[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

মঙ্গলবার, ১ মে, ২০১২

অবুঝ বালক



যখন তখন মন খারাপ হয়ে যায় রাজুর। সে কিছুতেই বুঝতে পারেনা, কেন তাকে সবাই এত অবহেলা করে? রাজুর কোন বন্ধু নেই। বিকেলবেলা পাড়ার সব শিশুরা যখন মাঠে খেলাধূলা আর চিৎকার- চেঁচামেচি করে বেরায়, ওকে তখন চুপচাপ বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রাজু খেলতে নামলেই পাড়ার ছেলে-বুড়োরা সব টিটকারী মেরে বলে ওঠে, “বুড়া পোলার শখ কত। বাচচাদের সাথে খেলতে আসছে!” রাজু ভেবেই পায়না,কেন সবাই তাকে বুড়া পোলা বলে ডাকে? ওর ও তো পাড়ার বাচচাদের সাথে সারাক্ষণ খেলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কেউ ওকে খেলায় নিতে চায়না!
রাজু শুনেছে ওর জন্মের কারণেই নাকি ওর বাবা ওদেরকে কে ছেড়ে চলে গেছে! কথাটা কতটুকু ঠিক, কে জানে। রাজু বোঝেনা,ও জন্মাতে সবার কেন এত রাগ? ওর বড় আপু আর ভাইয়াও খুব বাজে ব্যবহার করে ওর সাথে! ভাইয়াটা তো সময়-অসময়ে থাপ্পড় মেরে বসে ওর গালে! আর তাতে রাজু একটু কান্না করলেই হয়েছে, সারা বাড়ি মাথায় নিয়ে ভাইয়া বলতে থাকে, “বুড়া ছেলে বাচচাদের মত নাকি কান্না কাদতে বসেছে”। রাজু বুঝতেই পারেনা,কেন ভাইয়া ওর মত একটা ছোট একটা বাচচাকে ‘বুড়া ছেলে’ বলে? রাজুর তো বয়স মাত্র ১৬! এখনও মামনি ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে চুল আচড়ে দেন। খেলনা গাড়ি আর লোগো সেটগুলোই ওর প্রিয় বন্ধু। না,না, আসলে মামনি রাজুর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। একমাত্র তিনিই রাজুকে বুঝতে পারেন।রাজুর সব আব্দার-অভিযোগ মনযোগ দিয়ে শোনেন আর নীরবে রাজুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। সে যখন মা’র চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, “মা,কাঁদো কেন?” মা তখন নীরবতা ভেঙ্গে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন।
রাজু স্কুলে যেয়ে শুনেছে আজ নাকি ‘মা দিবস’। ‘মা দিবস’ মানে কী,সেটা না বুঝলেও,এটা বুঝতে পারল যে আজ মা এর জন্য বিশেষ একটা দিন। রাজুতো এ পথিবীতে সবচেয়ে ভালোবাসে মামনিকে। তাই ও ঠিক করল আজ একটা কিছু উপহার দিয়ে চমকে দেবে মামনিকে। উপহার কেনার জন্যতো টাকা চাই। কিন্তু সে টাকা কোথায় পাবে? মা তো অফিসে গেছেন। আপুর কাছে টাকা চাইতেই সে ১০ টাকা দিয়ে বলল, “যা যা, আইস্ক্রীম কিনে খা,হাবলু”। রাজুকে সবাই ‘হাবলু’ ডাকে— ওর মন খারাপ হয়ে যায়।
অনেক চিন্তা ভাবনার পর রাজুর মনে পড়ল গত বছর বৈশাখী মেলায় মামনি তাকে একটা মাটির ব্যাঙ্ক কিনে দিয়েছিল, আর সেটাতে টাকা জমানোর জন্য মা তাকে মাঝে মাঝে ৫-১০ টাকা দিতেন। ব্যাঙ্কটা আলমারী থেকে নামিয়ে ভেঙ্গে ফেলল সে, পেল উপহার কেনার মত বেশ কিছু টাকা। সবাই বলে রাজু নাকি হাবলু,বোকা। কিন্তু আজই সবাই বুঝে যাবে যে ছোট রাজুর মাথায়ও কত বুদ্ধি আছে! কাছের একটা দোকান থেকে একটা কেক কিনে আনল সে। আম্মুকে খুশি করার জন্য ঘর-দোর গুছাতে লাগল। ঘর গোছাতে যেয়ে অবশ্য দুটো প্লেট ভেঙ্গে ফেলেছে ও! ভাগ্যিস ওগুলো আপু-ভাইয়া দেখেনি,তাহলে নির্ঘাত কান মলানি খেতে হত আজ।
আপু আর ভাইয়া একবার এসে দেখে গেল কেকের বাক্সটা। ভাইয়া ভেংচি কেটে বলল, ‘গবেট রাজু,কেক এনেছিস ভাল কথা, কিন্তু এই কেক কাটবি কিভাবে বলতো? নাকি তোর মত সবাইকে অভদ্র ভাবিস, যে বাচচাদের মত থাবা দিয়ে দিয়ে সবাই কেক খাবে!”এই কথা শুনে রাজু মাথা চুলকাতে থাকে,তাইতো, কেকটা কী দিয়ে কাটবে? কেক কাটার জন্য যেন কী লাগে? রাজুর বয়স ১৬ হলে কী হবে? সে তো আর সব বাচচার মত স্বাভাবিক হয়ে জন্মায়নি, আর সব মানুষের মত স্বাভাবিক বুদ্ধি সম্পন্ন নয় সে! সে ভাবল, মা তো কাপড় কাটার জন্য কেঁচি ব্যবহার করেন, তাহলে নিশ্চয়ই কেক কাটার জন্যো কেঁচি লাগে? সে দৌড়ে মামনির সেলাইয়ের বাক্স থেকে কেঁচিটা নিয়ে আসে। তাই দেখে আপু-ভাইয়া তো হেসেই খুন। আপু মাথায় চাটি মেরে রাজুকে বলল, “গাধা ছেলে, কেঁচি দিয়ে কেক কাটেনা, ছুরী দিয়ে কাটা হয়”।
রাজু মাথা চুলকায়, তাইতো সে তো ভুলেই গিয়েছিল যে কেক কাটা হয় ছুরী দিয়ে। কিন্তু সে এখন ছুরী কোথায় পাবে? বাজার থেকে কিনে আনবে? মামনি যে এক্ষুণি চলে আসবে অফিস থেকে! ঝেড়ে দৌড় দিল সে দোকানের উদ্দেশ্যে। ওর বড় মাথার ছোট বুদ্ধিতে একবারও ভেসে উঠলনা যে, বাসার রান্না ঘরেই রয়েছে ওর কাংখিত ছুরী! রাজু দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। ওর মাথায় ঝড়ের বেগে বয়ে চলেছে একটা নির্দেশ, মা বাড়ি ফেরার আগেই ওকে ছুরী যোগাড় করতে হবে! বড় রাস্তায় উঠেও রাজুর মনে থাকেনা যে একটা ঘাতক ট্রাক ছুটে আসছে ওকে লক্ষ্য করে!
রাজু এ নিষ্ঠুর পৃথবী থেকে চলে যাওয়াতে আর সব মানুষজন হাঁফ ছেড়ে বাচলেও মামনির কান্না যেন আর থামতেই চায়না। এ পৃথবীর সবার কাছেই রাজু ছিল একটা বোঝা, কিন্তু মামনির কাছে রাজু ছিল অমূল্য ধন। গোরস্থান থেকে ফিরে এসে ভাইয়া পড়ার টেবিলে দেখতে পেল সেই কেকের বাক্সটা। বিরক্ত হয়ে বাক্সটা বাস্কেটে ফেলে দিতে যেয়েও কী মনে করে বাক্সের ঢাকনাটা খুলতেই দেখতে পেল একটা সুন্দর কেকের ওপর গোটা গোটা করে লেখা, “ ভালবাসি মামনিকে, ভালোবাসি আপু-ভাইয়াকে”। অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামল, এই প্রথম রাজুর জন্য কাঁদল ভাইয়া!

কোন মন্তব্য নেই: