[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১২

তিন তিতলী....


তিন তিতলী....

“মেঘ বলেছে যাবো যাবো” বইটি দ্বিতীয় বারের মত শেষ করেছি। সময়টা ২০০৭ সাল। আমি তখন নবম শ্রেনীতে। টার্ম এন্ড পরীক্ষা শেষ। ভ্যাকেশন আর চার পাঁচ দিন পর। এই সময়টা সবাই গল্পের বই পড়ে কাটায়। স্যার রাও কিছু বলেনা। হাতে কোন বই না থাকায় তৌফিকের কাছ থেকে নিয়ে এই বইটিই আবার পড়লাম। প্রথম পড়েছিলাম সপ্তম শ্রেনীতে। দ্বিতীয় বার পড়তে গিয়ে অজানা অনুভূতি টের পেলাম। তিতলী নামের মেয়েটির প্রেমে পড়লাম। এবং তা ভয়াবহ ভাবে। মাথার ভেতর তখন তিতলী তিতলী। বাস্তব জীবনে তিতলীকে খুঁজতে লাগলাম। খুঁজে পেলাম ২০০৯ সালে। ফেসবুক নামের ভার্চুয়াল জগতে। তিনজন তিতলীকে পেয়েছিলাম। একজন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের,একজন ফেনী গার্লস ক্যাডেটের এবং একজন ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেটের। তিন তিতলীর সাথেই আমার বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতি আছে। এরমধ্যে প্রথম দুই তিতলী আমার ক্লাসমেট। সবেমাত্র ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছি। সারাক্ষন অনলাইনে থাকি। রংপুরের তিতলীর সাথে আমার টুকটাক কথা হয়। আমি তাকে তেতুল নামে ডাকি। মোটামুটি মধুর সময়। একটা সময় ছুটি শেষ হয়। আমাকে ফিরে যেতে হয় ক্যাডেট কলেজে। তিতলী নামের ভূত তখনো মাথায়। ক্যাডেট কলেজে বসে লিখে ফেলি তিতলী নিয়ে চার লাইনের একটি কবিতা,

“তেতুল বনে উঠেছে জোছনা আবার নতুন করে
সেই জোছনা বিলিয়ে দিলাম তিতলী তোমার তরে
জোছনা হয়ে জড়াবো তিতলী তোমার এলো চুলে
জোছনা ভরা এই লগনে খোপা রেখো খুলে. . . .”


কবিতাটি তিতলীকে দিতে পারিনি। ছুটি শেষে বাসায় ফিরে দেখি তিতলী আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নাই। থাকার কথাও না। দীর্ঘ তিন মাসের অনুপুস্থিতি একটা মানুষকে ভোলানোর জন্য অনেক। তাও যদি মানুষটা ভার্চুয়াল জগতের হয়। তিতলীরা কারো জন্যে অপেক্ষা করতে পারেনা। এক মুহূর্তের পাশে না থাকলে এরা অন্য কাউকে বেছে নেয়। অনেক কাল তিতলীর কোন খোঁজ নেই। হয়তো ভালোই আছে।

পরের দুই তিতলী সম্পর্কে অনেক কিছুই বলতে আমি অপারগ। সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক কিছু কারনে। ফেনীর তিতলী ছিল আমার ভালো বন্ধু। অন্য দুই তিতলীর সাথে ফেসবুকে পরিচয় হলেও এই তিতলীর সাথে পরিচয় মুঠোফোনে। ক্যাডেট হবার সুবাধে ভালো সম্পর্ক। মেয়েটিও ভালো। গান জানে। হুমায়ূন আহমেদ এর অন্ধ ভক্ত। অল্প দিনেই সম্পর্ক বেশ ভালো হয়ে যায়। তুই তোকারী সম্পর্ক। সুন্দর সময়। কোন এক ছুটি শেষে এসে দেখি সে আমার মুঠোফোন আর ধরেনা। এক দিন,দুই দিন,তিন দিন. . .একটা পর্যায়ে বুঝতে পারলাম সে আমার সাথে কথা বলতে চায়না। কাউকে জোড় করে কিছুই আমি করাইনা। আমিও ফোন দেইনা। একসময় ফেসবুকে তাকে পেয়ে যাই হুট করেই। আমার মুঠোফোন নম্বর নেয়। আবার কথা হয়। পেছনের অতীত ভুলে যাই। আবার বন্ধুত্ব। ইচ্ছে ছিল তিতলী নামের কোন মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলে তাকে মেঘ বলেছে যাবো যাবো বইটি উপহার দেব। তিতলীকে মনের কথা জানাই। সে ইচ্ছে পূরনের সুযোগ দেয়। তবে মেঘ বলেছে যাবো যাবো বইটি তার কাছে থাকায় সে অন্য বই দাবী করে। আমি তার জন্যে ‘তেতুল বনে জোছনা’ বইটি কিনি। বইয়ের মলাটে লিখে দেই সেই কবিতাটি,
তেতুল বনে উঠেছে জোছনা আবার নতুন করে. . . .

কবিতাটি তিতলী নিশ্চই পড়েছিল। কোন এক অজ্ঞাত কারনে তিতলী আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কবিতা পড়ে তিতলীর অনুভূতি জানা আর হয়ে ওঠেনি। অনেক কাল পরে তিতলীর সাথে আমার হঠাত্‍ দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে। প্রথম এবং শেষ দেখা। ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই অবাক হই। অনেক কথার ভীড়ে হারিয়ে যায় আসল কথাটি। কবিতার কথা আর জিজ্ঞেস করা হয়না। একসময় হুট করেই তিতলীর কাছ থেকে বিদায় নেই। ফিরে আসার সময় হঠাত্‍ মনে হয়,তিতলীর মুঠোফোন নম্বরটা চাই. . . . . .

অনেক কিছু ভেবে আর চাওয়া হয়ে ওঠেনা। কিছু ইচ্ছে অপূর্ন রেখে দিতে হয়। আবারো হয়তো আমাদের দেখা হবে,চলমান বাস্তবতায়,ঢাকা শহরের ব্যস্ত কোন রাস্তায়. . . .

তৃতীয় এবং সর্বশেষ তিতলী ছিল আমার চেয়ে বয়সে একবছরের বড়। নায়িকা টাইপ চেহারা। চোখে মুখে twilight এর বেলা বেলা একটা ভাব। খুব সাধারন ভাবে দেখেই বোঝা যায় এই মেয়ে ভীষন অহংকারী হবে। যার কাছে ছেলেরা কাগজের নৌকার মত। একটি গেলে খুব সহজেই আর একটি চলে আসবে। এক প্রকার ভয়ে ভয়েই তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই। একসেপ্ট ও করে। পরে জানতে পারি সে সে বাংলাদেশের মেয়েদের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক এবং আক্ষরিক অর্থে সেরা কলেজের অধিনায়ক। বিশাল ব্যপার। পার্ট থাকা স্বাভাবিক। আমি কবি মানুষ। ফেসবুকে তখন ছ্যাঁকা খাওয়া স্ট্যাটাস দেয়ার কারনে বন্ধু এবং পরিচিত মহলে প্রচুর টীজ খাই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার সাথে কথা বলার দুঃসাহস করি। টুকটাক কথা হয়। হায়,হ্যালো পর্যায়ের। আমার চ্যাটের রিপ্লাই দেয় এটাই আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়।মেয়েটাকে যতটা অহংকারী ভেবেছিলাম ততটা না। কিছুটা শান্ত শিষ্ট কিছুটা চঞ্চল মেয়ে। ততদিনে আগের দুই তিতলী কারো সাথে আমার যোগাযোগ নেই। নতুন এক তিতলী,নতুন এক অনুভূতি। হঠাত্‍ করে মনে হয় এই সেই তিতলী যার প্রতিচ্ছায়া আমি মেঘ বলেছে যাবো যাবো বইতে পাই। এই প্রথম মনে হয় গল্পের কোন চরিত্রকে আমি বাস্তবে দেখছি। হুমায়ূন আহমেদ এই মেয়েকে দেখলেও হয়তো তাই বলতো। তিতলী আমার বড় হওয়ার সুবাধে আপু ডাকতে হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আমরা একটা নির্দিষ্ট কম্যুনিটির অর্ন্তভূক্ত হওয়ায় সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্ক মেইনটেইন করতে হয়। তিতলী আপুর সাথে সম্পর্ক ভালোই হয়। মানুষকে কাছে টানার এক দারুন ক্ষমতা তার আছে। আর হয়তোবা এজন্যেই কলেজ জীবনে সে কলেজ অধিনায়ক হবার মত সম্মান টা পেয়েছে। তিতলী আপুর সাথে যত সহজে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তত সহজেই তা ভেঙে যায়। প্রথম প্রথম তাঁর ওয়ালে কবিতা পোষ্ট করতাম। যেখানে তুমুল কমেন্টস এ আমরা মেতে উঠতাম। এরপর কোন এক ছুটিতে এসে দেখি তিনি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। কারন কিছুটা অজ্ঞাত কিছুটা অনুমেয়।

অনুমেয় কারন গুলোকে কল্পনা স্তরেই রেখে দিয়েছি। আমি আর এর কারন ঘাঁটাতে যাইনি। কিছু রহস্য অমীমাংসিত থেকে যাওয়াটাই ভালো। এর অনেক কাল পরে একটি অনুষ্ঠানে তিতলী আপুর সাথে আমার দেখা হয়। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে মাঝামাঝি বাকরুদ্ধ এই আমাকে অবাক করে দিয়ে তিতলী আপু কৌতুহলের সুরেই জিজ্ঞেস করে, ক্যামন আছো কবি? আমাকে চিনতে পেরেছো?
তিতলীদের চিনতে অসুবিধা হয়না। হুমায়ূন আহমেদ তৈরি তিতলী উপন্যাসের কালি আর পাতাকে ছাড়িয়ে জীবন্ত হয়ে আছে এই বাংলার আকাশে বাতাসে। প্রতি পূর্নিমায় তিতলীরা জোছনা বিলাস করে। পাশে থাকে নতুন কেউ। আর তিতলী প্রেমী কবিরা লিখে যায় আপন মনে,

তেতুল বনে উঠবে জোছনা আবার নতুন করে
সেই জোছনা বিলিয়ে দেব তিতলী তোমার তরে
জোছনা হয়ে জড়াবো তিতলী তোমার এলো চুলে
ছোছনা ভরা এই লগনে খোঁপা রেখো খুলে. . . . .


অস্বচ্ছ জোছনার আবছায়া মায়াবী আলোয় তিতলীরা খোপা খুলে রাখে কিনা,মাঝেমাঝে জানতে ইচ্ছে. . . . .
(উদাসী কবি)

নিষিক্ত প্রভাতে..

 

নিষিক্ত প্রভাতে



আমাকে নতুন কিছু খুঁজে বের করতে হবে! এমন কিছু, যেটা একদম নতুন। মাঝে মাঝেই ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গে যায়, বুকটা ব্যথা করে ওঠে আর আশেপাশের সব অচেনা মনে হয়। বারান্দা দিয়ে হলুদ রোদ অল্প তাপে গায়ে এসে লাগে, আমি মশারীর ভেতর বসে অনেকটা সময় পার করে দেই। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। ভাবতে থাকি, আমাকে কি যেন খুঁজে বের করতে হবে! নতুন কিছু! অতীত ঘেঁটে কিছু একটা মেলানর চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা যে কি...

একসময় খুব ক্যারাম খেলতাম আর প্রচ্ছন্ন গর্বে চেয়ে দেখতাম আশে পাশের কোন বন্ধুই ক্যারাম খেলায় পারছে না আমার সাথে। এমন কি বড়রাও। আর ছোট কাকু যে কিনা বরিক পাউডার দিয়ে সরল রেখা টেনে আমাকে প্রথম খেলা শিখিয়েছিল, সেই ছোট কাকুও আমার কাছে বারে বারেই হেরে যাচ্ছে দেখে আমি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে মুখ গোমড়া করে রাখতাম সারা-বেলা। তখন ২ টাকা করে, রাস্তার ওপাড়ের ক্লাবে ক্যারাম খেলা হতো। ক্লাস এইট আসলে নিয়মিত ক্লাবে যাওয়ার জন্য তেমন ভালো সময় না। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া “রবিন”রা এলো। চশমা পড়া ছেলেটা যে এক সপ্তাহের মাঝে বোর্ড আর তাল গাছ মিলিয়ে মোট নয়বার আমাকে হারিয়ে দেবে তা বুঝি নি। তাও আবার ৩বার নীলে হেরেছিলাম। আমার স্মৃতি শক্তি খুবই দুর্বল, মুখস্থ করতে পারতাম না বলে ইসলাম শিক্ষা আর সমাজে বরাবরই কম নম্বর পেতাম, কিন্তু ভোরের হালকা তাপে হতবাক আমি দেখতে থাকি, রবিনের স্মৃতিটা বেশ অমলিন হয়ে আছে। এই এতো দিন পরেও...

এক দুপুরে আম্মু কেঁদে কেঁদে বলেছিল, “খোকন, রবিন আর নেই, এই মাত্র খবর এলো মারা গিয়েছে!” কি আশ্চর্য রবিন সাত দিন ধরে হসপিটালে ছিল, আম্মু-আব্বু দু দিন পর পর ওকে দেখতে গেলেও আমি একবারও দেখতে যাইনি। হাতের ভেতর লাল রঙের গুটিটা ধরে বসে থাকতাম বিকেল পর্যন্ত “এবার রবিন এলে ওকে আমি এমনিতেই রেডটা দিয়ে দেব আর রেড কভারও দিতে হবে না” রবিন আর আসে নি কোন দিন! সব মনে পড়ে যায়...

এরপর আমি আর কোন দিন ক্যারাম বোর্ড খেলেছি বলে মনে পড়ে না। সূর্যের আলো গায়ে এসে পড়তে থাকে আমিও বসেই থাকি। মাথার উপরে ফ্যানটা শোঁ শোঁ করে ঘুরে চলছে। হঠাৎ তরস্বিনীকে মনে পড়ে যায় নাকি অন্য সব চিন্তারাই অযাচিত ভাবে তরস্বিনীর ভাবনা থেকে আমাকে খানিক ফিরিয়ে রাখে, আমি এবার তা মেলানর চেষ্টা করতে থাকি। এই তো সামনে তরস্বিনীর বিয়ে! কিন্তু এটা অতোটা ইম্পরট্যান্ট না! গুরুত্ববহ হচ্ছে, আমাকে অবশ্যই নতুন কিছু একটা খুঁজে বের করতে হবে! নতুন কিছু একটা! কিন্তু সেটা যে কি...
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে...


অনেক সবুজের প্রান্তে তুমি থাকো একাকী
আমি ধূসর ধূসর হয়ে জেগে থাকি,
অনেক মানুষের ভিড়েও তুমি থাকো একাকী
আমি অনেক আশা নিয়ে বসে থাকি।


(শিরোনামহীন)

শূন্য নিশি

 

শূন্য নিশি




রাতের আকাশ, শূন্য উঠান, নিশি মেঘের বাণ,
হাস্না হেনা শুনছে জেগে, জোছনা পালার গান।

তারার দেশে, ঘুম আবেশে, রাত্রি জেগে রয়,
ঘুম পাড়ানি হালকা বাতাস, মৃদু সুরে বয়।

চাঁদের প্রেমে, আঁধার নামে, উদাস মনের ঢেউ,
নদীর ধারে, কাশবনে আজ, একলা বসে কেউ।

রাতের নদী, নিরবধি, ঢেউ খেলে তার জলে,
চাঁদের আলোয়, অবুঝ মনে, দুঃখ পাহাড় ঢলে।

তন্দ্রা মোহে, আচ্ছাদিত, শুকতারা সাম্পান,
রাতের বুকে, মুখ লুকিয়ে, রোদের অভিমান।

চাঁদের সাথে আড়ি আমার, অন্ধকারে ফেরা,
শূন্য নিশি, দেয়না স্বপন, ঘুমের কাঁথা ছেড়া।

শেষ ট্রেনে আজ ফিরছি বাড়ি, শুন্য তেপান্তর,
শূন্য নিশি, আমার চোখে বাঁধবি কি তুই ঘর...

রবিবার, ২২ জুলাই, ২০১২

ভালবাসায় মনোনিবেশ


ভালবাসায় মনোনিবেশ

যদি আমার তরে তোমার হৃদয়
করো ভালবাসায় মনোনিবেশ;
তবে দূর করো আজি মনোবেদনা
জাগুক হৃদয়ে স্বপ্নীল মনোবাসনা।


পশ্চাতে ঠেলে দাও নির্ভয়ে পুরোনো
হৃদয়ের সবটুকু মান-অভিমান;
তোমার প্রতি বাড়বে মম মনোধিকার
ভালবাসা আজি দু’জনার সমোধিকার।

করো চরিতার্থ নিশীতে স্বপ্নালোকের
মাঝে তোমার শত কামনা-বাসনা;
তোমার তৃষায় দূরীভূত হোক বেদনা
জাগুক যুগল মনে ভালবাসার চেতনা।


স্বপ্নের বিভোরে খুলে দাও তোমার
অবরুদ্ধ করা তমাট মনোমন্দির;
রাখ অটুট চিরতরে ভালবাসার মনোবল
ঘুচে যাক দুঃখ-ঝরুক চোখের নোনাজল।

শীতল করো মন ভালবাসায় রাঙ্গিয়ে
জীবনের গদ্যে-পদ্যে হৃদয় মনোরঞ্জন;
প্রেম যেন না হয় মিছে শুধু মরীচিকা
স্বপ্ন যেন না হয় প্রেমহীন বিভীষিকা।

সব মেঘ গর্জনে আমি রইবো তোমার পাশে

 

সব মেঘ গর্জনে আমি রইবো তোমার পাশে
 

আজ দুইদিন ধরে পৃথিশার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি । ওর সামনে পড়তে চাচ্ছি না । কেমন জানি একটা অস্বস্তি খেলা করছে বুকের ভিতর ।
কি সহজ সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল ওর সাথে আর এখন কেমন জানি হয়ে গেল । হয়তো কিছুই হয় নি কিন্তু নিজের কাছে কিছুতেই সহজ হতে পারছি না । স্যার ঢোকার পরপরই ক্লাস রুমে ঢুকেছি তাই পৃথিশা কথা বলার সুযোগ পায় নি । এখন স্যার ক্লাস রুম থেকে বেরোনোর সাথে সাথে বের
হয়ে যেতে হবে যাতে পৃথিশা আমাকে ডাকার সুযোগ না পায় । কিন্তু যেমনটি ভাবলাম তেমনটি হল ।
ক্লাস রুম থেকে বের হতে যাবো ঠিক এমন সময়ই পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম
-এই আবির । দাড়া বলছি ।
পৃথিশা ডাকছে । ডেকে যখন ফেলেছে দাড়াতেই হল । আমার সামনে এসে বলল
-মোবাইল হারিয়ে ফেলছিস ?
-মোবাইল হারাবো কেন ?
-কাল আর পরশু মিলে কত বার ফোন দিয়েছি ?
আমি হিসাবটা জানি । পরশু দিন থেকে ও কম করে হলেও সত্তর বার ফোন দিয়েছে । মেসেজও পাঠিয়ে অনেক গুলো ।
আমি ধরি নি ।
বলতে গেলে ধরতে পারি নি । অস্বস্তির জন্য ।
-সাইলেন্ড ছিল তো বুঝতে পারি নি ।
-পরে তো দেখেছিস । ব্যাক করিস কেন ?
-আসলে ........
-থাক মিথ্যা কথা বলতে হবে না । আমি দুদিন ধরে দেখছি তুই আমাকে এড়িয়ে চলছিস । কারনটা বলবি ?
-কই না তো এড়িয়ে চলছি না তো । এড়িয়ে চলবো কেন ? আশ্চর্য ।
-আমার সাথে মিথ্যা কথা বলার ট্রাই করিস না । এখন পালাচ্ছিলি কেন ?
-পালাবো কেন আশ্চর্য ?
-আমি তোর বিহেবিয়ার খুব ভাল করে জানি । তুই যখন কিছু লুকাতে চাস তখন তুই কথার শেষে বারবার আশ্চর্য লাগাস । আর তোর নাক ঘামতে থাকে ।
কথা সত্য । নাকে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি নাক ঘামতেছে ।
-না সত্যি এখন আমার একটা জরুরী কাজ আছে । এখনই যেতে হবে ।
মনে হল না যে পৃথিশা আমার কথা বিশ্বাস করেছে । বলল
-ঠিক আছে যা । তবে বিকাল বেলা দেখা করবি ।
আমি বলতে যাচ্ছিলাম টিউশনি আছে কিন্তু আমার বলার আগেই পৃথিশা বলল
-আমি জানি আজ তোর টিউশনি নাই ।
তারপর কি মনে হল পৃথিশা আমার আর একটু কাছে এসে দাড়াল । আমার হাতটা ধরে বলল
-আমার হাত ছুয়ে কথা দে যে দেখা করবি । বল ।
আমি অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলাম ।
ওর চোখের দিকে তাকাতেই অস্বস্তিটা আরো বেড়ে গেল । কি গভীর চোখেই না ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে । এই দৃষ্টিটা আমার একদমই পরিচিত নয় ।
-আচ্ছা আমি কথা দিলাম । আসবো ।
পৃথিশা ক্লাস রুমের ভিতরে চলে গেলো । আমি পালালাম ওখান থেকে ।

বলতে গেলে পৃথিশা আমার সব থেকে ভাল বন্ধুদের একজন । একজন বলছি কেন ও ই সব থেকে ভাল বন্ধু আমার । ওর সব থেকে যে দিকটা আমার ভাল লাগে সেটা ও সব কিছু সোজা সুজি বলে । কোন ঘুরিয়ে পেচিয়ে না । একজনকে ওর পছন্দ না সরাসরি বলবে যে পছন্দ না । কথা ঘোরাবে না । আর ও কোন কিছুতে লুকোছাপা করতো না । একটু এক গুয়ে । যা একবার বলবে তা করবেই ।
এমন একটা মেয়ের সাথেই ছিল আমার বন্ধত্ব । ওর সাথে সময় বেশ ভালই কাটছিল । আমাদের সম্পর্কটা বেশ সহজ আর স্বাভাবিক ছিল । আমরা একসাথে পড়তাম খেতাম ঘুরতাম গল্প করতাম । কি চমৎ‍কারই না দিন কাটছিল !
কিন্তু সব কিছু কেমন পরিবর্তন হয়ে গেল দুদিন আগে । দুদিন আগে ওর সাথে সোঁনার গায়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম । আমাদের প্লান ছিল বিকালের মধ্যেই ফেরত্‍ আসবো । সোঁনার গা দেখার পর আমরা পাশের একটা গ্রামের পথ ধরে হাটছিলাম ।
সত্যি বলতে ওর সাথে হাটতে খুব ভাল লাগছিল । পৃথিশাকে হাসি খুশি লাগছিল । কিন্তু হঠাত্‍ ওর মুখটা কালো হয়ে গেল । আমি বললাম
-কি হল ? তোর মুখটা ওমন কেন হয়ে গেল কেন ??
ও আকাশের দিকে ইশারা করে বলল মেঘ জমছে ।
-তো কি হয়েছে ? আমরা গ্রামের কোন ঘরে আশ্রয় নিয়ে নেবো । সমস্যা কি ?
-না না চল । জলদি চল ।
-কেন ? দেখ না কি চমৎ‍কার একটা আবাহাওয়া । আর একটু থাকি না ?
কিন্তু পৃথিশার চেহারায় কেমন জানি একটা অস্বস্থিরতা দেখতে পেলাম । ও বারবার বলতে লাগল
-চল আবির । প্লিজ চল ।
আর থাকা গেল না । ওকে নিয়ে রওনা দিলাম । কিন্তু এতো দ্রুত সারা আকাশ কালো হয়ে গেল যে আমরা খুব বেশি যেতে পারলাম না । পুরো আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল । আর বিদ্যুৎ‍ চমকাতে লাগল । বাধ্য হয়ে একটা বড় বটগাছের নিচে দাড়াতে হল ।
একটু পর খুব জোড়ে বিদ্যুৎ‍ চমকাতে লাগলো । আমি অবাক হয়ে দেখলাম পৃথিশা কেমন জানি ভয় পাচ্ছে । প্রতিটা বর্জ্যপাতের সাথে ওর চেহারায় কেমন একটা ভয়ে চিহ্ন দেখা দিচ্ছে । বাচ্চা মেয়ে মত ভয়ে কুড়রে উঠছে ও ।
আমি ওর হাত ধরলাম ।
-কি হয়েছে পৃথু ? এমন করছিস কেন ?
ঠিক তখনই খুব জোড়ে বাজ পড়ল । পৃথিশা এতোই ভয় পেলো যে আমাকে জড়িয়ে ধরল । এতো জোড়ে জড়িয়ে ধরল যে আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগা আরাম্ভ করল ।
প্রতিবার বাজ পড়ছিল আর ও আরো একটু একটু করে আমাকে জড়িযে ধরছিল । কি করবো ঠিক মাথা কাজ করছিল না । তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে ও বর্জ্যপাতে ভয় পাচ্ছিল । আমার জড়িয়ে ধরে ও আশ্রয় খোজার চেষ্টা করছিল । যতক্ষন আকাশে মেঘ ডাকছিল ও আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল । তবে শেষের দিকটা ওর ভয় পাওয়ার মাত্রটা একটু কম ছিল ।
মেঘ ডাকা কমে গেলে আমরা ঢাকা দিকে ফিরে আসি । পুরো রাস্তা ধরে ও এক দম চুপ করে থাকল । আমার হাতটা একটা বারের জন্যও ছেড়ে দেয় নি । মনে হচ্ছিল যেন বাচ্চা একটা মেয়ে । কোন কিছু দেখে ভয় পাচ্ছে । তাই আমার হাত ধরে রেখেছে ।
ওকে হলে পৌছে দিলাম কিন্তু আমার মনের ভিতর একটা অস্বস্তি রয়েই গেল । বার বার ঐ সময়ের কথা আমার মনে পরছিল । পৃথিশা কিভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল ।
এই অনুভুতিটা আমি কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছি না । তাই বিকেল বেলা যখন ওর সাথে দেখা হল খুব অস্বস্তি লাগছিল ।

আমি বসে ছিলাম জারুল গাছটার নিচে । পৃথিশা কেমন এলোমেশো পা ফেলে এগিয়ে আসছিল । কিছু একটা ভাবছিল । কাছে আসতে ওকে বললাম
-কেমন আছিস ? কেন জানি ওকে তুই করে বলতে একটা কষ্ট হচ্ছিল ।
-ভাল । পৃথিশা হাসল ।
আমার কাছে এসে বসল । কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকল । একসময় বলল
-কিছু বলছিস না কেন ?
-কি বলব ? তুই না বললি কি যেন বলবি ।
পৃথিশা আরো কিছুক্ষন চুপ করে থাকল । তারপর হঠাৎ‍ করে বলল
-তুই খুব অবাক হয়ে ছিলি না ?
- হুম ? কি বললি ?
-ঐ দিন যে তোকে জড়িয়ে ধরেছিলাম । অবাক হয়েছিলি ?
-একটু হয়েছিলাম ।
-এই জন্য আমার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলি ?
-পালাবো কেন ? আশ্চার্য !
পৃথিশা হেসে ফেলল ।
-তুই আসলেই একটা গাধা । ঠিক মত মিথ্যা কথাও বলতে পারিস না ।
আমি কিছু বললাম না । ও আবার বলল
-জানিস আবির আমি মেঘ ডাকা খুব ভয় পাই । সেই ছোট বেলা থেকে । এতো ভয় লাগে আমার । এই জন্য তোকে জড়িয়ে ধরেছিলাম । ভয়ে ।
-ঠিক আছে সমস্যা নাই ।
-জানিস আগে এতো ভয় পেতাম । মাঝে মাঝে তো অজ্ঞান হয়ে যেতাম ।
-এতো ভয় কেন পাস ?
-জানি না ।
-ওকে সমস্যা নাই । চল কিছু খাওয়া যাক ।
আমি উঠে দাড়ালাম ।
-আবির বস । আমি এখনও কথা শেষ করি নি ।
আমি আবার বসে পড়লাম । ও বলল
-আমি সারা জীবন মেঘ ডাকাকে এতো ভয় পেয়েছি তোকে কিভাবে বোঝাবো ? কিন্তু সেদিন যখন তোকে জড়িয়ে ধরেছিলাম প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগছিল । কিন্তু একটা সময় এসে আমি লক্ষ্য করলাম আমার আর ভয় লাগছে না । আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম । তোমার বুকে আমি নিজেকে এতো নিরাপদ বোধ করছিলাম যে তোকে বলে বোঝাতে পারবো না ।
পৃথিশা চুপ করে থাকল কিছুক্ষন ।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না ।
-আবির ?
-হুম ।
আমি পৃথিশার দিকে তাকালাম । ওর ঠোট দুটো কাঁপছে । কিছু যেন বলতে চাইছে । কিন্তু বলতে পারছে না । ওর চোখ দুটো নির্বাগ চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । চোখের ভিতে পানি জমতে শুরু করেছে ।
আমি হঠাৎ‍ করে বুঝে ফেললাম ও কি বলতে চায় ।
হঠাৎ‍ করে সেই অস্বস্তিটা চলে গেল ।
ওখানে কেমন যেন একটা ভাল লাগা আমার পুরো মন কে স্পর্শ করল । ওকে বললাম
-তোকে কিছু বলতে হবে না ।
ওর হাত দুতো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম
-আমি সব সময় তোর পাশে থাকবো ।

পৃথিশার চোখ দিয়ে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ল । আমি সেই অদ্ভুদ ভাল লাগা অনুভূতি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম ।


অননিতার গল্প

 

অননিতার গল্প

অননিতা যখন এস্টেটার গেটের সামনে দাড়াল তখন বিকেল ছুই ছুই করছে । রোদ আছে কিন্তু রোদের তেজ অনেকটা কম । অবনিতা নামটা আবার পড়ল ।
মামুন এস্টেট । অননিতা আরো একবার ঠিকানা টা মিলিয়ে নিল । হুম এটাই সেই জায়গা ।
গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই একটা লোক এগিয়ে এল । পোষাক দেখে মনে হল দারোয়ান হবে হয়তো ।
-কার কাছে যাইবেন ?
-এখানকার এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মাহাফুজ করিম , ওনার বাংলাটা কোন দিকে বলতে পারেন ?
দারোয়ান গোছের লোকটা প্রথমে কি যেন ভাবল । কিছু যেন মনে করার চেষ্টা করছে ।
অননিতার ভয় হল হয়তো লোকটা বলবে মাহাফুজ করিম নামে এই চা বাগানে কেউ চাকরী করে না ।
-আবির স্যারের কতা বুলছেন ?
অননিতার জানে পানি এল । এতো দিন পর আবিরকে খুজে পাওয়া গেল ।
-হ্যা । আবির । আমি ওর ওয়াফ । মানে স্ত্রী ।
লোকটা হাসল ।
-মেমসাব ওয়াপের মানে জানা আছি । লোকটা আবার হাসল ।
-আপনি একটু খাড়ান আমি ভ্যান লিয়ে আসছি । সারের বাংলো একে বায়ে শেষ মাথায় ।
লোকটা বেশ সাহায্য করল । নিজেই ভ্যান নিয়ে এল । ব্যাগটাও অননিতাকে তুলতে দিলো না । বলল
-আপনে আবির সারের ওয়াইপ । আপনাকে ব্যাগ তুলবেন আর হামি চাইয়ে চাইয়ে দেখমু তা হবি না ।
ভ্যানটা যখন এস্টেট টার মাঝ খান দিয়ে যাচ্ছিল অননিতা চারিপাশে তাকিয়ে দেখছিল । চারি পাশে কি শান্তির একটা ছায়া রয়েছে । আবিরের সব সময় এমন একটা চা বাগানে চাকরি করার স্বপ্ন ছিল । ওর আগেই বোঝা উচিত্ ছিল । তাহলে আরো আগে ওকে খুজে পাওয়া যেত ।
গত কাল তুহিন যখন ফোন করে আবিরের ঠিকানাটা দিল ওর প্রথমে বিশ্বাসই হয় নি । প্রায় দুইমাস ধরে আবির গায়েব । কোন খোজই পাওয়া যাচ্ছিল না ।
অননিতা কোথায় খোজ করে নি ? প্রথমে ভেবেছিল হয়তো আবির ওর গ্রামের বাড়ি গিয়েছে । কিন্তু না । ওখানে সে যায় নি । তারপর ওর যত বন্ধুবান্ধব আছে সবার বাসায় ও গিয়েছিল । সম্ভাব্য সব জায়গায় ও আবির কে খুজেছে । কিন্তু আবির যেন একেবারেই হাওয়া হয়ে গিয়েছিল ।
প্রথম প্রথম অননিতার মনে হত আবির হয়তো ওর সাথে ফান করছে । কিংবা ওর উপর অল্প স্বল্প রাগ করেছে । রাগ পড়ে গেলেই চলে আসবে । কিন্তু এক সপ্তাহ পরেও যখন আবির এল না তখন অননিতা খুব টেনশনে পড়ে গেল ।
-এই যে আবির সারের বাংলু ।
অননিতা ভ্যান থেকে নেমে পড়ল । লোকটাকে টাকা দিতেই লোকটার ৩২টা দাঁত আনন্দে বের হয়ে গেল । বাংলোর সিড়ি পর্যন্ত ওর ব্যাগ পৌছে দিল ।
বাংলোটা বেশ সুন্দর । সিমসাম ছোট । অননিতার মনটা ভাল হয়ে গেল । একে তো আবিরকে পাওয়ার আনন্দ তার উপর এতো সুন্দর একটা পরিবেশ । অননিতার মনে হল আজকের দিনটা ওর জন্য খুব আনন্দের ।
বাংলোর মেইন দরজা খোলাই ছিল । ওর সারা শব্দ পেয়ে একটা বুড়ো মত লোক বেরিয়ে এল ।
-কাকে চান ? লোকটা এই প্রশ্নটা করেই খানিক চুপ করে থাকল । ওর চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন । একটু পর বুড়োর মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল । বলল
-অনেকটা পথ এসেছেন । ক্লান্ত নিশ্চয় ? আমার সাথে আসেন ।
-আমি আসলে আবির .......
অননিতা বলতে গেল । বুড়ো মত লোকটা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কে । আমি স্যারের বাবুর্চি । স্যারের সব দেখাশুনা আমিই করি । স্যারের আসতে আরো কিছু সময় লাগবে । আপনি ফ্রেস হয়ে নিন । এইটা স্যারের রুম ।
অননিতা আর কোন কথা বলল না । তবে একটু অবাক হল । বুড়ো ওকে চিনল কিভাবে ? যাক পরে এক সময় জিজ্ঞেস করতে হবে ।
অননিতা আসলেই অনেক ক্লান্ত ছিল । সারাটা দিন জার্নির উপরই ছিল । তুহিনের কাছ থেকে খরব পেয়ে ও আর দেরি করে নি একটুও । কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই চলে এসেছে । ওর কেবল মনে হচ্ছিল যে কোন ভাবেই আবিরের কাছে ওকে যেতে হবেই ।
ফ্রেস হবার পর ওর ক্লান্তিটা একটু কম মনে হল । বিছানার এসে গা এলিয়ে দিল ।
চোখ যখনই সিলিংয়ের দিকে গেল একটা ধাক্কার মত খেল ও । পুরো বিছানার সমান বড় একটা পেইন্টিং সিলিংয়ে আটকানো । যেই বিছানায় শোবে সরাসরি চোখ পরবে পেইন্টিং টার দিকে । অননিতা চমকালো । কারন পেইন্টিংটা ওর নিজের ।
আবির সব সময় ঘুম থেকে উঠে ওর মুখ দেখতে চাইতো । ও বলত আমি যাকে সব চেয়ে ভালবাসি প্রতি দিন যেন তার চেহারা দেখেই আমার ঘুম ভাঙ্গে । এখানেও যেন ঘুম ভাঙ্গার পর আবির ওকেই দেখতে পায় সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে । আর এই জন্য বুড়ো বাবুর্চি ওকে চিনতে পেরেছে ।
অননিতা একটু চোখ বুজল । আজ প্রায় দুই মাস পর ও যেন একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারছে ।

অননিতা সব সময় একটু উশৃঙ্খল টাইপের ছিল । সব কিছুতেই ওর যা ইচ্ছা তাই করতো । কারো বাধা শুনতো না । কিন্তু অননিতা সব সময় ওর বাবাকে দেখে ভয় পেত । যদি ওর বাবা ওর কোন কাজেই বাঁধা দিতো না কিন্তু বাবার রাগ কে ও খুব ভয় পেত । তাই যখন ওর বাবা ওর বিয়ের জন্য আবির কে নিয়ে এল অননিতা আপত্তি করার সাহসই পায় নি ।
বিয়ের পর ওরা আলাদা বাসায় উঠে এল । অননিতা আরো আবিষ্কার করল যে আবির খুবই ভাল একটা ছেলে । ও যেন আরো একটু ছাড় পেয়ে গেল । আগে তো বাবা নজর দাড়ি ছিল । তাই কোন কিছু করতে হলে একটু ভয় ভয় করতো । বিয়ের পর সেই ভয়টুকুও রইল না । আবির সারাদিন অফিস করত । সন্ধ্যায় বাসায় এসে ওর সাথে সময় কাটাতো ।
সারা দিনে কোথায় ছিল কি করছিলে এমন কিছুই জিজ্ঞেস করতো না । মোট কথা অননিতা খুব আনন্দেই ছিল । আর একটা ব্যাপার অননিতা খ্যাল করলে আবিরের সঙ্গ ওর ভাল লাগছে । ও যতই বাইরে বাইরে থাকুক অন্য মানুষের সাথে মিশুক , আবিরের সাথে কাটানো সময় গুলো ওর কাছে বেশ মধুরই মনে হত । সব থেকে বড় কথা অননিতা খুব ভাল করে টের পেত আবির ওকে ভালবাসতে শুরু করেছে । ব্যাপারটা অননিতা নিজেও খুব উপভোগ করত ।
এভাবেই ওর দিন গুলো কাটছিল কিন্তু একদিন এর স্বন্দ পতন হল । ঐ দিন অননিতার এক বান্ধবীর বাসায় পার্টি ছিল । বেশ রাতই হয়ে গেছিল । বাসায় আসছিল না দেখে আবির নিজেই পার্টিতে হাজির হয় । অননিতা তখন ড্রিংস করায় ব্যস্ত । আবীব মোটামুটি জোড় করেই ওকে বাসায় নিয়ে এল ।
অননিতা বোধহয় একটু বেশিই ড্রিংস করে ছিল । বাসায় এসেই আবীরের উপর ঝাপিয়ে পড়ল । আবীর কে বলল
-তোমার সাহস তো কম না ! তুমি কোন সাহসে আমাকে নিয়ে আসলে ?
-অননি আমি তোমার হাসবেন্ড । এই অধিকার আমার আছে ।
-হাসবেন্ড মাই ফুট । আমার বাপের অফিসে চাকরী করে আমার বাপের তা খেয়ে এমনকি আমার বাপের দেওয়া ফ্লাটে থেকে তুমি কোন সাহসে আমার উপর অধিকার ফলায় । এক্ষনি তুমি বের যাও আমার বাসা থেকে । আমি তোমার মুখ যেন আর না দেখি ।
অননিতার যদিও হুস ছিল না , তবুও আবীরের কাছে কথা গুলো খুব খারাপ লেগেছিল । ঐ রাতের বেলা ও বাসাতেই ছিল কিন্তু সকাল হতেই ব্যাগ গুছিয়ে ঐ বাসা থেকে বের হয়ে গেল ।
সকালে অননিতার ঘুম ভাঙ্গলে রাত্রের সব কথা ওর মনে পড়ে যায় । ও ভেবে রাখে যে সন্ধ্যায় আবীর যখন অফিস তখন অফিস থেকে আসবে তখন ওকে সরি বলবে । বেচারা নিশ্চই অনেক কষ্ট পেয়েছে ।
কিন্তু যখন সন্ধ্যার পরেও যখন আবীর যখন বাসায় আসল না , অননিতার কেমন যেন একটা ভয় করতে লাগল । ওর ভয়টা সত্যি হল যখন বাড়ির কাজের লোকটা বলল যে আবীর সকাল বেলা বড় একটা ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে ।
অননিতা ভয়তে ওর বাবাকে কিছু বলতেও পারছিল না । ঠিক সাত দিন পর অননিতার বাবা ওকে ফোন করল । ফোনে বলল
-কি ব্যাপার আবীর কই ?
অননিতা কিছু বলতে পারল না ভয়তে । ওর বাবা বলল
-ও আজকে রিজাইন করেছে । ওর মোবাইল ও অফ পাচ্ছি । কি হয়েছে বলত ?
অননিতা বলল
-আব্বু ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে ।
-কেন বাড়ি ছেড়ে যাবে কেন ?
অননিতা বুঝল আর চুপ করে থেকে লাভ নেই । আস্তে আস্তে সব বলে দিল । সব শুনে অননিতা বাবা খুব রাগ করল । অননিতাকে বলল
-তুই আবীরকে খুজে কে খুজে আনবি তারপর আমার সামনে আসবি ! এর আগে আমি তোর মুখ দেখতে চাই না ।
তারপর থেকেই অননিতা ওকে পাগলের মত খুজে বেড়াচ্ছে ।

প্রতিদিনই অফিস থেকে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । আবীর চায় আরো ব্যস্ত থাকতে । সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওর সময়টা ভালই কেটে যায় । কাজের মধ্যে ডুবে থাকে । কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে আর সময় কাটতে চায় না কিছুতেই । কেমন যেন সব কিছু থেমে যায় ।
ও ভাবে নি যে অননিতাকে ও অতো খানি মিস করবে ? মাঝে মাঝে মনে হয় ঐ দিন ওভাবে চলে না আসলেও তো হত । অননিতা ড্রাঙ্ক ছিল । কি বলতে কি বলেছে ! কিন্তু কথা গুলো ওর ঈগোতে বড় লেগেছিল ।
অননিতার উপর প্রচন্ড এক অভিমান জন্মে ছিল বুকে । যাকে ভালবাসা যায় তার উপর তো অভিমান করা যায় ।
সন্ধ্যার কিছু পর কাজ শেষ হল । সারা দিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে । বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দিতে হবে । আবীরের কাছে এই চা বাগানের চাকরীরা অনেক আকর্ষনীয় ছিল । আবীর অনেক দিন থেকেই এরকম একটা চাকরীর চেষ্টাই ছিল । ইচ্ছা ছিল এরকম একটা চাকরী হলে অননিতাকে নিয়ে চলে আসবে । তারপর দুজনে মিলে খুব সুন্দর একটা জীবন কাটাবে ।
কিন্তু অননিতাকে ছাড়া এই আকর্ষনীর চাকরীটা মোটেই খুব বেশি আকর্ষনী মনে হচ্ছে না । এই চা বাগানের সৌন্দর্য আবীরকে খুব আনন্দ দিতে পারছে না । আবীর খুব ভাল করে বুঝতে পারছে ওর সামনের দিন গুলো আরো কষ্ট নিয়ে আসবে ।
ও বাসার দিকে রওনা দিল । ইদানিং আর একা একা বাইরে বেশি ভাল লাগে না । নিজের শোবার ঘরটাই ওর কাছে এখন ভাল লাগে । যখন ও নিজের বিছানায় শোয় তখন ও অননিতা মুখটা দেখতে পায় ।
কি যে ভাল লাগে ওর ! বাসার কাছে চলে এসেছে এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠল ।
তুহিন ফোন করেছে ।
-বল ।
-দোস্ত একটা কাজ করে ফেলেছি ।
-কি করেছিহ ?
-অননিতাকে তোর ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি ।
আবীর কিছু বলতে গিয়েও বলল না । তুহিন আবার বলল
-প্লিজ রাগ করিস না । ও তোর ঠিকানা পাগলের মত খুজতেছিল । খুব অস্থির হয়ে গিয়েছিল । আমি আর না দিয়ে থাকতে পারি নি । প্লিজ কিছু মনে করিস না । আর কত দিন ওর উপর রাগ করে থাকবি ?
-আচ্ছা ঠিক আছে ।
ফোন রাখার পর আবীরের কেন জানি একটু আনন্দ বোধ হচ্ছে । ওর মনে হচ্ছে দু এক দিনের মধ্যে অননিতা ওর এখানে চলে আসবে । ওর এই কথা মনে হতেই খুব ভাল লাগতে লাগল ।

আবীর যখন ওর বাংলোতে পৌছিয়ে তখন বেশ অন্ধকার । বাংলোতে কোন আলো জ্বালানো হয় নি ।
-এই সগির মিয়া এতো আলসে হয়েছে ! সন্ধ্যার সময় আলোটাও জ্বালাতে মনে থাকে না । বাংলোর সিড়িতে উঠে বলল সগির মিয়া ! লাইট জ্বালাও নি কেন ? সন্ধ্যার ঘরবাড়ি অন্ধকার কেন ? ঠিক তখনই আলো জ্বলে উঠল ।

আবীর খুব চমকে উঠল । ওর ঘরের চৌকাঠের সামনে অননিতা দাড়িয়ে আছে । কেমন চোখ ছলছল চোখে ।
আবীরের প্রথমে মনে হল ওর হয়তো চোখে ভুল । অননিতা একটুও দেরি করল না সরাসরি ওকে জড়িয়ে ধরল ।
আবীর কোন কথাই বলতে পারল না । কেবল একটা আনন্দের অনুভূতি ওকে ঘিরে ধরল । আবীর ভেবেছিল অননিতা আসবে কিন্তু একেবারে আজকেই আসবে ও ভাবতেই পারে নি ।
একসময় আবীর অনুভব করল যে অননিতা কাঁদছে ।
-কাঁদছো কেন ?
-কাঁদবো না তো হাসবো ? গাধার মত কথা বলবা না ।
আবির হাসলো ।
ফোপাতে ফোপাতেই বলল
-তুমি এমন করে আমাকে কেন কষ্ট দিলে ? আমি কি ইচ্ছে করে ওসব বলেছিলাম । তুমিতো জানতে আমি ড্রাঙ্ক ছিলাম । আমার কথায় এতো রাগ করলে কেন ? কেন এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে এলে ? আমার কথা একবারও মনে পড়ে নি ?
আরো কতশত অভিযোগ !
আবীর কোন কথা বলে না ।
অননিতাকে আরো নিবির করে জড়িয়ে ধরে । ওর বুকের স্পন্দন দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চায় তোমাকে ছেড়ে আর কোন দিন যাবো না । দুরে ছিলাম কিন্তু মনটা তো তোমার কাছেই পড়ে ছিল । কতক্ষন ওরা একে ওপরকে জড়িয়ে ধরেছিল ওদের নিজেদের কোন সময় জ্ঞান ছিল না । সগির মিয়ার কথায় খ্যাল হল ।
-রাতে কি খাবেন স্যার ?