"বাবু, চলেন চলেন---"
ঘুম ভেঙে ঝেড়েঝুড়ে উঠে পড়লো শোভন। ভুবন দাস তার আগেই উঠে পড়ে ঝোলাঝুলি নিয়ে তৈরি হয়ে বসে রয়েছেন। তরুণটি তার পায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকাচ্ছিল। মাঠ জুড়ে শেষ বিকেলের ছায়াছায়া আলো-আঁধারি নেমে এসেছে। সারা সপ্তাহের বিকিকিনি সেরে লোকজন এবারে বাড়িমুখো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিল শোভন। ছেলেটাও এবারে তার দোকান মাথায় তুলে নিয়েছে। মাথার ওপর একটা বিড়ে বসিয়ে তার ওপর বাঁশের চ্যাঙারি, চ্যাঙারিতে রাখা রয়েছে বিক্রিবাট্টার শেষে অবশিষ্ট সামান্য কিছু মুড়ি ও অন্যান্য উপকরণ। শোভনরা উঠে দাঁড়াতে চ্যাঙারি মাথায় তারাপদ আগে আগে হাঁটা দিল।
মাঠের উত্তরপ্রান্ত ছাড়িয়ে বন্ধুর জমি হঠাৎ করেই আকাশমুখো বাঁক নিয়েছে। পথের কোন চিহ্ন নেই তার বুকে। তবু, অভ্যস্ত পদক্ষেপে কোন এক অদৃশ্য পথকে অবলম্বন করেই যেন বা, তরতর করে ওপরদিকে উঠতে থাকলো তারাপদ। নিচে প্রসারিত গ্রামটি ছাড়িয়ে যত ওপরের দিকে পৌঁছায় ততই ঘন হয়ে আসে শাল, মহুয়া ও পলাশের জঙ্গল। বনজ গন্ধে ছেয়ে আছে নির্জন পাহাড়ের দেহটি।
গাছের ফাঁকে ফাঁকে পথ করে চলতে চলতে ভুবন বললেন, "এই অন্ধকারে জঙ্গল পাহাড়ে কেন নিয়ে এলি রে ছোঁড়া? আর একটু আগে বের হলেই তো হত! দিনে দিনে বেশ----"
তারাপদ হঠাৎ থেমে দাঁড়ালো। একটা বড় পাথরের চাঙড় এইখানটায় পথকে আড়াল করে আছে। তার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে এক হাতে মাথার চাঙাড়ি সামলে অন্য হাতটা ভুবনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, "সব হাটেই তো সেইরকমই করি গো! এ বনে ভালুকের গতায়াত আছে। সেই ভয়েই তো বিকেল থাকতে থাকতে বাড়ি ফিরতে হয়। আজ আপনারা সঙ্গে আছেন। বুকে একটু বল এসেছে। তাই সাহস করে ভাবলাম----"
তার হাতটিকে অবলম্বন করে পাথরের চাঙড়টির ওপরে উঠে এলেন ভুবন দাস। তারপর কোমরে হাত দিয়ে শরীর বাঁকিয়ে ক্লান্তি অপনোদন করতে করতে বললেন, "ভেবে আমাদের উদ্ধার করেছো বাবা! এখন তাড়াতাড়ি পা চালা । আর কতটা উঠতে হবে বল দেখি! সঙ্গে বাতিটাতি তো কিছু নেই। এই অন্ধকারে----"
তারাপদ হেসে বললো, "এক্ষুণি আলো হয়ে যাবে গো! পেছনে চেয়ে দ্যাখেন দেখি! আজ পুর্ণিমা নয়?"
পেছন ঘুরে তারা দেখলো, দূরে বিহারীনাথ পাহাড়ের অন্ধকার আবরণের পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে সদ্যজাগ্রত চাঁদ। এখনও তার শরীরে লেগে আছে প্রথম সন্ধ্যার লোহিতাভ ছাপ। মৃদু হাওয়া ছেড়েছে তখন। বুক ভরে সেই সুগন্ধ বাতাস ফুসফুসে টেনে নিয়ে শোভন বললো, "চলো ভুবনদা, পা চালিয়ে চলো দেখি এইবারে!"
বনপথ ধরে এগিয়ে যায় তিনটি মানুষ। তাদের পেছনে পুরাণবর্ণিত সেই ক্রৌঞ্চপর্বতের কোল ছেড়ে আকাশ সাঁতরে চাঁদ ক্রমশ উঠে আসে ওপরে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার ধারা গলিত রূপোর মতো ঝরে পড়ে তাদের মাথার ওপরে ছেয়ে থাকা অতিকায় বৃক্ষরাজদের পত্রমুকুটের ফাঁকফোকর গলে।
ভুবনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তারাপদর ভাব হয়ে গিয়েছে বেশ। হাত ধরাধরি করে তারা আগে আগে হাঁটে। মাঝে মাঝে ঘষা, প্রাচীন গলায় জেগে ওঠে পরিচিত সুর, "একবার এসো গৌর দিনমণি----"
পরক্ষণেই সদ্য ভাঙা তেজি, তরুণ গলাটি শুনিয়ে দেয় তার বয়সোচিত কোন চটুল ঝুমুর গানের কলি,
যৌবন ও বার্ধক্য পাশাপাশি প্রবাহিত হয় আপন আপন সঙ্গীতের ধারায়। চন্দ্রালোকিত পাহাড়টি মৌন হয়ে তাই শোনে।
আন্দাজ আটটা নাগাদ অবশেষে পায়ের নিচে ডিগলি গ্রামের দেখা পাওয়া গেল। ছোট্ট গ্রামটি। জঙ্গলের মধ্যে খানিক জায়গা পরিষ্কার করে তার ওপর বড়জোর শ'খানেক মেটে ঘর, চাঁদের আলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের কোন সাড়াশব্দ নেই সেখানে। সেইদিকে আঙুল তুলে তারাপদ ঘোষণা করল, "এসে গেলাম। সব শুয়ে গেছে। ডেকে তুলতে হবে।"
শোভন মাথা নেড়ে বললো, "এই তোর একঘন্টা স'ঘন্টা হলো? কম করে তিন ঘন্টা হাঁটিয়েছিস আমাদের তুই আজ।"
"কী করব? বুড়োবাবার জন্য আস্তে চলতে হলো যে! আপনারা বরং এইবার ধীরেসুস্থে আসেন, আমি আগে আগে গিয়ে কাকারে ডেকে তুলি গে।"
বলতে বলতেই ভুবনের হাতটি ছাড়িয়ে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গেল সে। চন্দ্রালোকিত প্রস্তরভূমির ওপর তার ছায়াটি টলমল করতে করতে ছুটলো তার পায়ে পায়ে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার দীঘল কালো শরীর মিলিয়ে গেল বনময় পাহাড়ের গায়ে।
মিনিট পনেরো বাদে গ্রামের সীমানায় পৌঁছে দেখা গেল, তারাপদ সহাস্যমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আরেকজন প্রৌঢ়। তাড়াহুড়োয় ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। চোখেমুখে এখনও সেই ঘুমের জড়তা মাখা। শোভনের দিকে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, " আমি অনন্ত। বাবুদের আসা হচ্ছে কোথা থেকে? পরিচয়?"
শোভন বললো,"আমরা নদে জেলার লোক। সুন্দরনগর সাবডিভিশান কোর্টের নগেন উকিল আপনাদের ঠিকানা দিলেন।"
"নগেন ঘোষ? ও বাব্বা। তিনি তো অনেক উঁচাদরের মানুষ গো! কুমারহাটের জমিদারবাড়ির এক আনার শরিকের বড়ছেলে। আপনারা তেনার বন্ধু নাকি? আমার কাছে কী কাজ?"
অনন্ত বাউরির চোখেমুখে সম্ভ্রমের ছাপ। সম্ভবত তার পরিচিত বৃত্তে অত্যন্ত উঁচুস্তরের বাসিন্দা এই নগেনবাবু।
শোভন মাথা নাড়লো, "না না বন্ধু টন্ধু নই। ওনার দুই ছেলেমেয়েকে পড়াতাম, সেই থেকে জানাচেনা। ভালো ঝুমুরগানের সন্ধান করছিলাম, তখন তিনি আপনার খোঁজ দিলেন। তাই গান শুনতে আসা।"
"আচ্ছা আচ্ছা সে সব হয়ে যাবে'খন। নগেনবাবু পাঠালেন। গান তো হবেই। কালকের দিনটা থাকা হবে তো?"
"হ্যাঁ। পরশু সকালে ফিরবো ঠিক করেছি।"
"তবে তো মিটেই গেলো," প্রৌঢ় মানুষটি মাথা নাড়েন, "কালকে আসর বসায়ে দেব। এখন আসেন দেখি। খাওয়াদাওয়া করেন, আরাম করেন। দুপুরবেলায় তো শুনলাম মুড়ি ছাড়া কিছু জোটে নাই।"
আদরভরা ডাকটির পেছনে ভরপেট খাদ্য ও নিশ্চিন্ত শয্যার আহ্বান ছিল। এইবারে দুনিয়ার ক্লান্তি এসে যেন ভর করলো যাত্রী দুজনের দেহে। অলস পদসঞ্চারে তারা অনন্তর পিছুপিছু এগিয়ে গেল গ্রামের মাঝামাঝি একটি বাড়ির দিকে। তার পূর্বের ভিটার রান্নাশাল থেকে গণগণে কাঠের আগুনের আভাস আসছিলো। চুড়ির রিনিঠিনি, নারীকন্ঠের দু একটি মৃদু ফিসফাস, আর সেই সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠছিলো ফুটন্ত ভাতের সুগন্ধ।
উঠোন পেরিয়ে উল্টোদিকের ভিটার একটি ঘরে তাদের ছেড়ে দিয়ে তারাপদ রান্নাবাড়ির দিকে গেল। তার বারান্দায় একটি মাদুর পেতে ঝোলাঝুলি নামিয়ে আরাম করে দুটি বিড়ি ধরাল শোভনরা। কেরোসিন তেলে ভরা একটা কুপি রাখা রয়েছে সামনে। সেটাকে সামনে টেনে দেশলাইটা ফের বের করে এনেও কি মনে করে শোভন সেটাকে ঢুকিয়ে রাখল পকেটে। বারান্দা জুড়ে চাঁদের আলো পড়েছে। কুপি জ্বালিয়ে রেখে আর কী দরকার!
পরদিন সকাল থেকেই গ্রাম জুড়ে সাড়া পড়ে গেল। অনন্তর হাতে একশোটি টাকা দিয়েছিল শোভন। তাই দিয়ে হাঁড়িভরা ভাতের মদ জোগাড় করে আনা হয়েছে। উঠোন জুড়ে আসর বসাবার আয়োজন চলেছে। বাউরি নারীপুরুষেরা অনেকেই এসে হাত লাগিয়েছে সে কাজে। গ্রামের মানুষগুলির এই মূহুর্তে কোন কাজের চাপ নেই বর্ষার শুরু পর্যন্ত। শীতের মরশুমে যে সামান্য কিছু জমিতে মটর বা সর্ষের চাষ হয়েছিল সে ফসলও উঠে গিয়েছে অনেকদিন হলো। হাতে তাদের সময়ের অভাব নেই কোন। যারা গাইবে কিংবা সঙ্গত করবে তারা একে একে এসে জড়ো হচ্ছে অনন্তর উঠোনে। অনন্ত নিজে তাদের নিয়ে বড়োই ব্যস্ত। ঢোল, ধামসা, খঞ্জনী, কাঁসি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র এর ওর বাড়ি থেকে বের করে এনে সুরে চড়ানোর কাজ চলছে। উঠোন জুড়ে উৎসবের হাওয়া লেগেছে যেন। দুপুর পার হতে না হতে গোটা গ্রামের লোকজন এসে জড়ো হল অনন্তর প্রশস্ত উঠোনে। উঠোনের মাঝখানে বসেছেন শিল্পীরা। তাঁদের ঘিরে চারপাশে গ্রামের মানুষ বসেছেন। তাঁদের সমবেত গুঞ্জনধ্বনি থেমে এলে পরে গান শুরু হল। অনন্তই ধরলেন প্রথমে। আসর বন্দনার গান-
তীব্র, তীক্ষ্ণ অলংকারবহুল স্বর। শোভন অবাক হয়ে শুনছিল। কয়েকমাস আগে গঙ্গাবিধৌত বরেন্দ্রভূমির সীমান্ত অঞ্চলে শুনে আসা আলকাপ নামের সেই প্রাকৃত লোকসঙ্গীতের সঙ্গে প্রস্তরময় মালভূমির এই গানের সুরশরীরের আমূল পার্থক্য। তবু, শুরুতেই বন্দনার মূল আদর্শটি কিন্তু সেই একই রয়েছে। দশজনের পদমালা কন্ঠে ধরেছিলেন আলকাপের আসরবন্দনাকারী। সেই দশের চরণেই বন্দনা করে সংগীতবাসরের সূচনা হল ঝুমুর গানের এই বাউরি লোকশিল্পীর কন্ঠেও।
"কেমন করে হয়?"
"কেমন করি কী হয় গোঁসাই?"
শোভন সচকিত হয়ে ভুবনের দিকে তাকিয়ে একচিলতে হাসল। বলল, "না গো ভুবনদা! তাই ভাবছিলাম, কোথায় চুর্ণি আর কোথায় দামোদর। কোথায় আলকাপ আর কোথায় ঝুমুর। কিন্তু আসর যখন শুরু হল, তখন নদিয়ার বীণাপানি ছোকরা আর এই ডিগলির অনন্ত বাউরি দুই সুরে একই কথা কেমন করে বলে বলো দেখি! তাই মুখ দিয়ে ও কথাটা বেরিয়ে গেল।"
বৃদ্ধ কৌতুকভরা চোখে হাসলেন একবার। এ প্রশ্নের একটা উত্তর তাঁর কাছে আছে। পাঁচ শতাব্দী আগে এক মানবপুত্র এই দেশকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন একটি মন্ত্র --
সেই মন্ত্রের আত্মাটিই আজ এতকাল ধরে এ দেশের লোকসমাজের সমস্ত মরমী স্রষ্টা-শিল্পী-সাধকের চেতনায় ধীরে ধীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে কতই বিচিত্র পথে। বিনয়ের বহিঃপ্রকাশের এই ঐক্য হয়তো বা তারই ফল।
তবে, সে তত্ত্বভাবনার সময় এ নয়। চটুল লঘু চালে একের পর এক গান উড়ে চলেছে তখন অনন্তর উঠোনে। শোভনের মন গিয়ে পড়েছে সেই সুরের স্রোতে। তার হাতের টেপরেকর্ডার নিঃশব্দে ধরে রাখছে সেইসব সুর ও কথাগুলিকে। বৃদ্ধের তত্বকন্টকিত মনটিও কখন যেন ঘুরে ফিরে ফিরে আসে গানের আসরেই। সেখানে তখন নকুল নামে এক ছোকরা বিচিত্র মুখভঙ্গী করে গান ধরেছে-
রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন প্রেমলীলার কাহিনী, নবরূপে, নতুন কালের অনুষঙ্গ নিয়ে ফিরে এসেছে তার গানে। যমুনা নদী ধরেছে চাপাকলের রূপ। তবু পরকিয়া রসের মূলতত্ত্বটি কিন্তু তাতে রয়ে গেছে অবিকল।
সারা দুপুর ধরে সুদর্শন, সত্যদাস, ঈশ্বর, সুদাম, ভক্ত, ফটিকরা পরপর গান গেয়ে চলল। কখনও মানভূমের, কখনও বাঁকুড়ার, কখনও বা পুরুলিয়ার ঝুমুর। শ্রোতা ও গায়ক, ভাতের মদের নেশা খানিক খানিক করেছে সকলেই। তারপর সন্ধ্যার মুখ মুখ পুরুষ গায়করা "টুকচু নিশা করিয়ে আসি গ" বলে সদলবলে পুরোন হয়ে আসা নেশাটিকে চাগিয়ে নিতে চলে গেলে আসরে এসে বসলেন অবগুন্ঠিতা মহিলারা। টুসু গাইবেন তাঁরা। অবগুন্ঠনের আড়াল থেকে একটি ক্লান্ত ও মধুর একক কন্ঠ সুর ধরল,
সঙ্গে সঙ্গে বাকি দলটির থেকে জেগে উঠল কোরাসে সুরেলা জবাব-
ফের প্রশ্ন আসে,
এইবারে জবাব দেয় একটি একক কন্ঠ। মলিন স্বরে বলে,
তারপর হঠাৎই যেন প্রসঙ্গ পালটে অনুযোগের সুরে সে জানায়
জবাবে অদেখা জামাইয়ের উদ্দেশ্যে ফের জেগে ওঠে মিনতিভরা লোভ দেখানো কোরাস-
কিন্তু ঠিক তার পর, সবেধন নীলমনি কন্যাটিকে দান করবার প্রতিজ্ঞার পরই ভেসে আসে একক কন্ঠে একটি সতেজ সাবধানবাণী,
আর এমনি করেই টুসু নামের আদরের দেবকন্যার চরিত্রটিকে অবলম্বন করে ডালপালা মেলে গ্রামীণ ঘরণী-কন্যা-মাতার হাজার সুখ দুঃখের কাহিনী। কখনও সে চপল কন্ঠে গায়,
আবার পরক্ষণেই মাতৃকন্ঠে বেজে ওঠে এক প্রাকৃত বিজয়ার সুর,
অথবা চটুল সখী টুসুকে দেখে সিনেমায় দেখা কোন আধুনিকার বেশে,
গান ভাঙলো যখন, রাত তখন দুই প্রহরের মাঝামাঝি। আকাশে প্রতিপদের সামান্য ক্ষয়া চাঁদের জ্যোৎস্না ছিলো। অনুষ্ঠানক্লান্ত মানুষগুলি সেই আলো মেখে বাদ্যযন্ত্রগুলি নিয়ে একে একে ফিরে গেলে তাদের পিছু পিছু শোভনও এগিয়ে গিয়েছিলো খানিকটা পথ। ফিরে এসে দেখে ভুবনের সঙ্গে অনন্তর কথাবার্তা চলছে। মেলায় দুটি রাত গান গাইবার জন্য আসবে অনন্ত বাউরির দলটি। জনা পনেরো লোক হবে। টাকাপয়সা তারা নেবেনা কিছু। যাতায়াতের ভাড়াও লাগবে না। মধুকুণ্ডা স্টেশন থেকে ট্রেনে ট্রেনে বিনা ভাড়াতেই পৌঁছে যাবেন তাঁরা। হারি-বাউরির আবার ট্রেনের ভাড়া কি? জেলে ওঁদের কেউ কখনো পাঠাবে না। ওতে সরকারেরই লোকসান। মিনিমাগনার খোরপোশ দিতে হবে যে কদিন! এ দিগরে বিনি ভাড়ায় রেলের গাড়িতে চড়া মানুষদের তাই ধরা পড়লে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত দেয় রেলবাবুরা। বলতে বলতে চোখ টিপে হেসে উঠে অনন্ত বলে, "নামিয়ে দ্যায় তো দেবে! পরের গাড়িতে ফের উঠে চলে আসবো! সে আপনারা ভেবো না।"
তবে হ্যাঁ। দুবেলা পেটপুরে ভাত চাই দুটি আর নেশার দ্রব্যের পয়সা। ওটি না হলে গান জমবে কী করে?
ঘুম ভেঙে ঝেড়েঝুড়ে উঠে পড়লো শোভন। ভুবন দাস তার আগেই উঠে পড়ে ঝোলাঝুলি নিয়ে তৈরি হয়ে বসে রয়েছেন। তরুণটি তার পায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকাচ্ছিল। মাঠ জুড়ে শেষ বিকেলের ছায়াছায়া আলো-আঁধারি নেমে এসেছে। সারা সপ্তাহের বিকিকিনি সেরে লোকজন এবারে বাড়িমুখো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিল শোভন। ছেলেটাও এবারে তার দোকান মাথায় তুলে নিয়েছে। মাথার ওপর একটা বিড়ে বসিয়ে তার ওপর বাঁশের চ্যাঙারি, চ্যাঙারিতে রাখা রয়েছে বিক্রিবাট্টার শেষে অবশিষ্ট সামান্য কিছু মুড়ি ও অন্যান্য উপকরণ। শোভনরা উঠে দাঁড়াতে চ্যাঙারি মাথায় তারাপদ আগে আগে হাঁটা দিল।
মাঠের উত্তরপ্রান্ত ছাড়িয়ে বন্ধুর জমি হঠাৎ করেই আকাশমুখো বাঁক নিয়েছে। পথের কোন চিহ্ন নেই তার বুকে। তবু, অভ্যস্ত পদক্ষেপে কোন এক অদৃশ্য পথকে অবলম্বন করেই যেন বা, তরতর করে ওপরদিকে উঠতে থাকলো তারাপদ। নিচে প্রসারিত গ্রামটি ছাড়িয়ে যত ওপরের দিকে পৌঁছায় ততই ঘন হয়ে আসে শাল, মহুয়া ও পলাশের জঙ্গল। বনজ গন্ধে ছেয়ে আছে নির্জন পাহাড়ের দেহটি।
গাছের ফাঁকে ফাঁকে পথ করে চলতে চলতে ভুবন বললেন, "এই অন্ধকারে জঙ্গল পাহাড়ে কেন নিয়ে এলি রে ছোঁড়া? আর একটু আগে বের হলেই তো হত! দিনে দিনে বেশ----"
তারাপদ হঠাৎ থেমে দাঁড়ালো। একটা বড় পাথরের চাঙড় এইখানটায় পথকে আড়াল করে আছে। তার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে এক হাতে মাথার চাঙাড়ি সামলে অন্য হাতটা ভুবনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, "সব হাটেই তো সেইরকমই করি গো! এ বনে ভালুকের গতায়াত আছে। সেই ভয়েই তো বিকেল থাকতে থাকতে বাড়ি ফিরতে হয়। আজ আপনারা সঙ্গে আছেন। বুকে একটু বল এসেছে। তাই সাহস করে ভাবলাম----"
তার হাতটিকে অবলম্বন করে পাথরের চাঙড়টির ওপরে উঠে এলেন ভুবন দাস। তারপর কোমরে হাত দিয়ে শরীর বাঁকিয়ে ক্লান্তি অপনোদন করতে করতে বললেন, "ভেবে আমাদের উদ্ধার করেছো বাবা! এখন তাড়াতাড়ি পা চালা । আর কতটা উঠতে হবে বল দেখি! সঙ্গে বাতিটাতি তো কিছু নেই। এই অন্ধকারে----"
তারাপদ হেসে বললো, "এক্ষুণি আলো হয়ে যাবে গো! পেছনে চেয়ে দ্যাখেন দেখি! আজ পুর্ণিমা নয়?"
পেছন ঘুরে তারা দেখলো, দূরে বিহারীনাথ পাহাড়ের অন্ধকার আবরণের পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে সদ্যজাগ্রত চাঁদ। এখনও তার শরীরে লেগে আছে প্রথম সন্ধ্যার লোহিতাভ ছাপ। মৃদু হাওয়া ছেড়েছে তখন। বুক ভরে সেই সুগন্ধ বাতাস ফুসফুসে টেনে নিয়ে শোভন বললো, "চলো ভুবনদা, পা চালিয়ে চলো দেখি এইবারে!"
বনপথ ধরে এগিয়ে যায় তিনটি মানুষ। তাদের পেছনে পুরাণবর্ণিত সেই ক্রৌঞ্চপর্বতের কোল ছেড়ে আকাশ সাঁতরে চাঁদ ক্রমশ উঠে আসে ওপরে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার ধারা গলিত রূপোর মতো ঝরে পড়ে তাদের মাথার ওপরে ছেয়ে থাকা অতিকায় বৃক্ষরাজদের পত্রমুকুটের ফাঁকফোকর গলে।
ভুবনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তারাপদর ভাব হয়ে গিয়েছে বেশ। হাত ধরাধরি করে তারা আগে আগে হাঁটে। মাঝে মাঝে ঘষা, প্রাচীন গলায় জেগে ওঠে পরিচিত সুর, "একবার এসো গৌর দিনমণি----"
পরক্ষণেই সদ্য ভাঙা তেজি, তরুণ গলাটি শুনিয়ে দেয় তার বয়সোচিত কোন চটুল ঝুমুর গানের কলি,
"সাইকেল নয়কো রেলগাড়ি
চলি যাবে তাড়াতাড়ি
বিহাই যাইছেন বাড়ি
বিহান দেখছেন ঘড়ি
সাইকেলে বিহাই যাইছেন ঘরে
দুটা ঠ্যাং ফাঁক করে"
যৌবন ও বার্ধক্য পাশাপাশি প্রবাহিত হয় আপন আপন সঙ্গীতের ধারায়। চন্দ্রালোকিত পাহাড়টি মৌন হয়ে তাই শোনে।
আন্দাজ আটটা নাগাদ অবশেষে পায়ের নিচে ডিগলি গ্রামের দেখা পাওয়া গেল। ছোট্ট গ্রামটি। জঙ্গলের মধ্যে খানিক জায়গা পরিষ্কার করে তার ওপর বড়জোর শ'খানেক মেটে ঘর, চাঁদের আলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের কোন সাড়াশব্দ নেই সেখানে। সেইদিকে আঙুল তুলে তারাপদ ঘোষণা করল, "এসে গেলাম। সব শুয়ে গেছে। ডেকে তুলতে হবে।"
শোভন মাথা নেড়ে বললো, "এই তোর একঘন্টা স'ঘন্টা হলো? কম করে তিন ঘন্টা হাঁটিয়েছিস আমাদের তুই আজ।"
"কী করব? বুড়োবাবার জন্য আস্তে চলতে হলো যে! আপনারা বরং এইবার ধীরেসুস্থে আসেন, আমি আগে আগে গিয়ে কাকারে ডেকে তুলি গে।"
বলতে বলতেই ভুবনের হাতটি ছাড়িয়ে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গেল সে। চন্দ্রালোকিত প্রস্তরভূমির ওপর তার ছায়াটি টলমল করতে করতে ছুটলো তার পায়ে পায়ে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার দীঘল কালো শরীর মিলিয়ে গেল বনময় পাহাড়ের গায়ে।
মিনিট পনেরো বাদে গ্রামের সীমানায় পৌঁছে দেখা গেল, তারাপদ সহাস্যমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আরেকজন প্রৌঢ়। তাড়াহুড়োয় ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। চোখেমুখে এখনও সেই ঘুমের জড়তা মাখা। শোভনের দিকে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, " আমি অনন্ত। বাবুদের আসা হচ্ছে কোথা থেকে? পরিচয়?"
শোভন বললো,"আমরা নদে জেলার লোক। সুন্দরনগর সাবডিভিশান কোর্টের নগেন উকিল আপনাদের ঠিকানা দিলেন।"
"নগেন ঘোষ? ও বাব্বা। তিনি তো অনেক উঁচাদরের মানুষ গো! কুমারহাটের জমিদারবাড়ির এক আনার শরিকের বড়ছেলে। আপনারা তেনার বন্ধু নাকি? আমার কাছে কী কাজ?"
অনন্ত বাউরির চোখেমুখে সম্ভ্রমের ছাপ। সম্ভবত তার পরিচিত বৃত্তে অত্যন্ত উঁচুস্তরের বাসিন্দা এই নগেনবাবু।
শোভন মাথা নাড়লো, "না না বন্ধু টন্ধু নই। ওনার দুই ছেলেমেয়েকে পড়াতাম, সেই থেকে জানাচেনা। ভালো ঝুমুরগানের সন্ধান করছিলাম, তখন তিনি আপনার খোঁজ দিলেন। তাই গান শুনতে আসা।"
"আচ্ছা আচ্ছা সে সব হয়ে যাবে'খন। নগেনবাবু পাঠালেন। গান তো হবেই। কালকের দিনটা থাকা হবে তো?"
"হ্যাঁ। পরশু সকালে ফিরবো ঠিক করেছি।"
"তবে তো মিটেই গেলো," প্রৌঢ় মানুষটি মাথা নাড়েন, "কালকে আসর বসায়ে দেব। এখন আসেন দেখি। খাওয়াদাওয়া করেন, আরাম করেন। দুপুরবেলায় তো শুনলাম মুড়ি ছাড়া কিছু জোটে নাই।"
আদরভরা ডাকটির পেছনে ভরপেট খাদ্য ও নিশ্চিন্ত শয্যার আহ্বান ছিল। এইবারে দুনিয়ার ক্লান্তি এসে যেন ভর করলো যাত্রী দুজনের দেহে। অলস পদসঞ্চারে তারা অনন্তর পিছুপিছু এগিয়ে গেল গ্রামের মাঝামাঝি একটি বাড়ির দিকে। তার পূর্বের ভিটার রান্নাশাল থেকে গণগণে কাঠের আগুনের আভাস আসছিলো। চুড়ির রিনিঠিনি, নারীকন্ঠের দু একটি মৃদু ফিসফাস, আর সেই সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠছিলো ফুটন্ত ভাতের সুগন্ধ।
উঠোন পেরিয়ে উল্টোদিকের ভিটার একটি ঘরে তাদের ছেড়ে দিয়ে তারাপদ রান্নাবাড়ির দিকে গেল। তার বারান্দায় একটি মাদুর পেতে ঝোলাঝুলি নামিয়ে আরাম করে দুটি বিড়ি ধরাল শোভনরা। কেরোসিন তেলে ভরা একটা কুপি রাখা রয়েছে সামনে। সেটাকে সামনে টেনে দেশলাইটা ফের বের করে এনেও কি মনে করে শোভন সেটাকে ঢুকিয়ে রাখল পকেটে। বারান্দা জুড়ে চাঁদের আলো পড়েছে। কুপি জ্বালিয়ে রেখে আর কী দরকার!
পরদিন সকাল থেকেই গ্রাম জুড়ে সাড়া পড়ে গেল। অনন্তর হাতে একশোটি টাকা দিয়েছিল শোভন। তাই দিয়ে হাঁড়িভরা ভাতের মদ জোগাড় করে আনা হয়েছে। উঠোন জুড়ে আসর বসাবার আয়োজন চলেছে। বাউরি নারীপুরুষেরা অনেকেই এসে হাত লাগিয়েছে সে কাজে। গ্রামের মানুষগুলির এই মূহুর্তে কোন কাজের চাপ নেই বর্ষার শুরু পর্যন্ত। শীতের মরশুমে যে সামান্য কিছু জমিতে মটর বা সর্ষের চাষ হয়েছিল সে ফসলও উঠে গিয়েছে অনেকদিন হলো। হাতে তাদের সময়ের অভাব নেই কোন। যারা গাইবে কিংবা সঙ্গত করবে তারা একে একে এসে জড়ো হচ্ছে অনন্তর উঠোনে। অনন্ত নিজে তাদের নিয়ে বড়োই ব্যস্ত। ঢোল, ধামসা, খঞ্জনী, কাঁসি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র এর ওর বাড়ি থেকে বের করে এনে সুরে চড়ানোর কাজ চলছে। উঠোন জুড়ে উৎসবের হাওয়া লেগেছে যেন। দুপুর পার হতে না হতে গোটা গ্রামের লোকজন এসে জড়ো হল অনন্তর প্রশস্ত উঠোনে। উঠোনের মাঝখানে বসেছেন শিল্পীরা। তাঁদের ঘিরে চারপাশে গ্রামের মানুষ বসেছেন। তাঁদের সমবেত গুঞ্জনধ্বনি থেমে এলে পরে গান শুরু হল। অনন্তই ধরলেন প্রথমে। আসর বন্দনার গান-
বন্দিব গো গণপতি শিবেরই চরণ
তা পরে বন্দিব গো দশেরই চরণ
তা পরে বন্দিব গো প্রভু গো গেরামের চরণ--।
তীব্র, তীক্ষ্ণ অলংকারবহুল স্বর। শোভন অবাক হয়ে শুনছিল। কয়েকমাস আগে গঙ্গাবিধৌত বরেন্দ্রভূমির সীমান্ত অঞ্চলে শুনে আসা আলকাপ নামের সেই প্রাকৃত লোকসঙ্গীতের সঙ্গে প্রস্তরময় মালভূমির এই গানের সুরশরীরের আমূল পার্থক্য। তবু, শুরুতেই বন্দনার মূল আদর্শটি কিন্তু সেই একই রয়েছে। দশজনের পদমালা কন্ঠে ধরেছিলেন আলকাপের আসরবন্দনাকারী। সেই দশের চরণেই বন্দনা করে সংগীতবাসরের সূচনা হল ঝুমুর গানের এই বাউরি লোকশিল্পীর কন্ঠেও।
"কেমন করে হয়?"
"কেমন করি কী হয় গোঁসাই?"
শোভন সচকিত হয়ে ভুবনের দিকে তাকিয়ে একচিলতে হাসল। বলল, "না গো ভুবনদা! তাই ভাবছিলাম, কোথায় চুর্ণি আর কোথায় দামোদর। কোথায় আলকাপ আর কোথায় ঝুমুর। কিন্তু আসর যখন শুরু হল, তখন নদিয়ার বীণাপানি ছোকরা আর এই ডিগলির অনন্ত বাউরি দুই সুরে একই কথা কেমন করে বলে বলো দেখি! তাই মুখ দিয়ে ও কথাটা বেরিয়ে গেল।"
বৃদ্ধ কৌতুকভরা চোখে হাসলেন একবার। এ প্রশ্নের একটা উত্তর তাঁর কাছে আছে। পাঁচ শতাব্দী আগে এক মানবপুত্র এই দেশকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন একটি মন্ত্র --
"তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা
অমানিনা মানদেন কীর্তনিয়া সদাহরি----"
সেই মন্ত্রের আত্মাটিই আজ এতকাল ধরে এ দেশের লোকসমাজের সমস্ত মরমী স্রষ্টা-শিল্পী-সাধকের চেতনায় ধীরে ধীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে কতই বিচিত্র পথে। বিনয়ের বহিঃপ্রকাশের এই ঐক্য হয়তো বা তারই ফল।
তবে, সে তত্ত্বভাবনার সময় এ নয়। চটুল লঘু চালে একের পর এক গান উড়ে চলেছে তখন অনন্তর উঠোনে। শোভনের মন গিয়ে পড়েছে সেই সুরের স্রোতে। তার হাতের টেপরেকর্ডার নিঃশব্দে ধরে রাখছে সেইসব সুর ও কথাগুলিকে। বৃদ্ধের তত্বকন্টকিত মনটিও কখন যেন ঘুরে ফিরে ফিরে আসে গানের আসরেই। সেখানে তখন নকুল নামে এক ছোকরা বিচিত্র মুখভঙ্গী করে গান ধরেছে-
"পাতকুয়ো নাই বাড়ির কাছে
চাপাকল তো দূরে আছে
(সেথা) চান করতে গেলে ননদ
করে গালমন্দ
হেসে কথা কই বলে
মরদ করে সন্দ-----------"
রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন প্রেমলীলার কাহিনী, নবরূপে, নতুন কালের অনুষঙ্গ নিয়ে ফিরে এসেছে তার গানে। যমুনা নদী ধরেছে চাপাকলের রূপ। তবু পরকিয়া রসের মূলতত্ত্বটি কিন্তু তাতে রয়ে গেছে অবিকল।
সারা দুপুর ধরে সুদর্শন, সত্যদাস, ঈশ্বর, সুদাম, ভক্ত, ফটিকরা পরপর গান গেয়ে চলল। কখনও মানভূমের, কখনও বাঁকুড়ার, কখনও বা পুরুলিয়ার ঝুমুর। শ্রোতা ও গায়ক, ভাতের মদের নেশা খানিক খানিক করেছে সকলেই। তারপর সন্ধ্যার মুখ মুখ পুরুষ গায়করা "টুকচু নিশা করিয়ে আসি গ" বলে সদলবলে পুরোন হয়ে আসা নেশাটিকে চাগিয়ে নিতে চলে গেলে আসরে এসে বসলেন অবগুন্ঠিতা মহিলারা। টুসু গাইবেন তাঁরা। অবগুন্ঠনের আড়াল থেকে একটি ক্লান্ত ও মধুর একক কন্ঠ সুর ধরল,
"হলুদ বনের টুসু তুমি হলুদ কেন মাখোনা?"
সঙ্গে সঙ্গে বাকি দলটির থেকে জেগে উঠল কোরাসে সুরেলা জবাব-
"শাশুড়ি ননদের ঘরে হলুদ মাখা সাজেনা।"
ফের প্রশ্ন আসে,
"ও টুসুর মা ও টুসুর মা তোদের কী কী তরকারি?"
এইবারে জবাব দেয় একটি একক কন্ঠ। মলিন স্বরে বলে,
"এই বাড়ির খেতের বেগুন
এই কানাচের গুগলি।"
তারপর হঠাৎই যেন প্রসঙ্গ পালটে অনুযোগের সুরে সে জানায়
"চিঠি পাঠাই ঘোড়া পাঠাই
জামাই তবু আসে না।"
জবাবে অদেখা জামাইয়ের উদ্দেশ্যে ফের জেগে ওঠে মিনতিভরা লোভ দেখানো কোরাস-
"জামাই আদর বড় আদর
তিনবেলা ভাই থাকো না।
আরও দু'দিন থাকো জামাই
খেতে দিব পাকা ধান
বসতে দিব শিতলপাটি
নীলমনিকে করব দান--।
কিন্তু ঠিক তার পর, সবেধন নীলমনি কন্যাটিকে দান করবার প্রতিজ্ঞার পরই ভেসে আসে একক কন্ঠে একটি সতেজ সাবধানবাণী,
"এক কিল সইলুম
দুই কিল সইলুম
তিন কিল বই আর সইবনা
আ লো ননদ বইলা দিবি
তোর ভাইয়ের ঘর করবো না।
আর এমনি করেই টুসু নামের আদরের দেবকন্যার চরিত্রটিকে অবলম্বন করে ডালপালা মেলে গ্রামীণ ঘরণী-কন্যা-মাতার হাজার সুখ দুঃখের কাহিনী। কখনও সে চপল কন্ঠে গায়,
"তোমার গালটা দেখি গন্ধ গন্ধ করে
তুমি মাখাছো নাকি লাক্স সাবান
আর মাইরো না অভাগীর পরাণ,
আবার পরক্ষণেই মাতৃকন্ঠে বেজে ওঠে এক প্রাকৃত বিজয়ার সুর,
"আমার টুসু ধনে
বিদায় দিব কেমনে
মাসাবধি টুসু ধনকে পুজ্যাছি যতনে
শাঁখা শাড়ি সিঁদুর দিলাম আলতা দিলাম চরণে
মনে দুঃখ হয় বড়ো ফির্যা যেতে ভবনে
দয়া কইরে আসবে আবার থাকে যেন মনে
ভুইল না ভুইল না টুসু আসবে আমার সনে।"
অথবা চটুল সখী টুসুকে দেখে সিনেমায় দেখা কোন আধুনিকার বেশে,
"টুসু আমার বাজার বেড়ায় পরিধানে নীল বসন
মিনি কাটিং ব্লাউজখানা বেশ মানাল হাল ফ্যাশান"-
গান ভাঙলো যখন, রাত তখন দুই প্রহরের মাঝামাঝি। আকাশে প্রতিপদের সামান্য ক্ষয়া চাঁদের জ্যোৎস্না ছিলো। অনুষ্ঠানক্লান্ত মানুষগুলি সেই আলো মেখে বাদ্যযন্ত্রগুলি নিয়ে একে একে ফিরে গেলে তাদের পিছু পিছু শোভনও এগিয়ে গিয়েছিলো খানিকটা পথ। ফিরে এসে দেখে ভুবনের সঙ্গে অনন্তর কথাবার্তা চলছে। মেলায় দুটি রাত গান গাইবার জন্য আসবে অনন্ত বাউরির দলটি। জনা পনেরো লোক হবে। টাকাপয়সা তারা নেবেনা কিছু। যাতায়াতের ভাড়াও লাগবে না। মধুকুণ্ডা স্টেশন থেকে ট্রেনে ট্রেনে বিনা ভাড়াতেই পৌঁছে যাবেন তাঁরা। হারি-বাউরির আবার ট্রেনের ভাড়া কি? জেলে ওঁদের কেউ কখনো পাঠাবে না। ওতে সরকারেরই লোকসান। মিনিমাগনার খোরপোশ দিতে হবে যে কদিন! এ দিগরে বিনি ভাড়ায় রেলের গাড়িতে চড়া মানুষদের তাই ধরা পড়লে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত দেয় রেলবাবুরা। বলতে বলতে চোখ টিপে হেসে উঠে অনন্ত বলে, "নামিয়ে দ্যায় তো দেবে! পরের গাড়িতে ফের উঠে চলে আসবো! সে আপনারা ভেবো না।"
তবে হ্যাঁ। দুবেলা পেটপুরে ভাত চাই দুটি আর নেশার দ্রব্যের পয়সা। ওটি না হলে গান জমবে কী করে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন