[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

চিঠি -পত্র - ইতিকথা....

 

চিঠি - পত্র - ইতিকথা

 
 
আমার কাছে আজকাল আর চিঠি আসেনা। চিঠি মানে কাগজে লেখা চিঠি। যে চিঠি নিয়ে আসার কথা ডাকপিওনের। ডাকে আসে শুধু ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল, ক্রেডিট কার্ড বিল, ফর্ম, অ্যাপ্লিকেশন এইসব। কালে-কস্মিনে এক দুটো বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রনের চিঠি। শুধু আমার কাছে কেন, কারোর কাছেই মনে হয় আসেনা। জীবন থেকে ক্রিম রঙা পোস্টকার্ড আর নীল রঙা ইনল্যান্ড কাগজ হারিয়ে গেছে। রঙিন ফুল ছাপ রাইটিং প্যাড আর লাল হৃদয়-চিহ্ন আঁকা রংচঙে খাম কিনিনি বহুদিন। আমিও কাউকে চিঠি লিখিনা। আমাকেও কেউ চিঠি লেখে না।

কিন্তু বেশ অনেকদিন আগে, যখন এস টিডি ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, ই-মেল ছিল না, তখন তো এই পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড-ই ছিল ভরসা। কোলিয়ারিতে চাকরি করা আমার অবিবাহিত বড়মামা নিয়ম করে একটা পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতেন প্রতি সপ্তাহে। নিয়মিত সবার খোঁজখবর রাখার জন্য এটাই ছিল তাঁর প্রধাণ যোগাযোগের মাধ্যম। মাঝে মাঝে সেই পোস্টকার্ডের পেছন দিকে কালো কালিতে আঁকা থাকত কোন স্কেচ- চিঠির সাথে উপরি পাওনা। বছরে দু'বার- নববর্ষে আর পুজোর পরে, আমি বসতাম ঠাকুমার সাথে, একতাড়া পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড নিয়ে। ঠাকুমা চিঠির বয়ান বলে যেতেন, আমি গোটা গোটা অক্ষরে লিখে যেতাম। চিঠি যেত কাছে-দূরে - হিলি, মালদা, শ্যামনগর, কল্যাণী, ভদ্রেশ্বর... সব চিঠির বয়ান প্রায় একই , শুধু সম্বোধনের নামগুলি পালটে যেত। "স্নেহের ভানু ও রেবা...", "স্নেহের পল্টু ও রিনা...", "স্নেহের রুবি ও সুরেন..." - যাঁদেরকে লেখা হত এইসব চিঠি, তাঁদের বেশিরভাগকেই আমি কোন দিন চোখে দেখিনি, বাবার পিসতুতো ভাই, বা মাসতুতো দিদি, এইরকম সব সম্পর্ক। কিন্তু আমি তাঁদের সবার নাম, ঠিকানা, ছেলেমেয়েদের নাম- সব জানতাম। চিঠি লিখে লিখে আর মাঝে মধ্যে পুরোনো অ্যালবামের ঝাপসা হয়ে যাওয়া সাদা-কালো ছবির মধ্যে দিয়েই তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন আত্মার আত্মীয়।  শুভকাজে শুভেচ্ছা জানিয়েছি, শোকে শোকজ্ঞাপন করেছি। ঠাকুমার বকলমে সেই অদেখা মানুষগুলির সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে ছিলাম বহু বছর।

তাই বলে কি শুধুই বকলমে লিখতাম? কখনই না। নববর্ষ আর বিজয়ার চিঠি নিজের নামে লিখে গুরুজনদের পাঠিয়েছি। অসুখ হয়ে স্কুলে না যেতে পারলে ক্লাসের প্রিয় বন্ধুদের পাঠিয়েছি লম্বা চিঠি। সে চিঠির উত্তরে এসেছে আরো লম্বা চিঠি। এই চিঠিগুলি দেওয়া নেওয়া করত আমার প্রতিবেশী স্কুলের বন্ধুটি। হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে রুমমেটদের চিঠি লিখেছি। প্রেমে পড়ে চিঠি লিখেছি পাতার পর পাতা, কাগজ রঙিন হোক বা সাদা।

এখন লিখি ই-মেল। বড্ড কেজো, বেশিরভাগ সময়েই তথ্য আদান প্রদান করার কাজে ব্যবহার করা এক যোগাযোগ ব্যবস্থা। মাউসের এক ক্লিকে ই-মেল পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর যেকোন কোণে। উত্তর এসে যাচ্ছে হয়তবা কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই।  বক্তব্যের আয়তন অনুযায়ী ইনল্যান্ড না পোস্টকার্ড বাছাই করতে হয়না, ফাউন্টেন পেন এ সুলেখা কালি ভরতে হয়না, ভুল হয়ে গেলে ঘিচিমিচি করে কাটতে হয় না। লিখতে হয়না অজানা শহরের চেনা ঠিকানা।  বেশিরভাগ সময়েই চিঠির শুরুতে কোন সম্বোধন থাকে না। শেষে লেখা থাকেনা -'ইতি...'।

হারিয়ে গেছে অপেক্ষা । চিঠি লেখার, চিঠি পাওয়ার, চিঠি পড়ার, চিঠিকে অনুভব করার...বালিশের নিচে ই-মেল নিয়ে ঘুমানো যায় না।

কোন মন্তব্য নেই: