[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

যাত্রী ২

|| ৫ ||
রঘুনাথপুর গঞ্জ থেকে বেরিয়ে রাস্তা উঁচু হয়ে উঠে গেছে একেবারে আকাশমুখো। এখানে জমির চরিত্র আলাদা। তরঙ্গসংকুল কোন এক সমুদ্রের স্ন্যাপশট যেন। ঢেউগুলি চারিদিকে স্থির হয়ে আছে। সাধ্যাতিরিক্ত যাত্রীর বোঝা নিয়ে তেমনই একটি তরঙ্গের গা বেয়ে উঠতে গিয়ে অসহায় প্রতিবাদ জানাচ্ছিল বাসের এঞ্জিন।
টিলাটার মাথার কাছাকাছি পৌঁছোতে শোভনের গলা থেকে একটা মৃদু উচ্ছ্বাসধ্বনি বের হয়ে এলো। পেছনের সিটে বসে ভুবন দাস সাড়া দিলেন, "কী হইল গোঁসাই, পাইলা?"
"হ্যাঁ ভুবনদা। মনে হচ্ছে এইবারে সিগন্যালটা টিঁকে যাবে। তিনটে কাঠি দেখাচ্ছে।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ ইবারে টাউয়ার পাবেন গো। সামনেই কোতোয়ালবাড়ি আইসবে। সেইখেনে গত বৈশেখে টিলার মাথায় নতুন টাউয়ার বইসলো যে!" পাশে বসা সহযাত্রীটি গভীর মনোযোগ দিয়ে তার মোবাইলের পর্দাটি দেখতে দেখতে মুখ খোলে।
"শুনলে ছোট গোঁসাই, আর সেই 'ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না' করতি হবে না। নাও এখন মনের সুখে যতো পারো কথা কও। আমি শুনি। বাপরে যে ব্যাস্ত হইয়েছো কাল বিকেল থেকে ওই ফোনের তরে। তিনদিন ধরি পথে পথে আছি, একবারও ফোনের বোতাম টিপতে দেখলাম না। তারপর কাল থিকে একেবারে পাগলপারা হইয়ে ফরিদার সন্ধান চইলছে। তোমার মনের তল পাওয়া বড় মুশকিল গোঁসাই।"
"সে আর তুমি পাবে কী করে ভুবনদা, কাল দুপুরে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোল যে। টেনশান হয় না?" ফোনের বোতাম টিপে সেটি কানের কাছে ধরে শোভন বলল।
"হরি হরি! আমি ভাবলুম গে---------"

তিনি যে কী ভেবেছেন সেটি ভেঙে বলবার আগেই শোভনের উত্তেজিত গলার শব্দ উঠল সামনের সিট থেকে। চাপা গলায় সে বলছিল, "হ্যালো, ফরিদা, বল।"
নীরব হয়ে বসে কান পেতে শোনেন ভুবন দাস। টেলিফোনের একপেশে বাক্যালাপ থেকে আন্দাজ করতে চান কথোপকথনের মূলসুরটিকে। প্রায় মিনিট দশেক পরে ফোন করা শেষ হতে দ্বিধাজড়িত গলায় তিনি প্রশ্ন করলেন, "খবরাখবর সব ভালো তো?"
হাসি মুখে ঘুরে বসে শোভন বলল, "পঁচিশটা ক্যাণ্ডিডেটের মধ্যে সাতটা স্টার ভুবনদা! মোট বাইশটা ফার্স্ট ডিভিশানে গেছে। বাকি তিনটে হাই সেকেণ্ড ডিভিশান। রেকর্ড ভাঙা রেজাল্ট হল এবারে!"
"সব তোমার ফরিদার কল্যাণে গোঁসাই। ও তোমার বিদ্যামন্দিরের লক্ষ্মী। এসে বসল আর সোনা ফলতে শুরু করল। অদূরে আরও ভালো হবে দেখো।"
"দূর। ফরিদা তো এলো মার্চে। ততদিনে মাধ্যমিক শেষ। ওকে আর ক্রেডিট দিচ্ছো কেন ভুবনদা? তবে হ্যাঁ, অদূরে আরো ভালো হবে ওর থেকে সেটা কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছো। কেন এ-কথা বলছি শোনো। কাল কী হয়েছে জানো? এই এখন ফরিদা বললো। বিপুল মণ্ডলের ছেলে অনুপমকে চেনো?"
"হ্যাঁ চিনি। যুগীপাড়ার বিপুল। অনাথ রায়ের জমিতে কিষানি করতো।"
"করতো নয়। এখনো করে। অনুপম ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো, কিন্তু একটু নরমসরম। ভেবেছিলো স্টার পাবে, কিন্তু দু'নম্বর শর্ট হয়েছে। সে ছোঁড়া শোভারাম ইশকুলে গিয়ে মার্কশিটটা নিয়েই বেরিয়ে কোথায় চলে গেছিল। বিকেলে বিদ্যামন্দিরে ফিরে সবাই ফরিদাকে রেজাল্ট দেখাচ্ছে, তা তখন ধরা পড়ল অনুপম দলে নেই। বাকি ছেলেদের মুখে তার রেজাল্টের কথা শুনে ফরিদার সন্দেহ হতে দুটো ছেলেকে সাইকেল দিয়ে যুগীপাড়া পাঠিয়ে দেয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। খানিক বাদে তারা ফিরে এসে যখন জানাল, অনুপম সেখানেও ফেরেনি, তখন মাধ্যমিকের পুরো ব্যাচটাকে নিয়ে বসে ফরিদা একটা সার্চপার্টি বানিয়ে চারপাশে পাঠিয়ে দেয়। ওদের বলে দিয়েছিলো, "নিজেদের বন্ধু হারিয়ে গেল খেয়াল করলি না, এখন তাকে খুঁজে না বের করে কেউ বাড়ি ফিরবি না।"
"খুঁজে পেল কি?"
"হ্যাঁ পেয়েছে। ছোকরা গিয়ে বিষ্ণুনিবাসের একশো আট মন্দিরের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিল। ভাবো দেখি একবার! পোড়ো ভাঙা কতগুলো মন্দির। সাপখোপের আড্ডা। ওর মধ্যে গিয়ে রাত্রিবেলা-------
"তা ফিরিয়ে আনবার পর, শেষরাত্রে সবাই মিলে মিছিল করে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়েছে ফরিদা। ভুবনদা, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে জানো, আজ!"

ভুবন হাসলেন, "সে তো হবেই গোঁসাই। অত ভালো সব ফল হইল পরীক্ষায়--"
"না না। সে তো আছেই। কিন্তু আসল আনন্দটা অন্য কারণে। ফরিদা একা একা ভার নিতে শিখে গেছে ভুবনদা। আমার ছেলেমেয়েগুলো ওর হুকুম মানতে শিখে গেছে। নইলে ওর এক কথায় গোটা ব্যাচ বাড়িতে রেজাল্ট দেখানো শিকেয় তুলে রাতভর বন্ধুকে খুঁজতে যায়?"

যুবকটির চোখে মুখে একটা খুশির ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যেন। সেই হাওয়া সংক্রামিত হয় তার সঙ্গী সর্বত্যাগী বৈরাগিটির মনেও। মৃদু গলায় তিনি স্বগতোক্তি করেন, "যেমন দ্যাবা তেমন তার দেবী জুটেছে। দুটোই পাগল। আত্মসুখ বলি কোন বস্তু নাই শরীরে। গুরু হে--------"
তার অস্ফুট প্রার্থনাটি অকথিতই থেকে যায় অবশ্য। কারণ বাসটি একটি মোড় ঘুরে এসে তীব্র এক ঝাঁকুনি মেরে তখন থেমে দাঁড়িয়েছে। দরজার থেকে কণ্ডাকটারের হাঁক উঠছে, "সারনির বাজার, সারনির বাজার--------কে কে নামবেন জলদি উঠে আসেন। এবারে এক্কেবারে সিধে মধুকুণ্ডা ইশটিশানে গিয়ে দম নেবো। মধ্যে আর কোন থামাথামি নাই--"
শোভন তাড়াতাড়ি তার ঝোলাঝুলি সামলে উঠে দাঁড়াল। বাইরে ধূ ধু করছে গ্রীষ্মের খরশান রৌদ্র। পেছন ঘুরে হাত বাড়িয়ে সে ডাক দিল, "এসো ভুবনদা। হাতটা ধরো। নামতে হবে যে।"
লোহা মেশানো জংধরা পাথরের টিলা পেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া পথে গর্জন করে লাল ধুলোর কুণ্ডলি তোলা বাসটা হারিয়ে যেতে নির্জনতা নেমে এলো চারপাশে। বিশাল আকাশে আবৃত গ্রামটি। দিগন্তের গায়ে পাহাড়ের প্রাচীর আকাশ ছুঁয়েছে। সেইদিকে তাকিয়ে শোভন বলল, "ওই যে পাহাড়টা দেখছো ভুবনদা, ওর নাম বিহারীনাথ। মহাভারতে ওর নাম ছিল ক্রৌঞ্চপর্বত।"

কোন মন্তব্য নেই: