলো না। অনেকের কৌতুহল হল সে কথা জানবার। আজব সওদা দেখতে ভিড় জমে গেল মুহূর্তের ভেতর। ছেলে-বুড়ো সব বয়সের লোক। এরি মধ্যে ধর ধর চিতকার। একটি ছোট্ট শিশু আসছিল ফুলের জটলা দেখতে। তাকে একটা গাড়ি চাপা দিয়ে চলে গেল। গোলাপের পাপড়ির মত ছোপছোপ রক্তে লাল হয়ে গেল পিচঢালা পথ। ফুল ছেড়ে সকলে ছুটে গেল ছেলেটির কাছে। ট্রাক বোঝাই গোলাপের আকর্ষন ফিকে হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। প্রান আছে, না নেই তাই ভেবে সকলে দৌড়ে এল। ভিড় সরিয়ে ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল হুমায়ূন। মাথার উপর দিয়ে চাকা চলে গেছে। সে মাথা আর জোড়া লাগানো যাবে না। জোড়াতো দুরের কথা ওর মা বাবা এসে শেষ দেখা দেখতে পাবে না প্রিয় সন্তানের মুখ। মানুষের মুখটাই যে সব, কারো মৃত্যু নাহলে সে কথা বোঝা যায় না। এই ছেলেটি মারা যাবার পূর্বে নিশ্চয় হাসি হাসি একটা মুখ নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছিল। গোলাপ দেখলে কার মুখ উজ্জ্বল না হবে। কিন্তু ছেলেটির মুখের পূর্ব এবং পশ্চিম কিছু বোঝার উপায় নেই। স্থানীয় লোকদের সংখ্যা দেখতে দেখতে বেড়ে দ্বিগুন হল। ছেলেটির মা-বাবাও এলো। তারা আসতেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে আকাশ ভারী হয়ে উঠল। জনতার মধ্য থেকে কেউ লেগে গেল ট্রাফিক নিরাপত্তায়। কেউ দায়িত্ব নিল ছেলেটির অবশিষ্ট শরীরটুকু সরিয়ে আনতে। তখনো রক্তের রঙ টকটকে লাল। নাম না-জানা কেউ একজন সাদা কাপড় দিয়ে রক্ত ঢেকে দিল। পুলিশ এসে যাবে কিছুক্ষনের মধ্যে। তখন তাদের দেখানো হবে মৃতুর নিশানা। তারপর নিয়মবদ্ধ হবে ছেলেটির ভবিষ্যত।
হুমায়ুন ফিরে এল তার গাড়ির কাছে। এসে দেখে পাশের সিটে রাখা সাদা খামটি নেই। কেউ হয়তো ভেবেছিল এতো টাকা যার তার খামেও থাকবে কিছু পাঁচশো টাকার নোট! তন্ন তন্ন করে সে গাড়ির ভেতর বাইরে, এমনকি ছাদের উপরেও খোঁজে মিলির চিঠি। পেছনে গিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে দেখলো। তারপর মাটিতে হাঁটু গেড়ে খুঁজলো গাড়ির নিচে। মৃত ছেলেটির পাশ থেকে কিছু মানুষ হুমায়ুনের সাথে ফিরে এল তার গাড়ি পর্যন্ত। হুমায়ুন কি খুঁজছে অনেকে সেটা জানতে চাইল। কাউকে কিছু বললো না সে। তার খুব কান্না এল। তবে সে-কান্না কেউ দেখতে পেল না। তারা দেখলো হুমায়ুনের রক্তশুন্য মুখ। গাড়ির দরজা খুলে সে ভেতরে এসে বসে পড়ল। শতবার দেখা সত্ত্বেও পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে আবারো খুঁজলো মিলির চিঠি। মানব মিলির মতন যে-চিঠি তার সাথে এতোদূর এসেছিল!
গোলাপের গন্ধ ছড়িয়ে যেদিন তুমি এক হাত দূর দিয়ে হেঁটে গেলে, সেদিন চমকে উঠেছিলাম! একটাই মাত্র গোলাপ, তবুও মনে হয়েছিল তুমি বুঝি আস্ত বাগান সাথে করে হেঁটে বেড়াচ্ছ। না হলে এতো ঘ্রাণ এলো কোথেকে! অনেক কষ্ট করে তোমার খোঁজ পেয়েছি। যেদিন কথা হবে সেদিন বলবো কি করে পেলাম সে খোঁজ। এবার কাজের কথায় আসি। প্রতিদিন তুমি হাতখোঁপা করে আসো, সেজন্য তোমার পুরো চুল দেখা হয় না কখনো। মা বলেন, ছেলের বউএর চুল হবে ঘন কালো। যেন কোমরের ভাজ ছুঁয়ে যায়। একটা মাত্র ছেলের বউ, দেখেশুনে বেছে নিবেন তাতো হতেই পারে! তোমাকে দেখতে এসে হয়তো চুল নিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করবেন। তাই বলে তোমাকে বলবেন না হেঁটে দেখাতে। জিজ্ঞেস করবেন না তুমি গান জানো কিনা, অর্থাত তুমি বোবা কিনা। তিনি শুধু বাছবেন ঘন কালো কেশ। অথচ দেখ, খোঁপাতে আমার কত দুর্বলতা। আবার সেটা যদি হয় হাতখোঁপা। খোপার উপর বসিয়ে রাখা ফুলের কথা আগে কখনো ভাবিনি। ওভাবে ফুলের সৌন্দর্য বোঝার জ্ঞান ছিল না। না হলে ফুল নিয়েও ভাবতাম।
চিঠিটা অনেক বড় করার ইচ্ছে নেই। তবুও হয়তো কয়েক পাতা হয়ে যাবে। এবার ছেলেপক্ষের কথা শোন। আমাদের ছোট সংসারটা মায়ের হাতে বোনা কাঁথার মতোই নক্সী করা। আমার ঘরটার কথাই ধর। জানালা থেকে তিন হাত দূরে চেরি রঙের ইটালিয়ান বেডরুম সেট। তার সাথে মিল করে রেখেছেন পড়ার টেবিল। তিন পাটের কাঠের ক্লোজেট করেছেন বাথরুমটার ঢোকার মুখে। প্রথম পাট খুললে দেখবে লম্বা করে সাজানো নানান রঙের প্যান্ট। আমি জিন্স পরতে পছন্দ করি। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা না হলে জিন্স পরতাম না। বেঁটে ছেলেদের জিন্সে মানায় না। কথাটি আমার ছোটখালার মুখে শুনেছি। তার স্বামী অর্থাত আমার ছোটখালু বেশ বেঁটে। তিনি জিন্স পরলে ছোটখালা ভীষণ রেগে জান। শুধু জিন্সের প্যান্ট নিয়েই ঝগড়া করে তিন-চারদিন কথা বলা বন্ধ করে বসে থাকে তারা। ফিরে আসি আমার বেডরুমে। ক্লোজেটের মধ্যখানের দরজা খুললে দেখতে পাবে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো নামিদামি ব্রান্ডের সার্ট। কোনটার বয়সই ছয় মাসের বেশি নয়। অথচ আমার পছন্দ নীল রঙের পাঞ্জাবি। আছে গোটা দশেক। মা সেগুলো হ্যাঙ্গারে রাখতে দেন না। ক্লোজেটের শেষ অংশে ছিল মিশ্র জিনিসপত্র। যেমন আইপড, ক্যামেরা, খাতা-কলম ইত্যাদি। এখন সেখানে ভাঁজ করা শাড়ির বাহার। গেল বছর থেকে আজেবাজে জিনিস সরিয়ে সেখানে বউ-এর জন্য কেনা শাড়ি সাজিয়ে রেখেছেন মা। বাবার মতো আমিও প্রথম প্রথম ভাবতাম এটা তার পাগলামি। বউ নেই তার আবার শাড়ি। সে ভুল মা ভেঙে দিলেন। তিনি বললেন, ছেলের বিয়ে নিয়ে ভাববো আর বউকে নিয়ে ভাববো না সে কেমন কথা! বউ আমার যেমন হয় হোক। শাড়ি দেখে যেন তার যেমন তেমন ভাব চলে যায়। জাতীয় দিনগুলোতে পরবে সূতি শাড়ি। পার্টিতে ঝকমকে কালো। বউ এর খোলা চুল হেলে দুলে শাড়ির গায়ের খেলা করবে। শাড়ি হবে বউ এর খেলনা। চুল হবে তার চাবিকাঠি। দেখবি বউ এসে বলবে তোমার মায়ের পছন্দ আছে!
আর একটা কথা খুব জরুরী। আমাদের টাকা-পয়সার কোন অভাব নেই। শুনেছি কিছু শাড়ির দাম সত্তুর থেকে আশি হাজার টাকা। লাখ টাকার শাড়িও আছে বেশ কয়েকটা। বাবার কাছে টাকা চাইলে তিনি কোন প্রশ্ন করেন না। বাবা শুধু বলেন বিকেলে নিয়ে আসবেন। বিকেল হলে বাবা ব্রিফকেস খুলে টাকার বান্ডিল তুলে দেয় মায়ের হাতে। একটা সত্যি কথা বলি? বান্ডিল বান্ডিল টাকা ছাড়া আমাদের বাসায় অনেক দিন হলো কোন খুচরা টাকা দেখা যায় না। বাবার রিটায়ারমেন্টের অনেক দেরি। তারপরেও সরকারি চাকরি বলে কথা! একদিন না একদিনতো তিনি অবসরে যাবেন। তখন কি হবে। মা হয়তো সে কথা ভাবেন না, কিন্তু বাবা ভাবেন।
আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে পড়াতে চেয়েছিল বাবা। কানাডার এক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েও যাওয়া হলো না। মা বলেছিলেন, যদি চোখের সামনে থেকে চলে যাই তিনি গলায় দড়ি দিবেন। এই নিয়ে অনেক কথা হয়েছে বাড়িতে। অনেক ক্ষুদ্র মিটিং হয়েছে। মাঝে মাঝে আত্মীয়দের কেউ কেউ এসে তাতে যোগও দিয়েছে। ছোটখালা খালুতো থাকতেনই। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শেষমেষ মায়েরই জয় হলো। তবে বাবাও বিনা শর্তে ছেড়ে দিলেন না। তিনি বলেছিলেন ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার তার নাকি খুব শখ ছিল। সেই শখ পূরণ করতে পারেননি। তাই দেশে বসে পড়াশুনা করলে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে হবে। এই শর্তেই আমাকে দেশে থাকতে হচ্ছে।
বাবা বিয়ে করেছিলেন ছাত্র অবস্থায়। আমি জন্ম নিয়েছিলাম তার ছাত্র জীবনে। মা তখন থাকতেন রাজশাহীতে তার বাবার বাড়ি। বাবা আসতেন যেতেন। এরই মাঝে আমিও এসে গেলাম। বড় হলাম নানার বাড়ি। পড়ালেখার শুরু অবৈতনিক বিদ্যালয়ে। তারপর সরকারি হাই স্কুল। বাবা এই সরকারি চাকরিটা পেয়ে গেলে আমরা ঢাকায় চলে এলাম। সংসারটা স্থায়ী হলো। কলেজ থেকে পাশ করে গত বছর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম। বাবা ছাত্রজীবনে বিয়ে করেছিলেন বলে তার উন্নতি থেমে থাকেনি। তাই মা-বাবার দুজনেরই ধারনা, ছাত্রবয়সে বিয়ে করলে আমারও কোন অসুবিধা হবে না। বাবার অঢেল ব্যবসা আছে রাজশাহীতে। ব্যবসাগুলো সব নানার নামে। খুব শিগ্রি বিদেশীদের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারে খুলতে যাচ্ছেন মিনারেল ওয়াটারের প্ল্যান্ট। সেটাও নানার নামে। আমার যে তিনটি ভাইবোন মারা গেছে, তারা বেঁচে থাকলেও কোটি টাকার মালিক হতো সকলে। এখন সব আমার একার ঘরে। টাকা-পয়সা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে। বাবা বলেছেন সেদিকে কান না দিতে। আমি যেন বিলম্ব না করে পড়ালেখা শেষ করে ফেলি। হয়তো আগামি বছরের মধ্যে আমার বিয়ে দিয়ে ছাড়বেন। ইতিমধ্যে নয়টি মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। মা হাসতে হাসতে বললেন, দরকার হলে চিরুণী অভিযান চালাবো। কথাটির মানে আমি বুঝতে পারিনি। আমি শুধু বুঝি, তোমার খোঁপা এবং খোঁপার ফুল দেখে মা বলবেন, এই মেয়েকে মোটেও বউ করে আনা যাবে না। আগেই বলেছি মা বিয়ের পরেও তার বাবার বাড়িতে থেকেছেন। ছোট বেলার অনেক কথা তিনি ভুলে গেছেন। বড়দের কাছ থেকে শেখা অনেক আচার-আচরন এখন আর মানেন না। শুধু একটা কথা ছাড়া। মা তার দাদির কাছে শুনেছিল খোঁপা করে ঘুরে বেরানো মেয়েরা পর-পুরুষের নজর কাড়তে চায়। খোঁপার উপর ফুল বসানোতো সম্পূর্ন বেলেল্লাপানা! শরিয়তের নিষেধের মতো মায়ের মগজে কথাটি গেঁথে আছে। ছোটবেলার অনেক কিছুই ভুলে গেছেন তিনি, শুধু ভুলতে পারেননি তার দাদির মুখে শোনা খোঁপার বেদাতি কথা।
তোমাকে চিঠি লিখবার এটাই একমাত্র কারণ। ফারজানার কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে তবেই এই চিঠি লিখছি। সে বলেছে, চিঠিটি তোমার হাতে পৌঁছে দেবে। এর চেয়ে বেশি আর কিছু করতে পারবে না। তোমার রুমমেট, সে জন্য বলছি না। ফারজানা তোমাকে খুব ভাল জানে। তোমার জন্য তার অনেক মায়া। তোমার খোঁপা নিয়ে সে নাকি তিনটি কবিতা লিখেছে। তুমি যে শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে পছন্দ কর, সেটা ফারজানাই আমাকে বলেছে। তোমার দূর সম্পর্কের কোন এক মামা থাকেন জিগাতলায়। রোকেয়া হল থেকে তোমরা প্রায়ই নাকি তার বাসায় চলে যাও শিং মাছের ঝোল খেতে। তোমার বাবা গ্রাম থেকে তোমাকে দেখতে এলে তিনিও সেই বাড়িতেই এসে উঠেন। তিনিও নাকি শিং মাছের ঝোল নিয়ে আসেন তোমার জন্য। আর আনেন রসে ভেজানো চিতই পিঠা। সেটাও তোমার খুব পছন্দ। ফারজানা আরো বলেছে তোমরা খুব গরীব। তুমি যে সব শাড়ি পর সেগুলো সব তোমার নিজের শাড়ি না। বেশিরভাগ হয় বান্ধবীদের কাছ থেকে ধার করা, অথবা জিগতালার মামীর।
ফারজানার কাছে কথাগুলো শোনার পর সেদিনই রাস্তার এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে বললাম, শিং মাছের ঝোল আর রসে ভেজানো চিতই পিঠা দিতে। তের চৌদ্দ বছরের একটি ছেলে ছিল সেই হোটেলের বয়। ছেলেটি হেসে বললো, আপনার বাড়ি কি ফরিদপুর স্যার? এই ঢাকা শহরে খেজুরের গাছ কই? আর গরমের দিনে রস পাইবেন কেমনে? আপনি একা না স্যার, মাঝে-মধ্যে এমন আজব আবদার করে অনেক ছাত্র। দুইদিন আগে একজন স্যার আইসা কইলো, চালতা দিয়া ডাল রান্না থাকলে তাকে দিতে। আপনাগো মায়েরা আদর কইরা কত কি খাওয়াইছে। রাস্তার পাশে হোটেলে সেইগুলা কে রান্না করবো?
বলতে পারো ছোটখাটো একটা বক্তৃতা শুনে এলাম। তাও খারাপ লাগেনি। ছেলেটির কথায় অনেক যুক্তি আছে। আমি ওকে পছন্দ করে ফেলেছি। আবার হয়তো একদিন যাব ওর হোটেলে খাবার খেতে। হয়তো তুমিও সেদিন সাথে থাকবে। ফারজানাকে কথাগুলো বলতেই সে হেসে লুটোপুটি। আমি তখন গোলাপের মত লাল হয়ে গিয়েছিলাম। চোখ বুজলেই দেখি লাল গোলাপ। দেখি গোলাপ উঁচু করে ডাকছো আমাকে। স্বপ্নে বহুবার তোমার হাতখোঁপা খুলে দিয়েছি। জানি না তোমার পক্ষে কতোটুকু সম্ভব খোঁপা না করে বাইরে আসা। তুমি চুল খুলে দিলে আমার চোখে হয়তো বন্যা বয়ে যাবে। জগত তাকিয়ে দেখবে। মাও খুশি হবেন। খোঁপার বিরুদ্ধে তার একটি অঘোষিত যুদ্ধ আছে। খোঁপাই যদি না থাকে, তাহলে শত্রুমিত্র নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না তাকে। এই হলো আমার নিবেদন। এখন তুমি যা জানতে চাও লিখে পাঠাও। যা বলতে চাও তাও লিখে দিও। তোমার সাথে যেদিন প্রথম কথা বলবো সেদিনটি স্মরণীয় করে রাখতে আমি এক মন লাল গোলাপ কিনে পানিতে ভাসিয়ে দেবো। খুব দেরি করো না। সামনেই একটি শুভ দিন। মার্চের চার তারিখে আমার জন্মদিন। সেদিন যেন আমাদের প্রথম কথা হয়!
হুমায়ুনের চিঠির উওর দিতে বেশি দেরি করলো না মিলি। খুব উজ্জল একটি দিন ছিল সেদিন। নোনাধরা গরমের বদলে হাল্কা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল চারিপাশে। ফুলঝরি একটি অনুভূতি। সামান্য মেঘ থাকলে আকাশটা আরো ভাল লাগতো। ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল উপরের জগত। গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল হুমায়ুন। একটি সাদা খামের ভেতর মিলির চিঠি নিয়ে এল ফারজানা। চিঠিটা হাত দিয়েই বললো তার কাজ আছে। ফারজানা চলে গেলে মিলির চিঠি নিয়ে হুমায়ুন গাড়িতে গিয়ে বসলো। প্রথমে উলটে-পালটে দেখলো কতোক্ষন তারপর চিঠিটাকে পাশের সিটে রেখে গাড়ি স্টার্ট দিল। সোজা চলে এল আরিচার পথে। অতিরিক্ত স্পিডে চলছে গাড়ি। হাই ভলিউমে বাজছে বাউল আব্দুল করিমের গান। একবার চোখ সরিয়ে দেখে, সাদা খাম আবার চোখ রাখে হাইওয়ের দিকে। এভাবেই চলতে থাকে তার শহর ছেড়ে আসা। হুমায়ুন ধরেই নিয়েছে নতুন কেনা সাদা শাড়ি পরে মিলি বসে আছে তার পাশের সিটে। ওটাই মিলি। মিলির চিঠি না। তাই মাঝে মাঝে চিঠির সাথে দু’চারটা কথাও বলছে তাকিয়ে।
মানিকগঞ্জ পেরিয়ে এলে ছোট্ট একটা নদী। হয়তো নদী নয় তবুও নদীর মতই দেখতে। জায়গাটি হুমায়ুনের বেশ পছন্দ! একবার রাজশাহী থেকে ফেরার পথে এই জায়গাটাকে দেখেছিল সে। নদীটা বেশ বেঁকে গেছে এক জায়গাতে এসে। সেই বাঁক খাওয়া জায়গাতে একটি বটগাছ। মনে হয়ে একশো বছরের পুরানো। হুমায়ুন ঠিক করে রেখেছিল যেদিন সে খুব খুশি হবে, সেদিন এখানে এসে কিছুক্ষণ একা-একা বসে থাকবে। তাই আজ মিলির চিঠি নিয়ে এদিকে চলে আসা। হটাত তার ফুলের কথাও মনে পড়ে গেল। চিঠি খুললেই মিলি কথা বলবে। শব্দ হবে না তবে চোখও ফিরবে না সহজে। নীরব কথা আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির মতো। ডানা-ঝাপটা শোনা যায় না। দেখেতে গেলে পলকও পড়ে না। পথের মধ্যে তাই ফুল খুঁজতে লাগল হুমায়ুন। কপাল ভাল তার। হটাত দেখতে পেল একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে চাকা বদলাচ্ছে। হয়তো চাকা পাংচার। সেই ট্রাক বোঝাই ফুল! উত্তরবঙ্গের কোন ফুল ব্যবসায়ীর ট্রাক হবে। হুমায়ুন তার গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে যায় উল্টো দিকের ট্রাকের কাছে। ফুল নিয়ে কি সব প্রশ্ন করে সে। ট্রাক ড্রাইভার তার মোবাইল ফোনে কার সাথে যেন আলাপ করতে থাকে। ফোনের কানেকশন কেটে গেলে সে আবার নম্বর টিপে। এক সময় ড্রাইভারটি তার ফোন এগিয়ে দেয় হুমায়ুনের হাতে। হুমায়ুনও কথা বলে। কিছুটা দেন-দরবার হলো। তারপর কথা ফাইনাল। ড্রাইভার হুমায়ুনের পিছে পিছে তার ট্রাক নিয়ে যাবে সেই বটগাছের কাছে। সেখানে গিয়ে ট্রাকের ডালা খুলে সব ফুল গড়িয়ে দেবে নাম-না-জানা একটি নদীর পানিতে। টাকা-পয়সার হিসেবটা জানা হলো না। অনেকের কৌতুহল হল সে কথা জানবার। আজব সওদা দেখতে ভিড় জমে গেল মুহূর্তের ভেতর। ছেলে-বুড়ো সব বয়সের লোক। এরি মধ্যে ধর ধর চিতকার। একটি ছোট্ট শিশু আসছিল ফুলের জটলা দেখতে। তাকে একটা গাড়ি চাপা দিয়ে চলে গেল। গোলাপের পাপড়ির মত ছোপছোপ রক্তে লাল হয়ে গেল পিচঢালা পথ। ফুল ছেড়ে সকলে ছুটে গেল ছেলেটির কাছে। ট্রাক বোঝাই গোলাপের আকর্ষন ফিকে হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। প্রান আছে, না নেই তাই ভেবে সকলে দৌড়ে এল। ভিড় সরিয়ে ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল হুমায়ূন। মাথার উপর দিয়ে চাকা চলে গেছে। সে মাথা আর জোড়া লাগানো যাবে না। জোড়াতো দুরের কথা ওর মা বাবা এসে শেষ দেখা দেখতে পাবে না প্রিয় সন্তানের মুখ। মানুষের মুখটাই যে সব, কারো মৃত্যু নাহলে সে কথা বোঝা যায় না। এই ছেলেটি মারা যাবার পূর্বে নিশ্চয় হাসি হাসি একটা মুখ নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছিল। গোলাপ দেখলে কার মুখ উজ্জ্বল না হবে। কিন্তু ছেলেটির মুখের পূর্ব এবং পশ্চিম কিছু বোঝার উপায় নেই। স্থানীয় লোকদের সংখ্যা দেখতে দেখতে বেড়ে দ্বিগুন হল। ছেলেটির মা-বাবাও এলো। তারা আসতেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে আকাশ ভারী হয়ে উঠল। জনতার মধ্য থেকে কেউ লেগে গেল ট্রাফিক নিরাপত্তায়। কেউ দায়িত্ব নিল ছেলেটির অবশিষ্ট শরীরটুকু সরিয়ে আনতে। তখনো রক্তের রঙ টকটকে লাল। নাম না-জানা কেউ একজন সাদা কাপড় দিয়ে রক্ত ঢেকে দিল। পুলিশ এসে যাবে কিছুক্ষনের মধ্যে। তখন তাদের দেখানো হবে মৃতুর নিশানা। তারপর নিয়মবদ্ধ হবে ছেলেটির ভবিষ্যত।
হুমায়ুন ফিরে এল তার গাড়ির কাছে। এসে দেখে পাশের সিটে রাখা সাদা খামটি নেই। কেউ হয়তো ভেবেছিল এতো টাকা যার তার খামেও থাকবে কিছু পাঁচশো টাকার নোট! তন্ন তন্ন করে সে গাড়ির ভেতর বাইরে, এমনকি ছাদের উপরেও খোঁজে মিলির চিঠি। পেছনে গিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে দেখলো। তারপর মাটিতে হাঁটু গেড়ে খুঁজলো গাড়ির নিচে। মৃত ছেলেটির পাশ থেকে কিছু মানুষ হুমায়ুনের সাথে ফিরে এল তার গাড়ি পর্যন্ত। হুমায়ুন কি খুঁজছে অনেকে সেটা জানতে চাইল। কাউকে কিছু বললো না সে। তার খুব কান্না এল। তবে সে-কান্না কেউ দেখতে পেল না। তারা দেখলো হুমায়ুনের রক্তশুন্য মুখ। গাড়ির দরজা খুলে সে ভেতরে এসে বসে পড়ল। শতবার দেখা সত্ত্বেও পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে আবারো খুঁজলো মিলির চিঠি। মানব মিলির মতন যে-চিঠি তার সাথে এতোদূর এসেছিল!
* * * ..শাড়ীর আঁচলে রক্তে লেখা একদিন.. * * *
* * * ..শাড়ীর আঁচলে রক্তে লেখা একদিন.. * * *
০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ ভোর ৪:৩১
একটু ভুলের কারনে হাতের ধাক্কা লেগে কাঁচের গ্লাস পড়ে যেতেই ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল .... কিভাবে কি হলো ভাবতে ভাবতে আনমনে তুলতে গিয়ে কাঁচের খোঁচা লেগে হাত কেটে রক্তের ধারা টপ টপ করে পড়তে শুরু করলো .... ব্যান্ডেজ বাধলেও কেন যেন রক্ত এই বাধ মানতে চাইছিলো না ... চুইয়ে চুইয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল রক্তের ধারা ... সাদা ব্যান্ডেজ লাল হচ্ছিল আর সেই রক্তের মাঝেই যেন ফুটে উঠলো এক পুরানো স্মৃতির টাটকা অনুভব ....
বাঙ্গালী মেয়েদেরকে শাড়ি পরা দেখলে কেন জানি আগে থেকেই ভালো লাগতো, মনে হতো এটাতেই ওদের আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পায় ... মনের এ গোপন কথাটি আমার বান্দরনী দোস্তটা কোন এক ভাবে জেনে গিয়েছিল .... তাকে আমি কখনোই বলিনি এ কথা ... তার পরেও সে জানলো কিভাবে ? ..... যাই হোক একদিন সে করলো কি , রাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো -- কাল একটু সময় হবে ?
আমি বললাম -- কতক্ষন সময়? কি কাজ ?
সে বললো -- খুব জরুরী না, তোর সাথে একটু ঘুরতে ইচ্ছা করছে ... আসতে পারবি ?
আমি বললাম -- আচ্ছা ঠিকাছে, কিন্তু সন্ধ্যার পরে ছাড়া যে পারবো না ?
সে বললো -- অসুবিধা নাই, তুই এসে আমাকে নিয়ে যাস বাসা থেকে তাহলে আম্মু যেতে দিবে ...
আমি বললাম -- আচ্ছা তুই রেডী থাকিস, আমি কিন্তু বসবো না, তোকে নিয়েই আমি বের হয়ে যাবো ... ঠিকাছে ?
সে বললো -- ঠিকাছে আমি রেডী হয়েই থাকবো।
পরদিন সন্ধ্যায় ওদের বাসার সামনে এসে নিচে রিক্সা থেকে নামিনি, এমন সময় শুনি ৬ তলার উপর থেকে চিৎকার করে বান্দরনীটা বলছে -- তুই রিক্সা ছাড়িস না, আমি আসছি ...
একটু পরে দেখি বাসন্তী রং এর শাড়ী পড়ে রাজকন্যা নীচে হাজির .... সেদিন ওকে আসলেই খুব সুন্দর লাগছিল ... মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই সে আমাকে বকা দিয়ে বলে -- জানি তোর শাড়ী অনেক পছন্দের তাই বলে এমন হা করে তাকায়ে থাকবি নাকি ? চলেন রিক্সাওয়ালা ভাই ... আপনি আপনার মতো চলতে থাকেন আমরা কোথাও থামবো না ....
আমি জিজ্ঞেস করলাম -- কি হয়েছে, আজকে এত সাজুগুজু করে শাড়ী পরে রিক্সায় ঘোরার ম্যুড হলো যে ?
সে বললো -- এই শাড়ীটা নতুন কিনেছি, তোর শাড়ী অনেক পছন্দ না ? তাই ভাবলাম নতুন শাড়ী পরে তোর সাথে একটু ঘুরি ... কেমন হয়েছে শাড়ীটা ?
আমার আসলে শাড়ীটা এত ভালো লেগেছিল যে বলার মতো না ... কিন্তু ওর সামনে প্রকাশ না করার জন্যই বললাম -- কি একটা ঘোড়ার ডিমের কালারের শাড়ী কিনেছিস, এ তো বুড়ীরা পরে ... তুই কি বুড়ী নাকি ?
এ কথা শোনার পরেও সে একেবারেই রাগ না করে বললো -- তুই না আমাকে মাঝে মাঝে বুড়ি ডাকিস ? তাহলে তো ঠিকই আছে ... এটা আমার জন্যই বানানো হয়েছে ... তাই না?
আমি মনে মনে ভাবছি কিরে বাবা, কাহিনী কি ... আজকে এর ম্যুড এত্তো ভালো ক্যান রে বাবা ... আর সাথে সাথে ওকে বিভিন্ন কথার মাধ্যমে খোচা দিচ্ছিলাম ... কিন্তু কোন ক্রমেরই সে ঐ দিন রাগছিলো না বরং আমার কথা কানেই তুলছিলো না ... অথচ অন্যদিন এমন কোন কথা বলা তো দুরের কথা খোচা মারার কথা মনে আসার সাথে সাথে ওর ধমক খাওয়া লাগে ... আবার রিক্সাওয়ালাও আমাদের কথা শুনে মজা পাচ্ছিলো আর বারবার ঘুরে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল ... উনাকে বললাম -- ভাই পিছনে না তাকিয়ে একটু সাবধানে চালান ...
একসময় বলা নেই কওয়া নেই আকাশ ফেটে বৃষ্টি শুরু হলো ... আমি রিক্সার হুড তুলে দিতে চাইলাম কিন্তু তা সে তুলতে দিবে না ... আরে ! কি মুসকিল ... বলে নাকি তার বৃষ্টিতে ভেজার ম্যুড হয়েছে তার ...
আমি মনে মনে বলি -- আজকে এর মাথাটা পুরা গেছে !!!!
ঝম ঝম বৃষ্টিতে ৫০ মিটার সামনের কিছুই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিলো না , রাস্তায় কোথাও কোথাও হাটু পানি জমে গেছে .... হঠাৎ কোনো এক ঢাকনা খোলা ম্যানহোল পানি কারনে দেখা না যাওয়ায় আমাদের রিক্সার একটি চাকা এর মধ্যে পড়তেই কাত হয়ে পড়লো ... ওদিকে বান্দরনীর ম্যুড এতই ভালো ছিল যে সে ঠিকমতো ধরে বসতেই নাকি ভুলে গিয়েছিলো .... ফলাফল হিসেবে রিক্সা কাত হতেই সে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলো ... কোনক্রমে ওর নিচে পড়াটা বাচাতে গিয়ে শেষমেষ নিজেই পড়ে গিয়ে একটা রাম-ধাক্কা আর কিছুটা ঘষা খেলাম রাস্তার পাশের লোহার রেলিং এ ... তবে হাত দুটো সামনে দিয়ে ব্যালান্সটা ঠিক করে চুড়ান্ত পতনটা ঠেকালাম...
অন্ধকারে ঠিক বুঝিনি ব্যাথা পেয়েছি কিনা ...তবে, ওখান থেকে হেটে একটু সামনে আসতেই বাম হাতটা কেমন জানি চটচটে অনুভূত হচ্ছিলো, ভাবছিলাম বৃষ্টির পানি এমন আঠালো তো হয় না, এরপরে হাতটা উপরে তুলে তাকিয়ে দেখি টাটকা রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে আমার হাত ...
তাড়াতাড়ি পাশের একটি টং এর দোকান থেকে পানি নিয়ে হাত ধুয়ে ফেলছি আর দেখার চেষ্টা করছি কতটুকু কেটেছে .... এর মাঝেই হঠাৎ পাগলিটা এক টুকরা কাপড় এগিয়ে দিয়ে বললো -- আয় তো, তোর হাতটা বেধে দেই, রক্ত পড়া কমে যাবে ... এর পরে সামনে গিয়ে ফার্মেসী থেকে ব্যান্ডেজ করে নিস ...
কাপড়টা হাতে নিতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ... আমি বেখেয়ালে রক্ত ধুচ্ছিলাম আর সেই ফাকে পাগলীটা নিজের নতুন শাড়ীর আচল ছিড়ে ফেলেছে ... সেটা দিয়েই আমার হাত বাধতে বলছে ...
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো, বললাম -- তোর নতুন শাড়ী ....
সে বললো -- তোর হাতের রক্ত বন্ধ করাটা আমার কাছে এই শাড়ীর চেয়ে বেশী জরুরী ... যা করতে বলছি কর তো ... এটা তো তোর জন্যই কিনেছিলাম...
আমি অবাক হয়ে বললাম -- মানে ?
সে আমার হাত বাধতে বাধতে বললো -- মনে আছে কয়েকদিন আগে আমার সাথে তুই শপিং এ গিয়ে এই শাড়ীটা দেখে বলেছিলি খুব "সুন্দর শাড়ী" ... এ জন্যই কালকে গিয়ে শাড়িটা কিনে আজকে তোর সাথে বেড়াতে বের হলাম ...
বান্দরনী দোস্তটা আমার হাতে শাড়ীর আচলের ব্যান্ডেজ বাধা শেষ করে মধুমাখা হাসি দিয়ে বললো -- দেখ ! ... শাড়ীটা আমি তোর জন্য কিনেছিলাম ... আর এখন শাড়ীটা আমাদের দু-জনকেই কেমন সুন্দর করে পেচিয়ে রেখেছে ...
এর পরেও দেখি আমার হাতে রক্তের প্রবাহ ওর নতুন শাড়ীর আঁচলকে লাল করে দিচ্ছে ... এটা দেখতেই সে নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ঐ রক্ত মাখা হাত ধরেই হাটতে শুরু করলো একসাথে .... পাশাপাশি
একরত্তি চিঠি
একরত্তি চিঠি
২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৬। রাত ৯:৩৫
জানো, আমার মাঝে মাঝে খুব চিঠি পেতে ইচ্ছে হয়!যে চিঠি পাবার পর---অনেকক্ষন হাতে নিয়ে একমনে বসে থাকা হবে!
তারপর খুব যত্নে ব্যাগের ভেতর রেখে দেবো।সারাদিন ক্লাস আর টং-এর চায়ের কাপে আড্ডার ঝড় তোলার সময়ও মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেবো – সেই চিঠি!!!
একটা ঘরে ফেরার তাড়াও থাকবে…কখন পড়বো সেই চিঠি!!!!
আহহহহহহ…অপেক্ষা এত আকাংক্ষার-ও বুঝি হয়!!!!
কি থাকতে পারে সেই একরত্তি চিঠিতে???
মেঘ করলো,যা দেখে ঠিক চোখের কাজলের কথা মনে পড়ে যায় -'
কিংবা'কখন এক টুকরো
‘ছোট্ট এক ঢেউ কিভাবে কাগজের নৌকোটা ডুবিয়ে দিলো’…
‘আরে…সেদিন বৃষ্টিতে কি হলো সেতো বলাই হয়নি…পাড়ার ছেলেরা সেদিন ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলতে গিয়ে নিজেরাই পা পিছলে গোলপোস্টে ঢুকে বসে আছে…হাহ হা হা হা!!!!
নাহয় লিখলে দু’লাইনের একটা কবিতা---হোকনা সেটা অন্যকারো-কিন্তু তোমার মনে কথা ঠিক ঠিক বলে ফেললোঃ
‘পাহাড় ভালো বেসেছিলো মেঘকে’
বিশ্বাস করো মেঘটাও পাহাড়কে প্রচন্ড ভালোবাসে…
আমার ছুঁইয়ে দেখা চিঠি…না জানি কি আছে লেখা ওতে!!!
মেঘ করলো,যা দেখে ঠিক চোখের কাজলের কথা মনে পড়ে যায় -'
কিংবা'কখন এক টুকরো
‘ছোট্ট এক ঢেউ কিভাবে কাগজের নৌকোটা ডুবিয়ে দিলো’…
‘আরে…সেদিন বৃষ্টিতে কি হলো সেতো বলাই হয়নি…পাড়ার ছেলেরা সেদিন ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলতে গিয়ে নিজেরাই পা পিছলে গোলপোস্টে ঢুকে বসে আছে…হাহ হা হা হা!!!!
নাহয় লিখলে দু’লাইনের একটা কবিতা---হোকনা সেটা অন্যকারো-কিন্তু তোমার মনে কথা ঠিক ঠিক বলে ফেললোঃ
‘পাহাড় ভালো বেসেছিলো মেঘকে’
বিশ্বাস করো মেঘটাও পাহাড়কে প্রচন্ড ভালোবাসে…
আমার ছুঁইয়ে দেখা চিঠি…না জানি কি আছে লেখা ওতে!!!
উত্তর:-
***
তুমি ফোন করোনা
চিঠি লিখ।
কারন কাগজে তোমার গন্ধ পাই।
একরত্তি লেখাটা ভালো লাগলো।
*****
একটা চিঠি পাঠালাম, দূর আকাশের ঠিকানায়...
ডাকপিওন মেঘে মেঘে-চিঠি পৌঁছে যে যায়।"
আমার কিছু চিঠি লিখার বাকি।
কিছু শব্দেরা তাই ছন্নছাড়া।
কত্তদিন চিঠি লিখিনা! কাগজের উপর মুখ গুঁজে একমনে লিখে যাওয়া...ও কি! জল কিসের? চোখের সমুদ্র উলটে পড়া জলে কিছু শব্দ লেপ্টে যায়। সেই জলে স্নান করে চিঠি আরো শুদ্ধ হয়।
চিঠিরা ভিজতে জানে...ভেজাতে জানে।
চিঠি -পত্র - ইতিকথা....
চিঠি - পত্র - ইতিকথা
কিন্তু বেশ অনেকদিন আগে, যখন এস টিডি ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, ই-মেল ছিল না, তখন তো এই পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড-ই ছিল ভরসা। কোলিয়ারিতে চাকরি করা আমার অবিবাহিত বড়মামা নিয়ম করে একটা পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতেন প্রতি সপ্তাহে। নিয়মিত সবার খোঁজখবর রাখার জন্য এটাই ছিল তাঁর প্রধাণ যোগাযোগের মাধ্যম। মাঝে মাঝে সেই পোস্টকার্ডের পেছন দিকে কালো কালিতে আঁকা থাকত কোন স্কেচ- চিঠির সাথে উপরি পাওনা। বছরে দু'বার- নববর্ষে আর পুজোর পরে, আমি বসতাম ঠাকুমার সাথে, একতাড়া পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড নিয়ে। ঠাকুমা চিঠির বয়ান বলে যেতেন, আমি গোটা গোটা অক্ষরে লিখে যেতাম। চিঠি যেত কাছে-দূরে - হিলি, মালদা, শ্যামনগর, কল্যাণী, ভদ্রেশ্বর... সব চিঠির বয়ান প্রায় একই , শুধু সম্বোধনের নামগুলি পালটে যেত। "স্নেহের ভানু ও রেবা...", "স্নেহের পল্টু ও রিনা...", "স্নেহের রুবি ও সুরেন..." - যাঁদেরকে লেখা হত এইসব চিঠি, তাঁদের বেশিরভাগকেই আমি কোন দিন চোখে দেখিনি, বাবার পিসতুতো ভাই, বা মাসতুতো দিদি, এইরকম সব সম্পর্ক। কিন্তু আমি তাঁদের সবার নাম, ঠিকানা, ছেলেমেয়েদের নাম- সব জানতাম। চিঠি লিখে লিখে আর মাঝে মধ্যে পুরোনো অ্যালবামের ঝাপসা হয়ে যাওয়া সাদা-কালো ছবির মধ্যে দিয়েই তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন আত্মার আত্মীয়। শুভকাজে শুভেচ্ছা জানিয়েছি, শোকে শোকজ্ঞাপন করেছি। ঠাকুমার বকলমে সেই অদেখা মানুষগুলির সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে ছিলাম বহু বছর।
তাই বলে কি শুধুই বকলমে লিখতাম? কখনই না। নববর্ষ আর বিজয়ার চিঠি নিজের নামে লিখে গুরুজনদের পাঠিয়েছি। অসুখ হয়ে স্কুলে না যেতে পারলে ক্লাসের প্রিয় বন্ধুদের পাঠিয়েছি লম্বা চিঠি। সে চিঠির উত্তরে এসেছে আরো লম্বা চিঠি। এই চিঠিগুলি দেওয়া নেওয়া করত আমার প্রতিবেশী স্কুলের বন্ধুটি। হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে রুমমেটদের চিঠি লিখেছি। প্রেমে পড়ে চিঠি লিখেছি পাতার পর পাতা, কাগজ রঙিন হোক বা সাদা।
এখন লিখি ই-মেল। বড্ড কেজো, বেশিরভাগ সময়েই তথ্য আদান প্রদান করার কাজে ব্যবহার করা এক যোগাযোগ ব্যবস্থা। মাউসের এক ক্লিকে ই-মেল পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর যেকোন কোণে। উত্তর এসে যাচ্ছে হয়তবা কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই। বক্তব্যের আয়তন অনুযায়ী ইনল্যান্ড না পোস্টকার্ড বাছাই করতে হয়না, ফাউন্টেন পেন এ সুলেখা কালি ভরতে হয়না, ভুল হয়ে গেলে ঘিচিমিচি করে কাটতে হয় না। লিখতে হয়না অজানা শহরের চেনা ঠিকানা। বেশিরভাগ সময়েই চিঠির শুরুতে কোন সম্বোধন থাকে না। শেষে লেখা থাকেনা -'ইতি...'।
হারিয়ে গেছে অপেক্ষা । চিঠি লেখার, চিঠি পাওয়ার, চিঠি পড়ার, চিঠিকে অনুভব করার...বালিশের নিচে ই-মেল নিয়ে ঘুমানো যায় না।
এলোমেলো চিঠি
এলোমেলো চিঠি
মে ২৭, ২০১২ |
প্রিয় জয়ীতা,
এলোমেলো কেন বললাম?
আমার সব কিছুইতো এমনই। জোরকরে মেলানো যায়ন।
পশ্চিমের জানালা দিয়ে আলো এসে মসৃন মেঝেকে আরো উজ্বল করেছে। আর তার উপর কৃষ্ণচুড়ার দূর্বল ডাল গুলোর ছায়ার দুলুনীটা অদ্ভূত দেখাচ্ছে। প্রতিটা সকাল সত্যিই অনেক সুন্দর হয়ে আসে আমাদের জীবনে। যদিু অনেকে তা মানতে পারেনা। হয়তোবা মানতে চায়না। কিংবা এই না মানার বিপরীতে কোন অভিমান বা ভালোলাগা কাজ করতে পারে।
ধুর…… কি সব বক্ছি বলতো !! আমার মাথাটা না, একদম গেছে।
গতকাল রবিনদের বাড়ির পাশদিয়ে যাবার পথে তাদেও বাতাবিলেবু গাছে জোড়া-শালিক চোখে পড়ল। থমকে দাড়িয়ে মনোযোগ দিতেই, জোড়া উধাও।
ভাবলাম ঠিকইতো আছে। অন্যের বেলায় যাইহোক, অন্তত আমার জীবনে জোড়াশালিক দেখিয়ে সুখ আনাটা আম্ভবই বটে।
ছেলেমানুষি..?
হে…..মাঝেমাঝে করি। তবে লোকচক্ষুর আড়ালে। বিশেষ করে তোমার সেখানো গুলি। এইযে জোড়াশালিকের সুখ….!!!
আমার জানালায়…..দুটো কোউটোয় রাখা খাবার আর পানি, দিনের শেষে এখন একি রকম থেকে যায়। চড়ূই পাখি গুলো এখন আর আসেনা….!!! তবু প্রতিটি দিনের শুরুতে আমি নুতন করে কোউটো গুলো সাজিয়ে দেই। তাদের ফেরার আশাটাকে বাঁচিয়ে রাখি।
যাইহোক, এবার তোমার কথা বল।
পমি কি এখনো অপরিচিত কাউকে দেখলে তেড়ে আসে…?
কটা জমলো, নইল-পলিশের কোউটো…?
নিশঃপ্রাণ গন্ধরাজ ফুলের গাছটার কি হাল, প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছ…?
আর….টেবিল-ল্যাম্প এর সেই অলো-আধারীর খেলাটা…….কি, এখনো চলে…?
লিখবেনা জানি। তাই উত্তর গুলো বলছি, মিলিয়ে নিয়ো।
হ্যা, পমি এখনো অপরিচিত কাউকে দেখলে তেড়ে আসে।
নিয়মের খুবএকটা হেরফের না হলে, এখন পর্যন্ত নেইল-পলিশের কোউটোর সংখ্যা ১৩৩।
না, গন্ধরাজ ফুলের গাছটাতে এখনো প্রাণ ফেরেনি।
আর……টেবিল-ল্যাম্প এর সেই অলো-আধারীর খেলাটা, তুমি কখনোই ছাড়তে পারবেনা।
আজ এইটুকুই। এর চেয়ে বেশী তোমাকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছে না।
ভালো থেকো, অনেক অনেক ভালো।
ইতি………..
পুনশ্চ : পাশের বাড়ির আংকেল এখনো অনেক রাত করে ঘরে ফিরে আন্টির সাথে ঝগড়া করে। দিপা নিয়ম করে এখেনো তার প্রিয় গোলাপের গাছটাকে দিনে দুবার চায়ের লিকার খাওয়ায়। সোহেল ভাই আর সায়মা আপুর সম্পর্কটা এখনো টিকে আছে। পদ্মপুকুর পারের বৃদ্ধ আমগাছটার গায়ে লিখা তোমার আর আমার নামটা মুছে যায়নি জানি। শুধু…আমাদের মাঝখানটার দূরত্ব আর কতখানি বাড়লো তা ঠিক বলতে পারছিনা।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)