মেঘ জমে আছে মন কোণে…
১
শ্রাবণী অনেকক্ষণ তার বাবার সামনে চুপচাপ বসে আছে আর পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মেঝেতে অদৃশ্য নকশা কাটছে। এই অভ্যাসটা তার অনেক পুরনো, ছোটবেলায় কতদিন মায়ের হাতে এ কারণে মার খেতে হয়েছে তাও অভ্যাসটা থামেনি। মোস্তাফিজ সাহেব পেপার পড়ছেন আর চায়ে শব্দ করে চুমুক দিচ্ছেন। এক সময় পেপারটা ভাঁজ করে বলে উঠলেন,-আজকাল দেশের অবস্থা কত খারাপ দেখেছিস? নিউজ পেপার খুললেই ভয়ঙ্কর সব খবর। সকাল সকাল কাগজ হাতে নিলেই মন খারাপ হয়ে যায়।মাঝে মাঝে ভাবি পেপার আর পড়বো না; কিন্তু এতদিনের অভ্যাস, ছাড়তেও তো পারি না। কিছুদিন আগে বাবা ল্যাপটপ কিনে দেয়নি বলে বাচ্চা একটা মেয়ে অভিমান করে আত্মহত্যা করলো। কেন? জীবন কি এতই ঠুনকো? ছোটবেলা থেকে মা-বাবা কি কম কষ্ট করে সন্তানদের বড় করে? নিজের সন্তানের খারাপ কেউ চায়…!
শ্রাবণী আলতো হেসে তার বাবার দিকে তাকায়। গোলগাল চেহারার হাসিখুশি একটা মানুষ, সব চুল প্রায় সাদা হয়ে গেছে, চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। বাবার দিকে তাকালেই সবসময় তার মন শান্ত হয়ে যায়। মানুষ মনে হয় যত বৃদ্ধ হতে থাকে ততই শিশুদের মত হয়ে যায়। বাবার দিকে তাকালে আজকাল কেন জানি তাঁকে আরও শিশু শিশু মনে হয় শ্রাবণীর। নরম গলায় সে বলল-ওই মেয়েটার আত্মহত্যার ঘটনা পড়ে তুমি খুবই মর্মাহত হয়েছ তাই না বাবা? আর আরও বেশি ভয় পেয়েছ কারণ আমার আর ওই মেয়েটার নাম একই।
মোস্তাফিজ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিষণ্ণ গলায় বললেন-খবরটা পড়ে বুকটা অবশ হয়ে গিয়েছিলো বুঝলি?
শ্রাবণী আলতো করে বাবার হাত ধরে বলল,কষ্ট পেওনা। অল্পবয়সী আর আবেগপ্রবণ ছিল মেয়েটা। আমি অনেক বড় হয়ে গেছি বাবা, টিন এজ সময়টা পার করে এসেছি অনেক আগেই। চায়ের কাপটা পাশে রেখে মোস্তাফিজ সাহেব প্রসঙ্গ পালটে বললেন- কদিন আগে যে মেজো খালার বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলি কেমন সময় কাটলো। তোর খালা বলল, তুই সেদিন কারো সাথে তেমন একটা কথা বলিসনি, অনেক চুপচাপ ছিলি!
-ভালোই লেগেছে। শ্রাবণী ছোট্ট করে উত্তর দিলো।
- দাওয়াতে আসা মানুষজনদের সাথে পরিচিত হোসনি?
-বাবা, তুমি দাওয়াতে আসা মানুষদের কথা জানতে চাইছ না। যার ব্যাপারে জানতে চাইছ তাঁর সাথে কথা হয়েছে। শ্রাবণী অন্যদিকে তাকিয়ে বলল।
মোস্তাফিজ সাহেব একটু থেমে বললেন-মা রে, আদনান নামের ভদ্রলোকটাকে আমার খুব ভালো মনে হয়েছে। শিক্ষিত, স্বল্পভাষী এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ। ইতালিতে নিজেদের রেস্টুরেন্ট আছে। বড়, ছোট সব বোনদের বিয়ে দিয়েছে, পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করেছে তাই নিজের দিকে তাকানোর সময় পায়নি। বয়সটা হয়ত একটু বেশি তবুও মানুষটা অনেক ভালো। তুই একটু ভেবে দেখিস মা। এভাবে আর কত দিন বল! তোর মায়ের হার্টে তিনটা ব্লক ধরা পড়েছে। সে সারাক্ষণ অসুস্থ থাকে; আর আমারও তো অনেক বয়স হল।
শ্রাবণীর গলা ধরে এলো। সে মাথা কাত করে বলল- ঠিক আছে বাবা। কিন্তু তিনি কি আমার ব্যাপারে সব জানেন?
-তোর খালা তাঁকে সবই খুলে বলেছে…
শ্রাবণী বিড়বিড় করে বলল-তিনি জানেন বছর চারেক আগে আমার আক্দ হয়েছিলো, আর সেই ছেলেটা তিন মাসের মাথায় আমাকে ফেলে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে…
মোস্তাফিজ সাহেব তাঁর মেয়ের হাতটি শক্ত করে ধরে বললেন-হ্যাঁ রে মা। সব জানেন। এমন প্রস্তাব, এমন ছেলে সহজে পাবি না…জীবন সবাইকে বারবার সুখী হওয়ার, নতুন করে সব সাজানোর সুযোগ দেয়না, তোকে দিচ্ছে ,তাই তুই আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করে নে। তোর গোছানো একটা সংসার, নাতি-নাতনীদের মুখ দেখার জন্যে আমি আর তোর মা প্রতি নিয়ত আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করছি। এতদিনে তিনি সদয় হয়েছেন…শোকোর আলহামদুলিল্লাহ।
শ্রাবণী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ধরা গলায় বলল-বাবা একটা গান গাইতে পারো? বিয়ের পরদিন তুমি যেই গানটা মাকে শুনিয়েছিলে, যেই গানটা ছোটবেলায় আমি বারবার তোমার কাছে শুনতে চাইতাম…
মোস্তাফিজ সাহেব চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে দরাজ গোলায় গান ধরলেন-
“মন দিল না বঁধু
মন নিলো যে শুধু
আমি কি নিয়ে থাকি
মহুয়া মাতায় ঢোলক
দোলে পলাশের নোলক
বাঁধে কেউ বাহুরও রাখী
আমি কি নিয়ে থাকি
মন দিল না বঁধু…”
-এই শ্রাবণী এই, ভর দুপুরে কই যাচ্ছিস? মা তারস্বরে চিৎকার করে উঠেন। আজকাল তার মন মেজাজ সব সময়ই তিরিক্ষে হয়ে থাকে।
-একটু কাজ আছে মা, ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই ফিরে আসবো…
-কি এমন জরুরী কাজ থাকে মানুষের ভরদুপুরে? তুই একজন আর তোর বাপ একজন, দুইজনে মিলে আমার জীবনটা বিষাক্ত করে ফেলছিস। একজন রিটায়ার্ড করে সারাদিন খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে রাখবে আর আরেকজন আইবুড়ো হয়ে ভর দুপুরে ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াবে, আমি আর পারিনা। আল্লাহ আমাকে তুলে নেন না কেন…
শ্রাবণী নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, মার সাথে এখন কথা বললেই কথা আরও বাড়বে। এরপর বেচারা বাবাকেও কড়া কড়া সব কথা শুনতে হবে। মায়ের দিকে তাকালেই শ্রাবণীর চোখে পানি চলে আসে, শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন মা, চোখের নিচে কালি আর সারা মুখে কেমন জানি বেদনা আর অসন্তুষ্টির ছাপ।
ভাদ্র মাসের তীব্র রোদে চারপাশ ফুলকির মত জ্বলছে। শ্রাবণী অনেকক্ষণ বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। বাস আসার কোন পাত্তা নেই। ভাগ্যিস রোদ থেকে বাঁচতে ছাতাটা নিয়ে এসেছিলো। ছোট হাত ব্যাগটা থেকে মোবাইলটা বের করে সে, জাহিদকে ফোন করতে হবে। কতদূর আছে জাহিদ!
২
সাইবার ক্যাফেতে বসে প্রায় গোটা পাঁচেক কোম্পানিতে সিভি ফেলে জাহিদ বের হয়ে এলো। জানা কথা এই কোম্পানিগুলো তাকে ডাকবে না, আর ডাকলেও চাকুরী দেবেনা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করা কারো জন্যে আসলে এই বিশাল শহরে ঠিক কোন কাজের পোষ্ট খালি আছে তা সে জানেনা। তার কোন প্রভাবশালী মামা-চাচাও নেই। শুধু একজন দূর সম্পর্কের আত্নীয় ছিলেন তবে তিনি ক্ষমতা থাকলেও সাহায্য করবেন না। তাঁর বাসায় গেলে দামী নোনতা বিস্কুট, নুডুলস আর চা খাওয়াবেন তারপর ভদ্র ভাষায় নিজের নানাবিধ সমস্যা কথা বলে বিদায় করে দিবেন। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জাহিদের। গত দু বছর ধরে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আসছে সে। প্রথমবার টেকেইনি আর দ্বিতীয় বার রিটেনে টিকলেও ভাইবাতে বাদ পড়েছে। এখানেও টিকতে হলে মামা-চাচা লাগবে। তাদের মত অতি সাধারণ ঘরের সাধারণ মানুষগুলোর জায়গা কোথায় কে জানে!!
কড়া রোদ উঠেছে, ভ্যাপসা বাতাসে ধুলোর গন্ধ। রাস্তার সবাই দারুণ ব্যস্ত, কারো হাতেই সময় নেই। গরম আবহাওয়ার মতই সবার মেজাজ গরম হয়ে আছে। শুধু জাহিদের কোন তাড়া নেই। বিকেল ৫টা পর্যন্ত সে ফ্রি। তারপর কোচিং এ পড়াতে যাওয়া তারপর টিউশনি।
-মামা, চা দাও দেখি একটা।
চায়ের দোকানের রহমান দাঁত বের করে হাসে-এই সময় চা খাইবেন? লাঞ্চ করিবেন না?
-ক্ষুধা নেই। মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে। চা দাও সাথে কেক দিও একটা…
-আইজকা কি আপা আইবো? কেকের প্যাকেট থেকে কেক বের করতে করতে বলে রহমান।
-হু…একটু পরেই আসবে।
জাহিদ শুকনো কেকে ছোট একটা কামড় বসায়। আজকাল প্রায় দুপুরে তার ক্ষুধা পায়না। হয়ত চা আর সিগারেটের পরিমাণ একটু বেশি হয়ে যাওয়াতে এমন হচ্ছে। কমাতে হবে। শ্রাবণীকে বললে মেয়েটা কষ্ট পাবে। এই মেয়েটার জীবনে অনেক বড় বড় কষ্ট আছে; এর মাঝে সে ছোট ছোট কষ্ট দিয়ে মেয়েটার কষ্টের বোঝা বাড়াতে চায় না আর।
-আইজকা একটা কবিতা শুনুম। চা বানাতে বানাতে রহমান এক গাল হেসে বলে।
-নতুন কোন কবিতা লিখি নাই মামা, কবিতা আসেনা আজকাল। মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে আমার। দুই আঙ্গুলে মাথায় টোকা মেরে দেখায় জাহিদ। রহমানের দিকে তাকিয়ে মনে হয় মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে বেচারার…
নাহ, কবিতা আজকাল আসেই না। গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতই যেন সব কবিতা উবে গেছে। অথচ আগে দিন নেই রাত নেই কতশত কবিতা লিখে ফেলত সে। বেশ কিছুক্ষণ ভেবেও কোন কবিতা বা অনুকাব্য ভেবে বের করতে পারলো না জাহিদ। মাথায় কেন জানি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ঘুরছে। কবিতার নাম “”স্ববিরোধী” ”জাহিদের খুব প্রিয় কবিতা, নিজের সাথে এই কবিতার অনেক মিল খুঁজে পায় সে…
আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ণ বর্ষায়,
কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত ।
আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে,
কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল ।
আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে,
কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি ।
আমি জন্মেছিলাম ছায়া সুনিবিড় গ্রামে,
ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা ।
জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম,
এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায় ।
আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম,
এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি ।
বিড়বিড় করে কবিতা আওরায় জাহিদ। “আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম…এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি …”এই লাইন দুটো মাথায় আটকে যাচ্ছে বারবার… এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই দিন দিন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হয়…বড় হতে হতে একসময় ফুরিয়ে যায়, হারিয়ে যায়…সেই হারিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা থাকেনা।
৩
গত আধ ঘণ্টা ধরে শ্রাবণী জাহিদের পাশে বসে আছে। শ্রাবণীর গা থেকে কেমন যেন একটা মন খারাপ করা বিষণ্ণ ঘ্রাণ আসছে। মানুষের মনের অনুভূতির সাথে মনে হয় তার দেহের ঘ্রাণও সম্পৃক্ত। মন ভালো থাকলে মিষ্টি কোন ঘ্রাণ আসবে, মন ঘুমিয়ে থাকলে আসবে ঘুমন্ত ঘ্রাণ…মানুষের দেহের ঘ্রাণও তার সাথে প্রয়োজনে ছোট হবে বড় হবে…একসময় মানুষের সাথেই ঘ্রাণ মিলিয়ে যাবে।
-আমি এখন কি করবো জাহিদ?
শ্রাবণীর কথায় জাহিদের চিন্তায় ছেদ পড়ে। শুকনো হাসি হেসে সে বলে-বিয়েটা করে ফেলো শ্রাবণ। আর কতদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করবে? চাকরি পাচ্ছিনা কোন, আর চাকরি পেলেও বেতন এমন আহামরি কিছু হবেনা। বাসায়ও টাকা পাঠাতে হবে, ছোটবোনের বিয়ের ব্যাপার তো আছেই। আর চাকরি কবে পাবো, তারও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তোমার বাবার সামনে এখন গিয়ে কি বলবো? আমি একজন কোচিং সেন্টারের শিক্ষক? আমি একজন প্রাইভেট টিউটর? আমাদের সম্পর্কের কথা উনি জানলে কতটা কষ্ট পাবেন ভেবে দেখেছ?
-এত সহজেই সমাধান দিয়ে দিলে? আমার আক্দটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর আমি মানসিকভাবে একদম ভেঙ্গে গিয়েছিলাম। আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছ তুমি, স্বপ্ন দেখিয়েছ তুমি। কাউকে ভালবাসলে তাকে কতটা সম্মান করা যায় তা দেখিয়েছ তুমি। আর এখন আমাকে চলে যেতে বলছ? স্বার্থপরের মত দূরে ঠেলে দিচ্ছ? কষ্টে, অভিমানে চোখ ভিজে এলো শ্রাবণীর।
-আমি তোমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিনা শ্রাবণ, আমি ভাবছি তুমি কিভাবে ভালো থাকবে, সব সময় আবেগ দিয়ে ভাবলে হয়না। আমি থাকি মেসে, তোমাকে বিয়ে করে উঠবো কোথায়? কোচিং আর টিউশনির টাকায় সংসার তো চলবেনা। আর তুমি এই প্রস্তাবটাও না করে দিলে তোমার বাবা আর অসুস্থ মায়ের হতাশা আরও বৃদ্ধি পাবে। আবার আমার কথা শুনলেও উনারা ভয়ঙ্কর কষ্ট পাবেন। তোমার পাশে তাঁরা যেমন জীবন সঙ্গী দেখতে চান, আমি তেমনটা নই একদমই। তোমাকে নিয়ে একবার উনারা কষ্ট পেয়েছেন, জেনেশুনে আবার কিভাবে কষ্ট দেই তাঁদেরকে!
শ্রাবণীর চোখে আরও তীব্র ও সুক্ষ্ন একটা বিষাদ কাজ করে। একসাথে অনেক কথা গলার কাছে পিণ্ড হয়ে জমে থাকে, যেন জমাট বাঁধা বরফ কোন, যাদের কখনো গলে যেতে নেই। শ্রাবণী বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সে সহজ হওয়ার চেষ্টা করতে করতে জাহিদের হাত চেপে ধরে। তারপর বলে-এখানে বসে দম বন্ধ হয়ে আসছে, চল, রিকশা করে আধ ঘণ্টা ঘুরে আসি। টাকা আছে আমার কাছে।
জাহিদ একটু আনমনা হয়ে বলল-আর একটু বসে যাও শ্রাবণ, একটু পরেই বৃষ্টি আসবে। এই ভ্যাপসা গরম ভাব আর থাকবেনা। এক কাপ চা খাও? অনেকদিন তোমার সাথে বৃষ্টি দেখে চা খাওয়া হয়না…
শ্রাবণী এবার ঠাণ্ডা গলায় বলল-তুমি বোধ হয় ভুলে গেছো এখন ভাদ্র মাস, এই মাসে আকাশে মেঘ থাকেনা, কোন বৃষ্টি হয়না বরং প্রখর রোদ থাকে। সেই রোদ সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ হাতব্যাগটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। বিদায়ও নেয় না
জাহিদের কাছ থেকে।
৪
এক পা, দু পা করে হেঁটে শ্রাবণী একটু একটু করে জাহিদের থেকে দূরে সরে যায়। এখান থেকে বাস স্ট্যান্ড যেতে বেশ কিছু পথ হাঁটতে হবে। শ্রাবণী একটু পর পর লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে যেন বুকের ভিতরের ভারি ভাবটা কমে আসে, কিন্তু কোন লাভই হচ্ছেনা। জাহিদকে তার অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু কিছুই বলা হয়নি। শ্রাবণী মনে মনে বলে- জাহিদ, আমার কিছুই ভালো লাগেনা আজকাল। কাল রাতে বারান্দায় বসে ছিলাম অনেকক্ষণ আর ভাবছিলাম যদি তোমার সাথে আমার কখনো বিয়ে হয় তবে আমি টানা একদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। এক মুহূর্তের জন্যেও তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা হতে দেবনা। দীর্ঘক্ষন তোমার হাত চেপে ধরে বসে থাকবো তাই হয়তো একটা সময় আমাদের হাত ঘেমে উঠবে আমি তবুও ভ্রুক্ষেপ করবো না। ছোট্ট এই চায়ের দোকানে কিংবা ফাস্ট ফুড শপে ঠিকমত হাত ধরা যায় না, বিয়ের পর সারাক্ষণ তোমার হাত ধরে থাকবো। তোমার হাত ধরে ছোট ছোট পা ফেলে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াব। বাবার পর শুধু তোমার হাত ধরলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়, আমি শান্ত হয়ে থাকি।
জানো, ভেনেজুয়েলায় ““মাউন্ট রোরাইমা”” নামে এই অপূর্ব সুন্দর পর্বত আছে, যা বছরের বেশির ভাগ সময় মেঘে ঢাকা থাকে, যেন এক স্বর্গ রাজ্য। সেই জায়গায় যাওয়ার বহুদিনের শখ আমার। কিন্তু সেখানে হয়ত যেতে পারবো না তাই আমি খুঁজে খুঁজে আমাদের দেশের একটা জায়গা খুঁজে বের করেছি যেখানে পাহাড় ডুবে থাকে মেঘের সাগরে। রাঙামাটির জেলার বাঘাইছড়ী উপজেলার একটি ইউনিয়ন সাজেক। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উচ্চতায় এখানকার বসতি। সেখানের পাহাড়ি প্রকৃতি অসাধারণ। তোমাকে বলা হয়নি, সাজেকে যাওয়ার জন্যে আমি গত কয়েকমাস থেকে হাত খরচ আর গ্যারেজ ভাড়ার টাকা থেকে টাকাও জমাচ্ছি, বেশ কিছু টাকা জমে গেছে আমার কাছে। আমিও একটা চাকরি খুঁজছি, দুজনে মিলে কষ্ট করলে একটা জীবন চলে যাবেনা? কী বলো? খুব বেশি কিছু কি আসে যায় যদি একসাথে থাকার জন্যে অবিরাম কষ্ট করে যাই? সত্যিই কি খুব বেশি কিছু আসে যায়!
শ্রাবণীকে বিস্মিত করে দিয়ে আকাশের রোদ মরে যেয়ে মেঘ জমতে শুরু করেছে। বাতাস শুরু হয়ে গেলো, সেই সাথে টিপ টিপ বৃষ্টি। ভাদ্র মাসের অবাক করা বৃষ্টি। শ্রাবণী লম্বা লম্বা পা ফেলছে, কোথাও দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না তার। ব্যাগ থেকে ছাতাও বের করতে মন চাইছে না। শ্রাবণী দ্রুত হাঁটছে, বাতাসে তাঁর মাথার চুল উড়ছে….
কালো মেঘে আকাশ বুঁদ হয়ে যাচ্ছে। জাহিদ এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট আর অন্য হাতে গরম চা নিয়ে বসে আছে। তার মন ভারাক্রান্ত, শ্রাবণী চলে যাওয়ার পর থেকেই তার নিজেকে কেমন যেন নিঃস্ব লাগছে। এখন মনে হচ্ছে শ্রাবণীর সাথে রিকশায় ঘুরতে গেলেই বেশ হত। রূঢ় কথাগুলো হয়তো মেয়েটার মনে অনেক বেশি আঘাত হেনে বসেছে। জাহিদ টিপটিপ বৃষ্টি দেখে কবিতা সাজানোর চেষ্টা করে মনে মনে, কিন্তু হয়ে ওঠে না..শ্রাবণীর চেহারাটাও মনে করা যাচ্ছেনা। চায়ের কাপের গরম ধোঁয়া বার বার দু চোখ ঘোলাটে করে দিচ্ছে। বৃষ্টি দেখে জাহিদের খুব শান্তি লাগছে। জীবন তাকে বার বার পরাজিত করলেও প্রকৃতি তাকে ছোট ছোট জয়ের আনন্দ দিতে পিছপা হয়নি।
জাহিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় আবৃত্তি করে…
” there’s not a cloud in the sky , it’s as blue as your blue goodbye.
And I thought that it would rain, the day you went away!!
পেছনে থাকা রহমান রেডিও অন করে চায়ের কাপে টুনটুন করে চামচ নেড়ে চা বানাচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাচ্ছে। রেডিওতে গান হচ্ছে- শচীন দেব বর্মণের বিখ্যাত গান…
“মনো দিল না বঁধু
মনো নীল যে শুধু
আমি কি নিয়ে থাকি…”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন