[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩

একজোড়া বৈশাখী চোখ....


একজোড়া বৈশাখী চোখ



ঘরের নোনাধরা দেয়ালটার মতো
আমিও পুরাতন হচ্ছি প্রতিনিয়ত
হয়তবা দূরের পাহাড়টার মতো
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে ।
এরই মাঝে আমাদের দেশ ভাবনা
অস্থিতিশীল অবস্থা ; হর সম্ভাবনা
ডান-বাম , সমাজ অথবা রাজনীতি
কখনো বুঝিনি ,বলি এখনো বুঝিনা ।
তারপরও, ঠিক যেন তোমার মতো
এই অবুঝ আমাকেই জড়িয়ে ফেলা ।

মাঝেমাঝে এক একটি বিচ্ছিন্ন স্মৃতি
আমার বয়েজ স্কুল ,সাদা স্কুল ড্রেস ,
ভীষণ তাড়াহুড়ো , রাস্তা পার হতেই
একটি সবুজ রঙের গার্লস স্কুল
বাস ,এক জোড়া চঞ্চল চোখ হঠাত্‍
যেন খুব এলোমেলো করে দিয়ে যায় ,
পহেলা বৈশাখে ,বৈশাখের এক মেলা
তালপাখার বেশ অবোধ্য আলপনা
বাঁশিয়ালার বাঁশির সুরও বুঝিনি ,
বিরক্তিকর অবান্তর মানুষ ভীড় ,
এরই মাঝে একজোড়া চঞ্চল চোখ
যেন খুব এলোমেলো করে দিয়ে যায় ।
কালবৈশাখী রূপে আজো এই আমাকে
যেন খুব এলোমেলো করে দিয়ে যায় ,
বৈশাখ মানেই কী শুধু কালবৈশাখী ?
প্রণয় মানেই কি ঐ একজোড়া চোখ ?


[একজোড়া বৈশাখী চোখ ... শৈবাল কায়েস । বেশ কিছু দিন শৈলীতে মেঘলা মেঘলা ভাব বৃষ্টির রিহার্সাল ... তাই চৈত্রের ১২তেই বৈশাখ কাল না আসতেই কালবৈশাখ নিয়ে ফিরলাম । কিছুটা পুরনোই এক বৈশাখের লিখা ।আমি ভাল আছি আশা করি সবাই ভালো আছেন ।

বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৩

মায়াবী গাংচিলের দেশে

মায়াবী গাংচিলের দেশে

আমার ছোট্ট ঘরের ছোটখাট জানালা দিয়া বড় আকাশ দেখা যায়। প্রতিদিন সেই ছোট্ট জানালার ফাক গলে সুযরশ্মির কিরন যখন চোখেমুখে লাগে তখনই আমার অঘোর ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। আমার এই ছোটখাট চোখ দিয়ে প্রতিদিন এই বড়সড় আকাশটা দেখি। আজ রোববার, তাই প্রাণ ভরে আকাশ দেখার দিন। করছিও তাই, মন ভরে আকাশ দেখছি। সাথে করছি আরেকটা কাজ। টিকেট কাটছি, দেশে যাবার টিকেট। কদিন যাবৎ সারা দিনই টিকেট দেখে বেড়াই। প্রবাসী মাত্রই জানেন এই মুহুর্তটা কতটা আনন্দময়, আর কতটা ভাল লাগার। কিন্তু টিকেটের দাম আকাশ ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ একদিন দেখলাম চাইনীজ এয়ারলাইন্স ১৪০০ ডলারে দেশের রিটার্ন টিকেট বিক্রি করছে।

চাইনীজ এয়ারলাইন্স সম্পর্কে একটু ধারনা দেই। “চাইনীজ এয়ারলাইন্স” আর “ঢাকা-গাজীপুর চৌরাস্তার” লোকাল বাস সার্ভিস একই জিনিস। চাইনীজ এয়ারলাইন্স শুধু আকাশপথে যায়, বাস যায় সড়কপথে – এই যা পার্থক্য। চাইনীজ এয়ারলাইন্সের বিমানআপুরাও অদ্ভুত কিসিমের। তাঁরা মাত্রাহীন পেইন দিয়ে বেড়ায়। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে জিনিসপত্র ফেরি করে বেচা বিক্রির চেষ্টা চালায়। এবং তার চেয়ে বড় কথা এদের কার হাসিতে দুই মার্কও দেওয়া যায় না। তবে সস্তায় যাচ্ছি বলে এসকল হাজার গুণা মাফ। তল্বি-তল্পা নিয়ে তাই যথাসময়ে এয়ারপোর্টে হাজির। চেক-ইন টেক-ইন শেষে যাত্রা হল শুরু।

আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে যাচ্ছে প্লেন। পাখির মত তাকিয়ে আছি নিচের দিকে। উপর থেকেও পাহাড় ঘেরা একটা আবছামতন দেখা যায় আটলান্টিক মহাসাগরের কিনারার দিকে। এক পাশে পাহাড়ের সারি অন্য পাশে নীল জলরাশির গভীর মহাসাগর। আর তখনই দেখলাম অনিন্দ্যসুন্দর একটি দৃশ্য। আমি আমার জীবনের সেরা সূর্যাস্তটা দেখলাম তখন। পাহাড়ের ধারঘেষা অনিন্দ্যসুন্দর জনবিচ্ছিন্ন একটি প্রান্তরে ঠিকরে পড়ছে সূর্যরশ্মি। আর সামনে আটলান্টিক মহাসাগরের গাঢ়নীল জলরাশি। ভেজা মেঘগুলো গলে প্লেন ভেসে যাচ্ছে নিস:ঙ্গ একটি সীগালের মত, যেন বাতাসে পড়ে আসা রোদের গন্ধ মুছে মুছে এগুচ্ছে সাদা গাংচিলটি। পেজা তুলোর মতন মেঘগুলোর উপর সুর্যরশ্মি হামলে পড়ছে অবিরত। কল্পনা করছি, একটি সাদা রঙের পঙ্খিরাজ ঘোড়া যেন মেঘের ডালি গলে বেরিয়ে আসছে সামনের দিকে। সূর্যাস্তের যে এতগুলা রং হতে পারে, আর সেটা যে এতটা সুন্দর হতে পারে, সেটা এই প্লেনের উপর থেকে সূর্যাস্ত না দেখলে হয়তো কোনদিনই বুঝতাম না। ছবি তোলে রাখার কথা চিন্তাও করলাম না। এই সীমাহীন সৌন্দর্য চোখে ধরে রাখতে হয়, ক্যামেরায় বন্দি করা যায় না।

শুরুতে টরোন্টো থেকে এয়ারকানাডার ফ্লাইট হচ্ছে ‘ঝিমধরা ফ্লাইট’। সব ভদ্র ভদ্র মানুষ, সাদা চামড়া! এরা কেন যেন, উঠেই ঝিম ধরে বসে থাকে, নড়চড় নাই। আমার মত বাদামী চামড়া শুধু এদিকওদিক তাকায়। আশেপাশে সুন্দরী খুঁজে বেড়ায় (বৌ শুনলে খবর আছে!)। একটু পরপর মুভিটুভি দেখে, গান-টান শোনে, শেষে কোন কায়দা করতে না পড়ে এরাও ঝিমিয়ে পড়ে। এয়ারকানাডাতে যতবার উঠেছি, ভ্রমনকে তাপহীন মনে হয়েছে।

তাপ তাহলে শুরু হয় কোথা থেকে? বলা যায় মধ্যপ্রাচ্যের বিমানবন্দরগুলো থেকে। মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে আসা এই ফ্লাইটগুলো মাঝে মাঝে মাছ বাজারের কাছাকাছি চলে যায়। বিমানের ভেতরটা সরগরম থাকে সবসময়। টয়লেটের কাছে সবসময়ের একটা ভিড় এই ফ্লাইটকে সারাক্ষন প্রাণবন্ত করে রাখে। বিমান-দিদিরা তাদেরকে সামলাতে সামলাতে হাপিয়ে উঠেন। বিমান-দিদিরা যন্ত্রণার উপর থাকে সারাক্ষন, আরা যারা তাদের যন্ত্রণার উপর রাখে, সে দলটাকে গোল হয়ে খোশগল্প করতে করতে লুকিয়ে এমনকি সিটের নিচে পানের পিক ফেলতে দেখা যায়! মেজরিটি সিটের গায়ে তাই পানের লাল দাগ দেখা যায়। বিমান-দিদিরা দেখে ফেললে তারা “চরি, চরি” বলে আবারও খোশগল্পে মেতে উঠে। একই বর্ণের হওয়াতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে দেখা হয়। কথা হয়। কথা হয়েছিল বিপ্লবের সাথে। বয়স- ২৬, বাড়ি- রাজশাহী। এলোমেলো উস্কখুস্ক চুল আর চোখগুলো ঘোলাটে।

গল্পের শুরুটা এমন। বিপ্লব নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা-মা আর বোনকে নিয়ে পরিবার। বাবা ছোট একটা দোকান চালায়, এতে সংসার চলে না। এলাকার অনেকের মত বিপ্লবেরও মধ্যপ্রাচ্যে আসার স্বপ্ন। পরিবারের আর্থিক অনটন দুর করতে হবে, বোনের বিয়ে দিতে হবে, নিজের সংসার গড়বে – এই ছিল তার লক্ষ্য। সাত লাখ টাকা দরকার, জোগাড় হয়েছে ছয় লাখ। ছেলের স্বপ্ন পূরণের জন্য মাও এগিয়ে এলেন অবশেষে। নিজের গয়না বিক্রি করে বাকি দুই লাখ জোগাড় করে দিলেন। ছেলে মধ্যপ্রাচ্য আসল, স্বপ্ন পূরণ হল। স্বপ্নের মধ্যপ্রাচ্য। কদিন পরেই বিপ্লব বুঝতে পারল, স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে অনেক ব্যবধান। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা অমানুষিক খাটুনি খেটে যা পায় তা দিয়ে দেশে পাঠানোর মত আর কিছূ অবশিষ্ট থাকে না। তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা। হঠাৎ দেশ থেকে খারাপ খবর এল। মায়ের পাকস্থলীতে টিউমার। প্রায় দুই লাখ টাকার দরকার। অল্পদিন হয়েছে মাত্র বিপ্লবের আসার। এখনও তার স্বল্প আয় থেকে কিছুই জমিয়ে তুলতে পারেনি। মনটা ছটপট করে উঠল বিপ্লবের। নিয়তি মাঝে মাঝে এতটা নিষ্ঠূর হতে পারে সে ভাবতে পারেনি। চেষ্টার ত্রুটি করেনি বিপ্লব। কিন্তু কোনভাবেই পারেনি। আর তার মাও বেশিদিন অপক্ষো করেননি। কদিন আগেই চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। সেই মায়ের লাশ দেখতেই দেশে যাচ্ছে সে। বিপ্লবের চোখে জল টলমল করে উঠল। সে চোখ তীক্ষ্ন করে বলল, যে মা তার জন্য বিপদের সময় গয়না বিক্রি করে দুই লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন, সেই মাকে সে দুই লাখ দিয়ে চিকিৎসাটা করাতে পারেনি। বিপ্লব আর কথা বলতে পারেনি, তার গলা আটকে গেল। তার চোখ দুটি ঝাপসা। প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরের মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। মেঘগুলোর উপর এখন আর সূর্যরশ্মি নাই। কোন আলো এখন আর ঠিকরে পড়ছে না। কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছে সবকিছু।

দীর্ঘ সাত ঘণ্টার যাত্রার পর, ট্রানজিটের জন্য প্লেন আটকালো। বিপ্লবকে দেখছি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখেমুখে অন্তরভেদী শুন্য দৃষ্টি নিয়ে যে মানুষগুলো ঘুরে বেড়ায়,এতো মানুষের ভিড়ে তাদের আলাদা করা যায় না। বাইরের ভদ্রসমাজের কেউ হয়তো বুঝতেই পারে না, এই স্বপ্নহারা মানুষগুলোর পা কতটা ভারী!
ল্যান্ডিং এর ঠিক আগের প্রস্তুতি শুরু করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কিছুক্ষন আগে। ফ্লাইটটি কিছুক্ষণ পড়ে ঢাকার আকাশে ঢুকবে। স্থানীয় সময়ে ভোর বলা যায়। সিটের সামনের স্ক্রিনে বিমানের গতি দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে বিমান একটু একটু করে নিচের দিকে নামছে। এখন গ্রাউন্ড স্পীড প্রায় দুইশর কাছাকাছি। অজস্র ভোরের নিয়ন আলোর কারনে দীপাবলির মায়াময় শহরের মত মনে হচ্ছে। বিপ্লবের অশুসজল চোখ আর ঢাকার ঘোলাটে আকাশ মিশে এখন একাকার। অল্প অল্প করে তার চোখ ভারী হয়ে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে যে শুন্য দৃষ্টি নিয়ে তারা এই ফ্লাইটে উঠেছিল, সেটা বদলে গিয়ে কি সেখানে স্বপ্নগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে?? চাপা একটা আনন্দ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। সবার চোখ বাইরের দিকে। নিচে মায়াভরা চোখে দেখছে মায়ের মত আপন দেশটাকে। এ মানুষগুলো হয়তো অনেক বছর ঝুম-ধরা বৃষ্টি দেখেনি। হেমন্তের শেষের দিকে শেফালী ফুলের যে গন্ধটা তাদের বাড়ির আঙিনায় ঘুরে ফিরে বেড়ায়, তারা সে গন্ধটাকে হয়তো অনেক বছর খুঁজে পায়নি, অনেকদিন হয়তো তারা জোনাকী পোকার ঝিকিমিকি আলোয় স্নান করেনি। দুর আকাশের তারা থেকে ভেসে আসা আলো আর চাঁদের আলো বাধ ভেঙ্গে জোৎস্নার অদ্ভুদ মিশেল হয়তো অনেকদিন স্পর্শ করেনি। বিপ্লবদের দলের যারা, ওরা অনেকেই ভূমধ্যসাগরের হিমশীতল পানি সাঁতরে ওপারে যেতে চেয়েছিল-একটা স্বপ্নের খোঁজে। তাঁরা কি জানতো এই ছোটখাট গরীব, মায়াবী দেশটা কতটা যত্ন নিয়ে আমাদের চোখে মুগ্ধতা এঁকে দিতে পারে? কতটা আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারে জানালা দিয়ে দেখা বড়সড় আকাশটির মত!

ভালবাসার জয়ন্তী!