[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

শনিবার, ৪ আগস্ট, ২০১২

রাত্রি জাগরণের কাব্য




এক.
বহু দূর ভ্রমণে রোদের মাখন
জেগে ওঠে তাঁর সুরমা রঙ গালের গেলাবে
চিকচিক দাড়ির বাগানে ফুটে ওঠে
মুক্তা রাশি রাশি- রহম খোদার।

দুই.
ভ্রমণে ক্লান্ত তাঁর কয়েদি পা
শিকল ছিঁড়ে তাহাজ্জুদ রাত্রিতে
কপাল চুম্বন করে ঐশ্বরিক পায়
জেগে ওঠে হাত
আর চোখের ফারাক্কা ভেঙ্গে
জোয়ারে ডুবে যায় নদী।

তিন.
তাঁর দীর্ঘ রোদভ্রমণ
রাত্রি জাগরণের তাহাজ্জুদ
কওমের সূর্য উঠার প্রত্যাশায়।

চোখের বয়ান


চোখের বয়ান





নার্সিং চোখ
কারামতি স্কার্ফের নিদ্রাহীন নার্সিং চোখ
রোদের স্পর্শে জ্বলে উঠে বুকের দরদ।

শরনার্থী চোখ
বাইশটি বছর মুখোমুখি
প্রতিবন্ধীর শরণার্থী চোখে
বৃষ্টির দীর্ঘ চুল চুমে
দোপাট্টায় ভাসে
চোখের কান্নাভরানত সিম্পোজিয়াম।

এপ্লিক চোখ
এমব্রয়ডারি সন্ধায়
থার্মোমিটার জ্বরে
রোদের পারদ গলে
লোমের গহবরে জন্মে
জুন আর্গাসের এপ্লিক চোখ।

মায়ামৃগ চোখ
নাষ্পাতি রঙে বেপথুয়া রাত্রী
লাশের মায়ামৃগ চোখে
বৌচি খেলে নার্সিসাস চলচ্চিত্র।

অনন্ত চোখ
এই চোখ অনন্ত চোখ
তরুনের চোখ চায়
তরুনীর চোখ।

গল্পঃ আ ধাঁ রে র অ নু ভ ব


গল্পঃ আ ধাঁ রে র  অ নু ভ ব



এক.
-তোমার তো যোগ্যতা, মেধা আছে এ অজপাড়া গাঁয়ে পড়ে থেকো না, শহরে কোথাও গিয়ে হাইস্কুলে গিয়ে চাকুরী-বাকুরী কর?
হেড স্যার রজতবাবু অরুপের হাত ধরে বললেন দেখ, অরুপ গ্রামের এ ছোট্ট প্রাইমারী স্কুল যে কোনদিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতদিন বড়কর্তারা সাহায্য করেছিলো চলেছে, মুখ গুটিয়ে নিয়েছেন তারা।
-হয়তো স্কুল আর চলবে না। আমাদের না হয় জমির বুকে ফসল তুলে কেটে যাবে, কিন্তু তুমি তো তরুন মানুষ, তোমার ম্যালাদিন পড়ে আছে সামনে। তাছাড়া এ গাঁয়ে তোমার আত্নীয়স্বজন কেউ নেই যে, তাদের সাথে থেকে যাবে!

অরুপ প্রথমে রাজী হয়ে চায়নি কিন্তু ভেবে দেখলো ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে এভাবে থেমে না থেকে একটু উপভোগ করা যাক, নয়তো শেষ বয়সে আফসোস জ্বিবের ডগায় আওয়াজ তুলবে। তাই শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেল। ঘরে ফিরে তাকে কিছু ভাবতে হলোনা।
পরদিন রজতবাবু পোষ্ট অফিস থেকে একটা চিঠি নিয়ে হাজির।
শোন,অরুপ উনি আমার বন্ধু রঞ্জিত মালাকার তুমি নিশ্চই চেন? তোমাদের কলেজের বাংলার ক্লাস নিতেন। অরুপ চিনতে পেরেছি বলতেই’ খামটা ধরিয়ে দিলেন ওর হাতে এটা তোমার চাকরীর জয়েনিং লেটার।
এবার তৈরি হয়ে নাও।
ও যে বাড়িতে ভাড়া থাকতো তাদের মনটা অবশ্য একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিলো মাসান্তের দশদিন সবেমাত্র গেছে, পুরো ভাড়াটা তাই তারা পাচ্ছেনা। অরুপের গোছানোর মতো কিছুই নেই । বাক্সপেটরা দুটো। শেষ বারের মতো ওর ছাত্ররা মনখারাপ করে রইলো কিন্তু কি আর করা সময় তো পরিবর্তন হয়; তাই এসব মেনে নিয়েই চলতে হবে।

পড়াগ্রাম ছেড়ে ওর যাত্রা এখন ‘নিদভাঙ্গার’ ছোট্ট শহরে বাসে চাপার আগ অবদি ওর চোখ একটু ঝাপসা হয়ে আসছিল কেউ ছিলনা এ গাঁয়ে । মা-বাবা তো সেই কবেই আকাশ পাড়ি দিয়েছে। তবুও আজ খারাপ লাগছে। কেন যে খারাপ লাগছে…..
দু’পাশে পাহাড় আর নদী একপাশে দুরন্ত ঘন বনজঙ্গল আর একপাশে ছোট্ট মফস্বল শহর। এ শহরে পা ফেলবার আগেই অরুপ শহরটাকে ভালোবেসে ফেললো। পথের ধারে না জানা জঙ্গলী ফুলকে হাতে তুলে নিল। ঠিক ছবির মতো শহরটা।
রজত বাবুই ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন স্যার রঞ্জিত বাবু এখানেই থাকেন। বাসে চাপার পর থেকে যদিও তার বুকটা ব্যাথায় চিনচিন করছিলো কিন্তু এই শহরের হাওয়া গায়ে লাগতেই খারাপ লাগাটা পাল্টে গেল।
তাই আপন মনেই বলে উঠলো ভাগ্যটা আমার উড়ন্ত ঘুড়ি হয়ে গেছে, হাওয়া লেগে কখনো নদীর ধারে কখনো ইটের ভাটায় কখনো ফুলওলা জমিনে আছরে পড়ে।

অটো থেকে নেমেই চোখ বুলিয়ে নিল অরুপ। হেটে আসতে হলো কিছুটা বাক্স-পেটরা নিয়ে ত্রিনাথ মন্দির অবদি। কার্ড ফোন থেকে ফোন দিতে হলো রঞ্জিত বাবু কে।
স্যার আমি তো এসে গেছি; ফোনের ওপারে হাসির আমেজ শোনা গেল।
-ওখানেই দাড়াও তুমি; আমি দয়মন্তিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ও তোমাকে জায়গা মতো পৌছে দেবে

রাস্তার একপাশে দাড়াতে চায়রি অরুপ কেমন দেখায়! ত্রিনাথের সিড়ি গোড়ায় দাড়িয়ে ছিল। পুব আকাশের দিবাকর ব্যাটা পশ্চিমের একপাশে হেলে পড়েছে তখন। পিনপতন নিরবতা হয়তো এখানে থাকার কথা কিন্তু তা নেই কদমের ফুলে ভরে গেছে গাছটা। সেটার চারপাশে ক’জুটি হাত পা ছড়িয়ে গুনগুন করছে; এ যেন আরেক দৃশ্যপট। যে ছবিগুলো না জানা কোন চিত্রকরের আঁকা তার সেই আঁকাটা ক্যালেন্ডারের পাতায় শোভা পেত। ন্যুড ক্যালেন্ডার দেখার মাঝে যেমন একটা অন্যরকম অনুভব আছে ঠিক তেমনি আছে যুগলবন্দী কদমগাছ ও কদম,ফুল দেখাতে।
মনটা তন্ময় হয়ে গিয়েছিল।
- হয়েছে কদম যুগল অনেক দেখেছেন, এবার আসুন ট্যাক্সি রাস্তায় দাড়িয়ে রয়েছে।
বালুচরি একটা শাড়ী পড়ে ফর্সা মতোন একটা মেয়েটা দাড়িয়ে। ওই বোধহয় দয়মন্তি !!
ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলো এর আগে একবার এই যানটিতে উঠার সুভাগ্য হয়েছিলো অরুপের এই নিয়ে দু’বার।
-কটায় বেড়িয়েছেন
- সাতটায়
- কিছু খেয়েছেন
- অত সকালে কিছু খেতে পারিনা।
- এসব ন্যাকামো এখানে টিকবে না, সব উঠে যাবে। বাবু কাবু হতে মাত্তর সাতদিন লাগবে। ভজহরি লাগাবে কড়াকড়ি।
- এই ভজহরিটা কে?
- আপনার পাশে পাশে থাকবে পিয়ন ও কেয়ারটেকার।
অরুপ এবার একটু সহজ হয়ে বসে বললো স্যার কি আপনাকেই পাঠালো আর কোন লোক ছিলোনা? দয়মন্তি একটু হেসে নিয়ে বললো কেন আমি কি দেখতে ব্যাঙ্গাচির মতো!! নাকি বোবা
- বোবা যদি আপনি হতেন তাহলে ঈশ্বরের পস্তাতে হতো যা মুখ আপনার!! তাছাড়া দেখতে খারাপ না হলেও তবে কাচালঙ্কার মতোই মনে হচ্ছে; এই সন্ধ্যেয় মেয়েছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তো তাই ভেবে কষ্ট লাগছে।
- অত ভেবে কাজ নেই এটা গ্রাম না এটা শহর। কষ্ট ‘কেষ্টর খাতায় তুলে রাখতে হয়’ আদিখ্যেতার কোন দাম নেই।
চুপ মেরে গেল অরুপ; দু’পা ফেলে জগৎ দেখা হয়নি তার। তাই ভাবনাটা আপাতত কম থাকলেই ভালো।


দুই.

ত্রিনাথ মন্দির থেকে দুই কিলো দুরে নিদডাঙ্গা। পাহাড়ী টিলার কাছে ওর স্কুল। একপাশে জলাভুমি পিছনে উচু পাহাড় আর দুপাশে সারি সারি বাড়ি; জোর বর্ষন হলে নিচের রাস্তায় পানি জমে যায়, চলাচল বন্ধ। স্কুলটা একটা টিলার উপর নেমে যাবার রাস্তাটা পুরোনে হলেও সুন্দর ফুলের চাদরে মোড়ানো। এখানকার ছাত্র-ছাত্রী মূলত খ্রীষ্ট বংশীয় কো এডুকেশন স্কুল।
তিন ক্লাসের স্কুল সিক্স টু এইট শ’তিনেক ছাত্রছাত্রী। স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষকই এই নগরীর তাই পাঁচটার আগেই বাড়ি ফেরে ওরা। অরুপ হেড পদেই যোগ দিয়েছে। স্কুলের পেছনেই দু’রুমের ছোট অর্ধপাকা দোচালা ঘর । থাকা খাওয়া ওখানেই সার্বক্ষনিক পিয়ন ও কেয়ারটেকার ভজহরি বাবু।
স্কুলের একমাত্র ড্রয়িং টিচার দয়মন্তি, রঞ্জিত বাবুর দুর সম্পর্কের ভাতিজি। কারো প্রতি ইন্টারেষ্টেড ভাবটা অরুপের নেই, সে ড্রিংক করেনা নস্যিও নেয়না কাজের বাইরে সবকিছুতেই তার উদাসীনতা। উদাসীনতার একটা কারণ দেখানো দরকার ভেবেই কেউ প্রশ্ন করলেই বলে দেয় আমি এমনটি হতে পারিনা। ভজহরি বলে ঠিক হয়ে যাবে লক্ষীর গুতো খেলেই।
বর্ষাবরনের অনুষ্ঠানে কজন টিপ্পনী কেটে বললো বিয়ে করছেন না কেন? বয়স তো গেল চলে;
-যাকনা এসব আমাকে দিয়ে হবেনা।
-অন্য কোন সমস্যা আছে কি?
দয়মন্তি পেছনেই ছিলো সশব্দে বলে উঠলো কদম তলায় অন্যের প্রেম করা দেখতো খারাপ লাগেনা বিয়ে করতেই আপত্তি !! ঢং!!
কত বয়স হলো? দিন কি শেষ হয়ে আসছে? এই জাতীয় প্রশ্ন অরুপের মাথায় আসে না; দিন কাটছে কাটুক না; অরুপের সাথে রঞ্জিত বাবুর প্রায়ই দেখা হয়। তা এবার তো বয়েস হলো; বিয়ে টিয়ে কিছু একটা করো অরুপ? মেয়ে দেখবো? আমি ছাড়া তো এখানে তোমার গার্জেয়ান কেই নেই।

দিন তো যাচ্ছেই কাটুক না ; অরুপের উদাসীনতা রঞ্জিতবাবুকে খানিকটা ভাবায় কিন্তু কি করবেন। প্রেম-ট্রেম কিছু করলে না হয় একটা কিছু হতো ! স্কুলের বাদ-বাকীরা কদ্দিন বলে ক্ষান্ত দিয়েছে।
পড়াগ্রামে না হয় ঝামেলা ছিলনা; পাথর হয়ে থাকা কোন সমস্যাই ছিলোনা। কিন্তু এইখানে একা থাকা বিস্তর সমস্যা। কারো বাড়ি বেড়াতে না গেলেও পার্টি জাতীয় কিছুতে একা যাওয়া বড়ই বেমানান।
কিন্তু কারো সাথে ওর এডজাষ্ট হওয়া অসম্ভব বলেই জানে, তাছাড়া বেশি ভাবতে জানেনা অরুপ ভালোবাসে প্রকৃতিকে; তাই নীরবতা যেন ওর নিরব সঙ্গী।
দয়মন্তির সাথে মাঝে-সাঝে গা-ছেড়া কথাবার্তা হয়; এ পর্যন্তই।
মাঝে মাঝে যদিবা কখনও একটু মায়া হয় কিন্তু দার্শনিক মার্কা কথাবার্তা আর আদিখ্যেতা সব ভন্ডুল করে দেয়। অরুপের কাছে এসে ওর আগোছালো জীবনটাকে গোছাতে ইচ্ছে করলেও তা আর করা হয়ে উঠেনা। এমন মানুষ গুলোকে কেউ একজন গাইড না করলে যতœ ছাড়া এমনি করে তালগাছের মতো বেড়ে উঠে তবে সেটা নিরসহীন। দয়মন্তি আড়চোখে ঠিক খেয়াল করে চলে অরুপে পথচলাকে এভাবে নিরব যন্ত্রনায় পুড়তে দেয়া যায়না।

এক মেঘলা আকাশের দিন স্কুল ছুটির পর বার্ষিক রেজাল্ট জমা দিতে এসে অনেকক্ষণ বসে থেকে শেষে অরুপের সাথে দেখা হলো। ততক্ষনে বৃষ্টি নেমে গেছে।
- ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠলো কোথায় গিয়েছিলেন?
- কোথায় আর যাব বলুন? তেমন তো জায়গা নেই?
- করে নিলেই তো হয়?
- আমাকে দিয়ে হবেনা
দয়মন্তি কিছু বলতে গিয়ে চেপে যায় তারপর রেজাল্টশীট গুলো জমা দিয়ে বললো তাহলে এ বেলা যাই। পরশু তো রেজাল্ট!!
- আচ্ছা যান
দয়মন্তি চলে যাচ্ছিল আবার ফিরে এলো
শুনুন !!
-বলুন
- এভাবে জীবন চলেনা। এভাবে জীবন কাটানো যায়না! কথা গুলো বলতে বলতে দয়মন্তি উঠে দাড়ালো বৃষ্টিধারা একটু থেমেছে কিন্তু আকাশের মুখ কালো হয়েই আছে। মনে হয়না আজ আর থামবে। ছাতা মেলে দরজায় পা বাড়ালো।
অরুপ বাবু তাহলে এবার যাই। সন্ধ্যে হয়ে এলো বলে।
ঠিক আছে তাহলে যান!
নাহ্ অরুপ বলবেনা বসে যান একটু কিংবা চা খান এককাপ,এসব ওর ধাচে নেই আছে খালি জ্ঞানগর্ভ কথা।
সিড়ি পেড়িয়ে চোখ কপালে উঠার মতো অবস্থা, নিচে তাকিয়ে আক্কেল গুড়–ম হয়ে গেল দয়মন্তির!! রাস্তায় থই থই পানি; স্রোত বইছে, নিচের পানাঢাকা পুকুরটা ডুবে গেছে। ফিরে এলো দরজার সামনে।

-এবেলা বাড়ি না গেলে পরে তো আর যেতে পারবেন না, অরুপ এই কথা বলতে বলতে সামনের জানালায় তাকালো, আরে রাস্তাতো ভরতি হয়ে যাচ্ছে পানিতে।
সর্বনাশ!! পানি বাড়ছে যে, ডুবতে হবে নাকি; মরন-টরনের ভয় নেই অরুপের। বিধিলিপি কি বদলানো যায়? চিন্তা এখন একটাই দয়মন্তি এখনো বাড়ি যেতে পারেনি!!
- অরুপ বাবু বাড়ি যাবো কি করে? এখন গেলে সাঁতরে যেতে হবে, আমি আবার সাঁতার জানিনা।
- হয়তো বোট নামবে; একটু পড়েই যেতে পারবেন
- এটা ম্যারিকা না যে দ্রুত সাহায্যের জন্য বোট নামবে; এটা মফস্বল এলাকা।
- হয়তো আপনাকে নিতে বাড়ি থেকে লোক আসবে।
- কি করে আসবে, সাঁতরে!! কাকাবাবু বড্ড বিশ্বাস নির্ভর লোক, সে জানে অরুপ বাবু তার খুব ভালো মানুষী বোকারাম ছাত্র। আর যাই হোক দ্রুপদীর বস্ত্র হরণ করার সাহস তার হবেনা।
দয়মন্তি কিছুক্ষণ বসে রইলো ; পানিতে গ্যাসের লাইন ডুবে গেছে, বাতিটাও হঠাৎ তাই নিভে গেল। মোম জ্বাললো অরুপ।
ভজহরি নেই এক সপ্তাহ বাড়ি গেছে। আজকাল তাই হাত পুড়িয়ে তাকেই রাঁধতে হচ্ছে। উপায় নেই, লক্ষী ছাড়া ঘর এলোমেলো হয়ে আছে,বিচ্ছিরি কান্ড!! দয়মন্তি ভেতরে এসো বসলো।
‘রান্নার আয়োজন করছেন নাকি’
- হ্যা, রাতের,কেরোসিন নেই। মোম ও শেষ হয়ে আসছে। আজ বোধহয় বাতি জ্বলবে না তাই রাত হবার আগেই রান্নাটা করতে হবে। তাছাড়া বৃষ্টি কমে এসেছে আপনাকের তো যেতে হবে!!
-তারাতে চাইছেন নাকি? বসে ছিল দয়মন্তি ছট করে উঠে দাড়ালো, ছাতা মেলে সোজা রাস্তায় তখনি আবার ঝুপ বৃষ্টি নামলো।
রান্নাঘরে চুলো জ্বালাতে গিয়ে চোখ জ্বলে উঠলো, অরুপের মনটা দু’ডানার চিল হয়ে গেল, নিচে যা পানি জমেছে। দয়মন্তি যেতে পারবে বলে তো মনে হয়না। অথচ কি করবে ও, এখানে রাখাও তো বিপদ !!

ছাতা হাতে নিয়ে নিচে নামলো। অন্ধাকার হয়ে গেছে চোখ তাই বেশি চলে না, চোখের জমিনে কিছুতেই চোখ পড়লো না দয়মন্তিকে, পানিতে ভেসে গেল কি ? রঞ্জিত বাবু কে কি বলবো?
কিছুটা সময় ভেবে-টেবে এসে ঘরে ঢুকতে যাবে ; দূরের বারান্দায় কে দাড়িয়ে? দয়মন্তি’ ভিজে শাড়ীতে হাতে ছাতা নেই, হাওয়ায় উড়ে গেছে।
- আসুন ঘরে আসুন?
- আপনি যান বৃষ্টি থামলে চলে যাবো।
- পানিতে পড়লে আপনাকে তো আর পাওয়া যাবেনা।
- সেও ভালো পাথরের গায়ে ফুল হতে হবে না।
- আসুন তো !
ঘরের ভেতর ঢুকে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে দয়মন্তি বললো , ভিজে কাপরে গায়ে জ্বর আনব নাকি একটা শুকনো কাপর দেয়া যাবে?
মেয়েদের কাপড় এখানে আসবে কোত্থোকে? আমি তো প্যান্ট-লুঙ্গি ছাড়া কিছু পড়ি না, -এবার তাহলে নিচে নামতে হয়!
- কেন?
- ও পাশের কারো বাড়ি থেকে শাড়ি নিয়ে আসি!
- কি বুদ্ধি বোকার!! বে-কার তালপাতা আর কি? লোক না জানালে হচ্ছেনা বুঝি? নিজের শুকনো কাপর দিন?
- আপনি এক মিনিট দাড়ান?
- দাড়িয়েই তো আছি এবার কি পটের মুর্তি হতে বলছেন?
অরুপ ছুটে গেল ভজহরির ঘরে ওর প্যাটরা খুলে কালোরঙ্গা একটা শাড়ি পেল; তাই নিয়ে এল।
ব্যাপার কি ঘরের ভেতর মেয়েছেলের শাড়ি; বলি কিছু-টিছু কেস্ আছে নাকি?
অরুপ মাথা চুলকে বলে আরে নাহ্, ভজহরির বউ কদ্দিন আগে যে এসছিলো, ফেলে গেছে আর কি?
শাড়ি চেঞ্জ করতে গেলাম, ভাষ্কর্য হয়েই এখানটায় থাকবেন যেন।
সিগারেট জ্বালালো অরুপ, ধোয়া ছাড়লো মুখ টিপে টিপে। দয়মন্তির গলায় যা ঝাজ। যাই হোক ‘এই সময় সিগারেট খাওয়া তার নেশা’।

খুব ভারি বর্ষণ হচ্ছে। দোচালা ঘরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেবে।
‘আমার দিকে চোখ তুলে একদম তাকাবেন না? শাড়ি না হয় পাল্টেছি কিন্তু ভেজা জামা, কি করবো? তাই আপাতত শাড়ি দিয়েই।
দয়মন্তি চুল ছেড়ে বিছানায় বসলো।
অরুপ রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বললো, জ্বর না বাধাঁতে চাইলে তোয়ালে জড়িয়ে নিতে পারেন? আবার ন্যাকামো থাকলে দরকার নেই; ওটা আমি ব্যাবহার করি কি-না।
- হয়েছে থাক লাগবেনা,এমনি চুল শুকাবে।
চুলা জ্বেলে রান্নার আয়োজন করলো অরুপ। বৃষ্টি আজ থামবে না,,ভেতর ঘরের আলো যে কখন নিভে গেছে বুঝতেই পারেনি ও উঠে দাড়াতেই ভয় লেগে গেল! ঘর আধার! দয়মন্তি কোথায়? -এই যে শুনছেন?
- হুম ! ভয় নেই! পেছনেই আছি। রান্না করুন।
- দেয়ালের ভুত হওয়া হচ্ছিল নাকি? দেয়াল সেটে দাড়িয়ে আছে দয়মন্তি।

তিন.
ওদের খাওয়ার পরপরই ঘরের সব আলো ফুরিয়ে এলো। একটা তেলের প্রদীপও নেই যে আজ জ্বালাবে। টর্চ নেই, ভরসা হলো দেশলাই, কাঠি আছে মাত্র পাঁচটা।
এখানে পানি খুব উতলা, এই টিলা ডুবে যেতে পারে পেছনের যে বর্ষণ হচ্ছে পাহাড়ে, পানির স্রোতে স্কুল সহ ভেসে যেতে কোন বাধাঁই লাগবে না।
দয়মন্তির মুখে এসব শুনে কিছুটা ঠান্ডা হয়ে গেছে অরুপ।
বিছানা একটা মেঝেতেই শুতে হবে তাকে।
নিন শুয়ে পড়–ন বলে মেঝেতে শুয়ে পড়লো ও। চুল বেঁধে দয়মন্তি খাটে শুয়ে পড়লো । প্রচন্ড রকমের বাজ পড়ছে ঘর কেপে উঠছে। বুকে দিদ্রিড়িম করে লাগছে দয়মন্তির। কেটে যাচ্ছে একটু একটু করে ভয়ানক প্রহর ভয় তাড়াতেই হয়তো দয়মন্তি বললো Ñ – কেন?
- কামড় দেব!
- কি বলেন?
- হুম!
অরুপ চুপ করে গেল।
‘ কি হলো হাত দেন? আমার ভয় করছে ! আপনার হাতটা ধরবো?
অরুপ হাতটা বাড়িয়ে দিল। শীতল হাত, উত্তাপ নেই; কেমন যেন সাপের মতো।
- মেঝেতে পানি জমে যাচ্ছে, দাড়িয়ে থাকতে হবে মনে হচ্ছে?
- তাই থাকুন, এখানে শোয়ার ধান্দা করা যাবেনা। শরীরে শরীর লাগলে ঘুম হয়না আমার।
এভাবেই কাটলো বেশ কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত দয়মন্তির পাশেই শুতে হলো অরুপকে। শর্ত একটাই গায়ে গা-লাগানো যাবেনা।
দয়মন্তি নীরবতা ভেঙ্গে বললো, আপনার হাত এতো ঠান্ডা কেন? হঠাৎ কোথাও বাজ পড়লো হাতটা শক্ত করে ধরলো পুনরায়। অরুপ ঠান্ডা হয়েই ছিল একটা ছোট্ট দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো, যার জীবনটাই ঠান্ডা হয়ে আছে, যার কোন উত্তাপ নেই, তার হাত তো ঠান্ডা হবেই।
- তো উত্তাপহীন ভাবে এখানে পড়ে আছেন কেন? আজ যা স্রোতের তান্ডব মরেও যেতে পারেন!
- না হয় গেলাম, কিন্তু এখানে থাকা ছাড়া যে আমার কোন উপায় নেই
- সত্যিই

ঘরের একপাশে পানি জমে গেছে। প্রচন্ড বর্ষন হচ্ছে। ঘর কাপানো বজ্র দানবের শব্দ।
- শুনছেন ওপাশটায় ফিরুন? ভয় করছে আমার ! দয়মন্তি তরল কন্ঠে বলে গেল। অরুপ উল্টো দিকে মুখ ফেরালো, পেছন থেকে দয়মন্তি ওকে ধরলো । আবারও প্রচন্ড কাপুনি দিয়ে কাছে কোথাও বজ্রপাত হলো। মনো হলো পুরো ঘরটা যেন দুলে উঠলো।
মিনিট দশেক এভাবেই থেকে আস্তে আস্তে করে নিজেকে সড়িয়ে নিল দয়মন্তি, তারপর বললো আসলেই তুমি অন্যরকম একটা ভালো মানুষ এই উত্তাপেও এভাবে উপেক্ষা করলে……….।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো অরুপ
-এমন ঠান্ডা হয়ে থাকলে কিভাবে একটুও উত্তাপ জাগলো না? নাকি সকাল হবার আগেই মারা পড়তে পারে এই ভয়ে!

দীর্ঘ রাতটা যে কখন দীর্ঘ থেকে স্বল্পতায় নেমে এলো ঘুম ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত অরুপ বুঝতেই পারলো না, চোখ ফেলা যায়না, দয়মন্তির বুকের কাপর সরে গেছে; শরীরে শিরশির উঠে আসবার আগেই ঘর ছেড়ে বাইরে চলে এল।
চারপাশটাকে যেন কোন দানব এসে তছনছ করে দিয়ে গেছে। পানি নেমে আসছে আস্তে আস্তে। এ যাত্রায় বেচেঁ গেল। সত্যিই পাশে একজন কেউ থাকা প্রয়োজন নয়তো বেচেঁ থাকাটা কষ্টের হয়ে দাড়ায় !! একা এ ঝড়ের রাত পাড়ি দেয়া হয়তো হতোইনা , হয়তো স্রোতে ভেসে যেতে হতো।

দৌড়ে ঘরে ছুটে এলো অরুপ। বিছানায় দয়মন্তি তখনও ঘুমুচ্ছে।
ওর মুখের উপর ঝুকে বললো, এই মেয়ে আমার ঘরের ঘরনী হবে?
হঠাৎ কানের কাছে কথা শুনে হকচকিয়ে তাকালো দয়মন্তি। অরুপ বললো তুমি বধূ হবে?
‘ঠোট টিপে হাসলো ঘুমচোখ নিয়ে’ তারপর বললো কার ঘরনী হব? তোমার?
- তোমার মতো পাথরকে করবো বিয়ে?
- পাথরের জীবনটা তুমিই সাজাতে পারবে?
- পারবো না!!
- পারতে তোমাকে হবেই

সূর্যের উত্তাপ গগন ছড়াবার আগেই অরুপের চোখ জোড়া ঝাপিয়ে পড়লো ওর চোখে।<img

গল্পঃ * * অ পূ র্ন * * ১ম পর্ব

 

গল্পঃ * * অ পূ র্ন * * ১ম পর্ব



০১.
প্লাটফর্ম থেকে চোখ ঘুড়িয়ে এনে সামনে তাকাতেই দেখি একটা তরুনী মেয়ে সিটে ব্যাগ রেখে সবে দাড়িয়েছে।
হাত পাখা ও একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল সহ।
ট্রেন কামরার ফ্যান গুলো ঘুড়ছে না। জানিনা কেন বন্ধ হয়ে আছে। নোনা ঘাম গুলো গড়িয়ে পড়ে ঘাড়ের পাশটা হয়ে শার্ট ভিজছে আমার।
কিচ্ছু করার নেই। হাত পাখাটা আনতে ভূলে গেছি সাথে পকেট টিস্যুও নেই। শার্ট ভিজছে আমার।
হাত পাখাটার দিকে নজর পড়তেই; “একটু পাখাটা দেবেন এই নামক শব্দের অনুভূতিটা উকি দিচ্ছে”বারংবার।
বোধ করি আমার চোখে চোখ পড়তেই সেটা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে সে।
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। এই গরমে হাত পাখাটা হাত করার ধান্দাটা মাথা থেকে নড়ছে না। কি,করে যে বলি। ও দিকে মেয়েটা ততক্ষণে বসে গেছে সিটে।

ট্রেন আজ দু’ঘন্টা লেট। ন’টার জায়গায় এগারোটায় ছাড়ছে। ভীড় নেই বললেই চলে। মাত্র চল্লিশ মিনিটের পথ। ময়মনসিংহ যাবো। বিশেষ কোন কাজ নেই এমনি; সাথে ছোট্ট একটা ব্যাগ ছাড়া কিছুই নেই। কালকেই আবার ফেরত আসবো।
তরুনীটিও সাথে তেমন কিছু নিয়ে বসেনি, শুধু একটা ব্যাগ ছাড়া। দেখে মনে হয় না দূর যাত্রায় যাবে।
আমার চোখ তাকে দেখছে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। নীল কালো রঙ্গের ডোরাকাটা শাড়িতে সাদাপাড়। মুখে বয়সের ছাপ সবে পড়তে শুরু করেছে। খুব সুন্দর না হলেও মুখমন্ডলে সুন্দর্যের আকারটা কিন্তু বেশ। বুদ্ধিমত্তার একটা ছাপ আছে মুখে। কপালে টিপ নেই থাকলে ভালো লাগতো। মুখে তার ছোট্ট একটা অতৃপ্তি কাজ করছে। আমার চোখ দেখতে দেখতে; মেয়েটা হাত পাখা নিয়ে দোলাতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে।
হাতপাখার আশা ছেড়ে জানালাটা খুলবো ভাবতেই দেখি মেয়েটা পাশেই হাতপাখা রেখে জানালার শার্শি ধরে টানছে,এই সুযোগে হাত পাখাটা নিলাম। জানালা খোলা হলেও বাতাস কিন্তু আসছে না। বাইরের আকাশটা ঘুমোট ভাব ধরেছে আজ রোদ নেই, মেঘ নেই কিন্তু ভ্যাপসা গরম লাগছে।
মেয়েটা কিছু বলার আগেই আমিই বলে বসলাম কিছু মনে করবেন না। আপনার হাতপাখাটা একটু নিয়েছি; যা গরম পড়েছে না। শরীরটা তো জ্বলছে মরিচের মতো। বাতাস তো উত্তর বঙ্গে চলে গেছে সব তাই পাখা দোলানো আর কি।
ঠিক বলেছেন বেশ গরম আজ, বলে মেয়েটা ঠোট টিপে বললো কোথায় যাবেন ময়মনসিংহ। আমি বললাম হ্যাঁ আপনি? আমিও যাবো। বেশ তাহলে তো ভালই হলো।
মেয়েটি বসতে বসতে বললো আপনি থাকেন কোথায়?
-উইল কিংসন রোড।
-মাধবী লতা বিল্ডিং এর কোন পাশে।
- দক্ষিনে, চিনেন দেখছি আপনি কোথায় থাকেন?
-রিভার ষ্ট্রিট; আমি এখানে খুব কম থাকি; একাদশ পাশ করবার পর এখন কলকাতার নাগরিক হয়ে আছি।
- তাই তো চিনতে পারিনি।
নাম জানতে চাইলাম বললো শ্যামা সে অবশ্য আমার নাম জানতে চাইলো না। আমি অবাক হলাম না। এমনটি হয়। হতে হয় কখনো কখনো। কথা আর এগোলো না। আজকাল আমিই কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি।
হাতপাখার বাতাসে খানিকটা শীতলতা পেলেও গরম কিন্তু গেলো না। ভদ্রতা বশত মিনিট পাচেঁক পড়েই ফিরিয়ে দিলাম হাতপাখা।

ট্রেন চলছে মাঝারি স্পিডে, ব্যাগ খুলে পত্রিকা বের করলাম। একসাইড ভাজ করে হাতপাখার আকার করে দোলাতে লাগলাম গরম কাটছে না।
শ্যামা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো আজকের পেপারটার এ,কি হাল করছেন?
না আজকের না এটা, কালকের বাসি পেপার।
একটু দিন তো পড়ি। হাতপাখাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে পেপার নিয়ে নিলো। যা হোক ভালোই হলো বলে দোলাতে লাগলাম।
একটা ষ্টেশনে এসে থামলো ট্রেনটা আমি নামতে গেলাম কিন্তু মাথাটা আবার মনে করিয়ে দিলো পানির বোতল তো আছে পাশের জনের কাছে। নিচে গিয়ে কি হবে।
একটু পানি খেতে পারি? নিচে আর নামতে হলো না।
বেশ চঁটপটে মনে হলো মেয়েটাকে। পানির বোতল দিলো কুন্ঠা বিহীন ভাবে। এই না হলে মানুষের জন্য মানুষ।

০২.
শ্যামা এক মনে পত্রিকা পড়েই চলেছে। আমি দুলিয়ে দুলিয়ে বাতাস করছি । ঝিমুনি আসছে আমার। তন্দ্রামতন একটা ভাব তার কারণ কাল সারারাত ঘুমুতে পারিনি। আর ঘুমুতে না পারার একটা কারন হলো। রাতে পেপারে একটা গল্প পড়ে মনের ভেতর খচখচানি শুরু হয়ে গেছে। গল্পটার ভেতরের চরিত্রটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছিলো। কিন্তু চিনতে না পারার যন্ত্রণাটা আবার আমাকে কুড়েঁ কুড়েঁ খাচ্ছিল। যে গল্প গুলো মাথায় ঢুকে যায় তা নিয়ে আমার অস্বস্থি বাড়ে ধীরে ধীরে যখন কিছুতেই এর সুরাহা না করতে পারি। আমি খুব বেশি পরিমানে ভাবতে পারি অকারনেই আকাশ থেকে কাঠরোদ্দুরে মেঘ নামায় আমার চিন্তা’রা। তাই কাল যখন পড়েছি অর্ধেকটা তখন বুঝেছি গল্পের শেষ পরিনতি করুন হবে আর সেটা পড়লে ভাবাভাবি টা আমার কদ্দিনের জন্য পাঁকা হয়ে দাড়বে।
কিন্তু না পড়ার কারনে কিছুতেই ঘুম আসেনি। রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সকালে ময়মনসিংহ চলে যাবে বন্ধুদের সাথে কথা বললে হয়তো বিষয়টা ভুলে যেতে পারবো। তাই এই সকালে ট্রেনে। কিন্তু বুঝতে পারছি গল্পটা মাথা থেকে যাবেনা।
যখন এসব ভাবছি তখনি পাশে বসে থাকা শ্যামার একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেয়ে তাকালাম। এ,কি মেয়েটা কাঁদছে সোজা হয়ে বসলাম।
কি হয়েছে আপনার কাদঁছেন যে চোখে কিছু পড়েছি কি?
না এমনি বলে কিছু একটা চাপা দিতে চাইলো । ভবলাম বাড়ি থেকে এসেছে মা’র কথা মনে পড়েছে বোধহয়। কিন্তু ও তো পেপার পড়ছিলো। তাছাড়া আজকাল কাদাঁকাটির পাট চুকিয়ে আসছে ধীরে ধীরে তবে কি !!
তবে কি !! সেই গল্পটা পড়ে ফেলেছে;
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম কাঁদছেন যে, ও কিছু বলবো মুখটা উপরে তোললো
কোন রকম ভনিতা না করে দু’ হাতে চোখ মুছতে মুছতে বললো একটা গল্প পড়ে কাদঁছি। আমি এবার অবাক হলাম না।
বুঝলাম আমার সিমপ্যাথিটা ওকেও পেয়েছে ।
গল্পটা শেষ করেছেন নাকি? শ্যামা মাথা নেড়ে বললো হ্যাঁ আর তাইতো চোখের পানিটা ধরে রাখতে পারিনি। আমি বললাম সত্যিই গল্পটা বেশ করুন কাল সারারাত ঘুমুতে পারিনি এ জন্য। কিন্তু সত্যি বলতে কি জানেন আমি গল্পটা শেষ করতে পারিনি কষ্ট লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো একটা কাচের টুকরো বুঝি এ পাশ দিয়ে ঢুকে ভেঙ্গেচুরে ও পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন কষ্টটা ঝাপটে ধরা আতংকের মতো। আমাকে সারারাত গল্পটা ধরে রেখেছে। যেটুকু পড়েছি; তার বাকীটুকু পড়লে আমিও নির্ঘাত কেঁদে ফেলবো। তাই পড়বার সাহস পাইনি। কিন্তু গল্পটা মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারিনি সারারাত। আমার মুখের কথা সরতেই দেখলাম শ্যামা হাফ ছাড়লো একটা। উঠে দাড়িয়ে চুলের ক্লিপ খুলে দিয়ে চুল গুলো ছেড়ে বসলো। চুলটা বেশ লম্বা তবে তাতে একটা রুক্ষ ভাব রয়েছে। কালোর ভেতর হালকা লালচে লাগছে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে শ্যামা আবার মুখ খুললো। গল্পটা পড়ে যতখানি কষ্ট লেগেছে তারচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছে গল্পের লেখকটার জন্য কেননা এটা তার নিজের গল্প কিনা।
আমি কিছুটা অবাক হলাম। আপনি কি করে জানলেন চেনেন নাকি?
শ্যমা চুপ হয়ে গেল কিছু বললো না।
আমি আবার বললাম এই লেখকের গল্প আমি প্রায়ই পড়ি পেপারে মাঝে মাঝে কিছু লিটল ম্যাগে। একটা ছোট আকর্ষণ রেখে গল্প গুলো শেষ করেন তিনি। তিনি সহজ ভাবে বেশ লিখতে পারেন। আর সবচেয়ে মজার বিষয় তার বেশ কিছু চরিত্রে মাঝে মাঝে নিজেকে আবিস্কার করি। লেখকের ঠিকানা পাইনি নয়তো জিজ্ঞেস করতাম। আমি থামলাম।
শ্যামা পত্রিকাটা আমার হাতে দিয়ে বলতে লাগলো এই লেখক আড়ালে এক ভিন্ন মানুষ। আপনাকে একটা গল্প বলি তাহলেই বুঝতে পারবেন। পত্রিকা ভাজ করে হাটুর উপর রেখে নড়েচড়ে বসলাম। গল্পটাতে মজা লাগতে শুরু করেছে মাত্র। রোদ হঠাৎ করে মরে গিয়ে হাওয়া আসতে শুরু করেছে মাত্র। হাওয়া চুল উড়িয়ে এনে ফেলছে হাতে। একটু হাত পাখাটা দেবেন?
আমি ফিরে চাইলাম। দিলাম। হাত পাখাটা ভাজ করে ব্যাগে রাখলো। শাড়ীর আচঁল টেনে সামনে এনে বসলো। যে ষ্টেশনে আছি এখন; সেখানে ভালো চা পাওয়া দুস্কর ওরা গরম পানিকেই চা বলে তাও আবার চিনি কম পানশে মার্কা।
ব্যাগটার উপর পত্রিকাটি রেখে জানালার দিকে তাকিয়ে বললো এবার শুরু করা যাক। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মাথানেড়ে বললাম হ্যাঁ শুরু করুন।
-আপনি কি আমাকে বাচাল টাইপের কিছু ভাবছেন জানা নেই শোনা নেই গল্প বলতে শুরু করে দিলাম।
-না , এরকম ভাববো কেন ? আজকাল ভাবাভাবি খুব একটা কেউ করেনা। আপনি বলে যান দ্বিধাহীন ভাবে। আমি শুনবো। আর তাছাড়া গল্পটা তো গল্প থেকেই শুরু হচ্ছে
- ঠিক আছে কথাটা ভালো লাগলো।

০৩.
বছর পাচেঁক আগে ইউ এন্ড আই রেস্তোরার পাশে যে বুক হাউসটা দেখেছেন সেখানে একজন হকার নিত্য বাক্স ফেলে পেপার বিক্রি করতো ঠিক তারই পাশে এখন যেখানে বিউটি পার্লারটা আছে সেখানে একটা তেলেভাজার দোকান ছিলো ও লোকটা কিন্তু আবার বাক্সে ভরে আইসক্রিম বিক্রি করতো। আমাদের নগরে যে ভালো আইসক্রিমের দোকান নেই এটা নিশ্চই আপনাকে বলতে হবেনা। আমি খানিকটা মাথা দুলিয়ে বললাম হ্যাঁ আপনি থামবেন না। বলতে থাকুন।
শ্যামা আচঁলটা ধরে নিয়ে আবার শুরু করলো।

চলবে………………………………………

গল্প : চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয়

 

গল্প : চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয়




(এক)
যদি পারতাম বন্দি করে রাখতে সেই সব দিনগুলোকে তাহলে হয়তো তাই করতাম।
আমার হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলো আজকাল আমাকে বড্ড ডাকে; সেই ডাকার ধরনটাও অদ্ভুত। মাঝ রাতে ঘুমুতে যাই দুচোখ ছাপিয়ে ঘুমও আসে; ভাবি এই বুঝি জ্ঞানশূন্য সাগরে ডুবে গেলাম, কিন্তু না; তা আর হয়না। চোখের পাতার ঘোর অমাবস্যার যে আধার; তাতে আচমকা ভেসে উঠে পোড়া মুখীর মুখটা, হতচ্ছাড়ি জ্বালিয়ে রেখেছে আমায় শেষ প্রদীপের সলতের মতো। আমি টিপ-টিপ করে জ্বলছি।
জানিনা আর কত রাত এভাবে ঘুম শূণ্য করে রাখবে আমাকে। ওর হাসির শব্দে মনে হয় চারপাশটায় কলরব উঠে যায়। মাঝ রাতের আধারে আমায় ডাকে; কান্ত এই কান্ত এসোনা……. মাঝ রাত্তিরে কানামাছি খেলি।
কিছুতেই আমার কানামাছি খেলা হয় না; সেই সাথে ঘুমের সাগর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বিতৃষ্ণা এসে ঠেকে জিবের ডগায়।
মাঝ রাতে বাইরে যে বেরুব সে উপায় টুকু পর্যন্ত নেই; র‌্যাকের পাশে পাহারাদার বসে আছে। এই অভাবনীয় ভয়ের রাতে আমাকে সঙ্গ দেয়। এমনটা হতো না; কিন্তু সেদিনের পর থেকে রিস্ক নেয়া যায় না;সেটুকু ভেবেই এই ব্যবস্থা।
আমার চিন্তা কিংবা চেতনার মাঝে অশরীরী কারও উপস্থিতিটা শুধু আমিই জানতাম; কিন্তু সেটা যখন দেয়াল থেকে বাগান ঘুড়ে কারো ঘরের আঙ্গিনায় গিয়ে দাড়াতে শিখলো; ঠিক তখনই সবাই আমাকে ঘিরে চোখ গোল করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলো; আর সেই সাথে সাতসতেরো থেকে সাতপাঁচ বারোর গ্যাঁড়াকলে আমার দৈনন্দিন জীবন ভাজা হতে লাগলো।
এমনও হয় যে আমি খেতে যাবো কিন্তু ঘোর লাগা টোপে বসে রয়েছি; কিংবা কিছুটা আনমনা; এই রকম হলেই চারপাশ থেকে কথা ছুটে আসতো; এই কান্ত তোর হয়েছেটা কি; বল দেখি ?
-কান্ত’র আর কি হবে !! প্রেমে-ট্রেমে পড়েছে বোধহয়;
-তোমাদের যা-কথা; কান্ত পড়বে কারো প্রেমে; ওর মতো এমন রসহীন ঘাস কি কারো সবুজ বনের অবুঝ সাথী হতে পারে ?
এইরকম প্রশ্ন গুলো আমাকে বিদ্ধ করতে করতে ওদের কথার ফলা আজকাল ভোতা হয়ে গেছে। তরে ওরা ক্ষান্ত হয়নি; নতুন করে শুরু করে, আর ভেতরের টিপ টিপ করে বয়ে চলা বর্ষণ টাকে ঝড়ের আকারে ধারণ করাতে চায়; কিন্তু আমি এত সহজে সেই ঝড়কে আহবান করতে চাইনা।
বর্ষা শেষের এক রাতে আমি যে কাণ্ডটা করলাম তাতে ওরা শংকিত হয়ে গেলো; আমাকে কিছুতেই একা থাকতে দেবেনা। আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হলো; তুমি কেন এমন করছো ?

(দুই)
আর একপা বাড়ালে হয়তো দেখতে আর হতো না আমাকে; আমি বট তলার শ্মশান ঘাটের যাত্রী হয়ে যেতাম। নিশুতি রাতে ঘুম সাগরে হতচ্ছাড়ি সুশি এসে আমাকে খুব করে ডেকে, হাত ধরে ছাদের উপরে নিয়ে এসে যে কাণ্ডটা ঘটালো তাতে লোক মুখের রহস্য কাহিনীর চরিত্র হয়ে গেলাম আমি।
অদৃশ্য সুশি হঠাৎ দৃশ্যমান হয়ে ছাদের উপর দুহাত তুলে ডেকে বললো কান্ত ভালবাসা কত লম্বা হতে পারে তা জানো তুমি ?
আমার সেই রসহীন উত্তর ;জানবো কি করে, কখনো মাপিনি তো !!
ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো; মাপ নি বেশ করেছ; এবার ছাদের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়; যত দূরে গিয়ে পড়বে আমি বুঝে নেব ততখানি লম্বা তোমার ভালোবাসা !!
আমি ঝাপ দিতে গেলাম; ভালবাসার দুরত্ব দেখাতে……………
সেদিন মরেই যেতাম; কিন্তু পেছন থেকে রন্তু এসে ধরে ফেললো আমায়; তাই বেঁচে গেলাম। দেখাতে পারলাম না আসলে কতখানি ভালবাসতাম সুশি কে।

আজ মাসের পাঁচ তারিখ। আর্ট গ্যালারিতে আমার ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে; পুরো হল রুম জুড়ে মানুষের সমাগম; আমি গ্যালারির একপাশে চুপচাপ দাড়িয়ে; রন্তু এসে বললো কান্ত দা একজন তোমার ছবি কিনতে এসেছে।
আমি তখন কিছু একটা ভাবছিলাম; একটু আনমনা ছিলাম তাই নিষেধ করে বলতে ভুলে গেলাম যে, বলে দাও ছবি বিক্রি হবেনা।
নিচে গেলাম; যিনি নিতে এসেছেন তাকে তাড়িয়ে দেব এই ভেবে।
জলরঙ্গে আঁকা পেইন্টিং টার নাম “উদোম” যিনি কিনতে এসেছেন তাকে দেখে কিছুটা অবাক হলাম;কেননা তার বয়স চব্বিশ ছাড়িয়ে যায়নি; মনে হয় নতুন শাড়ি পড়া শিখেছে; আঁচল টানতে জানেনা। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা নেই কিন্তু দেখে আন্দাজ করা গেল চোখে লসিক করা। আমি কাছে গিয়ে দাড়ানোর পর তিনি বিস্ময় মাখা চোখে বললেন আপনিই কি ছবিটা একেছেন ?
আমি বললাম হ্যা। তার চোখ আর ঠোট উল্টানো দেখে বোঝা গেল তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না;
বললেন ভেবেছিলাম বয়স্ক গোছের লোক হবে কিন্তু এতো তরুন ভাবিনি; যাই হোক কত দাম চাইছেন ?
-সতের হাজার পাঁচশো তের টাকা।
-আমি সতের হাজার টাকা দিচ্ছি;
-না ,হবেনা; টাকা পুরোটাই দিতে হবে।
-কিছু কম রাখুন !!
-আমি পারছিনা।
মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো না; ব্যাগের ভেতর টাকা খুজলো; তারপর টাকাটা আমার সামনে মেলে ধরে বললো; এই নিন পুরোটাই আছে !!
আমি গুনে দেখলাম আট টাকা বেশি আছে; ফেরত দিতে চাইলাম কিন্তু পকেটে ভাংতি নেই;
-রেখে দিন পড়ে নিয়ে নেব;
-পড়ে আমাকে পাবেন কোথায় ?
-পেয়ে যাবো পৃথিবীটা খুব বড় নয়; চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয়; বাকী থাকে শুধু মনের ইচ্ছেটা; ইচ্ছেটা যদি থাকে তো পুনরায় দেখা হয়।
আমি বললাম সহজ ভাবে বলুন; কাব্যিকতা পছন্দ করিনা। মেয়েটা হাসলো অদ্ভুত ওর দাঁতগুলো খুব সাদা।
মেয়েটার চলে যাওয়া দেখলাম; খানিক বাদে ভুলেও গেলাম। কিন্তু ওর রেখে যাওয়া কথাটা মুছে দিতে পারলাম না মন থেকে; “পৃথিবীটা খুব বড় নয় চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয়; বাকী থাকে শুধু মনের ইচ্ছেটা; ইচ্ছেটা যদি থাকে তো পুনরায় দেখা হয়”
এই কথাটা আমাকে কেউ একজন এর আগে বলেছিল;
কে বলেছিল ? কেন বলেছিল; মনে করতে পারছিনা।

(তিন)
ভরদুপুরে ক্যামেরা কাধে বাসায় ফিরছি। রাস্তায় হন্যে হয়ে কিছুক্ষণ হেঁটেছি। একটা অটো কিংবা সি.এন.জি. কোনটাই পাইনি; দুপুর রোদে তৃষ্ণায় বুক জ্বলছে কি-করি;
সাউথ হিলসের কাছে আসতেই ফুলের দোকানের পাশেই একটা সি.এন.জি পেয়ে গেলাম। কাছে ঘেঁষতেই ড্রাইভার বলে উঠলো বাবু রিজার্ভ আছে যাওয়া যাবে না। আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললাম ক’জন নিয়ে যাবেন; ড্রাইভার বলল মানুষ একজন আর কিছু ফুল।
- তাহলে তো যাওয়াই যায়।
- না বাবু উনি আমাকে বলেই নিয়েছেন আগে;
- কোথায় উনি
- ওই তো ভেতরে ফুল কিনছে।
আমি বাইরে দাঁড়ালাম দেখি কে সে; আর যাওয়া যায় কি না।
এক তোড়া ফুল নিয়ে চোখে পড়ার মতন একটা মেয়ে সি.এন.জি তে উঠে বসলো। রোদের তাপে মাথা তখন আমার আই-টাই করছে। সাত চৌদ্দ না ভেবে গিয়ে বললাম যদি কিছু মনে না করেন, আমি কি; সি.এন.জি তে আপনার পাশে কিছুটা সময় যেতে পারি; এ রোদের দুপুরে সব খা খা করছে বাড়ি যেতে হবে তারাতারি।
মেয়েটি চোখ কঠিন করে বলল না যেতে পারেন না; আমি তো রিজার্ভ নিয়েছি;
-যেতে পারিনা বলে কি !! মুখের উপর না বলাতে আমার একটু খারাপ লাগল।
সি.এন.জি স্ট্রাট নিয়ে চলে গেল। কিছু মেয়েরা যে বড্ড বাজে রকমের মেজাজী হয় সেটা জানা ছিলোনা; আজ জানলাম।
রোদমাখা পথে পা রাখলাম; সকাল থেকে মেঘালয়ের পাহাড় ধরে দু’টো প্রজেক্টের কাজ শেষ করেছি। আজ বাইকটাও আনিনি সাড়াতে হবে তাই; কে জানতো ভর দুপুরে এমন হবে।
পকেট থেকে দেশলাইটা হাতে নিলাম, সিগারেট বের করতে যাবো অমনি সি.এন.জি র আওয়াজ।
আরেকটা সি.এন.জি এলো বোধহয় ;
-এই যে আসুন;
পেছন তাকাতেই দেখি সেই মেয়ে।
কি ভাগ্য আমার !!
সিগারেট পকেটে ফেলেই উঠে গেলাম। আমাকে না নিয়েই চলে গিয়েছিলেন আবার যে এলেন;
- একটু যেতেই মনে হলো এই দুপুরে আপনার কষ্ট হচ্ছে তাই নিতে এলাম; তবে কথা বলা চলবে না কিন্তু।
আমি চুপচাপ বসে গেলাম। সি.এন.জি চলছে মাঝারি স্পিডে পাহাড়ী পথে। মেয়েটার দু’পাশে অনেক ফুল আর ফুলের তোড়া; অনেকটা ফুলের বনে পরি’র মতো লাগছে ওকে। ভালো করে তাকাতে গিয়ে চোখে চোখ পড়ে গেল মাথা নিচু করে গেলাম।
আমার সিগারেট খাওয়া দরকার কিন্তু ওনি যদি বিরক্তি বোধ করে। এই জাতীয় মেয়েদের তো সিগারেটের গন্ধ্যে অ্যালার্জি থাকে। বাধ্য হয়ে ড্রাইভারের কাছে দেশলাই চাইলাম এইবার মেয়েটা মুখ খুললো;
-না জনাব এখন সিগারেট খাওয়া চলবে না; ওটার গন্ধ সহ্য হয় না আমার।
কি আর করা; থাকলাম ভজু হয়ে। কিন্তু সিগারেট যে আমায় খেতেই হবে ও নেশা বড্ড বাজে।
আধঘণ্টা কেটে যেতেই আমি লজ্জাকে চুপসে যওয়া টিস্যুর মতো রাস্তায় ফেলে দিয়ে সিগারেট জালিয়ে নিলাম।
-আপনি তো বড্ড বাজে লোক, না বলা স্বত্তেও কাজটা করলেন। আপনি নামুন তো।
আমি হাসলাম; মেয়েটা ততক্ষণে রেগে গেছে, মুখটা ভবানির মতো লাগছে। এই দুপুরে নেমে গেলে আমি রোদে পোড়া নিগ্রো হয়ে যাবো। মেয়েটা ভ্র-কুচকালো তারপর বললো; হলে হবেন; আরেকটা নিগার খুজে পেতে কষ্ট হবেনা আপনার। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল; মুখ ভর্তি ধোয়া ছেড়ে দিলাম। দু’মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটার ভাব বদলালো।
- এবার ফেলুন;
সিগারেট আধ খাওয়ায় হয়নি ততক্ষণে; আমি ছুড়ে ফেলে দিলাম।

দু’পাশে পাহাড় ছাড়া আর কিছু নেই। দুরের মাঠে আজকাল রাখালও দেখা যায় না। গরু আপনা আপনি চড়ছে। ছেলেরা ঘুরি আর উড়ায় না; এ পথে কোম্পানি বসে গেছে, পাহাড়ের সাদামাটি কেটে তৈজসপত্র বানায়। আমি সাদা মাটির পাহাড়ের দিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে ছিলাম; তাকিয়ে থাকা মনে মাঝে মাঝে কল্পনার অ্যানিমেশন শুরু হয়ে যায়।
আনমনা থেকে সৎবিত ফিরে পেলাম যখন দেখলাম সি.এন.জি থেমে আছে।
অসহ্য গরম !! কাঠ রূপালী রোদ্দুর রাস্তা আর বনাঞ্চল জুড়ে।
মেয়েটা বসে থেকে ঘেমে গিয়ে নেমে গেল সাথে পা ফেললাম আমিও।
গ্যাস নেবে বলেই থেমেছে সি.এন.জি।
শাড়ির আঁচল ভাজ করতে করতে ও বলল রোদ আজ কড়কড়ে।
- তাই মনে হচ্ছে
- রোদের ছেলে কে জানেন? কাব্যিক প্রশ্ন!! অমন রাগী মেয়ে আবার কবিতা জানে নাকি ?
-মুখ ঝাঁকিয়ে বললাম জানি না।
- রোদের ছেলে হলো পড়ন্ত বিকেল।
- তাই নাকি !!
- মনে হচ্ছে রোদের মা ক্ষেপেছে আজ। শরীর থেকে সব বেরিয়ে যাচ্ছে।
- মেয়েটি এবার আঁচল ছেড়ে দিয়ে হাতের কঙ্কন ঘুড়াতে ঘুড়াতে বলল, আপনার কোনটা ভাল লাগে রোদ না বৃষ্টি। আমি মিথ্যে করে বললাম আমার রোদ ভাল লাগে।
- মেয়েটি বলল কেন ?
- রোদ না এলে সব কিছুতে গুমোট থেকে যায়। আর আধারটাকে ভালো লাগেনা বলেই তো রোদটাকে প্রিয় ভাবি।
- ও তাই; কাব্যিক সংলাপ।
- আপনিও কিন্তু কম না; রোদের যে ছেলে আছে সেটা তো জানতাম না। আজ শুনলাম।
- তাই নাকি; ওই যে দূর পাহাড়ের ঝরনা দেখছেন বলতে পারেন ওই ঝর্ণার প্রিয় বন্ধু কোনটা ?
- প্রিয় বন্ধু যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে স্রোতকে;
- নাহ্ ঝর্ণার প্রিয় বন্ধু প্রকৃতি। প্রকৃতির কোলে ঝরনার সৌন্দর্যই সেরা।
- হু বুঝলাম; আপনি কাব্যিক করে বলেন বলে ভালো লাগলো; নয়তো এগুলো আতলামু।
- তাই; তবে আপনি হলেন একটা ট্যা-ট্যা টাইপের লোক; বানিয়ে একটা মিথ্যে বললেন আমার সাথে।
আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে বুঝলেন ?
আর কোন কথা হলোনা ; সি, এন জি ততক্ষণে ষ্টার্ট নিয়েছে।
বাড়ি ফিরবার পথে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম এত বড় উপকার করলেন; আপনার নামটা তো জানা হলোনা।
ও বললো হাজার লোকের ভীড়ে কতজনকেই আর মনে রাখতে পারি বলুন; তাছাড়া আমাকে মনে না থাকলে কোন দোষ হবে না তাতে।
দোষ হবেনা জানি কিন্তু উপকারটা ফেরত দিতাম আরকি ?


(চার)

সুশির সাথে দ্বিতীয় বার দেখার তারিখটা আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিনা তবে এটুকু মনে আছে; গারো বাজারের শিবতলার পথে এক ভিখেরির থালায় পয়সা দেব বলে পকেট হাতড়াচ্ছিলাম; আচমকা ও পেছন থেকে ভিক্ষে থালায় পয়সা দিয়ে বলেছিলো; দরাজ দিলের একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে; দরাজ দিল না হলে ভিক্ষের পয়সাও পকেটে থাকেনা।
রিকসা করে যাচ্ছিল সেদিন; তাই আর ধরতে পারিনি ।
মেয়েটির নাম যে সুষ্মিতা বিনতে সুশি সেটা প্রজেক্ট ম্যানেজারের কাছেই প্রথম জানতে পাই। নীল লেকের ফটোসেশনের মিশনেই তৃতীয়বারের মতো ওর সাথে দেখা হয় আমার। সেদিন একটা বালুচরি শাড়ী পড়ে এসেছিলো; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে বাচ্চাদের ডাটা এন্ট্রি লিখছিল। আমি সামনে গিয়ে হ্যালো বলার পর ও বললো; আমি কি আপনাকে চিনি ?
আমি হাসি চাপা রাখতে পারছিলাম না; তাই বললাম আপনার নাম তো সুশি; তাই না। মেয়েটি কপট রাগ দেখিয়ে বলল; হ্যা তো; বলুন এখন আপনার জন্য আমি কি করতে পারি ? নাকি আপনি আমার ডাটা নিতে এসেছেন ?
কিছু করতে হবেনা আপাতত পরিচিত হতে চাই। আমি আর আপনি মানুষ এটাই বড় পরিচয়। আমি হেসে বললাম কেন পরিচয় দিতে অসুবিধে আছে ?
আমি ব্যাস্ত হয়ে গেলাম কাজে তাই আর কথা বলা হলোনা সেদিন। নীল লেকের ফটোসেশনে সুশিরও ছবি তোলা হয়েছিলো। সেই ছবিটা দেখে আমি জলরঙে একটা ছবিও এঁকেছিলাম।
সেদিন দুপুরের পরে সাদা মাটির উপর বসে ডাটা এন্ট্রির টেবিল ছেড়ে সুশি হাওয়া লাগাচ্ছিল গায়ে। আমি ঠিক তারই পাশে ক্যামেরা রেখে ডাইরি লিখছিলাম। এরই মাঝে আমার ধোয়া ছাড়বার নেশা পেয়ে বসলো তাই ডাইরি রেখে উঠে গিয়েছিলাম; এসে দেখি ডাইরি নেই;
খোজা-খুজি করতে হলো অনেক। কিন্তু পেলাম না। সুশিও নেই যে ওকে জিজ্ঞেস করবো। শেষে টিম ম্যানেজমেন্ট অফিসার কে জিজ্ঞাসা করলাম সুশি কোথায় ? উনি ভ্র-বাকা করে বললো সুশি নিচে পানি আনতে গেছে।

বিকেলে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম আবারো ।
সন্ধ্যের দিকে তখনও আধারটা পুরো আসেনি; তবে আসবে আসবে করছে। সবাই হিলস ছেড়ে বাড়ির উদ্যেশ্যে হাঁটছি তখন। পিছনে দেখা গেল সুশিকে; আমি পাশে গিয়ে বললাম আমার ডাইরিটা দেখেছেন ? ও চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললো হ্যাঁ।
মনে মনে আমার একটু রাগ উঠে গেল; না বলে কেন এমনটা করলো। ও বললো বাতাসে ডাইরি পড়ে গিয়েছিলো তাই আমি নিয়ে গিয়েছিলাম; ভয় নেই পড়িনি।
কোম্পানীর মিনিবাসে করে সবাই যে যার আস্তানায় ফিরছিল; গারো বাজারে নামবার সময় সুশি বলে উঠলো লেখায় এতো বানান ভুল করেন কেন ?


(চলবে…………………….)

গল্প : চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয় শেষ পর্ব


গল্প : চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয় শেষ পর্ব


প্রথম পর্বের পর………………
(পাঁচ)
গারো বাজারের অন্ধ গলির পাশেই একটা বাঈজীখানা যে আছে তা আমি জানতাম; কিন্তু কখনো সেখানে যাইনি। প্রয়োজনও পড়েনি; নীল লেকের প্রজেক্ট শেষ হবার আগের দিন সুশি আমায় বললো আপনি কখনো নর্তকীর উদোম নৃত্য দেখেছেন ? আমি বললাম না তো;
-তাহলে গনিকাবৃত্তির উপর অমন একটা লেখা কি করে লিখলেন ?
-কোথায় পেলেন লেখাটা !!
-যেখানে ছাপাতে দিয়েছিলেন; সেখানেই।
-আসলে আন্দাজে লিখেছি;
-মিথ্যে বলতে ভয় করে আপনার। আমি জানি পুরুষরা একটু-আধটু ওই রকম যে হয়;
-অনেক পুরুষ নিয়ে গবেষনা করেছেন মনে হচ্ছে !
-অনেক না হোক আপনাকে নিয়ে কিছুটা করতে গিয়ে বুঝতে পারছি ;
আমি আকাশ থেকে পড়বার ভাব ধরলাম না; কিন্তু চোখ বড় করে বলালাম; হঠাৎ আমাকে নিয়ে !!
-হ্যা।
-গল্পে তো লিখি বিষ খেয়ে মরে যাচ্ছি; কিন্তু তা লিখতে গিয়ে আমাকে বিষ খেতে হয়;
-বুঝলাম কিন্তু বিষের স্বাদ যে কেমন; সেটা না জানলে কি লিখতে পারতেন ?
-তা পারতাম না; তবে গনিকা বৃত্তির ব্যাপারটা আন্দাজে লোকমুখে শুনে লিখেছি।
-তাই !!
-হ্যা

আমি নতুন প্রজেক্ট নেবার আগে সিডিউল দেখতে গিয়ে বারবার করে দেখছিলাম; সুশি কি আমাদের প্রজেক্টে অর্ন্তভুক্ত হয় কিনা। সুশির জন্য কেমন একটা টান যেন আমার মনে অনুভব করতে পারলাম। সুশি কাজে না এলে আজকাল ছবি তোলার কোন মুডই আমার মাঝে থাকে না। কদ্দিন নিউমারলজি নিয়ে ঘাটাঘাটি করে দেখলাম আমার লাইফে কি কোন প্রেম-ট্রেম আছে কিনা।
সুশিও মাঝে মাঝে আমায় সময় দিতো; রাস্তায় আসবার কিংবা যাবার পথে কিন্তু কোন পার্ক কিংবা রেস্তোরাঁয় নয়; আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম সুশি আমাকে একটু একটু করে চিনে নিচ্ছে; কিন্তু সেটা ও বুঝতে দিতে চায়না।
নতুন প্রজেক্টে সুশি আর আমি দুজনেই থাকলাম কিন্তু প্রজেক্টটা একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলে পড়ে গেল। যাবার কিংবা আসবার সমস্য না থাকলেও ওখান থেকে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে গেলে রাত অর্ধেক হয়ে যাবার সম্ভবনা আছে তাই কতৃপক্ষ ওখানের একটা গ্রামে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। শুরু হলো আমাদের নতুন প্রজেক্ট।

(ছয়)
আমি প্রজেক্টের কাজে যতটুকু মনোযোগী হলাম; তারচেয়ে কম মনযোগী হলাম সুশি’র প্রেমে পড়ার দিকে। কেননা আমি দেখতে চাইছিলাম সুশি কি আমাকে পছন্দ করে কি না; কি জানি জীবন নাট্যের রাজপুত্রকে আগেই পেয়ে গেছে কিনা কে জানে।
ওর কাজ থাকতো সন্ধ্যের পর তাই সন্ধ্যের পর আমি যখন মুক্ত বিহঙ্গ তখন ওর কাজে নিজেকে খানিকটা সময় ওর কাছাকাছি রাখতাম।
ও ব্যাঙ্গ করা হাসি হেসে বলতো; থাক আমাকে উপকারের শোধ দিতে হবেনা।
মেঘালয়ের পাহাড় ভেদ করে চাঁদ উঠতো চারপাশে; তার ঘোলাটে আবরণে পুরো পাহাড় জুড়ে রহস্যময়তা বিরাজ করতো; আমরা সবাই চারপাশে গোল হয়ে আড্ডা দিতাম অনেক রাত অবদি; এ তল্লাটে আইসক্রিম বা কফি পাওয়া যেত খুব কম; আমার তৃষ্ণার্ত মন তাই মাঝে মাঝে সুশির খোলা গলায় গাওয়া গানের নদীতে ডুব দিতো;
সুশি ভালো গান গাইতে পারতো; জানিনা কেন যে জীবনের লক্ষ্যে গানটাকে সঙ্গি না করে এই ঘুড়ে বেড়ানো আর শিশুদের নিয়ে মহা গ্যাঞ্জাম মূলক কাজের পিছু ছুটছে।
প্রজেক্টের মাঝামাঝি পাতাঝরা দিন যাচ্ছিল তখন; সেই সব দিনগুলিতে কাজের ফাকে ফাকে ভাবনার নদীতে খেয়া বাইতাম; আমি বুঝে উঠতে পারলাম না আসলে আমিই কি ভালোবেসে ফেললাম সুশিকে না সুশিই ভালোবেসে ফেললো আমাকে।
দিন শেষে, কাজ শেষে প্রতিদিন আড্ডা বসতো। সেই প্রতিদিনকার আড্ডাটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো দিনের পর দিন। তিন মাসের প্রজেক্ট; এর মাঝে কারো বাড়ি যাওয়া হবেনা।
সুশি এসেছে ঢাকা থেকে আমি এসেছি শিলিগুড়ি থেকে; দুজনার দুই দেশ হলেও কথা আর আচরণে পার্থক্য করা যায়না। আমাদের মধ্যে সেক্রিফাইস আছে সমান-সমান।
আমরা মাঝ রাতে তারা গোনা কিংবা কানামাছি খেলার আয়োজন করাতাম। আমাদের মাঝে রবীন্দ্র,ভলেটেয়ার কিংবা সত্যজিৎ ও শার্লক-হোমস নিয়ে জোর তর্ক হতো।
রোজকার খবর; দূর পাহাড়ের গায়ে সকালে বৃষ্টি হবে কিংবা নিচে পানি নেই; দুপুরে খাওয়া মিলবে না। এই সব খবর সুশি প্রতিদিন কাজে যাবার আগে লিখে আমার দরজার সামনে রেখে যেত।
ভুলেও যেন কাউন্টার থেকে হুইস্কির বোতল কিনতে না যাই; কিংবা আমার লাইসেন্স নেই এই জাতীয় কথা নিয়ে রোজ শাসাতে আমায়;
টিম লিডার পারুল আপা; কিংবা প্রজেক্ট ম্যানেজার বিভাস বাবু আমার কাজের প্রশংসা করলে সুশি ক্ষেপে গিয়ে বলতো ছবি তোলার জন্য চাই সফট হাত; এই রকম কঠিণ হাতে ভালো ছবি হয়না; ছবি তোলার জন্য চাই প্রকৃতির মতো মন; যেখানে দুঃখরাও করবে স্বপ্ন বুনন…………………………………………….।

আমাদের বেশি কষ্ট হতো নিচে পানি আনতে যেতে;
আমার স্নান করা নিয়ে ওর আপত্তি ছিলো; ঝরনার জলে স্নান করলে ঠান্ডা লেগে যাবে; আমার আপত্তি ছিল ওর চুল বাধায়; খোলা চুলে তোমাকে ভুতনি’র মতো দেখায়;
-তুমি এত ফরসা হইলা ক্যান এই কথা বলে সুশি’কে রোজ ক্ষেপাতো বাবুর্চি মিরাস আলী;
একদিন সুশি; হাতে করে পায়েস নিয়ে হাজির বললো নিজে রেঁধেছে; খেতে গিয়ে মিষ্টি হীন। পায়েস নিয়ে সে,কি হাসা-হাসি; গানের পাগল ছিলাম বলে কান থেকে এম.পি.থ্রি প্লেয়ার ছুড়ে একদিন নিচে ফেলেছিল । বসন্তের প্রথম দিন ও একটা কবিতা আবৃত্তি করছিলো। খুব সম্ভবত প্রেমের কবিতা; আমি মিস করেছি সেদিন কানে এম.পি.থ্রি প্লেয়ার ছিলো; সেদিন থেকে একটা আফসোস আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিল; আমি ওই কবিতা শত চেষ্টা করেও ওর মুখ থেকে আর শুনতে পাইনি; পড়ে জেনেছিলাম ওটা ওর লেখা কবিতা;
হলি খেলার দিন ও এসে বললো কান্ত আজ তো তোমার ছুটি; স্যার বলেছে তুমি আজ আমাদের সাথে ঘুড়তে যাবে; আমি বললাম আজ আমি তোমার সাথে একা ঘুড়বো; যাবে আমার সাথে;
-লোকে দেখলে বলবে কি
- কিছুই বলবে না। আমরা দু-জন কলিগ। তাছাড়া তোমার-আমার ব্যাপারটা সবাই জানে; জানলেই কি এটা তো সিনেমার পর্দা না; এটা গ্রাম বাংলার গেয়ো মাঠ-ঘাট এখানে এসব কেউ দেখতে চায়না।
সুশি একা যাবেনা আমি জানতাম; তাই বিকেলে ওকে বললাম এসো হলি খেলি;
এভাবেই শেষ হয়ে গেল আমাদের প্রজেক্ট।

(সাত)
আজকেই প্রজেক্টের শেষ দিন। বিকেল এই গ্রাম আর সবুজ পাহাড় ছেড়ে বাড়ি ফিরবো।
ব্যাগ গুছিয়ে সবুজ রঙ্গা একটা পাঞ্জাবী পড়ে আমি ঘর থেকে বের হলাম। বিভাষ বাবু আমাকে পেমেন্ট দেবার চেক দেবে বলে সেই সকাল থেকে ডাকছেন।
সবচেয়ে উচু পাহাড়টায় আজ আমাদের প্রজেক্টের শেষ কাজ হবে। আমি চেক নিয়ে ঘরে আর ফিরলাম না। পারুল আপা আমার ক্যামেরা নিয়ে গেছে সেই ভোর বেলা তার খোঁজে সামনে এগিয়ে গেলাম।
মেঘ নেই আজ; রোদও নেই। উচু পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে সুশি ক্যামেরা হাতে দাড়িয়ে;
কাছে যেতেই ও বলে উঠলো কান্ত তুমি আমাকে একটা আকাশ কিনে দেবে ; আমি সেখানে তোমার তোলা সমস্ত ছবি দিয়ে একটা গ্যালারী বানাবো। আমি হেসে বললাম দেব।
আমরা পুরো টিমের অর্ধেক এই পাহাড়ের গায়ে দাড়িয়ে আছি; হঠাৎ গুলির শব্দে সবাই সচকিত হলাম; বর্ডার থেকে গুলি আসছে; বর্ডার একশো গজেরও কম দুরত্বে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম গুলির আওয়াজ ক্রমশই বাড়ছে আমরা নিচে নামবার জন্য পা বাড়ালাম। পাহাড়ের চারপাশে আজ নীরবতা নেই বললেই চলে; আমরা সবাই পা চালিয়ে নিচে নামতে লাগলাম; অচেনা জংলী ফুল আমাদের পা ছুয়ে যাচ্ছিল; সবার মাঝে একটা উত্তেজনা শুরু হয়ে যাচ্ছে; আমরা সবাই সেই উত্তেজনা নিয়ে গতি বাড়াচ্ছি ক্রমশই।
ঠিক এই মুহুর্তেই একদল লোক হাতে অস্ত্র উচিয়ে ধেয়ে আসতে লাগলো; দেখে মনে হলো ওরা চোরা-কারবারি বর্ডার ক্রস করবার সময় হয়তো ধরা খেয়ে গেছে; আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম;
আমি সুশির হাত ধরে দৌড়ে দিলাম; আচমকা পেছন থেকে ক’জন ঝাপিয়ে পড়লো আমাদের উপর; আমি তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেলাম বুনো গাছের উপর। পিছু ফিরে দেখি সুশি নেই;
নেই !!
কোথাও নেই র!!
চোখ যতদূর যায়।
ওর আর্তচিৎকার শুনলাম; এগিয়ে গিয়ে দেখি;প্রায় দুশো গজ পাহাড়ের নিচে পড়ে আছে সুশি।

(আট)
আমার চারপাশের জটলাগুলো ক্রমশই কমে যেতে লাগলো। সুশি’র লাশ নিয়ে ওরা চলে গেছে সেই কখন; কিন্তু আমি যেতে পারিনি; আমি থেমে গেছি; আটকে গেছি।
নোনা জলের তান্ডবে বার বার মনে হলো; আলো ছাড়বো; মায়া ছাড়বো পৃথীবি ছাড়বো; আর ফিরবো না কোনদিন এই পৃথিবীতে; এই পৃথিবী খুব খারাপ। তিনি উপর থেকে খেলা শুরু করবেন; তারপর ইচ্ছে মতো খেলবেন; আনন্দ পাবেন বেদনা উপহার দেবেন।
আমি জ্ঞান শূণ্য ছিলাম তিনদিন। চোখ মেলবার পর থেকে আমার মুখে কথা ফোটেনি বেশ ক’মাস।
আর কোনদিন কোন সবুজের বনে যাইনি; খুব দূরে দূরে থাকি; নিরব পথ পেলেই সুশি এসে দাড়ায়। আমি পথ চলতে পারিনা। আমি ঝরনার জলে স্নান করতে পারিনা; ওর শাসন আমাকে এখনো মনে করিয়ে দেয়।
হুইস্কির বোতলে ওর ইচ্ছে গুলো ক্রমাগত ঘোর পাক খায়; আমি তীব্র যন্ত্রনা নিয়েও আপন করে ভাবতে চাই সব বেদনা ঘেরা স্মৃতি গুলোকে।
ওর বিদায়ের পর থেকে আজকের এই দুপুর পর্যন্ত আমি পাথরে গড়া ভাস্কর্য হয়েই ছিলাম; খানিক আগে সেই কথার পুনরাবৃত্তি আমাকে নাড়া দিয়ে গেল; কিছুটা উন্মাদনা আমার মাঝে প্রকাশ পেল। আকাশ মাঝে ভেসে উঠলো সুশি’র কন্ঠ;
-দেখো আমি যদি কোথাও হারিয়ে যাই; তোমার ব্যর্থতা গোছাতে এমন একজনকে পাঠাবো; যে তোমাকে ভালোবাসবে আমারই মতো; শুধু তুমি তাকে চিনে নিও…………………………।

গ্যালারির একপাশে বসে ছিলাম এতক্ষণ।
আবার কেউ একজন ছবি কিনতে এসেছে। আমি সুশি’র জগৎ থেকে ফিরে এলাম।
দৌড়ে গেটে এলাম; রন্তু ওই মেয়েটি কোথায় ?
- দাদা চলে গেছে তো !!
আমি অসহায়ের মতো বললাম কি বলিস !! কোনদিকে গেছে
-তা তো বলতে পারবনা।
আমি পিছু ছুটলাম গেট পেড়িয়ে একদম বাইরে;
পথে নামলাম কাঠ রোদ্দুর আমার সারা গায়; ওকে খুজে পেতেই হবে; আমার চোখ আজ রোদের ছেলের গায়ে আঁক কষবে ব্যর্থতা তাড়াতে…………………

সমাপ্ত
_____________________________________________
:-)
জীবনের বাকে বাকে প্রতিদিন জমে হাজারো গল্প। এটাও তেমনি একটা গল্প;
সত্য গল্প গুলো জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকে; সেই স্মৃতিগুলো ক্রমশই ডালপালা মেলে আর সেই ডালপালা গুলো মাঝে মাঝে পথ আটকে দেয়।