একটি রক্তাক্ত হৃদয়ের গান
অনেক অনেক দিন আগে তানি নামে একটি মিষ্টি মেয়ে বাস করত। প্রতি সন্ধ্যায় সে দারুণ সুরেলা একটি গান গাইত। একজন তরুণ একদিন বাড়ীতে ফেরার পথে মেয়েটির বাড়ীর সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার গলার স্বর শুনতে পেল। ছেলেটির নাম ছিল অপু। জীবিকা নিবার্হের জন্য তাকে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করতে হত এবং সন্ধ্যা নাগাদ সে ঐ রাস্তা ধরে হেঁটে বাড়ী ফিরত। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে সে দিনের পর দিন তানির গান শুনতে শুরু করল। বাড়ীতে ফেরা তার জন্য খুব একটা জরুরী বিষয় ছিল না। পৃথিবীতে তার আপনার বলতে কেউ ছিল না। অথচ তানির সুর তার কাছে চমৎকার ঝরণা ধারার মত ভেসে আসতে লাগল। বসন্তের ফোটা ফুলের রঙিন সৌরভ জড়ানো কোমল বাতাসের ন্যায় সংগীত ধ্বনি অপুর সত্ত্বা থেকে দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের গ্লানি ধুয়ে দিত। যখনই সে তানির গানে কান পেতে থাকত তখনই এই একই ঘটনা ঘটত। অপু ভাবল যে সে যদি মেয়েটির দেখা পায় তবে তার এই মন মাতানো গান শোনানোর প্রতিদান হিসেবে একটি সুন্দর উপহার দিবে তাকে। কিন্তু তাকে কী দেয়া যায়? একতোড়া ফুল? নাকি একটি পুতুল? সুন্দর একখানা পোশাক দিলে কেমন হয়? অপু দ্বিধায় পড়ে গেল। তারপর সে সিদ্ধান্ত নিল মেয়েটির সাথে দেখা করার এবং তাকেই জিজ্ঞাসা করবে যে, কোন জিনিস তার সবচেয়ে বেশী পছন্দ। পরদিন অপু খুব সহজেই মেয়েটির ঘরে প্রবেশ করল। অন্য কেউ সেখানে ছিল না। শুধু অপু আর তানি। অপুর কাছে বেশ অন্যরকম লাগল যে অপরিচিত হলেও তানি তাকে অত্যন্ত সমাদর করল। তাদের পরিচয়ের শুরু থেকেই তারা একে অপরের বিষয়ে অনেক কিছু আলাপ করল। যদিও সেই প্রথম আলাপ দীর্ঘ সময়ব্যাপী হল না তবু ধীরে ধীরে তা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হল। সত্যি কথা বলতে, তানির অতীত ইতিহাস অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। তার বাবা-মা একটি বিধবার ভীষণ ক্ষতি করেছিল এবং সেই মহিলা তাদের সন্তানসহ অভিশপ্ত করেছিল। তানির কাহিনীর এ পযায়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হওয়ায় আমি আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, শৈশব থেকে তানি গৃহবন্দি হয়ে পড়ল এই অভিশাপের কারণে। যাই হোক, আমাদের প্রধান নায়ক অপু আপাতত কোন কারণ ছাড়াই খুবই আনন্দের সাথে দিনাতিপাত করছিল। তার দিনগুলো এতটাই ঘটনাবহুল হয়ে উঠেছিল যে, তার মনের বিস্তৃত জায়গা কেন্দ্র করে তানির অবস্থান উপলব্ধি করার সুযোগই পেল না। তানির প্রেমে অপু পড়েছিল কিনা জানা নেই তবে অপুর মনে হতে লাগল যে, তার সমগ্র নিঃসঙ্গ জীবনেতিহাসের একটি অধ্যায় তানি নয় বরং সে হচ্ছে পুরোটুকুর সারকথা। অপরপক্ষে, তানির আকাঙ্খা ছিল একটু অন্যরকম। সে চাইছিল যেন অপু হয় তার উদ্ধারকর্তা। বাহির জগতের আলো দেখার জন্য তানি কতই না অপেক্ষা করে আছে! আকাশকে ছুঁয়ে এসে ধরণীর ধূলি অঙ্গে মেখে খোলা হাওয়ায় বুক ভরে নেয়ার স্বপ্ন লালন করেছে সে। যখন অপু সেটা বুঝতে পারল তখন সে কিঞ্চিৎ বিষন্নতার সাথেই আত্মাহুতির মহান সুখ অনুভব করতে পারল। প্রকৃতপক্ষে, তানির অভিশাপ দূরীকরনে সত্যিকার অর্থে তাকে ভালবাসে এমন কোন ব্যক্তি আর তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হবার দরকার ছিল। অপুকে নিজের দুই হাত দ্বারা তার হৃদপিন্ড তানির প্রতি উৎসর্গ করতে হবে। অপু স্বেচ্ছায় তা করতে প্রস্তুত ছিল কারণ সে ভাবল যে, তানির লালিত বাসনা পূরণের পণ সে একদিন করেছিল। সবোর্পরি, তানির খুশীই অপুর সন্তুষ্টি। রীতি পালনের উপযুক্ত সময় যখন এল তখন অপু তার বুক বরাবর ধারাল ছুরি হাতে তুলে নিল। সে এক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল। কাঠের মেঝেতে রক্তলাল পোশাকের অংশ ছড়িয়ে বসে ছিল তানি। তার উজ্জ্বল চোখ মাটিতে নিবদ্ধ ছিল। এই বিভৎস দৃশ্য অবলোকন করা তার পক্ষে ছিল অসম্ভব। অপু জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি আমাকে ভালবাস?”
তানি অনড় থাকল এবং কোন জবাব দিল না। সে আবার প্রশ্ন করল। তানি চোখ তুলে তাকাল অপুর সুগভীর চোখের পানে। তানির চোখের পাতায় দুই ফোঁটা অশ্রুকণা ঝিলমিল করছিল। অপু তৃতীয়বারের মত একই কথা জিজ্ঞাসা করল। এবার তানি কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে উত্তর দিল, “আমি জানি না।”
অপুর শেষ ইচ্ছা ছিল তানি শেষবারের মত একটি গান তাকে শোনাবে যেন তা নিদারুণ যন্ত্রণা মুছে দিতে পারে। তানি তা-ই করল। তানি গাইতে শুরু করার অনতি বিলম্বে অপু বুক চিড়ে ফেলল এবং হৃদপিন্ড কেটে বের করে নিয়ে এল। ওটা তানির হাতে তুলে দেয়ার সাথে সাথেই অপু মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল এবং তাতে জোরাল শব্দ সৃষ্টি হল। তক্ষুনি ঘিরে থাকা চার দেয়াল কাঁপতে আরম্ভ করল এবং অসংখ্য চিড় ফুটে উঠল। চিড়গুলো এতটাই বৃদ্ধি পেল যে ধীরে ধীরে দেয়াল ধ্বসে পড়তে লাগল। অপুর মৃতদেহ তানির গন্ডির ধ্বংসাবশেষের নিচে ঢাকা পড়ল। ঠিক সেসময় তানি ঋজু ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল অপুর সমাধির মধ্যস্থল হতে। এরপর থেকে তানি আশীবার্দপুষ্ট জীবন লাভ করল। সে স্বাধীন জীবনযাপন করেছিল এবং যেসকল নিয়ামত থেকে সে বঞ্চিত ছিল তা উপভোগ করেছিল। সে তার ভালবাসা এবং অপুর ভালবাসার স্মৃতিও অন্যান্য সাধারণ মানুষের মাঝে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনদিন সে গান করেনি। অবশেষে বলা যায়, তানির মধুর গানের মূল্যস্বরূপ অপু তাকে এমন একখানা উপহার দিয়েছিল যা তার সুরমূর্চ্ছনায় চিরদিনের মত নৈশব্দ এনে দিল।