[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

যাত্রী ৩

ভুবনের অবশ্য সেদিকে চোখ নেই তখন। বাসরাস্তার পাশে খানিক জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা হাটটির দিকে তাঁর নজর গিয়েছে। ভরা দুপুরে তার বিকিকিনিতে খানিক ঝিম ধরলেও একেবারে বন্ধ হয়নি তা। সেই দিকে দেখতে দেখতেই তিনি জবাব দিলেন, "পাহাড় দেখি পেট তো ভরবে না ছোটগোঁসাই। বেলা কতটা হল সে খেয়াল আছে?"
শোভন হাসল, "এই দেখো। ভুলে গেছিলাম একেবারে। কিন্তু ভুবনদা, এখানে ভাতের জোগাড় হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।"
চারপাশে সন্ধানী দৃষ্টি চালাতে চালাতেই হঠাৎ একটি অভিমুখে দৃষ্টি স্থির করে ভুবন বলে উঠলেন, "ভাত না মেলে তো মুড়িই সই। চল গোঁসাই, ওই হোথা মুড়ি ব্যাচে মনে হয়। তার সঙ্গে বাজার থেকে দুটো কাঁচা লংকা আর মুলো কিনে নিলেই হল। চলো গোঁসাই, পা চালাও।"
মুড়িওয়ালা কিশোরটি বেশ চালাকচতুর। এলাকার হালহদিশও রাখে দিব্যি। মুড়ি মেপে ভুবনের গামছায় ঢেলে দিতে দিতেই প্রশ্ন করল, "যাবেন কোথা?"
"ডিগলি গ্রামে যাবো। ওখানে অনন্ত বাউরির বাড়ি-----"

ঝকমকে দাঁত বের করে হাসল ছেলেটি। বলে, "আমার বাড়ি ডিগলিতেই। অনন্ত বাউরি আমার কাকা হয়। আমার নাম তারাপদ বাউরি। আপনারা?"
মুড়িভরা মুখে ভুবন জবাব দিলেন, "আমরা নদে থিকে আসতিছি বাবা। গানের বায়না দিব বলে আসা। তা সে গেরাম এইখান থিকে কদ্দূর?"
ছেলেটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, "সারনার টিলা পার হতে পারবেন কি? তাহলে জোর পায়ে হাঁইটলে ঘন্টা, স'ঘন্টার পথ। আর পাহাড় বেড় দিয়ে যেতে চাইলে তিনচার ঘন্টা লাগতে পারে। তা, এই রোদ মাথায় করে গেলে কষ্ট হবে যে!"
বাইরে সূর্যের উত্তাপে যেন ধিকি ধিকি জ্বলন্ত লাল, পাথুরে প্রান্তরটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন ভুবন, "ঠিক কথাই বলছ বাবা। তবে কিনা, কাজটাও মেটাতে হবে যে! এখন আর কী করা!" বলতে বলতেই আড়ে আড়ে বৃদ্ধের চোখ চলে যায় তাঁর তরুণ ভ্রমণসঙ্গীর দিকে। শোভনও চেয়ে চেয়ে দেখছিল ভুবনকে। বয়স্ক শরীরটিতে তাঁর নিদারুণ ক্লান্তির ছাপ। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল তার। ভরা গরমে মালভূমি অঞ্চলে এই বৃদ্ধকে নিয়ে আসাটা সম্ভবত ঠিক হয়নি তার পক্ষে। গরমের মধ্যে বাসযাত্রার ক্লান্তিটাই যেভাবে জানান দিতে শুরু করে দিয়েছে তার শরীরে, এরপর রোদের মধ্যে ওই খাড়াই পাহাড়ি পথ বেয়ে দেড় ঘন্টা হাঁটলে সমস্যা হতে পারে। মাথা ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে চেয়ে সে বলল, "তাহলে নাহয় এইখানে খানিক বিশ্রাম করে, রোদের তেজটা একটু কমলে পরেই যাব। তা, তুইও তো হাটের পরে বাড়ি যাবি তো?"
ছেলেটা মাথা নাড়ল, হাট ভাঙবে পাঁচটায়। তারপর আপনারা আমার সঙ্গেই ডিগলি যেতে পারবেন। এখন এখানেই বসেন খানিকক্ষণ তবে।"
মাঠজুড়ে হরেক রকম গাছ ইতি উতি ছড়িয়ে আছে। তারই মধ্যে একটা অতিকায় জারুল গাছের নিচে মুড়িওয়ালার দোকান। মুড়ির বস্তার পাশে একটি বাঁশের চ্যাঙারিতে কিছু ভাজা ছোলা, কুঁচিয়ে রাখা ধনেপাতা, কাঁচালংকা ও পেঁয়াজের স্তূপ। এই ভরদুপুরে তার দোকানে ক্ষুধার্ত খরিদ্দারের অভাব নেই। যন্ত্রচালিতের মত কাজ করে চলে সে।
খাওয়া দাওয়া সেরে একঘটি জল খেয়ে ভুবন তাঁর গামছাটি মাটিতে বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন। ফুরুফুর করে নাক ডাকছে তাঁর। উষ্ণ, মৃদু হাওয়া তাঁর অবাধ্য চুলদাড়ি নিয়ে খেলা করে। তাঁর পাশে বসে চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল শোভনেরও। হঠাৎ নিচু গলায় একটা সুরেলা ধ্বনিতে তার চটকাটা ভেঙে গেল একেবারে। চোখ খুলে দেখে, নিবিষ্ট হয়ে মুড়ি বিক্রির অনুপান পেঁয়াজ ও ধনেপাতা কুঁচোতে কুঁচোতে গান গাইছে কিশোরটি--
তুহার জন্য জরিমানা
তুহার জন্য জেলখানা
তবু শুনিব না মানা
না শুনিব রে মানা
করিব রে আনাগোনা
তুহার জন্য বিহার যাব
তুহার জন্য ছাতার যাব
তুহার জন্য ঝারগাঁ যাব
তুহার জন্য বরগা যাব
তবু শুনিব না মানা
না শুনিব রে মানা
তুহার জন্য প্রাণ দিব
তুহার জন্য হত্যা দিব
তুহার জন্য দিব্যি দিব
তবু শুনিব না-------
গাইতে গাইতে হঠাৎ করেই শোভনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে গান থামিয়ে চুপ করে যায় তরুণটি।

"থামলি কেন? গা----"
লাজুক হেসে মাথা নাড়লো তরুণটি। গাইবে না সে আর। চোখের আড়ালে থাকা কোন তরুণীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গানটি তার একান্তই ব্যাক্তিগত সম্পতি। কারও সঙ্গে ভাগ করে নেবার বস্তু সে নয়। হাতে ধরা ছোট ছুরিটি তার দ্রুত উঠে নেমে চলে।

**************



কোন মন্তব্য নেই: