দূরের সুরের কথামালা
১
যে চিনে সে চিনে নেবে অন্ধরেখাগুলো
আমার কী দায়? পথে পথে মৃত নদী
হয়তো নদীও নয়, একগুচ্ছ চুল
মেঠোখাল হয়ে মিশে আছে এঁকেবেঁকে।
আমি থাকি নদীর ওপারে- ওই ঘরে
এখানে হাওয়ায় মেঘ, অচেনা সংকেত
ক্ষণে ক্ষণে ধরা দেয় মনে। রোদ এসে
ঝড় এসে বলে, কিছু কী ফেলে গেলেন?
আমি আছি এইখানে, এই নদীতীরে
কেনই বা যাব, কিছু তো ফেলে আসিনি!
২
এ কি আলোড়ন? স্তব্ধতার স্মৃতি নিয়ে
একরাত ঘুমে কাটে, অন্যরাত জেগে
একবার ডাকি তারে, অন্যবার ভাবি
এ কি আলোড়ন, নাকি শিরশিরে হাওয়া?
দূরে থেকো ঝাঁকে ঝাঁকে, কাছে এসো একা
এইখানে আমি একা, মৌনতার দিকে
সঁপিনু পরাণ। তবু বাসনার ফাঁদে
সাধনা সাধনা বলে ডাকি কলহাস্য।
এ কি শিহরণ? শরীরের লোমকূপ
একবার মরে বেঁচে উঠে তিনবার।
৩
কখনো জাগিনি আগে এমন সকালে
পাহাড় ডিঙিয়ে নদী থেকে উঠে এল
স্ফটিক সময়। মনে হয়, ঢেউকেলি
হঠাৎ জোয়ার নিয়ে এসেছে এখানে।
এ কোন সকাল? শয্যা থেকে সরে যায়
ভিন্ন কোনো স্বাদশয্যা, মানুষের গন্ধ
উড়িয়ে-পুড়িয়ে নিয়ে যায় ঢেউগুলো
তবে কী তোমাতে আমি ভাসমান মেঘ?
কিছুটা সময় থাকি বালিরপ্রাসাদে
এ তো বালি নয়, এক সন্ন্যাসজীবন!
৪
যতদূরে বৃষ্টিরেখা ততদূরে তুমি
তারপর চোখের সীমানা ভুলে গিয়ে
রয়েছি তাকিয়ে। ধোঁয়া উঠে পথজুড়ে।
কোথাও কী জ্বলে গেল, নাকি সব ধুলি?
পথের সমস্ত রেখা, ধারাপাত জানি
তবুও বেপথু হাওয়া উড়িয়ে নিয়েছে
খড়কুটো। দিকচিহ্ন। যেন অন্ধরাতে
ছুটে আসে খরতপ্ত হাওয়ার দাপট।
পথ থেকে সরে গিয়ে বিপথেই হাঁটি
হেঁটে যেতে যেতে দেখি, সামনেই তুমি।
৫
বালুতটে থেমে গেছে স্রোতের কাঁপন
স্মৃতিগুলো ফাঁকা। মনে হয়, কেউ যেন
কেড়ে নিল মানুষের তিনভাগ দুঃখ
বাকিটুকু হারাল সূদুরে, শান্তস্রোতে।
এখন তো কিছু নেই, স্মৃতিহীন তটে
হঠাৎ কুকুর আসে, হরিণের পাল
ছুটে যায় বনে। যেন দুপেয়ে কুকুর
হন্য হয়ে খুঁজে হরিণীর হাড়-মাংস।
আমিও নিখোঁজ আজ, বনে বনে ঘুরে
মিশে গেছি এই বন্যকুকুরের দলে।
৬
কেশর উড়িয়ে আসে প্রলয়ের ঘোড়া
তোমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, বলে
এখানে জীবন মানে উদ্যত শরীর
এখানে জীবন মানে কেশর, নখর।
কামেপ্রেমে তার খোঁজ রাখেনি তো কেউ
তবু বলি, তাকে আনো পাহাড় চূড়ায়
গড়িয়ে যাবার আগে গলে যাবে সব
মতিভ্রম, ফের জন্ম নেবে অপরূপ।
কেউ বাঁচে অথবা মৃত্যুর দিকে যায়
তুমি যাবে কোন পথে, কোন আলিঙ্গনে?
৭
শুয়ে আছি মুখোমুখি। রাতের বেঘোরে
কখন যে কেটে গেল ছন্নছাড়া ঢেউ
বুঝি না ঠিকানা। তীরে, ভাসমান মেঘ
যেন লেগে আছে দুটি ঠোঁটের কোণায়।
বিষ ঢালি, শিশ্নে লেগে থাকা রস ঢালি
আকাশ ঘনিয়ে ঝড় এসে বলে যায়
আদিঅন্তহীন মহামিলনের কথা
আমরা কোথায় যাব, আদিরূপযোনী?
কোমলকঠিন হয়ে ঘনশ্বাসমূল
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়- হায়, রতিসুখসার!
৮
সবাই ছেড়েছে, জানি তুমি তো যাবেই
জীবন্মৃত। একে একে বৃষ্টির ভিতর
ছড়িয়ে পড়েছে বেলপাতা, নীলশাড়ি
ভাঁজে ভাঁজে যেন এক নৌকার দুলুনি।
আমি দুলি, সে-ও দোলে প্রায় প্রতিক্ষণে
মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলে, কোথায় যাবেন?
পেছনে বিস্ফার ঢেউ, কাঁপে মত্ততায়
যেন সে সন্ধ্যার বাঁকে দেখা রাজহাঁস।
আমি হাসি, সে-ও হাসে প্রায় প্রতিক্ষণে
শেষে উড়ে যায় বৃত্ত থেকে বৃত্তান্তরে।
৯
সব ছিন্ন করে দুটি কিচিরমিচির
উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে যুগযুগান্তর
যেন সুর, যেন ঘোর। উড়ে যাচ্ছে তারা
রক্তবীজ মুখে পুরে দূর অজানায়।
ডানাদের জন্ম জানি, মৃত্যু জানি বলে
জেগে আছে অতিকায় হাতি, দুটি ঘোড়া
পিঠে দাগ, দাগ থেকে দারুণ দুনিয়া
ঘুরছে, উড়ছে। যেন এক মোহ, জাদুচক্র।
কোথায় তোমার ছদ্মবেশ, জাদুবুড়ো
বৃক্ষছায়াতলে থামো, জিরোও এখন।
১০
কাঁদে না, কাঁপে না সুর দূর হাওয়ায়
এ তো সুর নয়, অন্ধ সানাইপ্রহার
কোথা থেকে এল? উদগ্রীব হয়ে শুনি-
সুর, সে তো তোমার মতোন একা নয়।
কায়া নিয়ে মায়াহীন হয়ে ছুটে চলি
মোহনায়। মেঘনা কী নেবে না আমাকে?
দরিয়ার বুক থেকে উঠে হুহু সুর
কাঁপে কেওড়াবন, এই বুঝি এল ঝড়?
কোনো সুর কোনো বাঁশি কাঁদে না এখন
কেননা তোমার মতো কেউ একা নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন