গল্পঃ * * অ পূ র্ন * * ১ম পর্ব
০১.
প্লাটফর্ম থেকে চোখ ঘুড়িয়ে এনে সামনে তাকাতেই দেখি একটা তরুনী মেয়ে সিটে ব্যাগ রেখে সবে দাড়িয়েছে।
হাত পাখা ও একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল সহ।
ট্রেন কামরার ফ্যান গুলো ঘুড়ছে না। জানিনা কেন বন্ধ হয়ে আছে। নোনা ঘাম গুলো গড়িয়ে পড়ে ঘাড়ের পাশটা হয়ে শার্ট ভিজছে আমার।
কিচ্ছু করার নেই। হাত পাখাটা আনতে ভূলে গেছি সাথে পকেট টিস্যুও নেই। শার্ট ভিজছে আমার।
হাত পাখাটার দিকে নজর পড়তেই; “একটু পাখাটা দেবেন এই নামক শব্দের অনুভূতিটা উকি দিচ্ছে”বারংবার।
বোধ করি আমার চোখে চোখ পড়তেই সেটা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে সে।
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। এই গরমে হাত পাখাটা হাত করার ধান্দাটা মাথা থেকে নড়ছে না। কি,করে যে বলি। ও দিকে মেয়েটা ততক্ষণে বসে গেছে সিটে।
ট্রেন আজ দু’ঘন্টা লেট। ন’টার জায়গায় এগারোটায় ছাড়ছে। ভীড় নেই বললেই চলে। মাত্র চল্লিশ মিনিটের পথ। ময়মনসিংহ যাবো। বিশেষ কোন কাজ নেই এমনি; সাথে ছোট্ট একটা ব্যাগ ছাড়া কিছুই নেই। কালকেই আবার ফেরত আসবো।
তরুনীটিও সাথে তেমন কিছু নিয়ে বসেনি, শুধু একটা ব্যাগ ছাড়া। দেখে মনে হয় না দূর যাত্রায় যাবে।
আমার চোখ তাকে দেখছে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। নীল কালো রঙ্গের ডোরাকাটা শাড়িতে সাদাপাড়। মুখে বয়সের ছাপ সবে পড়তে শুরু করেছে। খুব সুন্দর না হলেও মুখমন্ডলে সুন্দর্যের আকারটা কিন্তু বেশ। বুদ্ধিমত্তার একটা ছাপ আছে মুখে। কপালে টিপ নেই থাকলে ভালো লাগতো। মুখে তার ছোট্ট একটা অতৃপ্তি কাজ করছে। আমার চোখ দেখতে দেখতে; মেয়েটা হাত পাখা নিয়ে দোলাতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে।
হাতপাখার আশা ছেড়ে জানালাটা খুলবো ভাবতেই দেখি মেয়েটা পাশেই হাতপাখা রেখে জানালার শার্শি ধরে টানছে,এই সুযোগে হাত পাখাটা নিলাম। জানালা খোলা হলেও বাতাস কিন্তু আসছে না। বাইরের আকাশটা ঘুমোট ভাব ধরেছে আজ রোদ নেই, মেঘ নেই কিন্তু ভ্যাপসা গরম লাগছে।
মেয়েটা কিছু বলার আগেই আমিই বলে বসলাম কিছু মনে করবেন না। আপনার হাতপাখাটা একটু নিয়েছি; যা গরম পড়েছে না। শরীরটা তো জ্বলছে মরিচের মতো। বাতাস তো উত্তর বঙ্গে চলে গেছে সব তাই পাখা দোলানো আর কি।
ঠিক বলেছেন বেশ গরম আজ, বলে মেয়েটা ঠোট টিপে বললো কোথায় যাবেন ময়মনসিংহ। আমি বললাম হ্যাঁ আপনি? আমিও যাবো। বেশ তাহলে তো ভালই হলো।
মেয়েটি বসতে বসতে বললো আপনি থাকেন কোথায়?
-উইল কিংসন রোড।
-মাধবী লতা বিল্ডিং এর কোন পাশে।
- দক্ষিনে, চিনেন দেখছি আপনি কোথায় থাকেন?
-রিভার ষ্ট্রিট; আমি এখানে খুব কম থাকি; একাদশ পাশ করবার পর এখন কলকাতার নাগরিক হয়ে আছি।
- তাই তো চিনতে পারিনি।
নাম জানতে চাইলাম বললো শ্যামা সে অবশ্য আমার নাম জানতে চাইলো না। আমি অবাক হলাম না। এমনটি হয়। হতে হয় কখনো কখনো। কথা আর এগোলো না। আজকাল আমিই কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি।
হাতপাখার বাতাসে খানিকটা শীতলতা পেলেও গরম কিন্তু গেলো না। ভদ্রতা বশত মিনিট পাচেঁক পড়েই ফিরিয়ে দিলাম হাতপাখা।
ট্রেন চলছে মাঝারি স্পিডে, ব্যাগ খুলে পত্রিকা বের করলাম। একসাইড ভাজ করে হাতপাখার আকার করে দোলাতে লাগলাম গরম কাটছে না।
শ্যামা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো আজকের পেপারটার এ,কি হাল করছেন?
না আজকের না এটা, কালকের বাসি পেপার।
একটু দিন তো পড়ি। হাতপাখাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে পেপার নিয়ে নিলো। যা হোক ভালোই হলো বলে দোলাতে লাগলাম।
একটা ষ্টেশনে এসে থামলো ট্রেনটা আমি নামতে গেলাম কিন্তু মাথাটা আবার মনে করিয়ে দিলো পানির বোতল তো আছে পাশের জনের কাছে। নিচে গিয়ে কি হবে।
একটু পানি খেতে পারি? নিচে আর নামতে হলো না।
বেশ চঁটপটে মনে হলো মেয়েটাকে। পানির বোতল দিলো কুন্ঠা বিহীন ভাবে। এই না হলে মানুষের জন্য মানুষ।
০২.
শ্যামা এক মনে পত্রিকা পড়েই চলেছে। আমি দুলিয়ে দুলিয়ে বাতাস করছি । ঝিমুনি আসছে আমার। তন্দ্রামতন একটা ভাব তার কারণ কাল সারারাত ঘুমুতে পারিনি। আর ঘুমুতে না পারার একটা কারন হলো। রাতে পেপারে একটা গল্প পড়ে মনের ভেতর খচখচানি শুরু হয়ে গেছে। গল্পটার ভেতরের চরিত্রটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছিলো। কিন্তু চিনতে না পারার যন্ত্রণাটা আবার আমাকে কুড়েঁ কুড়েঁ খাচ্ছিল। যে গল্প গুলো মাথায় ঢুকে যায় তা নিয়ে আমার অস্বস্থি বাড়ে ধীরে ধীরে যখন কিছুতেই এর সুরাহা না করতে পারি। আমি খুব বেশি পরিমানে ভাবতে পারি অকারনেই আকাশ থেকে কাঠরোদ্দুরে মেঘ নামায় আমার চিন্তা’রা। তাই কাল যখন পড়েছি অর্ধেকটা তখন বুঝেছি গল্পের শেষ পরিনতি করুন হবে আর সেটা পড়লে ভাবাভাবি টা আমার কদ্দিনের জন্য পাঁকা হয়ে দাড়বে।
কিন্তু না পড়ার কারনে কিছুতেই ঘুম আসেনি। রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সকালে ময়মনসিংহ চলে যাবে বন্ধুদের সাথে কথা বললে হয়তো বিষয়টা ভুলে যেতে পারবো। তাই এই সকালে ট্রেনে। কিন্তু বুঝতে পারছি গল্পটা মাথা থেকে যাবেনা।
যখন এসব ভাবছি তখনি পাশে বসে থাকা শ্যামার একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেয়ে তাকালাম। এ,কি মেয়েটা কাঁদছে সোজা হয়ে বসলাম।
কি হয়েছে আপনার কাদঁছেন যে চোখে কিছু পড়েছি কি?
না এমনি বলে কিছু একটা চাপা দিতে চাইলো । ভবলাম বাড়ি থেকে এসেছে মা’র কথা মনে পড়েছে বোধহয়। কিন্তু ও তো পেপার পড়ছিলো। তাছাড়া আজকাল কাদাঁকাটির পাট চুকিয়ে আসছে ধীরে ধীরে তবে কি !!
তবে কি !! সেই গল্পটা পড়ে ফেলেছে;
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম কাঁদছেন যে, ও কিছু বলবো মুখটা উপরে তোললো
কোন রকম ভনিতা না করে দু’ হাতে চোখ মুছতে মুছতে বললো একটা গল্প পড়ে কাদঁছি। আমি এবার অবাক হলাম না।
বুঝলাম আমার সিমপ্যাথিটা ওকেও পেয়েছে ।
গল্পটা শেষ করেছেন নাকি? শ্যামা মাথা নেড়ে বললো হ্যাঁ আর তাইতো চোখের পানিটা ধরে রাখতে পারিনি। আমি বললাম সত্যিই গল্পটা বেশ করুন কাল সারারাত ঘুমুতে পারিনি এ জন্য। কিন্তু সত্যি বলতে কি জানেন আমি গল্পটা শেষ করতে পারিনি কষ্ট লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো একটা কাচের টুকরো বুঝি এ পাশ দিয়ে ঢুকে ভেঙ্গেচুরে ও পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন কষ্টটা ঝাপটে ধরা আতংকের মতো। আমাকে সারারাত গল্পটা ধরে রেখেছে। যেটুকু পড়েছি; তার বাকীটুকু পড়লে আমিও নির্ঘাত কেঁদে ফেলবো। তাই পড়বার সাহস পাইনি। কিন্তু গল্পটা মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারিনি সারারাত। আমার মুখের কথা সরতেই দেখলাম শ্যামা হাফ ছাড়লো একটা। উঠে দাড়িয়ে চুলের ক্লিপ খুলে দিয়ে চুল গুলো ছেড়ে বসলো। চুলটা বেশ লম্বা তবে তাতে একটা রুক্ষ ভাব রয়েছে। কালোর ভেতর হালকা লালচে লাগছে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে শ্যামা আবার মুখ খুললো। গল্পটা পড়ে যতখানি কষ্ট লেগেছে তারচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছে গল্পের লেখকটার জন্য কেননা এটা তার নিজের গল্প কিনা।
আমি কিছুটা অবাক হলাম। আপনি কি করে জানলেন চেনেন নাকি?
শ্যমা চুপ হয়ে গেল কিছু বললো না।
আমি আবার বললাম এই লেখকের গল্প আমি প্রায়ই পড়ি পেপারে মাঝে মাঝে কিছু লিটল ম্যাগে। একটা ছোট আকর্ষণ রেখে গল্প গুলো শেষ করেন তিনি। তিনি সহজ ভাবে বেশ লিখতে পারেন। আর সবচেয়ে মজার বিষয় তার বেশ কিছু চরিত্রে মাঝে মাঝে নিজেকে আবিস্কার করি। লেখকের ঠিকানা পাইনি নয়তো জিজ্ঞেস করতাম। আমি থামলাম।
শ্যামা পত্রিকাটা আমার হাতে দিয়ে বলতে লাগলো এই লেখক আড়ালে এক ভিন্ন মানুষ। আপনাকে একটা গল্প বলি তাহলেই বুঝতে পারবেন। পত্রিকা ভাজ করে হাটুর উপর রেখে নড়েচড়ে বসলাম। গল্পটাতে মজা লাগতে শুরু করেছে মাত্র। রোদ হঠাৎ করে মরে গিয়ে হাওয়া আসতে শুরু করেছে মাত্র। হাওয়া চুল উড়িয়ে এনে ফেলছে হাতে। একটু হাত পাখাটা দেবেন?
আমি ফিরে চাইলাম। দিলাম। হাত পাখাটা ভাজ করে ব্যাগে রাখলো। শাড়ীর আচঁল টেনে সামনে এনে বসলো। যে ষ্টেশনে আছি এখন; সেখানে ভালো চা পাওয়া দুস্কর ওরা গরম পানিকেই চা বলে তাও আবার চিনি কম পানশে মার্কা।
ব্যাগটার উপর পত্রিকাটি রেখে জানালার দিকে তাকিয়ে বললো এবার শুরু করা যাক। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মাথানেড়ে বললাম হ্যাঁ শুরু করুন।
-আপনি কি আমাকে বাচাল টাইপের কিছু ভাবছেন জানা নেই শোনা নেই গল্প বলতে শুরু করে দিলাম।
-না , এরকম ভাববো কেন ? আজকাল ভাবাভাবি খুব একটা কেউ করেনা। আপনি বলে যান দ্বিধাহীন ভাবে। আমি শুনবো। আর তাছাড়া গল্পটা তো গল্প থেকেই শুরু হচ্ছে
- ঠিক আছে কথাটা ভালো লাগলো।
০৩.
বছর পাচেঁক আগে ইউ এন্ড আই রেস্তোরার পাশে যে বুক হাউসটা দেখেছেন সেখানে একজন হকার নিত্য বাক্স ফেলে পেপার বিক্রি করতো ঠিক তারই পাশে এখন যেখানে বিউটি পার্লারটা আছে সেখানে একটা তেলেভাজার দোকান ছিলো ও লোকটা কিন্তু আবার বাক্সে ভরে আইসক্রিম বিক্রি করতো। আমাদের নগরে যে ভালো আইসক্রিমের দোকান নেই এটা নিশ্চই আপনাকে বলতে হবেনা। আমি খানিকটা মাথা দুলিয়ে বললাম হ্যাঁ আপনি থামবেন না। বলতে থাকুন।
শ্যামা আচঁলটা ধরে নিয়ে আবার শুরু করলো।
চলবে………………………………………
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন