[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

সেই চোখ.....................


সেই চোখ .....................

০৪ ঠা জুন, ২০০৯ সকাল ৮:০৪





পাখির নীড়ের মত চোখ ছিল তার। সাজানো গোছানো নীড়ের মত নিখুত জোড়া আখি। সে চোখ ছিল এক টুকরো মিষ্টি হাসির যোগ্য সহযোগী। চোখের কোনায় ছড়িয়ে থাকা আনন্দের ছটা দেখে এলোমেলো হয়ে যেতাম আমি। উফ! কি আক্ষেপ! কি বিষাদময় অতৃপ্তি! ওই অনিন্দসুন্দর চোখ, ওই মায়াবী আকর্ষন হাহাকার জাগিয়ে তোলে মনে। হাহাকার! মস্তিস্কের আধাধুসর কোষগুলো জট পাকিয়ে যেত। মাথায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হত। সৌন্দর্যের বিকিরনে এ কেমন প্রতিক্রিয়া? এমনই ছিল চোখজোড়া যে সহ্য করতেও কষ্ট হত। শুধুই কানে বাজত কি করি? কি করি? ক্ষনে ক্ষনে অবশপ্রায় হয়ে যেত হাতপা। ওটা সহ্য করতে না পেরে অস্থির হতাম আমি। দুহাত দিয়ে নিজের চুল ধরে টানতাম। অনেকদিন কেটে যাবার পর মনে হল আমি প্রেমে পড়ে গেছি...ওই চোখদুটার প্রেমে।

মনের যখন এ রকম অবস্থা, তখন কিছু একটা করতে ইচ্ছে জাগে। অনেক কিছু করার ইচ্ছে। মনে আকুলি বিকুলি করে ওঠে বিভিন্ন পরিকল্পনার ভুমিকারূপ। সময়ের চলার গতি দ্রুত হয়ে যায় দিবাস্বপ্নে। মনের গুঢ় ইচ্ছেগুলো বাস্তব করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সাধ্যসীমার সাথে যুদ্ধ করে পেরে উঠে না ইচ্ছে। তারপরেও একদিন কেমন করে জানি পরিচয় হয় তার সাথে। কথা হয়। অবাক হয়ে দেখি চোখের প্রতি যেন ওর নজরই নেই। কোন অহম নেই। মনে হয়, যদি ওই চোখের মাঝে হারিয়ে যেতে পারতাম!

পরিচয়টা বন্ধুত্বে গড়াতে সময় নেয় কেন যেন। লক্ষ্য করে দেখি ও যেন নিজেকে আড়াল করে রাখে। ইউনিতে কালো বোরখা পড়ে আসে ও। মুখটা পর্যন্ত ঢাকা থাকে, উন্মুক্ত থাকে শুধু দুচোখ, আমার একান্ত আপন আঁধার। আমার স্বপ্ন! ওই চোখজোড়া দেখেই তৃপ্ত আমি। ক্যাম্পাসে কালো বোরখা পড়ে আসে আরও অনেকে। কিন্তু ওই দুচোখ জোড়ার মালিককে ঠিকই চিনে নিই আমি অবালীলায়। ছুটে যাই তার কাছে। কেবল তার চোখ জোড়া তৃপ্ত হয়ে দেখতে, হয়ত হ্রদয়ের চোখটাও অনুভব করতে! কিন্তু ওটা আর করা হয়ে ওঠে না। নিজেকে খাচায় বন্দী রাখতে চায় যেন! উন্মুক্ত আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ হতে নারাজ। আমিও তখন এক আজব খাচাঁয় বন্দী। সে খাচাঁ থেকে বেরোব, সে উপায় নেই। সে চোখ সর্বক্ষন আটকে রাখে এই আমাকে। দুজনেই খাচাঁয় বন্দী, কিন্তু কেমন অদ্ভূত বিপরীতধর্মী সে দুঃসহ বন্দীশালা।

আমি অস্থিরতার পৌনপুনিকতা সম্পন্য করি। এ এক বিচিত্র চক্র। প্রথমে দুর থেকে দেখে...এখন কাছ থেকে...।

পরিচয়টা কোনমতেই গাঢ় বন্ধুত্বে রূপ নেয় না। সন্দেহ জাগে। খোজ নিয়ে দেখি সত্যি ও আড়ালে থাকে, এমনকি মেয়েদের থেকেও। সবার সাথেই নির্দিষ্ট দুরত্ব ওর। নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য অথচ নিষ্ঠুরতম দুর্গ গড়ে তোলে সবাইকে অন্যায়ভাবে আটকিয়ে দেয়। মনস্থ করে নিলাম, ওই দুর্গ ভাঙব। খানখান করে দেব। নয়ত নিজেকেই মচকে যেতে হবে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। জীবনের জটিল পাজলটাকে মেলাতে গেলে মচকে যাওয়া তো চলবে না। এক ঝটকায় মাথা উচু করলাম আমি।

সেদিন একটা ক্লাসরূমে বসে, অস্থিরতাকে প্রকাশ করে দিয়ে জানালাম আমার মনের কথা, যে কথাগুলো এতদিন ধরে আমার অবচেতন বা হয়ত সচেতন মনে কঠিন আর শক্ত এক বাসা বেধে বসে আছে। যে গুলোকে বহন করতে গিয়ে অস্থির আমি, বিপর্যস্ত আমি। সে কথাগুলো বলেই ফেললাম। আমার চোখে তখন আশা। প্রতিকুল পরিবেশে হারাবার ভয়হীন, অস্থির অথচ দুর্বার মন আমার আশা করে ইতিবাচক কিছু একটা। ভারমুক্ত হয়ে নিজেকে হালকা করতে মাউথ অর্গানটা মুখে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করলাম একটা চমৎকার সুরের আশায়। প্রশ্ন করে উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই।
কিন্তু একি! মাউথ অর্গানে এ কেমন দুখী সুর । গভীর দু্ঃখরোধের সে সুরই ভাল লাগল, বাজাতে লাগলাম হ্রদয়ের অন্তস্থল থেকে। সামনের সবকিছু তখন মনের দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য। মাউথ অর্গান বাজানোর সময় এমনই হয় আমার।

যখন সুর বন্ধ করে চোখ খুললাম, তখন জোছনাভরা চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত আমি। একি দেখি! ওই মায়াবী চোখে জল? দেখলাম, নিখুত সুন্দর চোখ জোড়ায় টুইটুই করছে জল। চোখদুটো তাকিয়ে আমার দিকে।
এরকম অনাকাংখিত ধাক্কায় বিমূঢ় আমি। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম চোখের দিকে। আর কিছু দেখার সুযোগও নেই। ওর বোরখা ঢাকা মুখ আমি দেখিনি কখনও। দেখতে ইচ্ছেও হয় নি তেমন। চোখ দেখেই যে আমি তৃপ্ত। কিছুক্ষন শব্দহীন দুজনে। এরপর দেখলাম ওর চোখ নড়ছে। কথা বলল ও -'তুমি আমার চেহারা পর্যন্ত দেখোনি!
ওহ! কি করে আমি বোঝাব ওকে। ওর চোখই যে সব আমার কাছে। পাখীর নীড়ের মত আমার আপন আঁধার ওদুটো। বলে ফেললাম তা।
'তবুও, তুমি আমাকে একবারও দেখনি।' একরোখার মত করে বলে ও।
ওমা! এতদিন ওকে দেখিনি, দেখতে চাই নি বলে রাগ করল নাকি? অনেক কিছু হারাবার ভয় হঠাৎ করে অপ্রস্তুত ভাবে জাপটে ধরেছিল তা ছেড়ে যেতেই স্বস্তির হাসি হাসলাম। বললাম-
'আচ্ছা। আজই না হয় দেখব।'
কোন কথা বলল না ও। দেখলাম ওর চোখের কোন আর যেন জল ধরে রাখতে পারছে না। কিন্তু একটু আগের মত বিপর্যস্তের রূপ নেই আর ওগুলোতে। এখন তা শান্ত, স্থীর।
একটুক্ষন নিরবতা। তাকেই অনেক বেশী দীর্ঘ মনে হল।
হঠাৎই হাত বাড়িয়ে বোরখার মুখের কাপর সরাল ও। আমি দেখলাম এতক্ষন খুব কষ্টে ধরে রাখা ওর চোখের জল টপ করে পড়ে গড়িয়ে গেল মুখময় বীভৎস ঘা এর উপর দিয়ে।

'ও মাগো!' অস্ফুট কথাটা আটকাতে পারলাম না আমি।
'আহ!' দেখলাম, ওই অনিন্দসুন্দর চোখের মালিক, সে কিনা এক বর্বর পশুর নির্মমতার শিকার। প্রায় পুরোটা মুখেই বীভৎস ঘা। নাকের জায়গাটা প্রায় খালি, দাতগুলোর উপর ঠোটের আবরন নামেমাত্র। আশ্চর্যজনকভাবে শুধুমাত্র দুচোখ আর তার আশেপাশের কিছু অংশ বেচে গেছে। নিজেকে আবার অস্থির লাগছে , অনেকদিন আগের মত আবার একবার হাতপা অবশ হয়ে যাচ্ছে। মুঠোবন্দী হাতদুটোতে চাপ বাড়ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ভাবনা। আর দেখতে পারলাম না আমি। চোখ সরিয়ে নিলাম দ্রুত। ওই বীভৎস ঘা টা পেড়িয়ে তাকাতে পারলাম না আমার আপন আঁধারের দিকেও। মাথা নিচু করে বসে রইলাম। প্রকৃতি যাকে এতকিছুর পরও সুন্দর, সজীব রেখেছে তাকে আর নিজের ভাবতে সায় দিল না অবচেতন মন। ভালোবাসা যেন উবে গেল।
'আহ! ছি! কাপুরুষ!' মনের আরেক অংশ বলে উঠল। মাথাটা আমার নিচুই রইল।

একটু পর চোখ মুছে স্বাভাবিকভাকে মুখের কাপড় লাগিয়ে উঠে দাড়াল ও। চোখ তুলে একবার তাকাল আমার দিকে। কিন্তু কই! ওই চোখজোড়াকে তো আর আগের মত লাগছে না। আমি ওর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।

আবার ওর চোখে জল ভরে উঠল। কিন্তু সামলে নিল ও। তারপর চলে গেল স্বাভাবিক ভাবে অন্য সব দিনের মত। যাবার সময় একবার চোরের মত ওর চোখে তাকিয়ে দেখলাম এতদিন ধরে অনেককষ্টে ধরে রাখা আনন্দগুলো উবে গিয়ে ওই চোখদুটিতে জায়গা করে নিয়েছে গভীর বিষাদ।

কাপুরুষের মতই শুধু বসে রইলাম আমি, মাথা নিচু করে...।

কোন মন্তব্য নেই: