অন্ধকার পথ, পিছনে বন্ধ দরজা
রাত দুইটা বাজে। বারান্দাতে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে দিব্য। দিব্য, দেশের একজন প্রথম সারির প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। অগুনতি ভক্ত তার, বেশীর ভাগই অবশ্য উঠতি বয়সের যুবক-যুবতীরা। দিব্যের লেখায় এদেরকে নিয়ে অনেক কথা থাকে, এদের মনের কথা স্থান পায়, এদের চাহিদা, দুঃখ, কষ্ট, হাসি, আনন্দ-বেদনা সব চলে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এই বয়সের পাঠকেরা যা পড়তে চায়, দিব্য সেটাই লিখতে পারছে। এটা অনেকেই পারে না, পারে না তাদের হৃৎস্পন্দন বুঝতে। দিব্য বুঝতে পারে, এটা ওর খুব বড় একটা গুণ। তাই দিব্য এত জনপ্রিয়।
আর কিছুদিন পরেই একুশের বইমেলা। দিব্যকে কমপক্ষে তিনটা উপন্যাস লিখতে হবে, প্রকাশকরা প্রায় প্রতিদিনই তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু দিব্য কিছুই লিখতে পারছে না। কাগজ, কলম নিয়ে টেবিলে বসছে, বসেই থাকছে, সাদা কাগজগুলো কালো আঁকিবুকিতে আর ভরে উঠছে না। একবার ওর মনে হলো রাইটার্স ব্লক হয়েছে, কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সে কবিতা লিখতে পারছে, তাও খুব সুন্দর প্রেমের কবিতা। অথচ দিব্য কবিতা আগে কখনো লেখেনি বা লিখতেও জানত না। একবার ভাবে এবার কবিতার বই লিখবে, পরক্ষনেই মনে হয় পাঠকরা ওর উপন্যাসই পড়তে চায়। মনটাকে সুস্থির করতে বারান্দাতে পায়চারি করতে গিয়ে আরো অস্থির হয়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকার এপার্টমেন্টের ছয় তলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দিব্যের অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। এই নিশুতিরাত ওকে যেনো কি মনে করিয়ে দিচ্ছে। মধ্যবয়স্ক দিব্যের মনে পড়ে যাচ্ছে মেহেরের সাথে সেই উচ্ছ্বল দিনগুলোর কথা।
ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিলো মেহের। শুধু সুন্দরী নয়, চৌকসও বটে। পড়াশোনা, খেলাধুলা, বিতর্ক সবকিছুতেই ছিলো মেহেরের পদচারণা। সে তুলনায় মফস্বল থেকে আসা দিব্যই ছিলো কিছুটা ম্রিয়মান। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত ওর ছোট গল্পগুলো পড়ে মেহেরের কাছে সেই দিব্যই হয়ে উঠলো স্বপ্নের রাজকুমার। তারপর মেঘনার জল অনেক দূর গড়িয়ে গেলো। তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বিয়ে করে থিতু হতে না হতেই ফুটফুটে অপর্ণার বাবা হয়ে গেলো দিব্য, ততদিনে অবশ্য লেখক হিসেবেও যথেষ্ট নাম যশ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। হিমেল হাওয়ার ঝাপটায় দিব্যের ভাবনায় ছেদ পরলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমে ঢুকে বিছানার দিকে তাকাতেই কেমন যেনো কুঁচকে গেলো দিব্য।
বিছানাতে কেঁচোর মতো জট পাকিয়ে মেয়েটা শুয়ে আছে। দীঘল কালো চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে চারপাশে, কিছু চুল দিয়ে ঢেকে আছে একপাশের গালের কিছু অংশ। গভীর ঘুমে মগ্ন সে। শরীরে একটি সুতাও না থাকাতে প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বুকের ছন্দময় উঠানামাটা দিব্যের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে। পাশের বেডসাইট টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্পের আলোয় কেমন যেনো অপার্থিব লাগছে। কী যেনো নাম মেয়েটার, দিব্য মনে করতে পারছে না। হঠাৎ ওর মনে হলো মেয়েটার নামই জিজ্ঞেস করা হয় নি, সন্ধ্যা থেকে একসাথে আছে অথচ মেয়েটার নামই জানা হয়নি ওর! অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেয়েটার মায়াময় মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার বারান্দাতে চলে আসলো দিব্য।
