বেঁচে
থাকা
আজ সন্ধ্যাটা খুবই অদ্ভুত। একদিকে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। ছোটখাটো আকদ অনুষ্ঠান। তাকে শুভেচ্ছা জানালাম।
আরেকদিকে
এক বাচ্চার জন্ম হল সেগুনবাগিচার বারডেম
হসপিটালে
যার মা আমাদের এক ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের মেয়ে, আমার
ইউনিভার্সিটির আপুর ছোট বোন
ও আমার বান্ধবী। মা ও বাচ্চাকে দেখতে গেলাম আমি আব্বু আম্মু। কেক খেলাম, ছবি তুললাম, বাবু কোলে নিয়ে সবার সাথে হাসি তামাশা করলাম। আসার
সময় বান্ধবীকে শুভেচ্ছা
জানালাম।
এরপর
গেলাম এক বাসায়। ইকোনোমিস্ট ও রবীন্দ্র
সঙ্গীতশিল্পী
আনিসুর রহমান এবং তার বউ আমাদের ফ্ল্যাটের নিচ তলায় থাকেন। থাকতেন। আঙ্কেলকে
বরাবরই খুব ভালো লাগে আমার, প্রায়
৮০ বছর বয়সী কারোর এত আধুনিক মানসিকতা
খুব
কম দেখেছি। উনাদের বাসায় কাজের লোক ছিলো না, সব
কাজ নিজেরা ভাগাভাগি করে করতেন।
বিকাল বেলা উনি মুখে মাস্ক লাগিয়ে আর একটা হাফ প্যান্ট পরে রমনা পার্কে হাঁটতে
যেতেন। সাদা লম্বা লম্বা চুলওয়ালা এত বয়সী একজন মানুষকে এভাবে হাঁটতে দেখে সবাই
তাকিয়ে থাকতো, উনি
পাত্তাই দিতেন না। তাঁর ওয়াইফ ডোরা আন্টির সাথে আমার সবচেয়ে জলজ্যান্ত মেমোরি প্রায় চার বছর আগে একদিন
বাসায় রান্না করা খাবার তাঁদের বাসায়
দিয়ে আসতে গিয়ে বিস্তর আলাপে মজে যাওয়া। তার কিছুদিন আগে আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো
জেনেভা ঘুরে আসার। আঙ্কেল আন্টি বহু বছর বাস করেছেন ঐ শহরে, সেও বহু বছর আগে। আমার কাছে শুনতে চাইলেন এখনকার জেনেভার কথা।
আঙ্কেলের এত চুপচাপ শহরে থাকতে ভালো
লাগেনা, আবার
আন্টির অমন চুপচাপ শহরই ভালো লাগে - কথা বলতে বলতে দুই জনের জীবনের
নানা কথা, নানা
চাওয়া পাওয়া, অনেক
না-পাওয়ার কথা বের হয়ে আসলো। দুই ছেলেমেয়ের
বিদেশে গিয়ে থিতু হওয়াটা তাদের জন্য একইসাথে আনন্দের এবং বিষাদের তাও আলাপ
থেকে বোঝা গেল।
ডোরা
আন্টি গত আড়াই বছর ধরে প্যারালাইজড। ডান দিক পুরোটা। বসে থাকতে পারেন, বাম হাত দিয়ে একটু একটু খাবার মুখে দিতে পারেন।
কথা বলতে পারেন
না। প্যারালাইজড হওয়ার পর এই বাসা ছেড়ে সেগুনবাগিচায়ই আন্টির পৈতৃক বাসাতে গিয়ে
উঠেছেন যেখানে তার ভাই এবং ভাবী থাকে। সেই বাসায়ই গেলাম আজ। আম্মু মাঝে মাঝে এখানে
গেলেও আমার যাওয়া আজই প্রথম। আম্মু গিয়ে তার পাশে বসতেই উনি কেঁদে দিলেন। আম্মুর
হাত নিয়ে নিজের গালে ঘষতে থাকলেন। আমাকে দেখে উনার এক্সপ্রেশন দেখে বুঝলাম চিনতে
পেরেছেন, কিন্তু
আমি পাশে গিয়ে বসার সাহস পেলাম না। উনাকে এভাবে দেখেই গলার মধ্যে
কি যেন আটকিয়ে যাচ্ছিলো। দূরে আরেকটা সোফায়ই বসে থাকলাম নির্বোধের মত। আম্মু
কথা বলল উনার সাথে, উনি
মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ না উত্তর দিতে থাকলেন। আমরা চলে আসার আগে আম্মু আমাকে বলল উনার পাশে বসতে। আমি অনেক
সাহস করে তার পাশে গিয়ে বসলাম। উনার
গায়ের উপর হাত রাখলাম, উনি
আমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি কোনো রকমে কান্না আঁটকিয়ে রাখলাম।
আমার
দাদা দাদী নানী কাউকে নিজের চোখে দেখারই সৌভাগ্য হয়নি। শেষ বয়সের মানুষকে খুব কাছে থেকে দেখিনি
বললেই চলে। জানিনা সেইজন্যই বোধ হয়
এত দুর্বল হয়ে গেলাম আজ উনাকে দেখে। কি ভয়ংকর একটা স্টেট অফ হেলথ! সব জানি, সব বুঝি, সব
মনে পড়ে, সব
অনুভব করি কিন্তু কিছু প্রকাশ করতে পারিনা, একটু
দুরের একটা বই
তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করতে পারিনা। বাথরুমে যাওয়ার জন্যেও অন্যের উপর নির্ভরশীল।
নিজের শরীরে বন্দি! তাদের প্রবাসী ছেলেমেয়েকে কি দোষ দেবো? তাদের কাছে এক্সপেক্ট করবো যে তারা নিজেদের এবং ছেলেমেয়েদের
উন্নত জীবন বাদ দিয়ে পোড়া দেশটায়
এসে withering বাবা মা
এর সেবা করবে? কোনটা 'উচিত' সেটা
কে কিভাবে define করবে?
একই
দিনে প্যারালালি ঘটে যাওয়া বিয়ে জন্ম এবং ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার সংস্পর্শে আসলাম।
খুবই অদ্ভুত লাগছে। মন খারাপ লাগছে।
জীবনকে pointless লাগছে।
একটু
পরেই আবার ঠিক হয়ে যাবো তাও জানি। এসবই ভুলে যাবো। আমরা কত এ্যক্টিভিস্টকে গালি দেই যে অমুক
ইস্যু নিয়ে এত লাফাইসিলা, এখন সব কই? ভুলে যাওয়া কি একটি survival technique না? ভুলে না গেলে বেঁচে থাকতাম কি করে?