ভুল পথে হেঁটেছি তাই পাইনি তোমার নাগাল, তা ব’লে হয়নি মিছে সেই পথ হাঁটা; দীর্ঘ এ বিরহ কাল, কম পাওয়া নয়! পথের ভুলে এ বিরহ, অপূর্ব আস্বাদ! মাঝ গগনে ঐ রবির কঠোর হাসি এরই মাঝে দেখি নিশার আঁধার, সঠিক পথে হেঁটে তোমার দেখা পেলে হয়তো পেতাম তোমায় আপন করে! যা পেয়েছি, তা হতো না পাওয়া!!
তুমি সুন্দর খররৌদ্রের মতো ঝর্ণার তীক্ষ্ণফোঁটার মতো বর্ষার ঘনঘটা মেঘের মতো
তুমি সুন্দর সন্ধ্যালালিমার স্নিগ্ধ আলোর মতো ফুটফুটে জোছনার মতো জোনাকির মিটিমিটি আভার মতো
তুমি সুন্দর শিল্পীর কল্পতুলির মতো চাঁদিনীরাতের গল্পের মতো দোলনায় ঘুমন্ত শিশুর মতো
তুমি সুন্দর তোমার সদাহস্যোজ্জ্বল চেহারামাধুরী আমি ভুলতে পারি এমন কঠোর মমত্বহীন নই আমি অপদার্থ অধম বটে-- অকৃতজ্ঞ নই।
যেই পবিত্র ভালবাসার অনলশিখা জ্বলছে আমাদের দুজনার মনে দোহাই, দোহাই সেই ভালবাসার দোহাই, দোহাই সেই ভালবাসার পূততার
আমারে ভুলে যাবে ভুলতে হবে-- পারবে না! এমন কেমন কথা, এমন কথা তোমারে শোভা পায়?
যার রাজ্যভার নিয়েছ মাথায় তারই আরাধনা নিত্য করো জপো নিরালায় তারই নাম শান্তি পাবে তাতে--সফলতা অনেক এ আমার আদেশ নয়, হুকুম নয় অনুগ্রহ-করপুটবিনীত অনুরোধ।
আর কিছু আমার বলার নেই আর কিছু আমার দিবারও নেই-- অলৌকিকশক্তি সর্বোত্তম সম্পত্তি আমার অশ্রুসিক্ত একমুঠো প্রেম তারে রেখে এলেম তোমার রাজ-রাজগৃহ ভাণ্ডারে সেই তোমারই প্রাপ্য।
আমারে আমি সংযম করতে পারি এমন সংবিত্তি আমার মাঝে নেই আজ আমি শূন্য করে ফিরি নে ফিরেছি একেবারে নিঃসহায় নিরাশ্রয় হয়ে
শুধু-- শুধু ভাবনারে এনেছি সঙ্গে এটুকু আমার পাথেয়-- পথের সম্বল।
ঊর্ধ্বে নীরব নিস্তব্ধাকাশ নিম্নে পরিপাটি মাটি আমি তার বুকে পদযুগল রাখি বন্ধু তারা খাঁটি।
আর কোনো ঠিকানা নেই? যেখানে ব্যথার বন্ধন সেখানে আমার ক্রন্দন যেখানে বেদনার সংবাদ সেখানে আমি মেঘনাদ যেখানে সূচনা দুঃখকষ্ট সেখানে আমার পাণ্ডুলিপি স্পষ্ট যেখানে বিষণ্নতাভরা সেখানে আমি আত্মহারা যেখানে অবৈধানন্দোল্লাস সেখানে আমি নির্বাক--জীবন্তলাশ!
আজ কার কাছে যাই আমি কার দিকে তাকাই আমি-- তোমার দিকে না মানবের দিকে দেশের দিকে না দশের দিকে জনতার দিকে না জননীর দিকে সমাজের দিকে না পরিবেশের দিকে।
তোমার দিকে তাকালে মন আবেগ মানুষের দিকে তাকালে কান্না আসে দেশের দিকে তাকালে ভাবনায় পড়ি দশের দিকে তাকালে আফসোস হয় জনতার দিকে তাকালে দুঃখ লাগে জননীর দিকে তাকালে বুক ফেটে যায় সমাজের দিকে তাকালে ফেলতে হয় দীর্ঘশ্বাস পরিবেশের দিকে তাকালে শুনি ধিক্কারবাণী!
স্তিমিত সমগ্র সৃষ্টির মন-- কোনো মালঞ্চে আজ পাই না সুবাস কোনো পাখি আজ দেখি না করতে কোলাহল কোনো ছেলেবেলে আজ করে না খেলা কোনো তামাশাগীর আজ দেখায় না প্রমোদতামাশা কোনো গায়ক আজ প্রাণখুলি গায় না গান কোনো যাত্রিক আজ চায় না পিছন ফিরে কোনো মানুষ আজ ভাবে না পরের তরে সবে আপন আপন চিন্তায় বিভোর--
এ কেমন ধারা চলছে অবিরাম! এমন কেন রে বিধি? কোথাও দেখি না আজ অতুল সুন্দর কোথাও খুঁজি পাই না আজ শান্তিস্থল কোথাও জমে না আজ নিশাতের আড্ডা-- বসে না চন্দ্রিমারাতের গল্পের আসর যে অসম্ভব ভাল আজ তারই দিন ফুরাল শুধু রইল, হিংসাবিদ্বেষ-ঈর্ষাপ্রখর?
না না-- তুমি সুন্দর তোমার চাহনি সুন্দর শুধু আমার পৃথিবী অসুন্দর!
আমি ব্যথিত ক্রন্দসী ব্যথা হ্রাসের মঞ্চে দোষী আমার এখানে ওখানে--সবখানে ফাঁসি! আমি যা কিছু ভাবি--ব্যর্থ, সব ব্যর্থ এখানে তুমি সার্থক!
আমার চাহনি তোমার চাহনির মতো আহা, হতে পারে না কেন উন্নত!
সেদিন স্নেহবাংলা আমার মাধুর্য জন্মভূমিকে ত্যাগ করি যখন উঠলেম আকাশযানে উপসাগরের উদ্দেশে, তখন দেখি আমার পাশের আসনে বসা উনিশ কি বা বিশ বছরের এক অতি সুন্দরী ললনা। বেশ কিছু খবরের কাগজ ও কিছু মাসিকপত্রিকা সামনে রেখেই উদাস মনে কি জানি কী ভাবছে! আমি আসন গ্রহণ করার পরও তার ভাবের মোহ কাটে না! মনে করি, ভাবার তো কথা : স্বদেশ জন্মভূমি যেমন জননী আরও কতকি ফেলে যাচ্ছে--মাতা-মাতামহ, পিতা-পিতামহ; ভাইবোন কত আপনজন, আত্মীয়-পরিজন, প্রেমভালবাসা-রাগানুরাগ আরও কতকি... নিজেরও তো একই দশা : আদরের বাড়ি, খেলার মাঠ, বৈঠকখানা--আড্ডাঘর, ছত্রিশ হাজার বান্ধব, বাহাত্তর হাজার বান্ধবী; এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার গ্রামবাসীরে ছেড়ে যাচ্ছি বিভুঁই--বিনগরে। যেন মনে হচ্ছে, সাড়ে দশ কোটি জনগণ কাঁদছে আমার জন্যে!
মেয়েটি কিছুক্ষণ নীরব রইল--আমিও তাই। তারপর নড়াচড়া--আমতা আমতা করে বললাম, পত্রিকা চাই... ও ঈষৎ হেসে সাদরে অনুমতি দিল। এভাবে শুরু টুকটাক আলাপ--যাবেন কোথায়? আমাকে জিজ্ঞেস করল! তার পর তুমুল আলাপ : আমি বললাম--এমিরাটস্। --কোন্ উদ্দেশ্যে? --উপার্জনে। --এই প্রথম যাত্রা? --বেশ কয়েকবার। --সেখানকার পরিস্থিতি ও জনভক্তি কেমন? --তেমন সুবিধা নয়। --তা হলে...? --কী করি : উপায় নেই--
তার পর প্রশ্নসূত্র আমার, আপনার সম্পর্কে কিছু বললেন না? --কী বলি? --যাচ্ছেন কোথায়? একা কেন? --যাব কানাডা। পুরো পরিবার সেখানে। এসেছিলেম কাকার বিবাহে। মা-বাবারা চলে গেছে মাসের মধ্যে। আমি আজ এক শ একষট্টি দিনে ফিরলাম-- --সেখানকার লোকেরা কেমন? --আমি বলব না সবাই একেবারে ভাল। ভালমন্দ সবখানেই আছে। তবে-- --তবে? --আমাদের দেশের তুলনায় বলতে গেলে, শতকরা নিরানব্বই জনকেই ভাল বলতে হয়। --স্বদেশ সম্বন্ধে এমন ধারণা কেন? --জন্ম থেকেই স্বদেশকে কখনো চোখে দেখি নি! তবে পত্রপত্রিকায় ও বেতার-টেলিভিশনে যা শুনতাম এবং দেখতাম তাতেও কোনো সময় কান দিই নি; সুতরাং আজ বাস্তব চিত্রটাই দেখে যাচ্ছি! --অর্থাৎ? --কি আর বলি, বলার তো রাহায় নেই। দীর্ঘদিন প্রবাসে বসবাস করে স্বদেশের প্রতি যে একটা মমত্ব গড়ে উঠেছিল সেটা নিমেষেই মাটি করা হল! --মানে?
--অতি ধূমধামে কাকার বিয়ে সম্পন্ন হল। সবেমাত্র নববধূ ঘরে এল। আমি বধূর পাশে বসা। হাসিঠাট্টা-আনন্দোল্লাস চলছে, বেলা বারটা। কখনো কখনো খাওয়ার ডাক পড়ছে--কেউ কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ খেতে বসছে; কেউ কেউ আলাপালোচনায় রত এবং কেউ কেউ এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা করছে। এমন সময় হুড়মুড় করে একদল মুখোশধারী সশস্ত্রবাহিনী বাড়িতে প্রবেশ করল! আমি নব কাকিমার কানেকানে বললাম : কোথাও যুদ্ধ বাধল নাকি? কারণ, আমি যুদ্ধভিত্তিক একটা গ্রন্থ পড়েছিলেম, সেখানে গুপ্তচরদের এমন কর্মকাণ্ড ছিল। কাকিমা লজ্জা ত্যাগ করে বলল : চুপ কর, এরা সন্ত্রাস। --সন্ত্রাস! আসলে শব্দটা আমার অত পরিচিত নয়। কাকিমা বুঝিয়ে বলল--টেররিষ্ট। আমার খুব ভয় লেগে গেল। কারণ ক্রিমিন্যাল কখনো আমি নিজচোখে দেখি নি... বাড়িতে অতিথি ভরপুর। সবাই ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। কারও মুখে সাড়াশব্দ নেই। মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যায়! ওরা বাবাকে ও কাকাকে ডেকে নিয়ে গেল! বাড়িতে মাতম পড়ে গেল! দিদিমা আহাজারি করতে করতে বেহঁশ হয়ে পড়লেন! মায়েরও একই দশা--তবে হুঁশ ছিলেন। দুই ঘণ্টা পর বাবা ফিরে এলেন! সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে চুপিচুপি ঘটনা বলতে লাগলেন...
‘কী চায়?’ ঘনিষ্ঠজনদের জিজ্ঞাসা। ‘টাকা।’ ‘কত?’ ‘পঞ্চাশ...’ ‘পঞ্চাশ হাজার?’ ‘পঞ্চাশ লক্ষ।’ ‘পঞ্চাশ লক্ষ!’ সকলে আশ্চর্য অনুভব করলেন। অত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা বাবার ছিলেন না। কেউ কেউ বললেন, থানায় খবরটা দেওয়া হোক। কেউ কেউ বললেন, কোনো লাভ নেই। সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী নাকি আমাদের দেশের পুলিশ? তারা নাকি টাকা ছাড়া কিছুই চিনে না! বাবার মুখে সব সময় একটা কথা শুনতাম--‘যেই দেশের প্রশাসন দুর্বল হয় সেই দেশের জনগণ নিরাপদ নয়। এসব দেশে ক্রাইম উত্থান হওয়াটা স্বাভাবিক। এমন দেশে বসবাস করার চেয়ে বনবাস শ্রেয়।’
--যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আপনার বাবা। তিনি বেশ অভিজ্ঞ ব্যক্তি মনে হচ্ছে। পৃথিবীটা মনে হচ্ছে আজ জঘন্য রাজনীতির অসংখ্য অদৃশ্যহাতে জিম্মি! আজকের এ ভয়ালনগরীর ভয়ঙ্করদশা থেকে কে সাধারণ জনগণকে মুক্ত করে--মুক্তির পথ দেখায়? সেই সুদিন কবে আসবে ফিরে জানি না। --পৃথিবীটা এভাবে চলতে থাকলে, হয়তো একদিন এমন দিন আসবে মানুষ মুক্তির চেয়ে মৃত্যুর কামনা বেশি করবে! --তা যেন দেখতে না হয় সেই প্রার্থনা করি। --বিধাতা সকলের মঙ্গল করুক। নিন্দুকের চেয়ে অধম ভাল। আজকের পরিস্থিতির জন্যে আমরাও কম দায়ী নই। --একেবারে খাঁটি কথা... ...তারপর... ...? --দিনের পর দিন গড়িয়ে যেতে লাগল, টাকার ব্যবস্থা হচ্ছে না; বাবা পাগলপ্রায়! কানাডা থাকে : তার মানে এ নয়, টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। আমাদের ঠাকুরদা নেই। তিনি খুব দরিদ্র ছিলেন। বহু বছর পূর্বেই দেবলোক গমন করেছেন। অনেক কষ্ট করেই বাবা এতটুকু মানুষ। চাকরি করে যা পেতেন তা ব্যয়বহুল সংসারের ব্যয়ভারবহনপর সঞ্চয় করার মতো আর অতিরিক্ত থাকেবা কতুটুকু! এর মধ্যেও যতটুকু সঞ্চিত হয়েছে : ভিটাবাড়ি ভূ-সম্পদ সবটুকু বিক্রি করেও তাদের দাবি পূরণ হওয়ার মতো নয়। তার পরেও বাবা সবকিছু বিক্রি করে দিলেন! অবশিষ্ট রইল শুধু ভিটেবাড়িটা।
অতঃপর অনেক কষ্টের বিনিময়ে মাত্র বিশ লক্ষ টাকা যোগাড় করতে পারলেন বাবা। রোজ তাদের কাছ থেকে একটা করে চিঠি আসছে, ... ...কী হল? সম্ভবত ভাইয়ের মায়া নেই? আর মাত্র... ...তারপর তাকে... ... বাবা মত্ত হতে লাগলেন। কোনো সুরাহা খোঁজে পাচ্ছেন না। বিশ লক্ষ টাকা ওদের কাছে পৌঁছে দিলেন, এবং বললেন : বাকিগুলোর জোরদার ব্যবস্থা চলছে, অচিরেই পৌঁছে যাবে; তবে অলখকে যেন আজই মুক্তি দেওয়া হয়।
কাকার নাম ‘অলখ পাল’। কানাডা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিসাহিত্যে এম এ পাস করেন। বাবার আগ্রহ ছিলেন, নিজদেশের কোনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে কাকাকে বিয়ে করাবেন। সো তাই করা হল। কে জানে, এই বিয়ের জামা কাকার মৃত্যুপরিধান হবে! --তা হলে! ... ...? --হাঁ, বিশ লক্ষ টাকার বিনিময়েও কাকাকে তারা রেহাই দিল না! এমনকি ওঁর লাশ পর্যন্ত ফিরিয়ে দিল না! ঘটনাটা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল, তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল; পেপার-পত্রিকা হতে শুরু করে এমনকি রেডিও-টেলিভিশনেও প্রচার হয়ে গেল। তারপর কী হল। এর মধ্যে কোনেকটা অপরাধীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হল না! অপরাধীরা রীতিমতো বাবাকে হুমকি দিচ্ছে : মামলাটা যেন দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়, অন্যথা পরিবারের কাউকে রক্ষা নেই! পুত্রশোকে দিদিমা হার্টএ্যাটেক করে মারা গেলেন! মা কাঁদতে কাঁদতে উন্মাদ হতে লাগলেন! কাকিমাও একপল বাঁচতে চাইছে না! বললেন, আমরা হিন্দু বলে এমন জোরজুলুম! বাবা আরও অসহায় হয়ে পড়লেন, একেবারে ভেঙে গেলেন। সেদিন দেখেছি বাবার চোখে স্বদেশের প্রতি ঘৃণা! অথচ ওঁ একজন দেশপ্রেমিক।
তারপর ক্রদ্ধ হয়ে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন কানাডা। আমাকে জোর করে কাকিমা রেখে দিলেন। বাবার ইচ্ছা, আমাদের কাউকে এক মুহূর্তের জন্যেও এখানে রেখে যাবেন না; কিন্তু কাকিমার অবস্থা দেখে মত পরিবর্তনে বাধ্য হলেন--আমরা কাকিমার বাপের বাড়ি চলে গেলাম।
--আপনার একটা কথার সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে। --সেই কেন? -অনুমতি দিলে বলতে পারি। --বলুন-না। --আপনার কাকিমার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। --যেমন? --এই যে, একটু আগে বললেন আপনার কাকিমার ভাষ্য ‘হিন্দু বলে এমন জোরজুলুম’ কথাটা আদৌ সত্য নয়। আসলে অপরাধীদের কাছে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতিভেদের কোনো ভেদাভেদ নেই; ওরা চিনে কেবল অর্থ, শুধু অর্থ। --তা হলে কি সামান্য অর্থের জন্যে কাউকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে! তারা কি জানে না, মানবহত্যা যে কত বড় অপরাধ এবং কত বড় পাপ! --জানবে না কেন, যারা অপরাধী তারা করে; তারা তো আর পাপপুণ্যের হিসাব করে চলে না। --আমার মতে, ওদেরকে পশুত্বের পরিচয় দেয়াও প্রযোজ্য নয়, কারণ পশুরাও একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আপনজনের প্রতি এদেরও একপ্রকারের দরদ আছে--মায়া আছে। কিন্তু... ... --কথাটা নেহাত সত্য। অপরাধীদের কাছে বন্ধুবান্ধব, আপনজন ও আত্মীয়স্বজন বলতে কোনো পরিচয় নেই। যারা অপরাধী তারা আজীবন অপরাধই করে... --এখানেই আমার দুয়েকটি প্রশ্ন : ওরা অপরাধী হয় কেন? অপরাধ করে কেন? ওদেরকে লালনপালন করছে কারা? অর্থ যোগান দিচ্ছে কারা? সবচেয়ে বড় অপরাধী তো তারাই! আর আমাদের দেশের সরকার এসব অপরাধজগৎকে সমূলে উৎখাত করতে পারছে কেন? --সরকারের পক্ষে হয়তো তা অসম্ভব? --অসম্ভব! তা আমি কিছুতেই মানতে পারি না; কোনো দেশের সরকার দুর্বল হতে পারেন না। সরকার ইচ্ছা করলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গোটা দেশকে লৌহদণ্ডের ন্যায় ঋজু করতে পারে। পারে কি না? -অবশ্যই পারে। কিন্তু... --কিন্তুর কোনো মানেই নেই। ছোট্ট একটা গল্প বলি শুনুন :--
এক ভদ্রলোকের একটি অপূর্ব ফুলের বাগান ছিলেন। সন্তানসম যত্ন করিয়া লোকটি বাগানটিকে দিন দিন পরিপূর্ণ করিয়া গড়িয়া তুলিতে লাগিলেন। বাগানটি যখন একদিন পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করিলেন, তখন তাহাকে একজন মালির হস্তে সোপর্দ করিয়া ভদ্রলোক প্রবাস গমন করিতে বাধ্য হইলেন। কয়েক বৎসর কাটিয়া যাইবার পর, একদিন মনে পড়িল তাঁহার অপূর্ব বাগানটির কথা। বড়ই বাসনা হইল স্বহস্তে মানুষ গড়া বাগানটিকে একবার দেখিতে। একদিন দেখিতে আসিয়া দেখিলেন : সেই ভরপুর যৌবনপ্রাপ্ত বাগানটি আর তদ্রূপ নাই! একেবারে অন্তিমশয্যায় শয্যাশায়ী হইয়া গিয়াছে। ইহা দর্শনমাত্র ভদ্রলোকের চিত্ত তিক্ত হইয়া গেলেন। ভগ্নান্তরে দুঃখ প্রকাশ করিয়া--সঙ্গে সঙ্গে মালিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, একি অবস্থা! ... ...? অবস্থার কথা মালি বিনয়ীকণ্ঠে ব্যক্ত করিলেন--হুজুর! ... --শত্রু! কেমন শত্রু? --একেবারে গৃহশত্রুসদৃশ। --ঘরে যে প্রথম শত্রু জন্ম নিতেছিল তখন তুমি কোথায় ছিলে? একমাত্র শত্রুকে দমন করা সহজ, কিন্তু অসংখ্য শত্রুকে কাবু করা কঠিন। --হুজুর! বহু কীটনাশক ব্যবহার করেছি, কোনো ফল হল না : একটু দমন হলে--পুনরায় তুমুলাকারে বেড়ে উঠে। --এখন তো তোপকামানেও কিছু করা সম্ভব না, সুতরাং এভাবে বাড়তে থাকলে তোমারও বিপদ আছে; কোনেকসময় তোমাকেও আক্রমণ করতে পারে। --হুজুর! তা হলে সুরাহা?
সেই ষোড়শী যুবতীর ন্যায় ভরপুর যৌবনপ্রাপ্ত বাগানটি আর তাহার হারানো যৌবন ফিরিয়া পাইতে পারিবে না, বরঞ্চ শত্রুহস্তে লাঞ্ছিত হইয়া তিলে তিলে মরিতে হইবেই। তাহা দেখিতে পাইয়া ভদ্রলোক দাহ্য মনে করিলেন, রাগান্বিত হইয়া মালিকে হুকুম দিলেন যে, দাবাগ্নিসম দহন করিয়া অনতিবিলম্বেই বাগানটিকে যেন সম্পূর্ণ ভস্মসাৎ করা হয়। আর এমনিভাবে দগ্ধ করিতে হইবে যে, যাহাতে কোনো শত্রু অর্ধমৃত হইয়া বাঁচিয়া থাকিতে না পারে।
--এই থেকে বুঝা যায় যে, কোনো দুষ্ক্রিয়া মাথা তুলে দাঁড়াতেই তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। --নিশ্চয়। তবেই দেশের মঙ্গল, দশের মঙ্গল। --অপরাধ এমন একটা জিনিস যেটা সব সময় অন্ধকারেই চলতে সক্ষম, যেইমাত্র আলোর সম্মুখীন হয় তখন আর ক্ষমতা থাকে না। --অপরাধ এবং অপরাধী দুটোকেই আমি ঘৃণা করি। --আপনি বা কেন, সকলেই ওদের ঘৃণা করে; কিন্তু ঘৃণাই এর সমাধান নয়। যেখানে তোপকামানের প্রয়োজন সেখানে ইটপাটকেল দিয়ে কী হবে? যুদ্ধ করে পরাজয় স্বীকার করার চেয়ে আগেই আত্মহত্যা করে মরে যাওয়া ভাল। --এই ফাঁকে একটা কথা বলি? --বলুন। --আমাদের দেশকে কোনেকদিন একমাত্র শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে পেতে পারি না? --একমাত্র! সেই আকাশকুসুম কল্পনা না করাটায় ভাল। স্বর্গরাজ্যও আজ নরক হতে চলেছে--সুতরাং পৃথিবীটা দিন দিন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। --বটে। তবে পৃথিবীতে এখনো অনেক রাজ্য আছে, যা স্বর্গ চেয়ে অন্যূন। যেমন, মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে বলতে হয় : তারা আজও স্বর্গরাজ্যে বসবাস করছে? --অবশ্য করছে! তবে আজ নাহয় কাল তাদেরও একদিন গণতন্ত্রে ফিরে আসতে হবে। --অবশ্য আসতে হবে, কারণ গণতন্ত্র এমন এক মাধ্যম যেখান থেকে দেখলে মানবাধিকার অতি স্পষ্ট দেখা যায়; কিন্তু রাজতন্ত্রে তা অস্পষ্ট। --তা সত্য এবং সত্যকে মিথ্যার পদতলে কখনো পিষ্ট করা যায় না। --তবে এটাও সত্য, ইউরোপ আমেরিকার বেশকিছু দেশকে এখনো নিঃসন্দেহে স্বর্গ বলা যায়। --নিশ্চয়। তন্মধ্যে কানাডার নাম আমি প্রথম সারিতে উল্লেখ করতে পারি? --অবশ্যই পারেন। --কত বছর ধরে আপনারা সেই দেশে অবস্থান করছেন? --প্রায় একুশ-কি-বাইশ...। মায়ের বক্তব্য : কানাডা আসার দুই বছর পর আমার জন্ম হয়। --তা হলে কি আপনার জন্মভূমি সেটাই মানা হবে? --কক্ষনো না--জন্ম যেখানেই হোক না কেন, জন্মভূমি শুধু নিজের দেশকেই মানা হয়। আজ না হয় কাল বা কোনেকদিন পরদেশ ত্যাগ করে স্বদেশ ফিরে আসতেই হবে। --শুনলাম নাকি ইউরোপ আমেরিকার প্রবাসীদের একটা জিন্দেগি আছে। --কেন নয়, অবশ্যই আছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে...? --এখানে তো আমরা যাযাবর... --যেখানে যা-ই হোক...স্বদেশ স্বর্গতুল্য...নয় কি? --কেন নয়। বেশ বলেছেন, আমার অন্তরের গভীরতা আপনি ছুঁয়ে ফেলেছেন। আমারও একই কথা। কিন্তু অনেকে মানতেই চায় না... --তাও মিথ্যা নয়। তবে নিজদেশের প্রতি সকলেরই স্বতন্ত্র একটা টান, স্বতন্ত্র একটা মমত্ব অবশ্য থাকে; যা কিছুতেই ক্ষুণ্ন হয় না। --এখানে একটি কবিতা মনে পড়ছে। --বলুন-না কবিতাটা শুনি।
--অপূর্ব কবিতা! কবিতাটা কার জানতে পারি? --এমুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না, অনেক দিন আগের পড়া। --আমার ঠিকানাটা দেব, মনে পড়লে অবশ্য জানাবেন; এ কবির বই পড়া চাই। --আপনার জন্যে অবশ্য মনে করব। বই পড়া ভাল। যেই জাতি বই পড়াতে অভ্যস্ত নয় সেই জাতি জ্ঞানে বড় নয়। আর নিজের সংস্কৃতি সম্বন্ধে যার কিঞ্চিৎ ধারণা নেই, পরের সংস্কৃতি সম্বন্ধে তার পূর্ণ অভিজ্ঞতায় কোনো লাভ নেই। --নিজদেশের প্রতি দেখছি আপনার বড়ই টান, একেবারে আমার বাবার মতো! --সে তো সকলেরই থাকা চাই। যে নিজের দেশকে ভালবাসে না সে তার মাকে ভালবাসে না। --এই কথাটা তবে আমার বাবারও : স্বদেশ স্বর্গতুল্য--স্বদেশকে ভালবাসা সকল নাগরিকের কর্তব্য। --দেশে এসে এত বড় একটা আঘাত পেলেন! এর পরেও দেশের প্রতি-- --তা তো থাকবেই, হাজার হলেও নিজের দেশ। নিজসন্তান যত বড় অপরাধই করুক না কেন, তাকে যেমন ক্ষমা করতেই হয়; তদ্রূপ নিজদেশ যত আঘাতই দান করে-না কেন, তা ভুলতে হয়। --আপনার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভাল লাগছে। এত দিন দেশের মাটিতে কাটালেন তবে দেশের অন্যান্য দিক আপনার কেমন লাগল? --যেমন? --সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক... --সামাজিক ব্যাপারটা কেমন যেন একঘেয়েমি মনে হল। কেউ কারও প্রতি সহানুভূতিশীল নয়! মানসম্মান ও আদরস্নেহ যেন একেবারে সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে!
আর রাজনৈতিক ব্যাপারস্যাপার : রাজনীতি আমি মোটেও বুঝি না। এর মানেটা কী। নিশ্চয় রাজাদের চালচলন? তাই যদি হয়, তা হলে আজকালকার রাজাদের আচারাচরণ এমন কেন? কে কাকে মেরে--আঘাত করে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে আগে উপরে উঠবে সেই প্রচেষ্টায় তৎপর! আর যেখানে রাজাদের শান্তি নেই সেখানে প্রজাদের শান্তি কী করে হতে পারে? রাজারা হচ্ছে প্রজাদের আশ্রয়স্থল। তাই আশ্রয়স্থলে যদি হিংসা-প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে, সেই হিংসার আগুনে কেবল আশ্রয়স্থল পুড়ে ছাই হবে না, সুতরাং আশ্রিতরা আগে ছাইয়ে পরিণত হবে। এ রাজনীতিকে আজ এমনভাবেই দুর্নীতিয়ে গ্রাস করেছে; যেখানে দাঁড়িয়ে সুনীতি কেন, সামান্য নীতির কথাও কল্পনা করা যায় না।
রইল অর্থনৈতিক ব্যাপার : মানবজীবনে অর্থের কী প্রয়োজন সেইটা বুঝাবার জন্যে কোনো পণ্ডিতের শরণাপন্ন হওয়ার গরজ পড়ে না; দোলনার ঘুমন্ত শিশুর হাতে টাকা গুঁজে দিলে সেও তা আঁকড়ে ধরে। অর্থ এমন এক বস্তু, যার জন্যে মানুষ নরকে ঝাঁপ দিতেও এক-পা-কাড়া! তার একমাত্র কারণ--‘দারিদ্র্য’। তবে এ-ই দারিদ্র্যের কবল থেকে রক্ষা পেতে হলে, অর্থনীতি সবল অত্যন্ত জরুরি। আর যেদেশের অর্থনীতি প্রায়ই দুর্বল থাকে সেদেশে দারিদ্র্যবিমোচন আদৌ সম্ভব নয়। এবং অর্থনীতি জোরদার করতে হলে বড় চোরদের দমন চাই-ই চাই...
--আমাদের দেশের অর্থনীতি কোনদিক দিয়ে কম নয়, তবে একটা কানাপাত্রের মতো। --বটে। তবে পৃথিবীতে অসম্ভব বলতে কিছু নেই, মানুষ সবকিছুই করতে পারে। মনকে আপনি যেভাবেই চালাবেন মন সেভাবেই চলবে। আপনার নিয়ন্তা কিন্তু বিধাতা এবং আপনি বিধানের কর্তা--আপনার মনের নিয়ন্ত্রণকারী তবে আপনি নিজেই।
--বহুক্ষণ আলাপ হল, আপনার নামটা তবে এখনো জানা হল না! --আপনি জিজ্ঞেস করলেই তো : ‘নীলিমা স্মারক পাল’। --সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর! একেবারে দেশের সুগন্ধমাখা। আপনারা...? --দুই ভাই, দুই বোন : সবাই আমার কনিষ্ঠ--আমি জ্যেষ্ঠ। আপনার নাম? ...? --আমার নাম ‘দোলন’। আমরাও দুই ভাই, দুই বোন; আমিও সকলের বড়। --কী আশ্চর্য! ...যদি কিছু মনে না-করেন। --তা কেন? --আপনার সাক্ষাৎ অল্পক্ষণের জন্যে বেশ আনন্দ দিল : এ আমার ঠিকানা--ঢের অবকাশ আছে আমার--চিঠিপত্র এবং ফোনালাপ দুনোটায় করতে পারেন। বন্ধুত্বের একমাত্র মাধ্যম... --আবার যদি দেখা হয়... ... ... --নাও হতে পারে... ...মনে থাকবে চিরকাল।
এভাবে পাঁচ ঘণ্টা আলাপের পর এসে পড়ল আমার বিদায়ক্ষণ। যার সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই, যাকে কোনদিন দেখি নি; তার সঙ্গে হয়ে গেল চিরপরিচয়! যেন শতাব্দীর সঙ্গিনী আমার। বন্ধু বা বান্ধবী আমার। আমি যাত্রা সমাপ্ত করলাম কিন্তু নীলিমার আলাপ--নীলিমার কথা--নীলিমার হাসি--নীলিমার চাহনি--নীলিমার শালীনতা সমাপ্ত হল না, অহরহ আমার সঙ্গে চলছে প্রেমিকার মতো।
অনেক ভাল করতে চেয়েছি তোমাকে তুমি মানুষ হতে পার না কোনদিন! আর মিথ্যো পাবারে চেয়ো না আমাকে আমি আর নেই--মরেছি সেদিন। নিন্দুকের নাম তোমার সাথে জড়িয়েছে-- নষ্টজীবন! আজও উন্নতাসনে বসে আছ--হায় রে ভ্রষ্টমন! স্রষ্টার ঘরে ঠাঁই নেই তোমার--তুমি জঞ্জাল তোমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দানিয়ে তিনি উত্তাপ আমি ভালবেসে আজ পথের কাঙাল আমাকে ভুলতে দাও এ যন্ত্রণার দুঃখতাপ। আমার এ মিনতি, সঞ্চিত রাখো বসুমতী তোমার করকমলে আমিও মুক্তি চাই, মানুষ হতে চাই অতি লাঞ্ছনা পায়ে দলে।