শুণ্য চেয়ার
(একটি দৃশ্যগল্প)
স্থান-এই শহরের একটি ছিমছাম গলি। একটি
দোতালা বাড়ির ঝুল বারান্দা। একটি কালো চেয়ার।
চরিত্র-
(একটি ছেলে) ছেলেটি-একটি পঁচিশ বছরের
ছেলে।
(একটি মেয়ে) মেয়েটি-একটি বাইশ বছরের
মেয়ে।
দৃশ্য এক –
শীতের অলস দুপুর।একটি ঝুল বারান্দায়
একটি কালো চেয়ার।একফালি তেছড়া রোদ
গায়ে মেখে ছেলেটি সেখানে বসে আছে। তার
হাতে একটি গিটার। কোলে উলটো করে
রাখা কবিতার বই। সে ভাবনায় বুদ হয়ে
তাকিয়ে আছে পাশের পথচলা গলিটার দিকে।
গলিটায় থেকে থেকে ফেরিওয়ালাগুলো
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে যাচ্ছে তার পাশাপাশি
কিছু মানুষের টুকরো টুকরো কথোপকথণ আর
আরো চলছে রিকশাওয়ালাগুলোর সরব
প্রতিযোগীতা। ছেলেটির হঠাৎ মনে হলো এই
সব কোলাহল আর তার ভাবনার ভোতা গুঞ্জন
ঠেলে একটুকরো কোমল নিরবতা যেন পায়ে
হেটে আসছে। সে আরো একটু ঝুকে দেখতে
লাগল মেয়েটির গায়ের কফি রঙের শীত
পোষাক,মাথায় হাল্কা করে টানা ঘোমটা,কাধের কালো ব্যাগ।
মেয়েটিও পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো দোতালাটির বারান্দাটিতে। প্রকট
চোখাচোখিতে ছেলেটিই প্রথম চোখ ফেরালো। তার মনে হলো এই মূহুর্তে তার সাথে
গ্রীলে ঝুলে থাকা বোগেনভিলিয়ারাও বুঝি সব পুড়ে খাক হয়ে গেছে ।
দৃশ্য দুই-
ফাগুন তার বাতাসে হৃদয়গুলোতে মিষ্টি
আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাতাসের বুক
চিড়ে একটা রিকশা যেন নৌকার তালে দাড়
টেনে আসছে।একটা সবুজ জামায় মেয়েটি
আজ কিছুটা অগোছালো।হাল্কা ব্যাগটাও যেন
কোলে পড়ে আছে অবহেলায়। রিকশাটা
আরো কাছে আসতেই আড়ষ্ট হতে থাকে ছেলেটি।
তবুও অবাধ্য চোখ বার বার চলে যেতে
চায়,দেখতে চায় একপলক । ভাবতে ভাবতেই
একজোড়া কালো কৌতুহলী চোখে থমকে গেল
তার কিছু মূহুর্ত। পাগলা বাতাসে
মেয়েটার ভেজা চুলও এলোমেলো হতে
চাইল,ছেলেটির এলোমেলো চুল আরো এলোমেলো হয়ে
গেল। রিকশাটা ছেলেটির একরাশ
ভালো লাগা বোঝাই করে ছুটে চলল দ্রুত।
দৃশ্য তিন -
সূর্য্য যেন তার পুরোটা উত্তাপ ঊপুর করে
দিচ্ছে। বারান্দার মেঝেতে পা ফেলা
যাচ্ছে না। তবু গরম ছাপিয়ে আজ পথের
মানুষগুলোর মুখে পহেলা বৈশাখের উপচে
পড়া আনন্দ। ছেলেটিও উত্তপ্ত চেয়ারে
বসে ঠায় চোখদুটো পথের ধুলোতে মিশিয়ে
দিতে চাইছে। অপেক্ষার গুনিতক গুনতে
গুনতে তার হৃদয় মরুভুমিতে বার বার
মরীচিকা খুজছে। তার তৃষ্ণার্ত চোখদুটোকে
আরাম দিয়ে দুর থেকে একটা লাল
বিন্দু আস্তে আস্তে বড় হতে থাকল। যেন
একটা যুগ অতিক্রম করল তা স্পষ্ট হতে।
হুড খোলা রিকশায় অন্য একটা মেয়ের সাথে
লাল শাড়িতে আসছে মেয়েটি। কিছুটা
উচ্ছল ভঙ্গীতে সাথের মেয়েটির সাথে সে
হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। চোখ ভরা
কাজল ছোট্ট লাল টিপ,কিছুটা লম্বা চুলের
মেয়েটিকে নিয়ে চলমান রিকশাটা একটি
দলছুট দখিন হাওয়ার মতোই ছেলেটিকে
প্রশান্তি দিয়ে যেতে লাগল। ছেলেটার
চোখে অপার মুগ্ধতা, আজ
সে লজ্জা পেতে ভুলে গেছে। ছেলেটির এমন দৃষ্টিতে মেয়েটিও যেন জমে
একটি পাথরের পরীর মত নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।
দৃশ্য চার-
ছেলেটির ইচ্ছে হচ্ছে বৃর্ষাকালকে তেড়ে
বিদেয় করে দিতে। সে বুঝতে পারছে না
বিধাতা কি মনে করে বর্ষাকাল পৃথিবীতে
দিয়েছেন আর তার কি উপকারিতেই বা
আছে। কেননা গত দু দিন সে বারান্দায় বসে
থেকেও মেয়েটিকে দেখতে পারেনি। হুড
উঠানো পলিথিনে ঢাকা রিকশাগুলোর ভেতরটা
বোঝা যায় না। আজ ও সেই নির্ধারিত
সময় বৃষ্টি পড়ছেতো পড়ছেই। তবু ছেলেটি
ছাতা মাথায় বসে আছে চেয়ারটায়।
পানির তোড়ে পুরোটাই ভিজে যাচ্ছে
সে।হঠাৎ বিরক্ত হয়ে ছাতাটা ছুড়ে ফেলে
দিল।অঝোর ধারার বৃষ্টির পানি বার বার
তার চোখ ঝাপসা করে দিচ্ছে। সে বার বার
চোখ মুছছে, ভিজতে
ভিজতে পথের দিকে তাকিয়ে আছে এক অসামান্য অপেক্ষায়।
দৃশ্য পাচ-
পৃথিবী এত সুন্দর কথাটা যেন আজই বুঝেছে
ছেলেটি। তার গীটারের সুর প্লাবনের
মত ছেয়ে ফেলছে আশপাশ। মন্ত্রমুগ্ধ
পথিকরা হাটার গতি শ্লথ করে দিচ্ছে
কিছুটা। শরতের নীল আকাশ ও যেন গালে হাত
রেখে কিছুটা ঝুকে এসেছে সুরের
মূর্ছনায় । আজ একটু আগে মেয়েটি তার দিকে
তাকিয়ে একটু হেসেছে। সেই হাসিই
যেন এখন চোখের তারায় বন্ধি করে সে চোখ
বুজে গাইছে,
“একটি অপেক্ষার ভুলই জীবন আমার
মাশুল দিবো কি?মরন আমার”?
দৃশ্য ছয়-
বৃষ্টি আর রোদ আজ পালা বদল করছে। ছেলেটি
যথারীতি একটু ঝুকে বসে আছে।
মেয়েটি আজ পায়ে হেটে আসছে। মাথার চুল
চুড় করে বাধা,ব্যাগটা কাধে না
নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরা। দুর
থেকেই সে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে।
ছেলেটি কিছুটা অবাক আর শিহরীত। কলজেটার
নাড়া চাড়া যেন মুঠিতে চেপে রেখে
সে তাকায় মেয়েটির চোখাচোখি। মেয়েটিও
তাকিয়ে বরাবর দৃষ্টিতে একটুও চোখ
নামিয়ে নিচ্ছে না কিন্তু সেখানে
মুগ্ধতা আর কৌতুহল নেই,যেন একটি তীক্ষ
প্রশ্ন আর অভিযোগ ছেলেটির বিরুদ্ধে।যেন
সে বলছে,”তুমি কি ভীতু না কাপুরুষ”
ছেলেটির এতদিনের খেলার বালিঘর যেন একটি
সশব্দ ঢেউ ভেঙ্গে দিয়ে গেলো।
অভিযুক্ত ছেলেটি প্রশ্নটা আর তার অপরাধ
বুঝতে পারল যেন।সে নিস্কম্মা জড়
পদার্থের মত নিরুত্তর চোখ নামিয়ে নিল।
দৃশ্য সাত-
হাল্কা একটা নিম্নচাপেই শীত ঝেকে বসেছে
আজ।। গায়ে বড় চাদরটা জড়িয়ে
ছেলেটা কাঠ হয়ে বসে আছে বারান্দায়।
তার পুরো চেহারা হতাশার আগাছায় ঢাকা।
গীটারটা ঘরের এক কোনে অবহেলায় পড়ে
আছে। কবিতার বইটা হাতে ভাজ বব্ধ করে
রাখা। অনেকদিন হয় মেয়েটি এই পথ দিয়ে
যায় না।সময় যেন আবার সেই ঘুন ধরা
পোকার মত ডেকে যাচ্ছে। তবুও সে এখন
চোখদুটো পাথর বানিয়ে পথে বসিয়ে দিতে
চাচ্ছে,
বুকে হাত দিয়ে বুঝতে চাচ্ছে শীতার্ত
ফাটা চৌচির হৃদয়টায় আশা আর
কতটুকু বাকি।
দৃশ্য আটঃ-
দামাল বাতাস বেহায়া বেলাজের মত আজ আবার
বারান্দা ছাপিয়ে যাচ্ছে। সেখানে
বসতে বেশ অসুস্থ বোধ করছে ছেলেটি।
বাতাসের রূপ নিয়ে কিছু সুন্দর মূহুর্তের স্মৃতি তাকে গলা টিপে
মেরে ফেলতে চেয়েও যেন মারছে না,তাড়িয়ে তাড়িয়ে কেবল কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি অস্থির হয়ে নিচে নেমে এসে সদর
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। একটু হাঁটবে বলে পা বাড়াতেই সামনে
তাকিয়ে আবার থমকে গেল সে।ঝাঁক ঝাঁক আলোর ভীমরূল যেন ছুটে আসছে তার দিকে।
রূপহীণ রাস্তাটাকে আলোয় বন্যায় ভাসিয়ে একটি নীল শাড়ি,খুচরো কিছু গয়নার
সোনালী চমক,চোখ ভরা কাজল ছেলেটার চোখ বহুদিন পর আবার ধাঁধিয়ে দিল। আলোর
বন্যায় ডুবে যেতে যেতে ভেসে উঠা চেতনায় বুঝল মেয়েটি এখন যুগল ছবি।
ঘোর ভাঙ্গল ছেলেটির।বাতাসের বিপরীত দিক থেকে আসায় রিকশাটার গতি এখন ধীর।
মেয়েটিও তাকে বিস্ময় নিয়ে দেখছে।মেয়েটার চোখ অনুসরণ করে ছেলেটা
নিজের পায়ের দিকে তাকালো এবার। ক্রাচে ভর দিয়ে আর এক পা এগিয়ে এলো
মেয়েটিকে দেখতে নয়,বরং নিজেকে ভালোকরে দেখাতে। তার চোখে
জমে উঠা পানিটা চিকচিক করার আগেই
রিকশাটা তালে পেছনে ফেলে চলে গেল।
ছেলেটি অপর দিকে ছুটে চলা রিকশাটা দেখতে
থাকলো যতক্ষণ দেখা যায়।।ঘাড় পর্যন্ত
এলোমেলো চুল,ধুসর টি-শার্ট,
দুটো ক্রাচ,অচল পায়ের পাজামার
বাতাসে উড়ন্ত ভঙ্গি যেন মানুষের অপারগতার চিরচেনা একটি বিষন্ন
স্থির চিত্র হয়ে রইলো।
শেষ দৃশ্যঃ
ঝুম বৃষ্টি। শুন্য বারান্দা,কালো লোহার চেয়ারটা
ভিজছে,তাতে ঝরে পড়ছে গন্ধহীন কিছু বোগেনভেলিয়া।
………………………………………………………………………………………………………।।