[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

মঙ্গলবার, ১ মে, ২০১২

অনুভূতিগুলো সব আমার



পুরানা পল্টনের পুরনো বাসাটা ছেড়ে যখন আমরা খিলগাঁওয়ের একটা ছোট্ট দু”কামড়ার বাসায় এসে উঠলাম তখন মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিন পরেই ২ তলার লাবনী আর ৩ তলার মিশি-ঐশী-ত্রয়ী এর সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর ছোট্ট বাসাটাকে আর খারাপ লাগতনা। বরং আমরা পিচচিগুলো তখন পুরা পাড়াটাকেই আমাদের বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলাম! মাঠ ছিলনা বলে বাসার সামনের লম্বা রাস্তাটাই ছিল আমাদের সকাল-বিকাল খেলাধূলা করার আদর্শ স্থান।
আমি তখন পড়তাম ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ক্লাস থ্রিতে। ডে শিফটে ক্লাস থাকায় সারাদিন পাড়ার বব্ধুদের সাথে খেলাধূলা করে স্কুলে যেতাম। স্কুল ছুটি হত বিকাল ৪ টায়। কিন্তু বড় আপুদের দেরীতে ছুটি হওয়ায় স্কুল বাস ছাড়তো ৬টায়। এই ২ ঘন্টা স্কুলের মাঠে দাপাদাপি করে বেড়াতাম আমি,মিষ্টি,রিতু আর শান্তা আপু। ক্লাস ৫ এর শান্তা আপুর বুদ্ধিতে স্কুল ছুটির পর এমন কোন দুষ্টুমি নাই যে আমরা করতাম না! খেলাধূলা, গাছ থেকে আম পাড়া, ছোটদের ভুতের গল্প বলে ভয় দেখানো, যাদেরকে পছন্দ করতাম না তাদের কে টীজ করা—এমন নানান আজব আজব কান্ড করে বেড়াতাম আমরা শান্তা আপুর নেতৃত্বে!
এদিকে মিশি-ঐশী-ত্রয়ী,লাবনী আর আমি মিলে একবার পাড়ার বাচচাদের নিয়ে আয়োজন করে ফেললাম sports tournament। একদিন আমরা ঠিক করলাম বিল্ডিং এর সিঁড়ি ঘরে আশেপাশের গরীব ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাব। ওদেরকে নিজেদের বই-খাতা-কলম দিলাম,কিন্তু কয়েকদিন পর বাড়িওয়ালার ঝাড়ি খেয়ে আমাদের স্কুল ভন্ডুল হয়ে গেল! তাই বলে আমরা বসে থাকার পাত্রী ছিলাম না। পাশের বিল্ডিং এর টুসী আপুর ছেলে পুতুলের সাথে ধুমধাম করে লাবনীর মেয়ে পুতুলের বিয়ের ব্যাবস্থা করে ফেললাম। বিয়েতে পুরো পাড়ার সব বাচচারা এসেছিল!একদিন শুনলাম এই ছোট্ট বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমরা। ক্লাস ফোর এ ওঠার পর মর্নিং শিফটে চলে আসার সময় শান্তা আপুকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। সেদিন শান্তা আপুরও চোখ ছিল ছলছলে।
এর ঠিক ৩ বছর পর হঠাৎ করেই একদিন স্কুলের মাঠে দেখি ঐশী! বুঝতে পারলাম ও আমাদের স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে। আমি দারুন খুশি হয়ে ছুটে গেলাম ওর কাছে, উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললাম, “আরে ঐশী! আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি রূম্পা!” ঐশী চোখ সরু করে বলল, “sorry,চিনতে পারছিনা”। ভাবলাম নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। তাহলে হয়তো এই মেয়ে ঐশী না। ঐশী হলে কবেই আমাকে জড়িয়ে ধরতো!আমি একটু দমে গিয়ে বললাম “আরে, আমি ঐ যে খিলগাঁওয়ের রূম্পা। মনে নেই তোমার? তোমার নাম তো ঐশী, তাইনা?” এবার মেয়েটা খুব স্পষ্ট গলায় জবাব দিল, “জ্বি হ্যাঁ,আমি ঐশী। কিন্তু আমি সত্যি খুব sorry আপু, আমি আপনাকে চিনিনা। এই বলে ক্লাসের দিকে দৌড়ে গেল সে। আমি হতবাক হয়ে গেলাম, মাত্র ৩ বছরে ওরা আমাকে ভুলে গেল কি করে?
এভাবে কেটে গেল আরও ৫ বছর,সবে মাত্র কলেজে পা রেখেছি। সিনিয়র আপুদের HSC এর রেজাল্ট আজকে। বেলা দেড়টা থেকেই রেজাল্ট ঘোষণা হয়ে গেল আর আপুদের সাথে আমরাও শুরু করে দিলাম হইহল্লা! হঠাৎ মাঠের এক কোণে দেখতে পেলাম লম্বা,শুকনা মত একটা মেয়ে, বন্ধুদের সাথে খুব আনন্দ করছে। ভাল করে তাকাতেই বুঝতে পারলাম মেয়েটা আর কেউ নয়, আমার হারিয়ে যাওয়া শান্তা আপু! আমি পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন বন্ধুকে বললাম, “আরে এ তো আমার শান্তা আপু! তোদের বলেছিলাম না ওর কথা? মনে হয় এ+ পেয়েছে!” ওরাও উত্তেজিত হয়ে বলল, “চল,শান্তা আপুকে অভিনন্দন জানিয়ে আসি!” ছুটে গেলাম শান্তা আপুর কাছে, জড়িয়ে ধরে বললাম, “শান্তা আপু, congratulation! কেমন আছ?” শান্তা আপু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, “thanks, কিন্তু তোমাকে তো চিনলাম না, আপু”। আমি আপুর হাত ধরে ঝাকিয়ে দিয়ে বললাম, “আমি রূম্পা, সেই যে আমি,তুমি,রিতু আর মিষ্টি স্কুলে কত মজা করতাম মনে আছে তোমার?” আপু আমার হাতের শক্ত মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, “তুমি মনে হয় ভুল করছো,রুম্পা নামে কাউকে আমি মনে করতে পারছিনা”। একগাদা বন্ধুর সামনে আমাকে অপমান করে শান্তা আপু তার বন্ধুদের ভীড়ে মিশে গেল!
৮ বছর আগে কেঁদেছিলাম শান্তা আপুকে ছেড়ে আসতে হবে ভেবে,আর আজ কেন অজান্তেই চোখের জল বেড়িয়ে গেল জানিনা। মানুষ এত সহজে প্রিয়জনকে ভুলে যায় কি করে? নাকি এটাই প্রকৃতির নিয়ম? শুধু আমিই হয়তো প্রকৃতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে প্রিয়জনদের মনে করে রেখেছি!

কোন মন্তব্য নেই: