বিয়ে ভালোবাসার দ্বিতীয় অধ্যায়
সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে মানব সমাজে স্থিতি, নির্ভরতা, আনার জন্য যে সব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা আজকের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় উপনীত হয়েছি তার মধ্যে বিয়ে ব্যবস্থার প্রচলন অন্যতম প্রধান বাঁক হিসেবে সমাজ বিজ্ঞানীদের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। দুজন নারী পুরুষের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস, বোঝাপড়া, উদ্বেগ ও একতাবদ্ধ থাকার মানসিকতা থেকে সফল আর সার্থক বিয়ের বীজ অংকুরিত হয়। বিয়ের পূর্ণাঙ্গ মানে বুঝতে পারার পর থেকে প্রত্যেক নর নারীর মনে হয়, কোথাওনা কোথাও কেউ একজন আছে যে তাকে বুঝতে পারবে। আর কাঙ্খিত মানুষের সাথে দেখা হলেই জীবনের সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটবে। তাকে বিয়ে করে বাকী জীবন সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু দেখা যায় পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব আর মানসিকতার অমিলের কারণে সম্পর্কে ভাঙ্গন দেখা দেয় আর দুজনের পথ আলাদা হয়ে যায়। এসব নানা তত্ত্ব নিয়ে আমাদের এবারের কাভারস্টোরি। লিখেছেন মোর্শেদ নাসের টিটু
সম্পর্কভাঙ্গার মনোকষ্ট আর দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সঙ্গীর জন্য মনের দুয়ার খুলে দিতে হবে। কেননা পরস্পরের মনোভাব আন্তরিক ও উন্মুক্ত না হলে লাভ ম্যারেজ কিংবা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ কোনটাই সার্থক হবে না। মানসিকতার অমিল শুধুমাত্র অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে হয় তা কিন্তু নয়, লাভ ম্যারেজেও এধরনের সমস্যার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। কেননা বিয়ের পূর্বে পরস্পরকে খুশি করার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে উভয়পক্ষের মধ্যে যে প্রবণতা বিরাজ করে বিয়ের পরে সে আগ্রহের রশিতে কিছুটা হলেও রাশ পড়ে। ফলে শুরু হয় মানসিক অশান্তি, একারণে সঙ্গীকে তার নিজস্ব গুণাবলীর জন্যই পছন্দ করতে হবে। সঙ্গীর আচরণে অভ্যাসে পরিবর্তন এনে তাকে নিজের মত করে গড়ে নিতে চাইলেই সমস্যা দেখা দেয়। তাই কাউকে ভালবাসলে তার দোষ ত্রুটি সহই তাকে ভালবাসতে হবে। কেননা বিবাহিত জীবনে সফলতার মূল কথা উপযুক্ত মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়াই নয়, বরঞ্চ নিজেকে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের জন্য প্রস্তুত করে নেয়াই এখানে বড় কথা। নারী-পুরুষের মধ্যে সদিচ্চা, আন্তরিকতা, অন্যকে সুখী করার আকাঙ্খা থাকলে নিজেদের জুটি বদ্ধ জীবনকে সার্থক আর সুন্দর করে তুলতে কোন বাধাই প্রতিন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ
অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ কিংবা পারিবারিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিয়ের ধারণাটা অতি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। আমাদের সামাজিক ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিচারে পারিবারিক ভাবে আয়োজিত বিয়েকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়। ছেলে-মেয়েরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করলে সেটাকে এখনো অনেকে গর্হিত কাজ বলে মনে করে। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের সূচনাটা হয়েছিল মূলত প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থায় রাজা, সামন্তপ্রভু আর জমিদারদের নিজেদের সহায় সম্পত্তি ও ভূমির মালিকানা নিজ নিজ পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে। সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের মধ্যে এ ধারণাটা প্রচলিত ছিল বলে পরবর্তীকালে এটি সর্বজন বিদিত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হলে সাধারণ পাত্র-পাত্রীর পারিবারিক স্থিতি, মান-মর্যাদা, অর্থনৈতিক অবস্থা সবকিছু বিচার বিবেচনায় আনা হয়। এতে করে একই সামাজিক অবস্থান থেকে পছন্দ করা হয় বলে আগে থেকে পরিচিত না থাকলেও পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বোঝাপড়ায় তেমন কোন সমস্যায় পড়তে হয় না। বাবা-মায়েরা যখন তাদের সন্তানদের সাথে আলোচনা, পরামর্শ করে বিয়ের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেন, তখন অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের সফলতার সম্ভাবনা শতগুণ বেড়ে যায়। তেমনিভাবে জোর জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেওয়া বিয়েতে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠতে মোটেও সময় লাগেনা। বাবা মায়েরা যদি তাদের ছেলে মেয়েদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেন তাহলে তার ফলাফল মোটেও ভাল হবে না। কেননা জীবনসঙ্গী পছন্দের ব্যাপারে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ রয়েছে। অভিভাবকেরা যদি বিয়ের আগেই হবু বর কনের মধ্যে দেখা করার ব্যবস্থা করে তাদের পরস্পরকে জানার জন্য ন্যুনতম সময় দেন এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতেই সামনে অগ্রসর হন কিংবা পিছিয়ে আসেন তাহলেই ছেলে মেয়েরা তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত পরিবারের হাতে ছেড়ে দিতে দ্বিধা করবেনা। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের ভিতও মজবুত হবে যদি পাত্র-পাত্রীরা তাদের পরিবারের পছন্দ করা মানুষের সাথে আলাপ করে নিজেদের মনমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
লাভ ম্যারেজ
দুটি হৃদয় যখন পরস্পরকে ভালোবাসে কাছে পাওয়ার বাসনায় সমাজ স্বীকৃত পন্থায় একতাবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করে এবং সুখে দুঃখে, ভাল-মন্দে, হাসি-আনন্দে, প্রাপ্তিতে-অপ্রাপ্তিতে একে অপরের পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা নেয় তার নামই লাভ-ম্যারেজ। ভালোবাসা নর-নারীর জীবনে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে নিয়ে আসে। ভালোবাসলে পৃথিবীর সবকিছুকে সুন্দর মনে হয়। ভালোবাসারজনকে কাছে পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষার প্রতিটি মূহুর্তকে পরম আরাধ্য মনে হয়। পরস্পরকে ভালবেসে দুজন মানুষ যখন সারাজীবন একত্রে থাকার জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, বস্তুত তখনই প্রকৃত ভালবাসার স্বাদ পাওয়া যায়। কেননা প্রিয়জনকে আপন করে পাওয়ার পর তাকে নিয়ে নিজের স্বপ্নের ঘর সাজাতে প্রয়োজন চেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রম। পরস্পরের প্রতি ভালবাসা থাকলে সমস্ত বাঁধার প্রাচীর ভেঙ্গে নিজেদের সুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেউই দ্বিধা করবে না। তবে ভালবাসারও যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন আছে। একে অন্যের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, বাহ্যিক কাজের মধ্যে থেকে নিজেদের জন্য সময় বের করে নেয়া, পরস্পরের পছন্দ অপছন্দের প্রতি মনোযোগ ইত্যাদি ভালোবাসার বন্ধনকে আরো দৃঢ় করে। লাভ ম্যারেজের সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে পাত্র-পাত্রী আগে থেকেই পরস্পরের সম্পর্কে জানে বলে বৈবাহিক জীবনে তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে পারে। জীবনের প্রথম প্রেম যদি হয় জীবনসঙ্গী তাহলে তার মতো সৌভাগ্যবান আর কেউই নয়। কেননা ভালোবাসার মর্ম সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করা যায় বিয়ের পরেই। ভালোবাসা হচ্ছে যাদুর কাঠি, যার পরশে সুপ্ত হৃদয় জেগে উঠে। ভালোবাসার মানে পুরোপুরি ভাবে বোঝার জন্য প্রিয়জনের সাথে সারা জীবন কাটিয়ে যেতে হয়। কেননা জীবনের প্রতি মূহূর্ত তখন মনে প্রশান্তি ও পূর্ণতা নিয়ে আসে। তাই লাভ ম্যারেজ নিয়ে মানুষের উৎসাহ আর আগ্রহের কোন সীমা পরিসীমা নেই। তবে এটাও ঠিক যে লাভ ম্যারেজ আপনা আপনিই সফল হয় না। এজন্য পাত্র-পাত্রী দুজনকেই পরস্পরের জন্য আজীবন সহানুভূতিশীল থাকতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন