[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১২

অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ

গল্প-(অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ)

অনুভব-পৃথিবীর সমান্তরাল একটি ভিন্ন জগৎ
(১)ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই জগৎ এ তপুর ইচ্ছানুযায়ি কিছুই ঘটে না তাই কংক্রিটের কঙ্কাল ঘেরা এই বৃষ্টির শহর তার কাছে শুধু আজ না সবসময়ই অনর্থক। আর শুধু এ কারণেই সে মৌরিকে অনুভব পর্যন্তই রাখতে চেয়েছিল”।

জীবনটা যদি বিজ্ঞাপনের মত হত!একটি বিশেষ টুথপেষ্ট আর নিরোগ শরীর,সবার মুখে চকচকে দাঁত শুদ্ধ হাসি, উচ্ছলতায় ভরপুর সকাল। একটি বিশেষ ইন্সট্যান্ট গুঁড়োদুধ শিশুরা সব দীর্ঘদেহী,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ….। একটি বিশেষ সীম কার্ড আর কৃষকের ফসল বিক্রির ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, তাদের গায়ের নতুন জামা,গ্রামগুলোতে শুধু মেলা আর আনন্দ,ভর-ভরান্ত গৃহস্থিতে পরবাসী স্বামীর বিরহী বধু। এক ফোটা কনডেন্সড মিল্ক হলেই সাদাকালো পৃথিবীর রঙ পালটে রঙ্গীন কিংবা একটি চায়ের ব্রান্ড মানে সতেজ দেহ,ধূমায়িত কাপ নিয়ে বৃষ্টি দেখা সুখী মনের মুখ।
কিন্তু জীবনতো আর এমন নয়!তাই তপুর হাতে ধূমায়িত এক কাপ চা থাকা স্বত্ত্বেও তার মুখ নিস্তেজ।সেও একটি বিশেষ ব্রান্ডের টূথপেষ্ট ও সীম কার্ড ব্যবহার করে কিন্তু তার চারপাশে আনন্দের কোন ঢেউ নেই। তপুর পরনে ফিকে হয়ে আসা সবুজ গেঞ্জি,একটি চেক ট্রাউজার,চোখে চশমা,মুখে দুইদিনের জমানো দাড়ি। তার চায়ের কাপেও বৃষ্টির ফোটা পড়ল আর সেও ও ঠিক বিজ্ঞাপনের মতই আকাশের দিকে তাকালো কিন্তু চোখে কোন মুগ্ধতা বা বিস্ময় নেই।
বৃষ্টির আগমনী হিসাবে আকাশ গুড় গুড় করে ডেকে ঘোষণা দিচ্ছে। এমন ডাকে মনে ভয় মিশ্রিত আনন্দ হয়,ময়ূর পাখা মেলে নাচে কিন্তু তপু তেমনি নির্বিকার। এবার বৃষ্টির একটি ফোঁটা তার চশমার কাঁচেও পড়ল আর তাতে দুনিয়ার তাবৎ চশমাওয়ালাদের মত সেও বিরক্ত হল। ঘোলা কাঁচ চোখে নিয়ে আর এখানে বসে থাকার সে কোন মানে খুঁজে না পেয়ে ছাদবারান্দা ছেড়ে ঘরে চলে এল।
শ্যামলির ছয়তলার এই মেসবাড়িতে তপু ছাদ লাগোয়া ইউনিটটির এই ঘরে আরো দুই জন রুমমেটের সাথে থাকে। ছাদের নিচে হওয়ায় প্রচন্ড গরম তাই অর্ধেকটা খোলা বারান্দা হলেও বাড়তি কোন আমেজ পাওয়া যায় না। আশেপাশে তেমন কোন গাছপালা নেই।কিছু নতুন দালান তপুর ছাদ ডিঙ্গিয়ে আরো উঁচুতে যাওয়ার ইচ্ছায় প্রতিদিন একটু একটু বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে যাওয়া বৃষ্টিতে এই সিমেন্ট রঙের কঙ্কালগুলো ভিজে চুপশে আরো ধুসর হয়ে আকাশের সাথে জোট বেধে গেল। তপু যেখানে বসে আছে সেখান থেকে ধুসর আকাশের পটভূমিতে দৃশ্যটা ওর মনের মতই ধুসরকালো দেখাচ্ছে।
নির্মাণ কাজ চলতে থাকা বামদিকের বহুতল বাড়িটার মিস্ত্রিগুলো ছাদ ছেড়ে নিচতলা গুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টি আসায় তারা মনে হয় খুশি হয়েছে। সবার মুখই হাসিহাসি। তপু বসে বসে কিছুক্ষুণ এদের খুশি মুখে চা খাওয়া দেখল তারপর তিন মাত্রার এই জগতের মাত্রা বাড়াতেই হয়ত তার পুরোনো পিসিটা চালু করল। ঘড়ঘড় শব্দ তুলে বার্ধক্য জানান দিতে দিতে সেটা চালু হলো। জন ডেনভারের “এনিস সং” গানটির অসাধারণ সুরের মূর্ছনায়, বৃদ্ধ পিসিটার সারা শরীরেও জ্বলজ্বল করছে এখন ধ্রুপদী রূপ।
পুরোনো সুরের এই ক্লাসিক গানটি তার ইদানিং খুব প্রিয় হলেও খুব কমই শুনে। কিছুদিন আগে তার করূন মুখ দেখে চারতলার মেসবাসিন্দা হিরন তাকে গানটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,

“এইটা টান ভালো লাগব”।
তপু কিছুটা বিরক্ত আর অবাক হয়ে বলেছিল,
“টানবো মানে এটা কি গাজা”!
“হা হা!তার চেয়েও মারাত্মক। কলিজায় বেশি লাগলে বন্ধ রাখবি। আবার কিছু কইরা বইস না”।
“সেড নাকি বেশি”।
“ইয়েস ম্যান”।
“নাহ! আমি নষ্টালজিক গান শুনি না”।
-“আরে ব্যাটা মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়। ডায়মন্ডস কাটস ডায়মন্ডস।বুচ্ছস।ওহ।আর একটা কথা,এক্সপেরিয়েন্স থেকে কইলাম,উৎকৃষ্ট সংগীত এইসব ব্যাপারে বিরাট ঔষধ তবে ভালো লাগলেই রিপলাই দিয়া রাখবি তাইলে শেষ। কয়দিন পর দেখবি টেষ্ট পাইতাছস না। গান কিন্তু আগের মতই আছে কিন্তু তর ব্রেইন এটার প্রতিটি ইন্সট্রুমেন্টের টুং টাং, প্রতিটা লাইনে তর ফিলিংস কপি করে ফেলছে বা ওভার রিভাইসড করে ফেলছে।ফিলিংস এর ক্ষেত্রে, যেটা ব্রেনে অলরেডি আছে সেটা আর ধরে না।বুচ্ছস।
“না”।
মানে হইলো সুন্দর বউ দেইক্ষা ঘরে আনলেই জীবন মধুময় হয় না আসলে রুপ বা গুন মুখস্থ হয়ে গেলে সেটাও আর ধরে না। ফ্লটিং এর মধ্যে থাকতে হবে আমাদের। অলয়েজ ভাসমান। হা হা।
হিরন গাজা খায়,এলাকার লিডারদের হয়ে চাঁদা তুলে।একসাথে ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স করলেও হিরনকে সবার মত সেও এড়িয়ে চলে। সবার মত সেও অস্বস্তিতে হিরনকে সেদিন তাড়াতাড়ি পাশ কাটাতে মিথ্যাসায় দিয়েছিল,যে সে বুঝতে পেরেছে। আর হিরনের প্রতি অবিশ্বাস থেকেই অনেকটা তাচ্ছিল্য নিয়েই গানটা শুনেছিল। কিন্তু প্রথমবার শুনতেই এমন ধাক্কা খেয়েছিল যে আর শোনার সাহস হয়নি কিছুদিন। শুধু মাঝে মাঝে গভীর রাতে, বৃষ্টি হলে, ছুটির দিনে, অলস দুপুরে কষ্টটা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়,যখন কষ্ট থেকেই তার মন তাকে আরো কষ্ট নেয়ার মত সাহসী করে তুলে তখনি শুনে।

আজ ও গানটা শুনতে শুনতে মৌরিকে মনে পড়ার মাত্রা একশোগুণ বেড়ে গেল তার। ঘন কালো মেঘের এমন দিনে মৌরি খুব কাছে আসতো। এই কাছে আসা অবশ্য পুরোটাই কাল্পনিক। অনলাইনে অনেকের মত তাদেরও একটা ছোট্রজগত ছিল। যেখানে কথা বলতে বলতে চাঁদের বুকে হাটা যেত, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোট্র নৌকা দাড় না টেনে দিগবিদিক ভাসিয়ে দেয়া যেত,বৃষ্টি হলে নগরের সব গাড়ি-ঘোড়া উধাও করে চকচকে মসৃন পিচঢালা রাস্তার বুকে দুজনে একছাতার নিচে দাঁড়ানো যেত। পাখি এই জগতটার একটা নামও দিয়েছিল,-“অনুভব”।
ইদানিং তপুর সেই জগতের দরজাটা বন্ধ থাকায় ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই তিন মাত্রার জগতেই তাকে থাকতে হচ্ছে সার্বক্ষকণিভাবে। ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এই জগতে তপুর ইচ্ছানুযায়ী কিছুই ঘটে না তাই কংক্রিটের কঙ্কাল ঘেরা এই বৃষ্টির শহর তার কাছে শুধু আজ না সবসময়ই অনর্থক। আর শুধু এ কারনেই সে মৌরীকে অনুভব পর্যন্তই রাখতে চেয়েছিল। পৃথিবী নামক জগতের জোগাড়যন্ত্রের গুণিতক এত বেশি আর অসম্ভব হয়ে ঊঠেছিলো যে সেখানে মৌরিকে বাস্তবে আশা করা করা তার কাছে পাপ বলেই মনে হত।
পৃথীবিতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাই সে মৌরিকে বলতে চাইত না। বলতে চাইত না তার মেসবাড়ির কথা,টানা টিওশনির কথা,গড় গড় করা বুড়ো পিসিটার কথা যেটা প্রায় মরি মরি করছে। কত কৌশল করে, কত কষ্ট করে সময় বাচিয়ে ব্যস্ততার দিনগুলোতে সে মৌরির সাথে চ্যাট করত সেই সব কথা। নিজেকে বড় বা ছোট করার জন্য নয় শুধু এই আড়াল ছিল অনুভবের আবেশ যাতে নষ্ট না হয়। যাতে অনুভব নামক এই জগতেও সমস্যার কথাগুলো কি বোর্ডে আঙ্গুল চেপে চেপে লেখা না হতে থাকে। কিন্তু এটাই মৌরি মানতে পারত না। সে তপুকে দুই জগতেই চাইত,রোদশুদ্ধ বৃষ্টির মত। আর এই অপূর্ণতার অভিমানে একদিন দরজাটা বন্ধ করে দিলো মৌরি, তা আজ তিন মাস হয়। এতদিন কষ্ট হলেও বেশ শক্ত ছিল সে। টাকা নামক বস্তুটা পকেটে,আর খাদ্য নামক দ্রব্যটা মুখে পুড়ার নির্লজ্জ ইচ্ছাটায় সে ভালোবাসাকে পেছনের বেঞ্চের বেয়ারা ছাত্র হিসাবেই দেখত।
এক মাস হয় তাকে অবাক করে দিয়ে তার ফুফাতো ভাই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে জুনিয়ার কেমিষ্ট হিসাবে তার চাকুরী ঠিক করে দেয়। বেতনটাও প্রথম প্রথম হিসাবে মোটা। এখন তাকে টিওশনি করতে হয় না,ক্লান্তির সাথে সময় নিয়ে দেন-দরবার করতে হয় না,লোকাল বাসের ছিট পাওয়া নিয়ে হাপিত্তেশ করতে হয় না। কিন্তু এই আর্থিক ও সময় স্বচ্ছলতার সুখ পাশাপাশি তাকে মানসিক স্বচ্ছলতার জন্য কাঙ্গাল করে তুলছে প্রতিদিন। জীবন নামক সর্বভূকের খেতে পেলে আরো ক্ষিদে বাড়ে। মানে টাকা আর সময়তো হল এবার তার ভালোবাসাটাও চাই। তবে দীর্ঘদিনের ছা পোষা জীবনে ভয়ের বীজটাইতো ডালাপালা মেলে এখন বৃক্ষ।ঘাড়ে চেপে থাকা এই ভয় নামক ভূতের পরামর্শে সে ইচ্ছেগুলো দমিয়ে রাখতে চায় প্রতিদিন। কিন্তু নিজের সাথে একলা হলে বিশেষ করে ছুটির দিনে তার ভীষণ কষ্ট হয়,কষ্ট থেকে তারও ইচ্ছে হয় সাহসী হতে, ইচ্ছে হয় ভয়এর বৃক্ষটা একেবারে উপড়ে ফেলতে।
আজও তেমনি একটি ছুটির দিন,রুম ফাকা। রুমমেট নাই তাই এয়ারফোন ছাড়াই গান চলছে। ডাইনিং এর ছেলেটি চা দিয়ে চলে গেছে একটু আগে। তপু তার ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গানটি শুনছে। তার কাছে মনে হচ্ছে গায়কের গলায় গাওয়া এটা কথামালা না,এক বুক কষ্ট। কি করুন সুরেই না সে প্রেমিকাকে ফিরে আসতে বলছে…
“You fill up my senses,
Like a night in a forest.
Like the mountains in springtime,
Like a walk in the rain.
Like a storm in the desert,
Like a sleepy blue ocean.
You fill up my senses,
Come fill me again”.

এতক্ষণ লক্ষ-লক্ষ, কোটি কোটি বা তার চেয়েও বেশি পানির ফোটায় শহরটা ঝাপসা হলেও দেখা যাচ্ছিল শুধু তার চোখে এক ফোঁটা পানি আসতেই ঝাপসা শহর পুরোটাই অদৃশ্য হয়ে গেল।
(২)“এই ছাদের পানিতে পা ডুবিয়ে সে কত কথা বলেছে তপুর সাথে,মেঘের সাথে ভেজা শরীরে আকাশের ঐ কোণায় কত উড়ে বেরিয়েছে সে! সেটা অবশ্য এই জগতের সমান্তরাল আরেকটি জগতে। যেখানে আকাশটাকে চাইলেই দু-তিনটা চাঁদ দিয়ে সাজানো যেত। যখন তখন সূর্যকে নিভিয়ে দেয়া যেত। সাদা সিফনের শাড়ী পড়ে বকুল জড়ানো যেত। শুনশান হাইওয়ের পাশে পাচিল ঘেড়া বাগান বাড়ি বানানো যেত,অন্ধকার সেই কাঠের বাড়িতে রাতভর গল্প করা যেত। ।এমন সুন্দর ভুবন অলীক হলেও তার অনুভুতিতে পুরোটাই সত্য ছিল।তা ইতো মৌরি জগতটার নাম দিয়েছিল -অনুভব”।
কয়দিন হয় বৃষ্টি হুটহাট আসা যাওয়া করছে। এমন রোদ-বিকেলে হঠাৎ আবার আকাশ ঘন কালো হয়ে গেল। এতক্ষণ মাঝখানে যা একটু নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিল তাও দ্রুতগামী কিছু মেঘের পাহাড় চট করে ঢেকে দিল।আঁধারের পিছু পিছু ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি যেন হাত ধরাধরি করেই এলো শহরে। বাইরে ঝড়ো হাওয়ার শো শো শব্দ ঘরের ভেতরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রটির মৃদু গোঙানী ছাপিয়ে কানে আসছে। বন্ধ জানালাটির পর্দা পুরোটা খুলে দিল মৌরি।চার বাই পাঁচ ফিট জানালার কাঁচে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বিন্দু বিন্দু জমা,তাদের আস্তে আস্তে ভারী হওয়া, একে অপরকে আকর্ষণ করে টপ টপ করে বেয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে দেখতে কখন তার মুগ্ধতা ভোতা হয়ে গেলো,কখন তাতে তপুর ভাবনা ভর করে পাখা মেলল সে টেরই পেলো না।
পাশের বাড়ির ছাদটিতে গরমের দিনে বৃষ্টি হলেই পানি নিষ্কাশনের নলটি কিছুদিন বন্ধ করে রাখে,। দু-তিন দিন ধরে বৃষ্টি আসায় এখন সেখানে প্রায় সাত-আট ইঞ্চি পানি জমে গেছে। সেখানে তাকিয়ে তপুর জন্য বুকের মধ্যে কেমন ছ্যাৎ করে উঠল মৌরির। এই ছাদের পানিতে পা ডুবিয়ে সে কত কথা বলেছে তপুর সাথে,মেঘের সাথে ভেজা শরীরে আকাশের ঐ কোণায় কত উড়ে বেরিয়েছে সে!
সেটা অবশ্য এই জগতের সমান্তরাল আরেকটি জগতে। যেখানে আকাশটাকে চাইলেই দু-তিনটা চাঁদ দিয়ে সাজানো যেত। যখন তখন সূর্যকে নিভিয়ে দেয়া যেত। সাদা সিফনের শাড়ী পড়ে বকুল জড়ানো যেত। শুনশান হাইওয়ের পাশে পাচিল ঘেড়া বাগান বাড়ী বানানো যেত, অন্ধকার সেই কাঠের বাড়িতে রাতভর গল্প করা যেত। এমন সুন্দর ভুবন অলীক হলেও অনুভুবে পুরোটাই সত্য। তাইতো মৌরী এর নাম দিয়েছিল “অনুভব”।

মৌরীর ভাবনায় এই দুই ভুবনের একটা যোগ ছিল। তার ইচ্ছা ছিল কখনো না কখনো দুই জগতের একটা সমন্ময় ঘটবে,সমম্বয় ঘটবে এই অনুভব আর সত্যের। কিন্তু কেন জানি তপু কথাটা শুনতেই পিছিয়ে যেত। তপু কোন অপারগতার কথা,কোন অযোগ্যতার কথা বলত না শুধু বলত “কি দরকার!এভাবেই ভালো আছি”। মৌরী শুধু শুনতে পেত তপুর অনিচ্ছা। আয়নায় দেখতে পেত তার গাল গড়ানো পানি। আস্তে আস্তে একদিন দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে সে কিংবা বন্ধ হয়ে গেছে নিজেই। এখন তপুর হাজার ডাকেও সেটা আর খুলে না সে।
বৃষ্টির থেমে গিয়ে রোদ ঊঁকি দেয়াতে সে ভাবনা থেকে কিছুটা ছিটকে এল। বড় বড় ফোটার ঝমেঝমে তাড়াহুড়ো বৃষ্টি ঝড়িয়ে, মেঘেরা আকাশ হতে পলাতক। নীল আকাশে কিছু দলছুট মেঘ শুধু ছেড়া তুলোর মত ভেসে আছে।

বৃষ্টিস্নাত বিকেল দেখতে মৌরি পেছন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ঝকঝক করছে প্রকৃতি এখন। আকাশটা যেন আরো নীল। সবকিছুতে সূর্য্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশের ছাদের জমে থাকা পানিতে রোদের বিকেলি প্রতিবিম্ব। বারান্দার কালো কালো গ্রীলগুলো চুইয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে,ঝুলন্ত পানির কনাগুলোও রোদের কিরণ লেগে হীরের মত জ্বলজ্বলে। মৌরি আঙ্গুল দিয়ে একটি হীরের টুকরো ছুয়ে দিল,সাথেসাথেই ভারী পানির বিন্দুটা মৌরির আঙ্গুল থেকে হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল।
পাখিরা কিচির-মিচির করতে করতে নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসছে। বারান্দার এক কোনে একটি চড়ুই বসে গা ঝাড়া দিচ্ছে,মৌরিকে দেখেও তার তেমন ভাবান্তর নেই। এখনো আশেপাশে সব বাসার কার্নিশ,ছাদ আর বারান্দার নলগুলো হতে পানি পড়ছে। বৃষ্টি চলে গেলেও শব্দের আবেশ এখনো বেশ জোড়ালো। টুপটাপ শব্দ আর সাদাটে হলুদ আলোর ছটায় চারপাশ ভীষণ মায়াবী লাগছে মৌরীর কাছে।কি সুন্দর!মৌরি নিজ মনে বলল।
হঠাৎ পেছন গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। অনেক ঝকঝকে সবুজ পাতা বেরিয়েছে তবে ফুলগুলো এখন আর জমকালো না। তাদের মধ্যে সন্নিবেশিত ভাবটাও আর নেই কেমন জানি ছাড়া ছাড়া আর রঙ্গটাও ম্লান। বৃষ্টির তোড়ে ফুলগুলো আরো ঝড়ে গেছে। রাস্তায় ঝরে পড়া ফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। বর্ষা ঝেকে আসলেই কৃষ্ণচূড়ারা শহর থেকে বিদায় নেয়।চাঁদের আলোয় এক বছর আবার কৃষ্ণচূড়া দেখা হবে না ভেবে আফসোস হল মৌরির।
হঠাৎ পেছনে মৌরির মা এসে দাঁড়িয়ে মেয়ের গায়ে হাত রাখেন। মৌরি চমকে ঊঠে,
-মা!
-হুম।ঘুমালি না।
-নাহ!তুমি কই যাও?
-মিতুলের কোচিং এ।আজ গারডিয়ানদের যেতে বলছে। ওকে নিয়ে একবারে বাজার করে আসব। আসতে সন্ধ্যা হবে। তুই কিছু খেয়ে নিস। আর সালমার মার দিকে খেয়াল রাখিস। নতুন বুচ্ছিস না?
-ঠীক আছে।
মৌরি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

মৌরির বাবা দেশের বাইরে থাকেন। মাঝে মাঝে নামে মাত্র দেশে আসেন। আর মা ব্যাংকে চাকুরী করেন। তিনি সপ্তাহ ভর চাকুরীতে ডুবে থাকেন আর টুকটাক ঝামেলায় ছুটির দিনেও ঘর-বাহির করেন। মৌরি তার মাকে চাকুরী ছেড়ে দিতে অনেক অনুরোধ করে কিন্তু তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,রাজি হন না। তার মতে,মানুষের সম্মান তার অর্থনৈ্তিক স্বাধীনতার সাথে জড়িত আর মৌরিও মাস্টার্স শেষ হতেই চাকুরীতে ঢুকে যাক এমনটাই তিনি চান।কিন্তু মার মত ঘোর প্যাচে জীবনটাকে ভাবতে চায় না সে। তার মতে অর্থের সাথে জীবনের যোগ থাকতেই পারে তার চেয়ে বড় যোগ ভালোবাসার।মৌরির কাছে জীবনের সংজ্ঞায় বিরাট অংশ ভালোবাসা আর ভালোবেসে মানিয়ে চলা।মায়ের শেখানো কাঠিন্য সে তাই কখনো রপ্ত করতে পারেন।
অতি সচেতন ইস্পাত ব্যক্তিত্ববোধ আর বদমেজাজের কারনে আজ শুধু মৌরির বাবা না,তার মায়ের আশেপাশে পুত্র-কন্যা ছাড়া আর কেউই নেই। মায়ের দমবন্ধ আনন্দহীন জীবনই তাকে স্বপ্ন আঁকতে শিখিয়েছে। তার ধারনা স্বপ্নগুলো যদি সে আঁকতে পারত তবে সে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সেরা চিত্রশিল্পীদের একজন হত।
মৌরি মার চলে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে আসে। দুপুরে অন করা পিসিটা স্ট্যান্ড বাই হয়ে আছে। সে পিসিটাকে স্ট্যান্ড বাই অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে অনলাইন নামক আকাশ রাজ্য ডুকে গেল। বেখায়ালি বিচরণ করে বেড়াতে থাকল এখানে-সেখানে। হঠাত অচেনা কারো মেইলের নটিফিকেশনে সে সচেতন হয়ে মেইলটা খুলে দেখে,আইডিটা অন্য কারো কিন্তু সাবজেক্টের জায়গায় লেখা,
Topu from the world onuvob
মেইলটার প্রেরকের নাম আবার যাচাই করে মৌরি। অচেনা নাম কিন্তু তপুর মেইল! তপুকে ব্লক করে রেখেছে তাই হয়তো অন্য আই ডি থেকে পাঠিয়েছে বুঝতে পেরে খুলবে না খুলেব না করেও খুলে ফেলে সে।

“come fill up my sense
Come fill m again.”
আমরা এই জগতেও আকাশে কি করে উড়ব? আমাদের পাখা নেই। তবে কি মৌরি আমাদের চার-পায়ে এক পা দু-পা করেই হাটব।
আমি তোমাকে ভয়াবহ রকম মিস করছি। তুমি ফিরে এসো,ভালোবাস আবার।–তপু”।

কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্দ বনে যায় মৌরি। নিশচল হয়ে যায় তার দেহ,সে দুহাতে তার মুখ ঢেকে ফেলে। আবেগরঙ্গা বৃষ্টির জন্য তার শরীর ও এবার কেঁপে কেঁপে উঠছে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেছে মৌরি বালিশে মুখ গুজে শুয়ে আছে। পিসিটা আবার স্ট্যান্ড বাইতে চলে গেছে,সে ঊঠে বন্ধ করে না,সন্ধ্যে নেমেছে তবু বাতি জ্বালায় না,কান্না ভেজা চোখে মুখে পানি দেয় না,মোবাইল বাজে তবু ধরে না,সালমার মা চা দিতে এসে ডেকে ডেকে ফিরে যায় মৌরি হু টাও করে না। আবেগে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে যেন তপুর সোহাগী অভিমানি বধু। বহুদিন পর তার মান ভাঙ্গার আগল অল্প অল্প করে খুলছে তাই প্রেমিকের ভালোবাসায় কিছুটা লজ্জিত,কিছুটা গর্বিত মুখ সে কাউকে দেখাতে চাচ্ছে না। মৌরি মনে মনে খুব জোরে জোরে ডাকে “তপু তপু তপু”। অনুভব নামক জগতে শব্দটা আলোর গতিতে লক্ষ লক্ষ মাইল ছুটে যায়।
(৩)
“ঈশ্বরের মত কুন বললে সেখানে সব হয়ে যায়।সেখানে জগতটা লেট দেয়ার বী লাইটের মতই সহজ। তপু আর মৌরীই সেখানে ঈশ্বর-ঈশ্বরী। ইশ!এমন একটা জগত যদি পৃথিবীটা হত”
“এক সাঈজ ছোট লাগবে মনে হয়”।
“আরে ভাই না। আপনার এক সাইজ বড়-ছোট হইলেই ফিট হবে না। ফিগার লাগে বুচ্ছেন। আপনার মত ফিগারে ভাই পাঞ্জাবি বানাইয়া পইড়েন। এইগুলা তো ফ্রি সাইজের”।
অনেকগুলো পাঞ্জাবি খুলে গায়ে দিয়ে মাপ দেয়ার পর দোকানের কম বয়সী ছেলেটি তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলল তপুকে। মালিক লোকটি হা হা করে ছুটে এলেন।
“আরে ব্যাটা ছাগল তুই কি বুঝস? ভাই আপনার পড়নের সার্টের সাইজ কত”?

কর্মচারি ছেলেটা ছাগল ডাকে খুশি হয়ে মালিককে দাঁত দেখায়। তপু বিষন্ন মুখে দেখায় সার্টের পেছনের ট্যাগ।
-“নাহ!সার্টের মাপ আর পাঞ্জাবীর মাপে তফাৎ আছে। তবে আপনিতো শুকনা মানুষ এর উপর লম্বা,ফিট ঠিকঠাক হবে না। হাতা ছোট হবে নাহয় শরীরে ফিট হবে। আবার হাতা ঠিক হলে লম্বা আর ঢিলা একটু বেশি হবে। এখন তো সব সর্ট পাঞ্জাবীর চল। অসুবিধা নাই একটু বড় ছোট পড়বেন এখন সবই স্টাইল। হা হা!”

লোকটি তার বিক্রি বাড়ানোর ধান্দায় বিভিন্ন দোকানি কথার সম্মোহন ছড়াতে থাকে আর তপু সম্মোহিত হবে না এমন ভাবতে ভাবতে দোকান থেকে বেরিয়ে বেশকিছুদুর চলে আসার পর কেবল আবিষ্কার করে, তার হাতে বড় সাইজের,মেরুন রঙের পাঞ্জাবীর একটি প্যাকেট। কিভাবে সে এটা কিনে ফেলেছে এখন কিছুই বুঝতে পারছে না। অথচ মৌরির প্রিয় রঙ কালো।
তার ইচ্ছে ছিল কালো রঙের পাঞ্জাবীই কিনবে। কিন্তু এতক্ষণ দোকনে দোকানে ঘুরে মনে হলো তার মাপের কালো পাঞ্জাবীর আকাল পড়েছে দেশে। একটা কিছু নতুন তাকে কিনতেই হত আর অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেয়ার সময় ও এখন নেই। ধুক পুক করা খুশি মনটা একটু দমে গেলো। এখন আর বদলাতে গিয়েও লাভ নেই। টাকা আর ফেরর দিবে না নিলে পন্য নিতে হবে।
তপুর কাছে মনে হচ্ছে এখন পর-পর বাকি ঘটনাগুলোই হতাশ করার মত ঘটবে। জুতোর দোকানে জুতো পাওয়া যাবে না,দেখা করার দিন হরতাল পড়ে যাবে,বা পাখি আসবে না বা আসলেও তাকে সামনা সামনি পছন্দ করবে না। বিদুৎ গতিতে সে বিয়োগাত্মক কিছু চিন্তা করে মনে মনে হয়রান হয়ে পড়ল। অফিস ছুটির ক্লান্ত শরীরেও যে জোড়টা ছিল এখন তা নিভু নিভু করছে।

মৌরির সাথে দেখা করার কথা একরকম হঠাৎ ই ঠিক হয়ে গেল। তাড়াহুড়াটা মৌরির দিক থেকেই ছিল তবে পাছে সে আবার ভুল বুঝে তাই আর দ্বিমত করে নি তপু। এখনো মাসের বেতন পায় নি সে। তবে ভাগ্যভালো যে, হিরন তাকে পুরো টাকাটা ধার দিয়েছিল।
হিরন ছাড়া টিওশনি করা,ছা পোষা চাকরী করা ছেলেগুলোর কারো কাছেই মাস শেষ না হলে টাকা থাকে না। তেমন কাছের বন্ধু না হওয়ায় ধারটা একটু কুন্ঠিত হয়েই চেয়েছিল সে। কিন্তু হিরন খুব স্বাভাবিক ভাব করেছিল,যেন সে জানতো। সে অভিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে নেড়ে বলেছিল,
“এই গানেই কাজ হবে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হইব ভাবি নাই। তোর সাহস বাড়ছে ঠিক ধরছি না?
-হুম।
হিরন তার মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে বলছিল,
-যখন টাকা হয় দিস। আরে ব্যাটা সাহসটাই সব,পকেটে টাকাটাই সব না। সাহস আছে তো তুই রাজা নাই তো ফকির। মানুষ কয় আমি গাঞ্জা খাই। আরে শালারপোরা তোগো সাহস আছে নি যে খাবি। শালা ননসেন্সের দল।

হিরন সমানে আরো কিছু বলে যাচ্ছিল। তপুর কানে আর কিছুই যাচ্ছিল না। টাকাগুলো গুনেই সে হিরনকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল আনন্দে। এক কান দু কান করে মেসের সবাই জেনে গিয়েছে তপুর কথা। যারা তপুকে তেমন পছন্দ করত না তাদের চোখেও স্নেহ, ঈর্ষা আর কৌতূহল দেখতে পেয়েছে এই কয়দিন। বেশির ভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা, মধ্যবিত্ত, জীবিকার সন্ধানে ছুটন্ত এই তরুনগুলোর কাছে চাকুরীর মত ভালোবসাও অধরা। ভালোবাসা কদর এই মেসবাড়িতে ছেলেগুলোর চোখে কতটুকু তা এই দুদিনেই তপু দেখতে পেয়েছে বেশ। এদের ভীরে লজ্জা আর খুশিতে একটু চনমনেই ছিল এই কয়দিন।
পাঞ্জাবীর প্যাকেটটি হাতে নিয়ে আজ হঠাৎ আবার বিষন্নতা তাকে পেয়ে বসলো। সে চিন্তিত মন নিয়ে জুতোর দোকানের দিকে ঢুকে পাঞ্জাবীর সাথে যায় এমন স্যান্ডেল খুজতে থাকল। পছন্দ অনুযায়ী গুলোর দাম অনেক বেশি।সে চলনসই একটা নিয়ে মনকে প্রবোধ দিল পাখি তো তাকে দেখবে, তার জুতো নয়। আর যাই হোক মেয়েটি কোন মতেই পন্যমুখী নয়। তবুও অনেক আকাঙ্গাখিত অপেক্ষার পর দেখা হবে,সবকিছু একটু সাজানোই ছিল কল্পনায়। তা একটু একটু যেন ভেস্তে যাচ্ছে দেখে তপুর আত্মবিশ্বাস আবার মাথা নোয়ালো।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে গেল। তাকে কিছু প্যাক্যাট শুদ্ধ দেখে নিচ-তলা থেকেই একজন দুজন করে পিছু নিল। ঘরে ঢুকে তপু দেখে তাকে ঘিরে রুমমেট সহ প্রায় দশ-বারো জনের একটি জটলা। এদের কেউ কেউ তার ক্লাসমেট, কেউ বন্ধুশ্রেনী। সবার সাথে তুই তোকারি সম্পর্ক। প্যাকেটদুটো পাশে রেখে তপু ক্লান্ত ভঙ্গীতে চোখবন্ধ করে লম্বা হয়ে শুলো।
চোখ বন্ধ করেই তিনতলার সোহানের জোর কন্ঠ শুনতে পেল সে,
-আরে দোস্ত তোর তো চান্নি কপাল। আয় তোর কপালে ঘসা দেই। চিকনা শইল্লেই নাইকা জুটায় ফেলছস? আমি ফিগার বানাইয়াও পারতাসি না। সবাই ফ্লেক্সি করতে কয় ভালোবাসে না!
সবাই হোহো করে হেসে উঠল। বন্ধ চোখে তপুও হাসার চেষ্টা করে, হাসিটা আসতে আসতেও কপালের চিন্তার রেখায় মিলিয়ে গেল। তার মনে পড়ল এগারোটায় মৌরীর নেটে থাকার কথা অথচ আজ কেউ সহজে ঘর ছাড়বে বলে তপুর মনে হচ্ছে না।
প্যাকেটগুলোর খোলার শব্দ হলো, কিছুক্ষন এটা সেটা মন্তব্য করে হাসাহাসি করে তারা একে একে আরো আরো যোগারের লিষ্ট শোনাতে লাগল। সে এবার চোখ মেলে ফ্যালফ্যালে তাকায় বন্দধুদের মুখে। পাশাপাশি অবসন্ন চিন্তায় কে কি বলছে তার মাথায় ঢুকছে না। শুধু শব্দগুলো কানে নিয়মমাফিক গিয়ে তার মনোযোগে নাড়া দিচ্ছে।
“হাতে টাকা রেখছিস?এই সময় টাকা রাখতে হয়”।
“সাথে কি নিয়ে যাবি মানে গিফট? ভালো কিছু নিয়ে যাস”।
“আরে না আজকাল চার-পাচ হাজার টাকা ছাড়া ভালো কিছু পাওয়া যায়? এত টাকা এখন ব্যবস্থা কিভাবে করবে তুই বরং ফুল নিয়ে যাইছ”।
“চুলটা ঠিকমত কেটে যাইস”।
“আরে না চুল আজ কাটিস নি কেন? চুল কাটলে প্রথমদিন খুব ই খারাপ দেখা যায়। মেয়েরা পছন্দ করে না”।
“তুই জানলি কেমনে তুই তো এই পর্যন্ত একটা মেয়েই যোগাড় করতে পারলি না হে হে”।
“অই শালা ফালতু কথা কবি না। আমি তো ছাগল না যে খুটি তে থাইক্কা ভে ভে করমু। আমার আইডিয়া আছে। ভালোবাসা পাই আর না পাই ডেটতো মারছি।
আবারো সম্মিলিত হাসি।

হঠাৎ হিরনকে ঘরে ঢুকতে দেখে সবাই একে একে তপুর কাছ ছাড়ে। তপুও উঠে দাঁড়ায়। হিরন তার জন্য এক প্যকেট কাচ্চি বিরিয়ানী নিয়ে এসেছে।এটা দেখে তপুর বেশ অসস্তি হয়। আডিক্টেড মানুষের স্নেহ যেমন বাড়তি থাকে,সময়ে তাদের ভুল বোঝার মাত্রাও বিরাট আকার ধারন করে আর এতে যে চরম ভোগান্তিই আনে এটা সে ভালো করেই জানে।প্যাকেটটা নিতে নিতে তার বলতে ইচ্ছে করে “কি দরকার ছিল। আমার খাবারতো দিয়েই গেছে ডাইনিং থেকে। সেটা শুধু শুধু নষ্ট হবে। এমন করে আর কিছু আনিস না”। কিন্তু সে এগুলোর কিছুই বলতে পারে না।
হিরন যেন বুঝতে পারে,মুখে কিছু বলে না। সে সিগারেটটা ঠোটে পিষে পিষে টান দিয়ে হাত উচু করে বিদায় জানায় আর ইশারায় বলে খেয়ে নিতে।
এই গরমে ফুলস্লিভ গেঞ্জি পড়ে আছে হিরন।পেছনে লেখা “মি মেড হিরো”।হিরনের চলে যাওয়া দেখতে কেন জানি খুব খারাপ লাগছে তপুর। আজ পেছন থেকে আসক্ত মানুষটিকে দেখতে পাচ্ছে না তপু,দেখছে ভালোবাসার কাঙ্গাল এতিম একটা ছেলে। কিছুবছর আগে যে কারো প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নিজের হাতের রগ কেটে ফেলেছিল। সে কোনরকম দৌড়ে গিয়ে হিরনের কাধে হাত রাখে,বলতে চায় “এত ভালোবাসা পেতে ভয় পাই রে।এমনকি মৌরির ভালোবাসাকেও”। কিন্তু এটাও বলতে পারে না সে।
হিরন এবারো কিছু না বলে একমুখ দাড়ি নিয়ে কবিদের মত হাসি দেয়। চোখ পিট পিট করে নাক-মুখ ভর্তি করে ধোয়া ছেড়ে আরো কষে টান দেয় সিগারেট।

কাপড় ছেড়ে খেতে খেতে চিন্তা নামক দৈত্যের কাছে বস হয়ে গেলো তপু। যোগাড়যন্ত্রের তালিকা বাড়ছেই। উপহারের কথাতো ভুলেই গিয়েছিল সে। আর এত টাকাওতো আর তার কাছে নেই। অথচ অনুভব জগতটা কত সহজ!মৌরির সাথে দেখা করতে হলে সেভ করতে হয় না,জুতো পর্যন্ত পড়তে হয় না,খালি পায়ে মৌরিকে নিয়ে পৃথিবী দাবড়ে বেড়ানো যায়। এক তোড়া ফুল কেন? কৃষ্ণচূড়ার পুরো একটা শহরই দেয়া যায়। জামা কাপড়ের রঙ সাইজ নিয়ে ভাবতে হয় না। ঈশ্বরের মত কুন বললে সেখানে সব হয়ে যায়।সেখানে জগতটা লেট দেয়ার বী লাইটের মতই সহজ। তপু আর মৌরীই সেখানে ঈশ্বর-ঈশ্বরী। ইশ!এমন একটা জগত যদি পৃথিবীটা হত!খাবারের নলা মুখে নিতে নিতে এমন অসম্ভব জগতের আকাঙ্খায় তপুর চোখদুটো জ্বলে উঠে।


(চলবে)...

গল্পটি একটু বড় বিধায় দুই পর্বে ভাগ করেছি।শুক্রবার শেষ পর্বটা পোষ্ট করব।
আর এনিস সং যারা শুনেন নি তাদের জন্য লিঙ্ক।

বহে সমান্তরাল

বহে সমান্তরাল


অবশেষে মনে হল সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সালমা বেগমের চোখে পানি আসল। মুখ আর বুকের থেকে কান্না শব্দ বের হতে আরম্ভ করলো। ছোট বোন পপিকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, লোকটা কি  ভাবে পারল এভাবে চলে যেতে। এখন আমাদের কি হবে। আগামী শুক্রবার শাম্মিকে দেখতে আসবে। ওকে বিয়ে দিতে না পারলে কেমন করে চলবে?
সালমা বেগমের স্বামী জুলমত আলি বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছে শারমনো  ক্লিনিকে। বাদ জুম্মা জানাজা, তার পর মাটি দিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। অবশ্য বেশির ভাগ মানুষ যে যার বাসায় চলে গেছে। স্বামীর মৃত্যুর খবরে সালমা একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিল। মুখ থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছিল না। উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে বড় জাম গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ছেলে মুন্না শেষ বারের মত চেষ্টা করলো, মা, বাবাকে এখন আমরা গোরস্তানে নিয়ে যাব। তুমি কি একটু বাবাকে দেখে বিদায় দেবে? তখন সালমা একইভাবে নির্বাক হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল; কোন ভাবান্তর হল না। জুলমতের বাড়ি থেকে শেষ বারের মত যাত্রা করলো। দু জনের চোখে চোখে কোন কথাই হল না। দু জোড়া চোখের এক জোড়া চোখ যদি বন্ধ থাকে, তা হলে কি আর কথা হয়?
চব্বিশ বছরের দাম্পত্য জীবন এই ভাবেই শেষ হল। প্রেম না দু পক্ষের বাবা-মা রা কথা বলে বিয়ে ঠিক করেছিল। কিন্তু বিয়ের পরে,  এক জন যেন আরেকজনকে সাথে একেবারে লেগে থাকত। একবারে বাধ্য না হলে, কেও কারোর চোখের বাইরে যেত না। মনে হত দু’
জনের জানা জানি যেন শত বছরের। তার পরেও জুলমত যখন সকালে কাজের জন্যে বাসার থেকে বের হওয়ার শেষ কদম দিত, তখন সে ঘুরে একবার তাকাবেই। সালমার সাথে চোখে চোখে কথা হবেই। চোখের ভাষায় জুলমত বলত, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব; আর সালমা বলত, আমি তোমার জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষায় থাকবো।
বৃহস্পতিবার বিকালে জুলমত অফিস থেকে এসে বলল, শরীরটা খারাপ লাগছে। একটু ডাক্তার দেখিয়ে আসি। সালমা খুবই অবাক হল। জুলমত আগে তো কখন শরীর খারাপ নিয়ে কমপ্লেন করে নি। সাথে যেতে খুব ইচ্ছে  হছিল। কিন্তু শাম্মি বাইরে গেছে, ওর জন্যে বাসায় থাকতে হবে। মুন্না বাসাতে ছিল। তাকে ডেকে বলল, তোর বাবার শরীর খারাপ করছে। বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যা।
পিঠাপিঠি ভাই বোন মুন্না-শাম্মি। শাম্মি বড়, মুন্না ছোট; বয়স উনিস কুড়ি। দু জনেই ইউনিভার্সিটি যায়। শাম্মি আবার সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস ফাইভের একটা ছেলেকে প্রাইভেট পড়ায়। আজকে সেখানেই গেছে। আসতে আসতে রাতের নয়টা বেজে যায়। বেশির ভাগ সময়েই মুন্না যেয়ে নিয়ে আসে। সালমা বলে দিয়েছে, মোবাইলে কল করে দিলে মুন্না যেয়ে নিয়ে আসবে। যদিও ছাত্রের বাসা পায়ে হাঁটার রাস্তায় দশ মিনিট। তার পরে সালমা কখনই রাজী হয় নি, শাম্মিকে একা রাতের বেলা হেঁটে বাসায় ফিরতে দিতে। মায়ের মন তো, সব সময় অজানা আশংকায় দুলতে থাকে। আজকে মাকে যেয়েই মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে।
পাড়ার ডাক্তার বুকের ব্যাথা আর আলামাত শুনে বলল, এখনই হাসপাতালে যান। হাসপাতালে জুলমত আর মুন্না যখন পৌঁছাল, তখন জুলমতের বুকের ব্যাথা চরমে। তার পরে হাসপাতালে ডাক্তার দেখতে আরও ঘণ্টা খানেক লাগাল। আসলে মুন্না আর জুলমতকে প্রমান করতে হল, তারা হাসপাতালের খরচ সব দিতে পারবে।
জুলমতের আয়ু এর পরে আর তিন ঘণ্টা ছিল। চোখ বন্ধ করেই ছিল। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে চোখ খুলে, বড় বড় চোখ করে মুন্নার দিকে তাকাল। তার পরে কি যেন একটা বলার চেষ্টা করলো। মুন্না শুধু একটা কথাই বুঝল,……তোর মা………। কথা শেষ হওয়ার আগে আবার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মুন্না দৌড়ে যেয়ে একজন নার্স ডেকে আনল। নার্স এসে জুলমতের হাত ধরে ঘোষণা দিল, রোগী মারা গেছে।

এমেরিকার খুব বড় একটা শহর হিউষ্টন। টেক্সাস ষ্টেটের বন্দর নগরী। সেখানকারই একটা ছোট পাড়া পার্ক ক্রীক। শ খানেক বাসা। বেশির ভাগ এক তালা। তবে কিছু দু তালা বাসাও আছে। মোটামুটি মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষরা থাকে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষেরা থাকে। সাদা, কালো, হিসপানিক, বাঙালি, ভারতীয়। এখানকার একজন বাসিন্দা, বব নিক্সন। বয়স কিছুটা বেশী অন্য প্রতিবেশীদের  তুলনায়। আসলে সে ই পার্ক ক্রীকের  একমাত্র মানুষ যে অবসরপ্রাপ্ত।
বব নিক্সন কিছুটা অদ্ভুত প্রকৃতির। একা একা থাকে। কেও তাকে কখন মেয়ে বন্ধুর নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে নি। একেবারেই হৈচৈ, হৈ হুল্লোর করে না। তবে সন্ধ্যার পরে একের পর বিয়ারের বোতল পান করে চলে।  গাড়ির শহর হিউষ্টন। তার একটা গাড়ি থাকলেও তাকে সপ্তাহে একবারের বেশী গাড়ি চালাতে দেখা যায় না।  প্রতি রোববার প্রায় পনের বছরের পুরনো একটা গাড়ি নিয়ে তাকে চার্চে যেতে দেখা যায়। পরনে থাকে কাল স্যুট, টাই আর কোটের উপরের পকেটে কাপড়ের লাল একটা ফুল।
বব সাইকেল চালায়। দু পায়ে প্যাডেল দেয়া সাইকেল। সকালের নাস্তা খেয়ে  বেড়িয়ে যায়। দুপুরে ফিরে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম। তার পরে আবার সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পরে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সব মিলিয়ে দিনে ছয়-সাত ঘণ্টা সাইকেল চালানো তো হয়েই যায়। কোন কোন দিন সাইকেল নিয়ে পাঁচ -ছয় মাইল পর্যন্ত দূরে চলে যায়। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কোন কিছু তাকে আটকে রাখতে পারে না। বাড়ি, মানুষ, আর কত না ঘটনার না স্বাক্ষী হয়ে থাকে প্রতিদিন বব নিক্সন। সাইকেল চালাতে চালাতে বব ওই গুলো দেখে। কখন যদি সুযোগ হয় এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। তবে, যান্ত্রিকতার দেশ এমেরিকায় নিজের হাতে অন্যকে সেবার সুযোগ দিনে দিনে কমে আসছে। ফোন উঠালে আর টাকা খরচ করলে,সব কিছুই হাতের কাছে চলে আসে মুহূর্তের মধ্যে। তা ছাড়া কেও কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। সব কিছুর মধ্যে স্বার্থ উদ্ধারের একটা গন্ধ খুঁজে পায়।
মানুষে বলা বলি করে, ববের সাইকেল চালানোটা একটা নেশা।
কিন্তু সাইকেল চালানোটা কি নেশা হতে পারে?

পার্ক ক্রীকের পাড়ার এক বাসায় শাম্মির শ্বশুর বাড়ি। বাড়ির মালিক মারা গেছে বেশ কিছু বছর আগে। তার স্ত্রী,  আর তার একমাত্র ছেলে খোকন সেখানে থাকে। খোকন হল শাম্মির স্বামী।  বাবা জুলমতের মৃত্যুর দুই সপ্তাহের মাথায় শাম্মির বিয়ে হয়।
বিয়েতে শাম্মির প্রবল আপত্তি ছিল।  কোন ক্রমেই বাবার মৃত্যুর চল্লিশ দিনের আগে বিয়ে করতে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু এমেরিকা প্রবাসী ছেলের মহা তাড়া। মেয়ে তার চোখে ধরেছে। সে দেশে এসেছে এক মাসের জন্যে। এর মধ্যে বিয়ের করে যেতে চায়। এর পরে আবার কবে দেশে আসতে পারবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই।  ছেলের মা এসে সালমা বেগমের সাথে কথা বলল।  বিয়ে এখন দিতেই হবে।  না হলে ছেলে দিওয়ানা হয়ে যাবে।
অদ্ভুত। যেই স্বামীকে একটু কিছুক্ষণ না দেখলে সালমা অস্থির হয়ে যেত। তার মৃত্যুর সাত দিনের মাথায় সে কঠিনভাবেই মেয়েকে বলল, তুমি এই ছেলেকে বিয়ে করে ফেলো।  এক বারো জানতে চাইল না, তার পছন্দ হয়েছে কিনা কিংবা এখন বিয়ে করতে চায় কিনা। শুধু কঠিনভাবেই জানালো, তোমার বাবা কিছু রেখে যায় নি। এখন কি ভাবে যে সংসার চালাবো। শাম্মির বুঝতে সময় লাগলো না, মা তাকে সংসারের একজন না ভেবে, বোঝা হিসাবে মনে করছে। মা বললে, সে তো আরেকটা টিউশানি নিতে পারে, কিংবা একটা চাকরি।
শেষ অস্ত্র হিসাবে, শাম্মি বলল, আমার পড়া লেখার কি হবে। আমার আগামী বছর বিএ  ফাইনাল পরীক্ষা। লাভ হল না, মা বলল, এমেরিকায় গেলে অনেক পড়ালেখা করতে পারবে।
দরজা বন্ধ করে শাম্মি অনেকক্ষণ কাঁদল। ঘরের মধ্যে ছিল শাম্মির গত তিন বছরের সাথী ধব ধবে সাদা পোষা বিড়াল। অনেক শখ করে নাম দিয়েছিল মিনি। শাম্মি যতক্ষণ বাসায় থাকে, ততক্ষণ ওর সাথেই লেগে থাকে।  মিনিও মনে হল, খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো শাম্মির দিকে। শাম্মিকে সে কখন কাঁদতে দেখে নি।  মিনি এসে শাম্মির একেবারে কাছে এসে বসল। শাম্মি অবুঝ এক পশুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। এক অবুঝ পশু তার জন্যে যতটুকু অনুভব করে, পৃথিবীতে আর কেও হয়তো তা করে না। যেই মানুষটা করত, সে মাত্র কয়েক দিন আগে না বলেই ওই পারে চলে গেল!

বব নিক্সন ভালবেসে বিয়ে করেছিল সামান্থা জোন্সকে। হাই স্কুলে তারা এক সাথে পড়তো। এমেরিকায় একে বলা হয় হাই স্কুল সুইট হার্ট। বয়সে তারা তখন একেবারে নবীন। মাত্র কলেজে পড়ছে। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিল বিয়ে করবে। এক সাথে থাকতে পারলে কত না আনন্দ। সারা দিন কত কিছুই না করা যায়।
বিয়ে করে যখন দু জনে চার্চ থেকে বের হচ্ছিল, তখন সামান্থা একটা লাল টকটকে কাপড়ের ফুল করে ববের কোটের পকেটের উপরে পিন দিয়ে লাগিয়ে দিল। মুখটা কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, সুইট হার্ট,  কথা দাও, তুমি যত দিন বেঁচে থাক আর যখনই স্যুট পড়, আমার এই ফুলটা এই জায়গায় লাগাবে। এমনকি যদি আমি মরে যাই কিংবা তুমি অন্য মেয়েকে বিয়েও কর। আমি এই ফুল নিজের হাতে বানিয়েছি। ফুল বানানো শেখার জন্যে আমি একটা ছয় মাসের কোর্সও করেছি। উদ্দেশ্য ছিল একটাই। তোমার জন্যে একটা ফুল বানিয়ে দেয়া , যা কখনো যাতে ঝরে না পড়ে। আজীবন টিকে থাকে। উত্তরে বব বলল, ডার্লিং ভেবো না। তুমি যেখানে আজ ফুলটা লাগিয়ে দিলে, সেই ফুল সেখানেই থাকবে। মনে রাখে বব একবার কথা দিলে, সেটা রাখে।
বিয়ের পরে এক সাথে থাকা গেল ঠিকই। কিন্তু বাস্তবতা এসে হাজির হল মুহূর্তের মধ্যেই। এপার্টমেন্ট ভাড়া, খাওয়া দাওয়া,  জামা কাপড় থেকে আরম্ভ করে সব কিছুর খরচ বেড়ে দ্বিগুনেরও বেশী হয়ে গেল। আগে সামান্থা মায়ের বাড়ি থাকত; কোন খরচ লাগতো না। বরং কিছু হাত খরচ পেত। বিয়ের পরে এগুলো সব বন্ধ হয়ে গেল। অন্য দিকে বব, দুই বন্ধুর সাথে এপার্টমেন্ট শেয়ার করে থাকত। সপ্তাহে ঘণ্টা বিশেকের পার্ট টাইম কাজ করে যা পেত, তা দিয়ে মোটামুটি চলে যেত। কলেজের খরচ সব সরকারী ঋণের থেকে দেয়া হত।
আনন্দের পুলক একেবারে ক্ষণস্থায়ী হল। মাস দু’কের মধ্যে সামান্থা পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে ফুল টাইম কাজ নিল। ববও তার কাজ বাড়িয়ে দিল। চোখে তখন তাদের স্বপ্ন।  বব পড়া লেখা শেষ করে অনেক টাকা বেতনের একটা চাকরি পাবে। সামান্থা আবার পড়ালেখায় ফিরে যাবে। তার পরে শুধু প্রাচুর্য, সুখ আর আনন্দ।
কিন্তু না জীবন স্বপ্নের সিঁড়ি ধরে উঠতে পারলো না। সংসার আর কাজের চাপে ববের পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগলো। পরীক্ষায় গ্রেড খারাপ হতে লাগলো। পর পর দু সেমিস্টারে ওয়ার্নিং পেল। শেষ রক্ষা হল না। তৃতীয় বারও যখন উন্নতি হল না, কলেজ থেকে তাকে বাদ দিয়ে দিল। ব্যাপারটা অনেকটা মরার উপর খাঁড়ার ঘা য়ের মত দাঁড়ালো। এমনিতেই টানাটানি, তার উপরে স্টুডেন্ট লোনের টাকা শোধ দিতে হবে। দু জনের একাবারে দিশেহারা অবস্থা হল।

শাম্মির এক খালাত বোন রিনি একই শহরে থাকে। কিন্তু কিছুটা দূরে। গাড়িতে যেতে প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যায়। শাম্মির এমেরিকায় আসার পরের দিন-ই দেখা করতে এসেছিল। অনেক দিন পরে দেখা। তাই অনেক হৈ চৈ  কথা বার্তা হল।  রিনি চলে যাবার পরে খোকন আসল। দু জনের দেখা হল না। শাম্মি খুব আহলাদ করে স্বামীকে বলল, রিনি আপু এসেছিল। আমার খালাত বোন। আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। কিন্তু একেবারে বন্ধুর মত। জানো ও গাড়ি চালায়। বলেছে শনিবারে এসে আমাকে মলে নিয়ে যাবে আর আমাকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিবে। কথাগুলো শুনলেও খোকন না শোনার একটা ভান করলো।
তার পরে খোকন গেল তার মায়ের ঘরে। সেখান থেকে যখন বের হল, তখন মুখটা একেবারে গম্ভীর। শাম্মি তো ভয়-ই পেয়ে গেল। ভাবল কি এমন হতে পারে। জানতে চাইলো, কি, কোন সমস্যা? খোকন আরো গম্ভীর হল, কোন উত্তর দিল না।  শুধু ঘুমাতে যাবার আগে, বেশ কঠিন ভাবেই শাম্মিকে বলল, আমি চাই না তোমার রিনি আপু এই বাসায় আর কখনো আসুক কিংবা তোমাকে ফোন করুক।
শাম্মি অবাক হল। ভীষণ অবাক হল। মনে হল স্বামী না, স্কুল মাস্টার কথা বলছে। এমেরিকায় থাকা এক জন লোক কি এ রকম করে কথা বলতে পারে? এখানে না সবার সমান অধিকার? তা হলে কি বাঙালি ছেলেদের জন্যে ব্যতিক্রম আছে? এখন বাংলাদেশেও স্বামীরা তাদের বউদের সাথে এমন করে কথা বলে না। বিয়ের আগে বলা হয়েছিল ছিল ইঞ্জিনীয়ার। তা হলে লোকটা দোকানে কাজ করতে যায় কেন?  কোন কারন ছাড়াই রিনির সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিচ্ছে।  লোকটার কি কোন দুর্বলতা আছে, যা বের হয়ে যাবে?  সারা রাত ঘুম আসলো না। একটার পর একটা চিন্তা মাথার মধ্যে আসতে থাকলো। ভোর রাতে একটু তন্দ্রার মত হল। কিন্তু একটু পরেই শাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাঙল। বেশ জোরেই বলছে, শাম্মি তোমার মা ফোন করেছে।
মা বুঝতে পারে নি, বাংলাদেশে যখন দিন তখন এমেরিকায় রাত। কথাটা শাম্মিই বলল; ভোর রাতে যাতে আর শাশুড়ির ঘুম, মায়ের ফোনের শব্দে না ভাঙ্গে। মা এ কেমন সে কেমন বলাবলি করার পরে বলল, মারে মিনি আজকে দুপুরে গাড়ির তলায় পড়ে মারা গেছে।

সালটা ১৯৭০। বব আর্মিতে যোগ দিল। রিক্রুটার বলল, আর্মি থেকে তিন বছর পর বেরিয়ে আসতে পারবে। তখন ত্রিশ হাজার ডলার আর পড়া লেখা শেষ করার জন্যে সব খরচ পাবে। তা ছাড়া বাকি জীবন চিকিৎসার জন্যে কোন খরচ লাগবে না। এ গুলো সব শোনার পরে, বব সামান্থাকে বলল, ডার্লিং মাত্র তিন বছর। তার পরে আমরা সব ধার দেনা শোধ করে দিতে পারব। আর্মি থেকে বের হয়ে, কোন একটা ছোট শহরে যেয়ে নতুন করে সংসার আরম্ভ করবো।  তা ছাড়া আর্মিতে জয়েন্ট করে ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে না গেলে, আমাকে ধরে এমনিতেই জেলে ডুকিয়ে দেবে।
বব, সামান্থাকে মায়ের সাথে থাকার ব্যাবস্থা করে দিল। বলল, মাসে মাসে তোমার খরচ আমি ই পাঠিয়ে দিব। তুমি কোন ভেবো না।  মা একাই থাকত। মেয়ে সাথে থাকবে, খরচ ভাগাভাগি করবে শুনে খুব খুশী হল। সামান্থার বাবা যখন অন্য একটা মেয়ের হাত ধরে চলে যায়, তখন তার বয়স পাঁচ। সামান্থার মা এর পরে আরেকটা বিয়ে করেছিল। প্রায় বছর তিনেক আগে সেই ভদ্রলোকও মারা গেছে।
সামান্থা বিয়ে করে বাসা থেকে চলে যাওয়াতে, তার মার এক ধরনের ভালই লেগেছিল। যাই হোক কিছুটা হলেও খরচ তো কমল। খাওয়া দাওয়ার জন্যে খরচ কমবে, হাত খরচ দিতে হবে না; ভালই তো।
ভিয়েতনামে যাবার দিন এয়ারপোর্টে বব সামান্থাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি ফিরে আসলে আমাকে কিন্তু একটা বাচ্চা গিফট দিতে হবে। ছেলে হোক মেয়ে হোক, আই ডোন্ট কেয়ার। তবে আমার মত দেখতে হওয়া চাই।  সামান্থা ববের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তুমি ফিরে আস। তোমাকে আমি খুব বড় একটা সারপ্রাইস দিব। বব পকেট সামান্থার দেয়া কাপড়ের লাল ফুলটা দেখিয়ে বলল, এইটা সব সময় আমার সাথেই থাকবে।
সামান্থা ববের থেকে গোপন করলো, তার পেটে ববের বাচ্চা বড় হচ্ছে।

শাম্মিকে এখন রান্না করতে হয়। আগে সখ করে এটা সেটা রান্না করলেও, প্রতিদিন ভাত ডাল, মাছ, মাংস কখন রাধে নি। একদিন শাশুরি ঘোষণা দিল, তার পক্ষে রান্না করে বাড়ির বউকে খাওয়ান সম্ভব না। শাম্মিকে হাল ধরতে হল রান্না-বান্নার। প্রায় প্রতি রাতেই দেখতে হত, খোকনের কাল মুখ আর বিভিন্ন ধরনের টিপ্পনি। রাঁধতেও শিখনি। দেশে কি সেজে গুজে প্রেম করে বেড়াতে?
এর মধ্যে শাম্মি একদিন আবিষ্কার করলো, খোকনের সাথে এক সাদা মেয়ের খুব অন্তরঙ্গ ছবি। আবার কিছু ছবিতে ওদের সাথে একটা পাঁচ ছয় বছরের ছেলের। ছবি গুলো হাতে নিয়ে শাশুড়িকে কাছে জানতে চাইলো, এ গুলো কাদের ছবি? শাশুড়ি কোন উত্তর দিল না। শুধু বলল, মেয়েদের বেশী কৌতহল থাকা ভাল না। ছবিগুল যেখানে ছিল সেখানে রেখে দাও।
ওই দিন রাতেই খোকন শাম্মির উপরে চড়াও হল। কিল, ঘুষি, চড়, থাপ্পর মারতে মারতে মাটিতে ফেলে ফিল, হারামজাদী তোর এতো বড় সাহস আমার কাগজ পত্র ধরিস, গবেষণা করিস। আবার জানতে চাস, কার ছবি। তার পরেও ক্রোধ গেল না। লাথি মারতে আরম্ভ করলো। শাম্মি তার পেটটাকে বাঁচানোর জন্যে গুটিশুটি হয়ে বসল। পেটে যাতে কোন আঘাত না লাগে। ওখানে একটা ছোট প্রান এর মধ্যে বড় হতে আরম্ভ করেছে।
খোকন এক ঘণ্টা পরে এসে আবার হাজির হল। এই বার মার না, তার নিজের শরীরের ক্ষুধা মেটানোর কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। মার ধর থেকেও এ কম লাঞ্ছনা না। শাম্মি চোখ বন্ধ করে  মিনির কথা ভাবতে লাগলো। সেই দৃশ্য চোখে ভেসে আসলো, সে কাঁদছে আর মিনি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মিনি হয়তো ভাবতেই পারে নি, শাম্মি কাঁদতে জানে। কিন্তু শাম্মি এখন কাঁদে, নিঃশব্দে, সব সময়ে!

সমাজতন্ত্র ঠেকাতে যেয়ে ভিয়েতনামে যুদ্ধে এমেরিকা  জড়িয়ে পড়ল। দক্ষিণ ভিয়েতমনাকে উত্তর ভিয়েতনামের হাত থেকে বাঁচাতে এমেরিকা তার সামরিক বাহুবল ব্যাবহার আরম্ভ করলো। এমেরিকা ৮ মিলিওন টন বোমা ফেলল। পরিমানে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ৪ গুন। নাপাম বোমা পর্যন্ত ব্যাবহার করলো। কিন্তু খুব সুবিধা করা গেল না। বাধ্য হয়ে মার্কিন স্থল বাহিনী আসলো উত্তর ভিয়েতনামকে হারানর জন্যে। জঙ্গল, পাহাড়, আর নদী-নালায় ভরা দেশটাতে। গেরিলারা অতর্কিত আক্রমনে মার্কিন বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। প্রচুর এমেরিকান প্রান হারাল। অনেকে আবার বন্ধী হল ভিয়েতনামিদের কাছে। কিছু মানুষ নিখোঁজ হল।
সায়গন থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা এক জঙ্গল। পাশ দিয়ে খরস্রোতা এক নদী চলে গেছে। খুবই বিশ্বস্ত সুত্রে খবর আসলো সেখানে পাহাড়ের চূড়ার এক ক্যাম্পে ছয় জন এমেরিকানকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে । তাদের উপর খুব অত্যাচার চালানো হচ্ছে। হয়তো মেরে ফেলা হতে পারে।
কম্যান্ডো বাহিনী ডেলটা ফোর্সকে  দায়িত্ব দেয়া হল এদের উদ্ধার করে নিয়ে আসার। এরা এই জাতীয় কাজ আগেও বেশ কয়েকবার করেছে। তার পরেও ৪ দিন তারা ব্যাপক ভাবে কাজটার মহড়া দিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে তাদের প্যারাসুট জাম্প করে নামতে হবে। তার পরে নদীতে সাঁতার কেটে, ক্যাম্পের পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেল করে পাহাড়ে উঠা আরম্ভ করবে। চলা ফেরা শুধু রাতে করবে। দিনের বেলা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকবে। ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে হিসাব অনুযায়ী সাড়ে তিন দিন লাগবে। তার পরে ঘণ্টা দুয়েক জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করে ভোর রাতে আক্রমন করে বন্দীদের মুক্ত করা হবে। ঠিক এ সময়ে হালিকপটর এসে তাদের জায়গাটা থেকে নিয়ে যাবে।  দলটার সদস্য ছিল পনের জন বাঘা বাঘা কম্যান্ডো।
সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হল। কিন্তু সবাই যখন হেলিকপ্টারে উঠছিল, তখন আরম্ভ হল ভিয়েতনামীদের বৃষ্টির মত গুলি। বেশ কয়েক জনের গায়ে গুলি লাগলো। তার পরেও তারা হেলিকপ্টারে উঠে যেতে পারল।
উঠতে পারলো না একজন। অন্যরা যাতে হেলিকপ্টারে উঠতে তারে সে কভার দেয়ার কাজ করছিল। অবিরাম শত্রপক্ষকে মেশিন গান দিয়ে গুলি করে যাচ্ছিল। ঠিক যখন সে হেলিকপ্টারে উঠতে যাবে, তার গুলি লাগলো কপালে। বাম দিক দিয়ে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বের হয়ে গেল। রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।  হেলিকপ্টার তাকে ছাড়াই উপরে উঠে গেল।
আহত এমেরিকান কম্যান্ডোর নাম বব নিক্সন।

এক দিন শাশুড়ি, খোকন দু জনই বাসায় ছিল না। শাম্মি ফোন করলো রিনিকে। অনেকক্ষন ধরে শব্দ করেই কাঁদল। বলল, মনে হচ্ছে এমেরিকা না এক নরকে এসে পড়লাম। সারাদিন বাসার সব কাজ কর আর রাত হলে মারধোর খাও আর অপমানিত হও। আমি প্রেগন্যান্ট, তার পরেও কেও জানতে চায় না আমার কোন কষ্ট হচ্ছে কি-না।
শাম্মি রিনির থেকে খোকন সম্পর্কে অনেক খবর পেল। রিনি বলল, খোকন সম্পর্কে এখানকার বাঙ্গালিরা কম বেশী সবাই জানে। এক সেমিস্টার করে, আর পড়া লেখা করে নি। এক দোকানে কাজ করত। সেখানকার সেফ (সিন্দুক) খুলে তিন দিনের বিক্রির টাকা গায়েব করে দিয়েছিল। পরে আরও দু বন্ধুকে ব্যাবসার পার্টনার বানানোর নাম করে তাদের সব টাকা পয়সা নিয়ে সর্বসান্ত করেছে। আরও অনেক ঘটনা শোনা যায়। কয়েকবার জেল পর্যন্ত খেটেছে।
গার্ল ফ্রেন্ড, পার্টি, মদ আনন্দ তার প্রিয় কাজ। অবশ্য, এক সাদা মেয়ের সাথে ফষ্টি নষ্টি করতে যেয়ে বিপদে পড়েছিল। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এখন তাকে চাইল্ড সাপোর্ট দিতে হয়। শোনা যায়, এখন ওদের সম্পর্ক ভাল। ছেলে তার মা কে নিয়ে এদিক সেদিক বেড়াতে যায়। শাম্মির ওই ছবিগুলোর কথা মনে পড়ল।
রিনি বলল তোমরা যে কেন বিয়ের আগে এই ছেলে সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলে না।  আমাকে একটু জানালেও তো পারতে। শাম্মি কোন উত্তর দিল না, মনে পড়ল বাবার মৃত মুখ আর মায়ের সেই অসহায়া মুখ, তাকে কঠিন ভাবে বলছে,  তোমার বাবা কিছু রেখে যায় নি। এখন কি ভাবে যে সংসার চালাবো।
১০
বব ছয় বছর কাটাল ভিতেয়নামিদের কয়েদখানায়।  সারা শরীরে তার অত্যাচারের চিহ্ন। কয়েদখানায় আসার আগে হাসপাতালে ছিল তিন মাস। তার তো বাঁচার কথা ছিল না।  কপালের গুলির ক্ষত তারা সারিয়ে তুলল। প্রথম দিকে খুব অত্যাচার চলত, এমেরিকানদের সম্পর্কে তথ্যের জন্যে। পরে যখন ওরা বুঝল, ববের থেকে নতুন কিছু জানার নাই, তখন ভোগান্তি ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। ভিয়েতনামিরা ববকে ধরার পরে, সব কিছু ছিনিয়ে নিল। অস্ত্র-শস্ত্র, জামা কাপড় সব কিছু। কিন্ত বব ইংরেজি জানা এক ইনভিষ্টিগেটারকে খুব করে বলল, আমার প্যান্টের পকেটে যেই কাপড়ের লাল ফুলটা ছিল, তা আমার কাছে রাখতে দাও।  ইনভিষ্টিগেটারের হয়তো দয়া হল। খুঁজে নিয়ে ফুল দিয়ে গেল। তার পরের ববের কাজ ছিল, সুযোগ পেলেই ফুলটার দিকে অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকা।
৩০ এপ্রিল, ১৯৭৫ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। তার পরে আরম্ভ হল, দু দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়। ববের ফিরতে আরও এক বছর লেগে গেল।  দফায় দফায় বিনিময় চলছিল। বব বারে বারে হিসাব করলো, সে কত দিন পরে দেশে ফিরছেঃ ৫ বছর, ১০ মাস, ৭ দিন, ৬ ঘণ্টা, ৩ মিনিট। সেকেন্ডটা হিসাব করতে পারল না। যাওয়ার সময়ে আসলে মনে করে আসলে সেকেন্ডটা দেখা হয় নি। আর ভাবতে লাগলো সামান্থা কি সারপ্রাইজ তাকে দিবে। না-কি এত দিন পরে সারপ্রাইজের কথা ভুলেই গেছে।
বব দেশে ফিরে আবিষ্কার করলো, তার সুইট হার্ট সামান্থা অন্য আরেকজনের ঘরণী। ওদেরই স্কুলের আরেক বন্ধু জনকে বিয়ে করেছে। বব জানতে চাইলো,  কেন কেন তুমি আমার জন্যে আপেক্ষা করলে না। সামান্থা বলল, আমরা তো জানি  ভিয়েতনামিরা তোমাকে মেরে ফেলেছে। তা ছাড়া তুমি কোন চিঠি, পত্র, খবর দাও নি। আমি কি করে জানবো, তুমি বেঁচে আছো?
সামান্থা বলতে লাগল, তুমি ভিয়েতনাম যাওয়ার তিন মাসের মাথায় মা মারা গেল। আমার পেটে তখন তোমার বাচ্চা। আমি তখন দিশেহারা হয়ে পড়লাম কি করবো, কোথায় যাবো, কে আমার পাশে আশে দাঁড়াবে। কি ভাবে এই বাচ্চা আমি মানুষ করবো।
১১
আজ শাম্মির মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হল।  একটা মানুষ তাকে কতটা ঠকাতে পারে। এক সে সময় সে স্বপ্ন দেখত, পড়ালেখা শেষ করে চাকরী করবে।  নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আর যাই হোক কেও তাকে অসম্মান করবে না।  কিন্তু সে কি জীবন পেল, সারাক্ষণ শুধু লজ্জা, অপমান আর অত্যাচার। কোন বাঙালীর সাথে কথা বলা তার কঠিনভাবে নিষেধ। তার পরেও, বাইরের জগতের সাথে খোঁজ খবর পেতে মন চায়। স জন্যেই সুযোগ পেলেই লুকিয়ে ফোনে কথা বলে রিনির সাথে।
মাসে একবার মায়ের সাথে কথা বলার অনুমতি আছে। মা জানতে চাইলে বলে, ভাল আছে। কোন অসুবিধা নাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, মাকে একবার বলে, তুমি আমাকে কেন এই নরকে পাঠালে। কিন্তু মা তার জামাইয়ের উপরে মহা খুশী। খোকন তার শাশুড়িকে মাসে দুই শ ডলার করে পাঠায়। শাম্মি কখনো খোকনকে টাকা পাঠাতে বলে নি। তবে কি মা নিজেই………। খোকন প্রায়ই এ নিয়ে শাম্মিকে ঠাট্টা করে, ফকিরনীর মেয়ে।
যাই হোক শাম্মি খোকনকে বলল, আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিলে ভাল হয়। আমার জানার দরকার,  তোমার যে বাচ্চা আছে সে কথা আমাকে বল নি কেন। বাচ্চার মা তোমার এখন গার্ল ফ্রেন্ড সেটা আমি ভালই বুঝতে পারি। কথাটা শুনে খোকন তেলে বেগুলে জ্বলে উঠলো। আরম্ভ হয়ে গেল মারপিট। মারতে মারতে বলল, তোর এই গুলো জানার কোন দরকার নাই। এই দেশের সবারই এরকম দু-চার টে গার্ল ফ্রেন্ড থাকে। কথাটা মনে থাকে যাতে।
১২
জটিলতা আরম্ভ হল সামান্থা আর জনের জীবনে। বব ফিরে আসাতে, জন সামান্থাকে বলল, তুমি ববের কাছে চলে যাও। ওর বাচ্চা ওর কাছে ফিরে মানুষ কর। সামান্থা এটাতে রাজী হল না। আমি কি জড় পদার্থ। একবার এইখান, এরেকবার ওইখান করে বেড়াব।  জন খুব দ্রুত আগ্রহ হারাতে থাকল সামান্থার উপর থেকে।
জন চলে গেল আরেক মেয়ের হাত ধরে। অনেক করে বলার পরেও সামান্থা ফিরে আসলো না ববের কাছে। তার খুব আত্মসম্মানে লাগলো। একই কথা আবার পরিস্কার করে বলল, আমি চাকরি করবো। আমার মেয়েকে আমি বড় করবো। আমার কারোর সাথে থাকার দরকার নাই।
বব আর নিয়ম মত চাকরিতে ফিরে গেল না। আর্মি থেকে প্রাক্তন আহত সৈনিক হিসাবে যে ভাতা পাচ্ছিল, তা দিয়ে মোটামুটি চলে যায়।  তার পরে  প্রতি মাসে কিছু টাকা জমিয়ে সামান্থাকে দিয়ে আসে মেরীর জন্যে খরচ করতে।
মেরীর বয়স যখন ১২ তখন সে জানতে পারলো জন না, বব তার আসল বাবা। ব্যাপারটা মেরীর খুবই অন্য ভাবে নিল। ববের সাথে ভয়ানক খারাপ ব্যাবহার করলো।  বলল, তুমি কাপুরুষ। নিজের মেয়ের জন্যে যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তা তুমি কর নি। আমি তোমাকে আমি চাই না, আমি তোমাকে ঘৃনা করি।  তুমি আমার সামনে কখনো আসবে না।
১৩
খোকনের মা মারা গেছে তিন বছর হল। শাম্মির মেয়ের তিন্নি দেখতে ঠিক মায়ের মত। ছয় বছর বয়স। ফার্স্ট গ্রেডে যায়। শাম্মি গাড়ি চালাতে পারে। ওই মেয়েকে স্কুলে আনা নেয়া করে। বাজার- গ্রোসারি করে। নিজের চেষ্টাতে গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছে। খোকনের পুরনো গাড়িটা চালায়। খোকন এই সব ব্যাপারে কোন কথা কখন বলে নি। তবে শাম্মি কিছু বাড়তি কিছু কাজ করছে, তাতেই হয়তো খুশী।
এক দিন বাড়ির সামনে ফুল গাছে পানি দেয়ার সময়ে, দেখল সাদা এক বয়স্ক লোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। খুব অবাক হল। সে সাধারণত দেখে অল্প বয়সের ছেলে মেয়েরা সাইকেল চালায়। কিন্তু এতো বয়স্ক এক জন?  লোকটা মিষ্টি হেসে হ্যালো বলে চলে গেল।
১৪
লোকটা বব। ছোট একটা বাসা কিনে এই পাড়াতেই থাকে। খকন-শাম্মির বাসা থেকে দেখা যায়।  প্রায় বছর চারেক হয়ে গেছে সে সাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। সামান্থা মারা যাওয়ার পর থেকে তার এই ভাবে সময় কাটে। অনেক দিন সামান্থা ক্যান্সারে ভুগেছে। শেষের এক বছর বব অনেকটা জোর করেই  সামান্থাকে তার বাড়ি নিয়ে এসেছিল। হাসপাতাল থেকে বলেছিল, ওদের আর কিছু করার নাই।
সামান্থা ববের বাড়িতে আসাতে মেরী আরও বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। বাবা-মাকে শাস্তি দেবার জন্যে উশৃংখলতা চরমে গিয়ে পৌছায়। ড্রাগ, সেক্স আর আনন্দ নিয়ে মেতে থাকে। সামান্থা মারা যাবার আগে ববের হাত ধরে বলেছিল, আমাদের মেয়েকে তুমি মাফ করে দিও। আর যত দিন তুমি বেঁচে থাক, ওকে দেখে রেখ।
বব কথা রেখেছিল। যতটুকু সম্ভব মেরীকে সে কারণে, অকারনে সাহায্য করছিল। প্রতি মাসে কিছু টাকা, কিছু গিফট নিয়মত পাঠাত। সামান্থার কথাও মিলে গেল। মেরী আরও কিছু পরে মা হল। বব শখ করে অনেক কিছু নিয়ে নাতিকে দেখতে গেল। যেতে যেতে ভাবছিল মেরী তাকে তাড়িয়ে না দেয়।
অবাক কাণ্ড। মেরী তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল। বলল, বাবা আমাকে মাফ করে দিও। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি। আমিও তো এখন মা। ববও আনন্দে কাঁদতে থাকলো। সে মনে করতে পারলো এর আগে সে কখন কেঁদেছে কি না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল। যদি সামান্থা দেখে যেতে পারত।
১৫
শাম্মির সাথে প্রায় প্রতিদিনই ববের দেখা হয়। বব সাইকেল থামিয়ে এইটা সেটা কথা বলে। কিন্তু, কেও কাওকে তার নিজের জীবনের কথা বলে না। কথা হয় আবহাওয়া, ফুল, ফল, পাখি, ধর্ম আর এমেরিকা, বাংলাদেশে নিয়ে। শাম্মির কিছুটা দম ছেড়ে নিঃশ্বাস নেয়ার একটা উপায় হল।
শাম্মি বব থেকে জানতে চাইলো, তুমি সাইকেল চালিয়ে বেড়াও কেন? বব বলল, সাইকেল চালিয়ে গেলে আমি মানুষকে একটু বেশিক্ষণ দেখতে পাই। আমার কল্পনার জগত পাখা মেলে সহজেই। মানুষ দেখে আমি তাদের অতীত, বর্তমান  বুঝে ফেলি সাথে সাথে। একটা উপকার আছে অন্যদের কথা চিন্তা করাতে, নিজের মনকে দূরে রাখা যায় নিজের থেকে। আমি এখন মানুষের মুখ দেখে বলে দিতে পারি, সে কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
পরের দিন ঈদ। শাম্মি দাওয়াত দিল ববকে দুপুরে ওদের সাথে খেতে। বলল, all Bangladeshi food. বব সানন্দে রাজী হল। রাতে খোকনকে বলল, কালকে বব আসবে। খোকন কোন উত্তর দিল না। শাম্মি বেশ কিছু দিন আগেই খোকনকে ববের কথা বলেছিল। তখন সে বলেছিল, কখন দরকার লাগলে বুড়াকে কাজে লাগান যাবে।
একটা কাল স্যুট পরে বব আসলো। কোটের পকেটের উপরে রঙচটা একটা লাল কাপড়ের ফুল। শাম্মি, খোকন, তিন্নি—সবার জন্যে গিফট নিয়ে এসেছে।  অনেক দিন পরে শাম্মির মন আনন্দে ভরে উঠলো। মনে পড়ল, ঈদের দিনে বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার কথা। বব যদি বাঙালি হত, তা হলে  নিশ্চয়ই সেই কাজটা করত।
খাবার টেবিলে অনেক কথা বার্তা,  রসিকতা হল। যেই খোকন বাসায় সহজে তেমন একটা কথা বলে না; সে অনেক কিছু বলা বলি করে হাসাহাসি করলো। বব সবার সাথে হাত মিলিয়ে বিদায় নিল।
১৬
এক দিন খোকন একটা মোবাইল ফোন শাম্মিকে দিয়ে বলল, এইটা সাথে সাথে রেখ। মেয়েকে নিয়ে বাইরে ঘুরা ফেরা কর, কখন বিপদ হলে ব্যাবহার কর। কিন্তু বিপদ হওয়ার আর দরকার পরে না। বাবা ওই ফোন করে মেয়ের খবর নেয়, মেয়ের সাথে কথা বলে।  শাম্মির জন্যে কিছুটা ভাল হল। সে এখন বেশ সহজেই ফোন করে রিনির সাথে কথা বলে।
রিনি এক দিন বলল, এই দেশে মেয়েদের পক্ষে অনেক ধরনের আইন আছে। স্বামী অত্যাচারী, এই খবর জানাজানি হলে পুলিশ স্বামীকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি বাসায় আসা  বন্ধ করে দিতে পারে। ডিভোর্স হলে স্বামীর সব সম্পদ অর্ধেক ভাগ হয়ে যায়। আরও বলল, যদি মনে হয় তুমি আর নিতে পারছ না, তা হলে আমার কাছে চলে এসো। আমিই যা করার করবো। তোমাকে শুধু শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে।
এর মাস ছয়েক পরে  খোকন আবার শাম্মির উপরে চড়াও হল। এবার অপরাধ ডালে লবন কম হয়েছিল। হয়তো সমস্যা ছিল অন্য কোথাও। একেবারে মদ খেয়ে নেশায় চুর হয়ে ছিল। অনেক ব্যাপারে গালাগালি করলো। শেষে বলল, কি মনে করিস। আমি বুঝি না। বুড়ার সাথে ফষ্টি নষ্টি। আর স্বামীর দিকে মুখ তুলে তাকাস না। কথাটা শাম্মি মেনে নিত পারলো না। বলল, খবরদার ববকে নিয়ে কোন কথা বলবে না। ওকে আমি বাবার মত ভাবি। উত্তরে খোকন বলল, মাগী বলে কি। প্রেমিককে বলে বাপ। আসলে বাপ না বব ডার্লিং। কথাটা শেষ করে, হাতের পাশে একটা ফুলদানী ছিল তা ছুড়ে মারল। যেয়ে লাগলো শাম্মির কপালে। রক্তে মুখ ঢেকে গেল। চিৎকার করে বলল, কালকেই আমার বাসা থেকে চলে যাবি। তোর মত মাতারির আমার দরকার নাই।
সকালের ঘর থেকে বের হবার আগে, খোকন শাম্মিকে আবার শাসিয়ে গেল, ফিরে এসে আর তোকে দেখতে চাই না। রিনি ঘটনা শুনে ছুটে আসলো। বলল, তোমার এখানে থাকার দরকার নাই। শাম্মি স্যুটকেস গুছিয়ে তিন্নিকে নিয়ে গাড়িতে যেয়ে উঠলো। তিন্নি গাড়ির থেকে বাবাকে ফোন করে বলল, বাবা আমরা চলে যাচ্ছি……রিনি খালামনির সাথে।
খোকন মেয়েকে বলল শাম্মিকে ফোনটা দিতে। ফোন নিয়ে বলল, মাগী বাড়ি ফিরে যা। না হলে তোকে গুলি করে মারব, তোর মেয়েকেও মারব। আমারে তুই চিনিস না। ফোনটা রেখে শাম্মি কাঁদতে কাঁদতে বলল, রিনি আপু গাড়ি ঘুরাও। আমি কোথাও যাব না। শাম্মির মনে হল, ওই লোক যদি সত্যি ওদের মেরে ফেলে কিংবা তিন্নিকে গুলি করে মারে। মাকে যে টাকা প্রতি মাসে পাঠায় তা বন্ধ হয়ে গেল মায়ের চলবে কি-করে? মায়ের তো আর কোন রোজগার নাই।
শাম্মির জন্যে সব নিষিদ্ধ হয়ে গেল। বাড়ির ফোন আর মোবাইল ফোন দুটোরই লাইন কেটে দিল। বাড়ির থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তার পরেও জানালা দিয়ে দেখত; বিকেল হলে, বব সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে আর বোঝার চেষ্টা করছে শাম্মি নাই কেন।
১৭
এক দিন দুপুর বারোটার দিকে দরজায় কলিং বেলের শব্দ। শাম্মি খুব অবাক হল, এই সময়ে তো কারো আসার কথা না। দরজা খুলতেই দেখল, দু জন পুলিশ দাড়িয়ে। ববের একটা ছবি দেখিয়ে বলল, তুমি একে চেন?  শাম্মি বলল, হ্যা, ওই যে ওই বাড়িতে থাকে। পুলিশরা জানতে চাইল, শেষ কবে দেখেছ? শাম্মি অনেক চিন্তা করে বলল, হয়তো সপ্তাহ তিনেক আগে।
কিছুক্ষণ পরে দেখল, বাড়ির সামনে এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সহ আরও অনেক মানুষের ভিড়। বুকটা কেঁপে উঠলো। ববের কিছু হয় নি তো! কাপড়টা পালটে ছুটে গেল ববের বাড়ির দিকে। হলুদ টেপ দিয়ে পুরো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে দিয়েছে।  যেই পুলিশটা কিছুক্ষণ আগে শাম্মির সাথে কথা বলেছে তাকে পেল।  তার থেকে জানতে চাইলো, কি হয়েছে।
পুলিশ বলল, ববের মেয়ে থাকে অন্য আরেক শহরে। গত তিন সপ্তাহ ধরে বাবার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে পুলিশকে ফোন করে। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ডুকে দেখে, কমপক্ষে দু সপ্তাহ আগে সে মারা গেছে। তার শরীর এর মধ্যে বিকৃত হয়ে জীবাণু আর গন্ধ ছড়াচ্ছে। শাম্মির আর শুনতে ইচ্ছা করলো না।
শাম্মির রাস্তার অন্য পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, এইটা কি করে সম্ভব। একটা মানুষ মরে গেল, আর কেও জানল না। শরীর মরে পচে গেল, তার পরে পুলিশ তাকে দরজা ভেঙ্গে বের করলো।
পরের দিন আবার দরজায় বেল। শাম্মি যেয়ে দেখল, চল্লিস-পয়তাল্লিস বছরের এক মহিলা দাড়িয়ে। সে বলল, আমি মেরী। ববের মেয়ে। বাবার কাছে তোমার কথা শুনেছি। বাবাকে একদিন লাঞ্চ করানোর জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তার পরে কথায় কথায় বলল,  বাবার মৃত শরীরের হাতের মুঠোয় সেই কাপড়ের লাল ফুলটা ছিল। তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিলে, বাবা যে দিন তোমার বাসায় এসেছিল, সেদিন তার কোটের পকেটের উপরে ওই ফুলটা ছিল। ওটা আসলে আমার মায়ের হাতে বানানো। তার পরে সে ফুলের পুরো গল্পটা বলল।
১৮
প্রায় দিন বিকালে শাম্মি জানালার পাশে যেয়ে বসে। কল্পনায় বব হয়। নিজের কষ্ট বিস্মৃত হয় কিছু সময়ের জন্য।  ভাবতে থাকে সে ঠিক ববের মত সাইকেল চালিয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। অনেক মানুষ, বাড়ি, ঘটনা দেখতে থাকে। অনেক কিছু মানুষের চেহারা দেখেই বুঝে ফেলে।  দেখে ওই যে ওই লোকটা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তার আজকে মায়ের মৃত্যু দিবস,  আর ওই যে ওই মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসছে, নতুন প্রেমে পড়েছে…………। খুব ভাল মজা তো।
মিনি, বব, মা, বাবা, মুন্না সবাই কেমন একাকার হয়ে যায় এই সব অপরিচিত মানুষগুলোর মাঝে ।
অক্টোবর ২৩, ২০০৭

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

BiLaShiR cHuka JooL [ বিলাসীর চুখে জ্বল ]...: কাব্যগল্প: এই যে একটু শুনুন

BiLaShiR cHuka JooL [ বিলাসীর চুখে জ্বল ]...: কাব্যগল্প: এই যে একটু শুনুন: কাব্যগল্প: এই যে একটু শুনুন মার্চ ০৭, ২০১২ তখনো ভাঙেনি শিশিরগুলো ভোরের সবুজ ঘাসের পাতা থেকে, শুভ্রতায় ঝলঝলে ভোরের রক্তিম উদিত সূর্যের...

একটি রাতের গল্প

একটি রাতের গল্প



রাত ১টা। চারিদিকের কোলাহল রাতের অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে। মাঝে মাঝে গাড়ির হর্ন আর নিজের হার্টবিট ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না সফেলা। টানা ছয় ঘণ্টা গাড়িতে থাকার দরুন গাড়ির শব্দটি খুবই সাধারণ ঠেকছে অথচ এই শব্দকে একদিন মোটেও সহ্য করতে পারত না সফেলা। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে পাশের বাড়ির সবদার শেখের মেয়ের বিয়ের কথা। সেবার দু’দুটো বাস এসে সফেলার উদোম উঠোনে এসে থামলো, শব্দে তো প্রায় জানটার যায় যায় অবস্থা! সফেলা সেদিন সবদার শেখকে প্রাণ ভরে গালি দিয়েছিল। গালিটাই তার একমাত্র সম্বল! সবদার সাহেবদের কাছে যেমন সফেলা অতি তুচ্ছ, সফেলার গালির কাছে তাদের দশাও তেমনিসফেলাকে যারা চেনে এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন দ্বিমত ঘটবে না। তাই তো সফেলা সুযোগ পেলেই তার এই অস্ত্রটা কৃতিত্ত্বের সাথে কাজে লাগায়।
বাসটি তেল পাম্পে এসে ভিড়লো। সফেলার ডান পাশের লোকটি প্রস্রাব করার জন্য তড়িঘড়ি করে নেমে পড়লো, বাম দিকের লোকটি নড়েচড়ে বসলো- এতক্ষণ সে সফেলার ঝুলে যাওয়া বাম স্তনটি মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছিল। এদের দু’জনার সহায়তায় আজ সফেলা অন্ধকারকে গ্রাস করে চলেছে দেহ-খাদক একদল পিশাচের ক্যাম্পে। ওরা ইচ্ছেমত ভোগ করবে তাকেউল্টে-পাল্টে, খাবলে-খুবলে খাবে তার পাখির ঠ্যাংয়ের মতো রসকষহীন শুকনো শরীর। প্রয়োজনে থাকতেও হতে পারে কয়েক রাতবিনিময়ে টাকা; কিন্তু কত দেবে ওরা? দেহের ওপর অনেক ধকল যাবে ভাবতেই মুখখানা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় সফেলার। সে ধকল না হয় সইলাম কিন্তু কত দেবে ওরামনে মনে ভাবে সফেলা। তাকে যা দেয়া হবে তার দুই ভাগ আবার যাবে এই দালালদের পকেটে। প্রতিটা কারবারে মধ্যস্তকারীরা সবথেকে বেশি সুফল ভোগ করে, এই বেশ্যা বাজারেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। দালালদের সহায়তা ছাড়া যে সফেলার পক্ষে আর কোন পার্টি ধরা সম্ভব না। বেশ্যা বাজারে তার দাম পড়ে গেছে। একটা সময় ছিল যখন আগে থেকেই দর হাঁকিয়ে পা বাড়ানো যেতো। কিন্তু এখন আর আগের সেই টসটসে মিনসে ভোলানো গতর নেই। ফুলে রস না থাকলে মাছি বসবে কেন! তাই দামাদামি করতে গেলে হটিয়ে দেয় সকলে। সফেলা নীরবে মেনে নেয় সব। দশ বছর পূর্বেকার কথা মনে পড়তেই তার মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠে। এক সাহেব গোছের মানুষ- সফেলার বয়স তখন বাইশ কি তেইশ- তার ভরাট যৌবন দেখে সাহেব তো একেবারে পাগলপ্রায়! সাহেব হলে কী হবেলোকটি পাজি-নচ্ছড়, বৌ-বাচ্চা রেখে চলে আসে সফেলার কাছে, সফেলাও খাসা মাল, চেয়ে বসে এক হাজার টাকা! ভদ্রলোক এক কথাতেই রাজি। সফেলা টানা নিঃশ্বাস ছাড়ে নিজের অজান্তেই। এ সমাজটাই হচ্ছে নচ্ছার। এ সমাজস্থ প্রতিটি লোক বেশ্যা অথচ ভারটা বইতে হয় সফেলার মতো গুটিকতক অসহায় নারীকে। রাত হলে সমাজের কতো হর্তা-কর্তা লালা ফেলতে ফেলতে মাগি বাড়ির সন্ধান করে সফেলার তা ভাল করেই জানা। ওরাই বড় বেশ্যা অথচ সকাল হবার সাথে সাথে যেনো এক একজন ধোয়া তুলসী পাতা।
গাড়ির শব্দ ভোতা হয়ে আসছে ক্রমশঃ। ভিতরের বাতিগুলো এখন বন্ধ। সকলে বোধহয় তন্দ্রচ্ছন্ন। বামের সিটে বসে থাকা দালালটির হাত আর নড়ছে না। রাস্তায় হালকা আলো-ছায়া সফেলাকে ভেংচি কেটে দ্রুত সরে পড়ছে। রাতের নীরব আত্মা তাকে শাঁসিয়ে যাচ্ছে ঘন ঘন। দিনের আলো সফেলার গায়ে কাটাতারের মতন বিঁধেঅপমানে, লজ্জায় কুঁকড়ে যায় তার সর্বাঙ্গ, অথচ রাতের পৃথিবীতে সে পানির মধ্যে মাছের মতোন খুবই স্বাভাবিক। দিনের আলোয় যারা ভালো মানুষের মুখোশ পরে সভ্যতার নকশা তৈরি করে, রাতে তাদের নগ্ন চেহারা দেখে সফেলার খুব করুণা হয়। সফেলা তো এই সমাজেরই একজন, সমাজের প্রতিটা মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে সেও বেঁচে থাকতে চায়ছে। মোদ্দা কথা টিকে থাকাটাই এখানে সব। কোন জগতটা তবে বেশি সত্যিরাতের নাকি দিনের? যদি রাতের হয় তবে সফেলাতো অন্যায় কিছু করছে না। বেঁচে থাকার জন্যই আর পাঁচটা ব্যবসায়ের মতন দেহ ব্যবসা করছে, ভদ্র ঘরের নারীদের মতো দৈহিক তাড়না কিংবা ভোগ বিলাসিতার জন্য কিছু করছে না, সে যা করে স্রেফ বেঁচে থাকার জন্যই করে; এক্ষেত্রে দেহ তার ব্যবসায়ের মূলধন; কিন্তু সমাজের সভ্য মানুষগুলো তো তার কাছে আসে দেহের গন্ধে, মাংসাশী প্রাণির মতন খাবলে-খুবলে খায়, সুখের নেশায় মাতাল হয়ে আচড় কেটে দেয় তার ভেতরে ও বাহিরে। বেশ্যা শব্দটা যদি এতটাই ঘৃণার হবে তবে আসল বেশ্যা তো ওরা যারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় মুখোশ পাল্টায়, রাজত্ব করে ভন্ড সভ্যতার!
এতসব বোঝেনা সফেলা। এত বোঝবার জ্ঞান তার নেই। সমাজের শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা তার কাছে জ্ঞান দিতে যায় না, যায় তাদের পাশবিক চেতনাকে উগরে দিতে। এদেরকে অজ্ঞ করে না রাখলে যে বড় ক্ষতিটা তাদেরই হবে! অন্ধকারে থাকে বলেই সফেলা জানে মানুষ কতটা হিংস্র হতে পারে।
গাড়িটা মেইন রোডের এক কোণায় থামলোদশ মিনিটের বিরতি। দুয়েকটি দোকান এখনো খোলা। বাম পাশের লোকটি বিড়ি কিনতে নেমে যায়, সফেলা বুকের কাপড়টা ঠিক করে আলোর দিকে মুখ বের করে দেয়, চোখ পড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চকচক করতে থাকা সিনেমার পোস্টারের দিকে। অর্ধ-উলঙ্গ নায়িকাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সফেলা। সমাজের এই উঁচু শ্রেণির বেশ্যাদের দেখে হিংসে হয় তার। সমাজে এদের বেশ কদর আছে, টাকাও পায় ঢের বেশি। আচ্ছা, এরা কি সুখ পায়, নাকি আমার মতো ব্যথায় কুঁকড়ে যায় পুরা শরীর?ছবির ওপরে দন্ডায়মান লাম্প-পোস্টটিকে প্রশ্ন করে সফেলা। প্রচন্ড সুখে যখন খদ্দেরদের মরে যেতে ইচ্ছে করে তখন আহত সফেলা খুব কষ্ট করে জানটাকে ধরে রাখে। পঁচিশ বছরের বেশ্যা জীবনে মাসিকের সময় যে শান্তিটুকু পেয়েছে সে, এছাড়া আর অবসর মেলেনি জীবনে। প্রথম যে বার মাসিক হয়, কী গালিটাই না দিয়েছিল মাসিককে! কী ভয়ানক রক্ত দলা বেঁধে শরীর থেকে নেমে আসে, ব্যথায় কুঁকড়ে যায় তলপেট, নারী জীবনে এর থেকে অভিশপ্ত আর কিইবা হতে পারে! তখন কি জানতো সফেলা- এই বিভৎস ঘটনাটাই তার জীবনে সব থেকে কাঙ্খিত হয়ে দাঁড়াবে!
রাত দু’টা। সফেলার মনে হচ্ছে গাড়িটা অন্ধকারকে আঁকড়ে তর তর করে বয়ে চলেছে অজানা এক শঙকার দিকে। বাড়িতে তার আট ও দশ বছরের মেয়ে দুটো একা। ছেলেটা ছ’ মাস ধরে জেলে। ছাড়াতে অনেক টাকা লাগবে। পুলিশের মন ভরানোর মতো বয়স ও টাকা কোনটাই তার নেই। ছেলেটা গেছে, এখনও সময় আছে মেয়ে দুটোকে রক্ষা করার। সফেলা অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আজকের রাতটিই হবে তার বেশ্যা জীবনের শেষ রাত; ওরা যে ক’টা টাকা দেবে তা নিয়েই মেয়ে দুটোকে সংগে করে এ সমাজের কোন এক গর্তে ঘাপটি মেরে পড়ে রইবে। টাকার কথা মনে হতেই হার্টবিটটা বেড়ে যায় সফেলার। বুক থেকে দালালের হাতটি হটিয়ে নিজের হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে সেখানে যেনো জানটা বেরিয়ে না যায়। আচ্ছা, কতো দেবে ওরা, নাকি খালি হাতেই ফিরতে হবে!এই সংশয়টি তার সকল সংশয়কে পিছনে ফেলে পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায়। একটা সময় ছিল যখন ওরা রূপের ঝলক দেখে দু’হাত ভরে দিত। তাইতো বেশ্যা বাজারে সকলে হিংসে করতো তাকে। এমনকি সতী-সাধ্বী নারীরাও আড়ালে-আবডালে সফেলার মতো হতে চায়তো। অথচ আজ ঝুলন্ত আর ঢিলে-ঢোলা গতর দেখে সকলে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এ ব্যবসায়ে কচি দেহ বিকোয় বেশি। তাইতো সুযোগ পেলেই প্রতারণা করে সবাই, সফেলাকে সয়তে হয় নীরবেএ প্রতারণার যে কোন বিচার নেই, আদালত নেই, আর থাকলেই বা কী এমন লাভ হতো! এদের ‘করুণাতেই’ যে সফেলারা বেঁচে থাকে! আর জীবন? টানা নিঃশ্বাস ছাড়ে সফেলা।
গাড়ি এসে থামলো গন্তব্যে। দালাল দু’জনের পিছন পিছন সফেলাও নেমে পড়ল হিড় হিড় করে। আচ্ছা কত দেবে ওরাফিসফিস করে বলল নিজেকে। আঁচলের গিট্টু থেকে একটা বড়ি বের করে গুঁজে দিল মুখে, দেহ অবশ করার এই ঔষধটা ওর সাথেই থাকে। বেশ কয়েক কদম হাঁটার পর পৌঁছাল পিশাচদের ক্যাম্পে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, বিশ্রি রকমের গরম পড়ছে আজ। মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়েই মেঘের মধ্যে লুকিয়ে পড়ছে চাঁদ। সখী, তোর যৌবনের ধার একটু ধার দিবি আমাকে? সফেলা কতবার বলেছে এ কথা! আজ তার মেজাজটা বেশ বিগড়ে আছে। মাগি, ছিনালিপনা করিস আমার সাথে? হাতের কাছে পেলে তোর মাথার চুলগুলো ধরে স্যাটাই ধান ভাংতাম! সফেলা মন্ত্র পড়ার মতো বিড়বিড় করে বলে। দালালের একজন এগিয়ে যায় দরজার দিকে। অন্যজন সফেলার হাত দুয়েক দুরে দাঁড়িয়ে ছছছড় করে পেশাব করতে থাকে। কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একটা ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘কে? কে এই অসময় দরজা হেটকায়?’ সফেলার বাম পাশের লোকটি একটু বিনয়ের সুরে বলল, ‘আমরা সাব, মাল লইয়া আইছি’। ভেতর থেকে আর কোন সাড়া শব্দ আসে না। সফেলা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে বলল, ‘কত দেবে ওরা?’ ডান দিকের লোকটা আন্ডারওয়্যার এর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে খিঁচুনি দিয়ে বলে উঠল, ‘চুপ কর শালী, এত্ত ঠাপ খেয়েও কামড় মেটেনি!’ ততক্ষণে ভেতর থেকে একটা তৃপ্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘আজ আর লাগব না; আমরা কম বয়সী এক মাগী পাইছি। অন্যদিন নিয়া আইসো’। সফেলাকে হটিয়ে দালাল দু’জন পিছন দিকে পা বাড়ায়। সফেলা মাথা ধরে বসে পড়েআরও একটি নষ্ট রাত, আরও একটি স্বপ্নের প্রতিক্ষায়। কিন্তু কত দেবে ওরা?

উদাস মনের কথন

উদাস মনের কথন


কে হে অলক্ষ্যরাগী, ডাকিছ আনমনে উদাসে?
সবুজ-শ্যামলাঘেরা মাঠে, ডাকিছ নীলঘন আকাশে
প্রকাশে প্রাপ্তি আমার আনমনা ছাহনি
অলক্ষ্য কোন যমুনায় বাহিব তরণী ।

কুহু পুস্পবনে, বসন্তেরই বার্তা আনে
কি পরশে উদাস মন স্বপ্ন বোনে নয়ন কৌনে !
এ কোন জড়ানো মায়া ? এ কোন প্রাপ্তির আশা ?
ঝরনার ধারায় হারায়, এ কোন ভালোবাসা ?
আজি সন্মুখে মোর আলোর প্রভাত, সাঙ্গ হয় বেলা
বাস্তব সে নাকি, নাকি মিছে খেলা ?
পঞ্চবটী কুঞ্জধারে স্বর্ণলতা জড়ানো
বাস্তব কবে দেবে ছোঁয়া, বসন্ত বাতাস মাতানো ।

বাঁকা মনের সোজা লেখা

বাঁকা মনের সোজা লেখা



সব কলমেই লেখা হয় যদি থাকে কালি
সব মরু- জমিনেতে হরেক পদের বালি।
সব সাগরেই মাছ থাকে যদি থাকে জল
প্রাণ না থাকলে পরেই হয় কিরে নিশ্চল?

কালি শুধু লেখার জন্য প্রধান শর্ত নয়
লেখক এবং কলমটিও সঠিক হতে হয়।

সাগর তীরেও বালু থাকে, সেতো নয় মরু
বৃক্ষহীন মরু বুকেও জন্মায় কিছূ তরু।

জল আছে নামও সাগর তবু মাছ নেই
লবন ভরা  সাগরটিকে মৃত নাম দেই।

প্রাণ আছে বৃক্ষরাজির , তবুও চলে কই
জীবন নেই তবু চীর সজীব থাকে বই।

জানা সব সত্য হয়না, চিন্তাও বেশ মিছে
কবি মরে যাবে তবুও কবিতা রবে পিছে।