আকাশে মেঘের গুরু ডাক। হয়তো বৃষ্টি নামবে, নতুবা নয়। একটা সিগারেট ধরালো দিব্য, বেনসন এন্ড হেজেস ব্রান্ডের। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আনমনে হাসলো সে। মেহেরের দিব্যকে পছন্দ করার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা ছিলো সে অধূমপায়ী। কিন্তু বিয়ের পর রাত জেগে জেগে উপন্যাস লিখতে লিখতে, প্লট চিন্তা করতে করতে কখন যে হাতে সিগারেট উঠে এলো সেটা ও বুঝতেই পারেনি। এরপর আরো কত কি- হাতে চলে আসলো বোতলও। জনপ্রিয়তার সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে দিব্যের রুচিবোধও অনেক উপরে উঠে এলো! প্রথম দিকে মেহের মনক্ষু্ন্ন হলেও কিছু বলতো না। কিন্তু যখন মধ্যরাতে সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষ করে অর্ধ মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতো, মেহের উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। সেই উত্তাপে ছোট্ট অপর্ণা ঘুম থেকে জেগে উঠে অবাক বিস্ময়ে বাবা-মায়ের দিকে তাকাতো, কাঁদতেও যেনো ভুলে যেতো। অপর্ণার যখন আলাদা রুম হলো, তখন আর ঘুম থেকে উঠতো না, কারণ সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। শুধু ভাবতো, বাবা খুব জনপ্রিয় না হলেই মনে হয় ভালো হতো। সময় যেনো কীভাবে গড়িয়ে যায়। অপর্ণা যখন ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলো, বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে ওর বাবার অসম্ভব জনপ্রিয়তা দেখে ওর মায়ের অসহায় মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠতো।
মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। সেই বৃষ্টির কিয়দংশ ছিটে ফোঁটা দিব্যের গায়েও লাগছে। বিছানাতে শুয়ে থাকা মেয়েটার কথা আবার মনে পড়লো। এতক্ষন খেয়াল করেনি, এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা বোধহয় অপর্ণার সমবয়সী। গত সন্ধ্যায় যখন ক্লাবে মেয়েটাকে দেখে, ওর কেমন যেনো নেশার মতো লেগেছিলো। মেয়েটিকে দেখে কোনো বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়ে মনে হয়নি তখন। দিব্যের সাথে যখন দিব্যের উপন্যাসগুলো নিয়ে গল্প করছিলো, দিব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলো। রাতে যখন দ্বিধান্বিত কন্ঠে বাসায় আসার আমন্ত্রন জানালো, কী সহজেই না রাজী হয়ে গেলো! হেসে উঠলো দিব্য, অনেকদিন পর বিছানাতে এত তৃপ্তি পেলো সে, মেহেরের কাছ হতে যা প্রায়শই পেতো না। এই যুগের মেয়েরা বোধহয় এরকমই। দিব্যের মতো একজন মধ্যবয়স্ককেও, যার মাথার চুলে কিছুটা পাকও ধরেছে, মুহূর্তের মধ্যে উন্মাতাল করে ফেলতে পারে।
এই ব্যাপারটা যেদিন থেকে সে বুঝতে পেরেছিলো, সেদিন থেকেই তার শুরু হয়েছিলো মেহেরের সাথে লুকোচুরি খেলা। কোনো কোনো রাত বাসায় আসতো না, আসলেও ভোর রাতের দিকে এসে চুপিসারে শুয়ে পড়তো। মেহেরের ততদিনে অনেক কিছুই গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু যেদিন দিব্যের মোবাইলে দিপ্তী নামের এক মেয়ের কামোদ্দীপক মেসেজ পড়লো, সেদিন নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না। না, সে দিব্যের সাথে কিছুই করে নি, কারণ এই পুরুষ শাসিত সমাজে সে প্রতিবাদ করে কিছুই করতে পারবে না, বরঞ্চ নির্যাতিত হয়ে খবরের কাগজের শিরোনাম হবে। তাই সে তার স্বপ্নের রাজকুমারের ঘর ছেড়ে এসে, বুক ভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে নিজের জীবনকে আপন গতিতে চলতে দিলো। তার মেয়েটা হয়েছে তার ন্যাওটা, তাই অপর্ণাও চলে আসলো তার সাথে। সেই থেকে দিব্য একা।
হঠাৎ মৃদু শব্দে পিছনে ফিরে দেখলো দরজার পর্দা ধরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ঘুম জড়ানো মায়াবী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘুমাবে না?’ মেয়েটিকে চমকে দিয়ে দিব্য ওর নাম জানতে চাইলো। কিছুটা অদ্ভুত কন্ঠে মেয়েটা বললো, ‘মেহের’! দিব্য তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির দিকে, তারপর বললো, ‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সকাল হলে আর বৃষ্টি থেমে গেলে তুমি চলে যেয়ো’।
রাত চারটার ঢাকা শহরে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে এক বাসার সামনে এসে থামলো দিব্য। তিনবার কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দাঁড়ালো মেহের।
- কেমন আছো মেহের? কেমন আছে অপর্ণা?
- এত রাতে তুমি?
- বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, না ভিতরে বসতে বলবে?
মেহের হেসে ফেললো। হাসলে মেহেরকে খুবই সুন্দর লাগে এই মধ্যবয়সেও। সে হেসেই বললো, ‘তোমাকে ভিতরে আসতে বলার সাধ্য আমার নেই। মেয়ে বড় হয়েছে, আমি তোমাকে ভিতরে আসতে বললে আমি ওর কাছে খুব ছোট হয়ে যাবো। আর সবচেয়ে বড়ো কথা তোমাকে ভিতরে বসতে বলার ইচ্ছেও আমার নেই, সে তুমি যাই মনে করো। ভোর প্রায় হয়ে এলো, অপর্ণা এখনই ঘুম থেকে উঠবে, আমি চাই না, সে তোমাকে দেখুক’।
মেহেরের দিকে কিছুক্ষন স্থির তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে দিব্য বের হয়ে আসলো। গাড়ির দিকে না এগিয়ে এই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই ভোরের আলোতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলো, কিন্তু দিব্যের মনে হলো সে অন্ধকার পথে হাঁটছে। একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে।
রাত দুইটা বাজে। বারান্দাতে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে দিব্য। দিব্য, দেশের একজন প্রথম সারির প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। অগুনতি ভক্ত তার, বেশীর ভাগই অবশ্য উঠতি বয়সের যুবক-যুবতীরা। দিব্যের লেখায় এদেরকে নিয়ে অনেক কথা থাকে, এদের মনের কথা স্থান পায়, এদের চাহিদা, দুঃখ, কষ্ট, হাসি, আনন্দ-বেদনা সব চলে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এই বয়সের পাঠকেরা যা পড়তে চায়, দিব্য সেটাই লিখতে পারছে। এটা অনেকেই পারে না, পারে না তাদের হৃৎস্পন্দন বুঝতে। দিব্য বুঝতে পারে, এটা ওর খুব বড় একটা গুণ। তাই দিব্য এত জনপ্রিয়।
আর কিছুদিন পরেই একুশের বইমেলা। দিব্যকে কমপক্ষে তিনটা উপন্যাস লিখতে হবে, প্রকাশকরা প্রায় প্রতিদিনই তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু দিব্য কিছুই লিখতে পারছে না। কাগজ, কলম নিয়ে টেবিলে বসছে, বসেই থাকছে, সাদা কাগজগুলো কালো আঁকিবুকিতে আর ভরে উঠছে না। একবার ওর মনে হলো রাইটার্স ব্লক হয়েছে, কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সে কবিতা লিখতে পারছে, তাও খুব সুন্দর প্রেমের কবিতা। অথচ দিব্য কবিতা আগে কখনো লেখেনি বা লিখতেও জানত না। একবার ভাবে এবার কবিতার বই লিখবে, পরক্ষনেই মনে হয় পাঠকরা ওর উপন্যাসই পড়তে চায়। মনটাকে সুস্থির করতে বারান্দাতে পায়চারি করতে গিয়ে আরো অস্থির হয়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকার এপার্টমেন্টের ছয় তলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দিব্যের অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। এই নিশুতিরাত ওকে যেনো কি মনে করিয়ে দিচ্ছে। মধ্যবয়স্ক দিব্যের মনে পড়ে যাচ্ছে মেহেরের সাথে সেই উচ্ছ্বল দিনগুলোর কথা।
ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিলো মেহের। শুধু সুন্দরী নয়, চৌকসও বটে। পড়াশোনা, খেলাধুলা, বিতর্ক সবকিছুতেই ছিলো মেহেরের পদচারণা। সে তুলনায় মফস্বল থেকে আসা দিব্যই ছিলো কিছুটা ম্রিয়মান। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত ওর ছোট গল্পগুলো পড়ে মেহেরের কাছে সেই দিব্যই হয়ে উঠলো স্বপ্নের রাজকুমার। তারপর মেঘনার জল অনেক দূর গড়িয়ে গেলো। তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বিয়ে করে থিতু হতে না হতেই ফুটফুটে অপর্ণার বাবা হয়ে গেলো দিব্য, ততদিনে অবশ্য লেখক হিসেবেও যথেষ্ট নাম যশ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। হিমেল হাওয়ার ঝাপটায় দিব্যের ভাবনায় ছেদ পরলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমে ঢুকে বিছানার দিকে তাকাতেই কেমন যেনো কুঁচকে গেলো দিব্য।
বিছানাতে কেঁচোর মতো জট পাকিয়ে মেয়েটা শুয়ে আছে। দীঘল কালো চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে চারপাশে, কিছু চুল দিয়ে ঢেকে আছে একপাশের গালের কিছু অংশ। গভীর ঘুমে মগ্ন সে। শরীরে একটি সুতাও না থাকাতে প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বুকের ছন্দময় উঠানামাটা দিব্যের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে। পাশের বেডসাইট টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্পের আলোয় কেমন যেনো অপার্থিব লাগছে। কী যেনো নাম মেয়েটার, দিব্য মনে করতে পারছে না। হঠাৎ ওর মনে হলো মেয়েটার নামই জিজ্ঞেস করা হয় নি, সন্ধ্যা থেকে একসাথে আছে অথচ মেয়েটার নামই জানা হয়নি ওর! অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেয়েটার মায়াময় মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার বারান্দাতে চলে আসলো দিব্য।
আকাশে মেঘের গুরু ডাক। হয়তো বৃষ্টি নামবে, নতুবা নয়। একটা সিগারেট ধরালো দিব্য, বেনসন এন্ড হেজেস ব্রান্ডের। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আনমনে হাসলো সে। মেহেরের দিব্যকে পছন্দ করার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা ছিলো সে অধূমপায়ী। কিন্তু বিয়ের পর রাত জেগে জেগে উপন্যাস লিখতে লিখতে, প্লট চিন্তা করতে করতে কখন যে হাতে সিগারেট উঠে এলো সেটা ও বুঝতেই পারেনি। এরপর আরো কত কি- হাতে চলে আসলো বোতলও। জনপ্রিয়তার সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে দিব্যের রুচিবোধও অনেক উপরে উঠে এলো! প্রথম দিকে মেহের মনক্ষু্ন্ন হলেও কিছু বলতো না। কিন্তু যখন মধ্যরাতে সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষ করে অর্ধ মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতো, মেহের উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। সেই উত্তাপে ছোট্ট অপর্ণা ঘুম থেকে জেগে উঠে অবাক বিস্ময়ে বাবা-মায়ের দিকে তাকাতো, কাঁদতেও যেনো ভুলে যেতো। অপর্ণার যখন আলাদা রুম হলো, তখন আর ঘুম থেকে উঠতো না, কারণ সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। শুধু ভাবতো, বাবা খুব জনপ্রিয় না হলেই মনে হয় ভালো হতো। সময় যেনো কীভাবে গড়িয়ে যায়। অপর্ণা যখন ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলো, বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে ওর বাবার অসম্ভব জনপ্রিয়তা দেখে ওর মায়ের অসহায় মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠতো।
মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। সেই বৃষ্টির কিয়দংশ ছিটে ফোঁটা দিব্যের গায়েও লাগছে। বিছানাতে শুয়ে থাকা মেয়েটার কথা আবার মনে পড়লো। এতক্ষন খেয়াল করেনি, এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা বোধহয় অপর্ণার সমবয়সী। গত সন্ধ্যায় যখন ক্লাবে মেয়েটাকে দেখে, ওর কেমন যেনো নেশার মতো লেগেছিলো। মেয়েটিকে দেখে কোনো বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়ে মনে হয়নি তখন। দিব্যের সাথে যখন দিব্যের উপন্যাসগুলো নিয়ে গল্প করছিলো, দিব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলো। রাতে যখন দ্বিধান্বিত কন্ঠে বাসায় আসার আমন্ত্রন জানালো, কী সহজেই না রাজী হয়ে গেলো! হেসে উঠলো দিব্য, অনেকদিন পর বিছানাতে এত তৃপ্তি পেলো সে, মেহেরের কাছ হতে যা প্রায়শই পেতো না। এই যুগের মেয়েরা বোধহয় এরকমই। দিব্যের মতো একজন মধ্যবয়স্ককেও, যার মাথার চুলে কিছুটা পাকও ধরেছে, মুহূর্তের মধ্যে উন্মাতাল করে ফেলতে পারে।
এই ব্যাপারটা যেদিন থেকে সে বুঝতে পেরেছিলো, সেদিন থেকেই তার শুরু হয়েছিলো মেহেরের সাথে লুকোচুরি খেলা। কোনো কোনো রাত বাসায় আসতো না, আসলেও ভোর রাতের দিকে এসে চুপিসারে শুয়ে পড়তো। মেহেরের ততদিনে অনেক কিছুই গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু যেদিন দিব্যের মোবাইলে দিপ্তী নামের এক মেয়ের কামোদ্দীপক মেসেজ পড়লো, সেদিন নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না। না, সে দিব্যের সাথে কিছুই করে নি, কারণ এই পুরুষ শাসিত সমাজে সে প্রতিবাদ করে কিছুই করতে পারবে না, বরঞ্চ নির্যাতিত হয়ে খবরের কাগজের শিরোনাম হবে। তাই সে তার স্বপ্নের রাজকুমারের ঘর ছেড়ে এসে, বুক ভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে নিজের জীবনকে আপন গতিতে চলতে দিলো। তার মেয়েটা হয়েছে তার ন্যাওটা, তাই অপর্ণাও চলে আসলো তার সাথে। সেই থেকে দিব্য একা।
হঠাৎ মৃদু শব্দে পিছনে ফিরে দেখলো দরজার পর্দা ধরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ঘুম জড়ানো মায়াবী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘুমাবে না?’ মেয়েটিকে চমকে দিয়ে দিব্য ওর নাম জানতে চাইলো। কিছুটা অদ্ভুত কন্ঠে মেয়েটা বললো, ‘মেহের’! দিব্য তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির দিকে, তারপর বললো, ‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সকাল হলে আর বৃষ্টি থেমে গেলে তুমি চলে যেয়ো’।
রাত চারটার ঢাকা শহরে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে এক বাসার সামনে এসে থামলো দিব্য। তিনবার কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দাঁড়ালো মেহের।
- কেমন আছো মেহের? কেমন আছে অপর্ণা?
- এত রাতে তুমি?
- বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, না ভিতরে বসতে বলবে?
মেহের হেসে ফেললো। হাসলে মেহেরকে খুবই সুন্দর লাগে এই মধ্যবয়সেও। সে হেসেই বললো, ‘তোমাকে ভিতরে আসতে বলার সাধ্য আমার নেই। মেয়ে বড় হয়েছে, আমি তোমাকে ভিতরে আসতে বললে আমি ওর কাছে খুব ছোট হয়ে যাবো। আর সবচেয়ে বড়ো কথা তোমাকে ভিতরে বসতে বলার ইচ্ছেও আমার নেই, সে তুমি যাই মনে করো। ভোর প্রায় হয়ে এলো, অপর্ণা এখনই ঘুম থেকে উঠবে, আমি চাই না, সে তোমাকে দেখুক’।
মেহেরের দিকে কিছুক্ষন স্থির তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে দিব্য বের হয়ে আসলো। গাড়ির দিকে না এগিয়ে এই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই ভোরের আলোতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলো, কিন্তু দিব্যের মনে হলো সে অন্ধকার পথে হাঁটছে। একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন