অনিন্দিতা,
তোমার কপালে সেদিন কোন টিপ ছিলনা। কালো টিপ আমার ভীষণ পছন্দ ছিল। অথচ তুমি কখনো
কালো টিপ পড়তে না। কলঙ্কের দাগ নাকি কালো হয়, তাই তুমি সবসময় গাঢ় লাল টিপ পড়তে।
কপালে লাল টিপ পড়লে সেটা আরো বেশী জ্বলজ্বল করতো। তোমাকে ভীষণ মানিয়ে যেত। মাঝে
মাঝে আমাকে বলতে তোমার নাকি সিঁদুরের টিপ পড়তে খুব শখ হয়। আমি শুনে তোমাকে একটা
ছোট্ট রূপোর কৌটো উপহার দিয়েছিলাম, সিঁদুর রাখবে বলে। সেটা টাঙ্গাইলের কোন এক
জমিদার বাড়ীর পুরোনো স্মৃতি। নওরোজ আমাকে দিয়েছিল। নওরোজকে তুমি চিনতে। একসময় আমার
অফিসেই চাকরী করতো। মগবাজারের বাসায় প্রায়ই আসতো। পরে অন্য অফিসে চাকরী নেয়। জমিদার
পরিবারের কেউ একজন সম্পর্কে ওর নানী হতো। সেই নানীই ওকে রূপোর কৌটটা দিয়েছিল। কেন
জানিনা একদিন সেটা আমার হাতে দিয়ে বললো, “স্যার এটা আপনাকে দিলাম। আমার নানীর
স্মৃতি। যেখানে যে অবস্থায় আছি এটা হারিয়ে যেতে পারে। তাই আপনাকেই দিয়ে দিলাম”।
নওরোজ প্রসঙ্গ এখন থাক। টিপের কথাই বলি।
যা বলছিলাম- সিঁদুরের টিপ পড়ার ব্যাপারে তোমার মায়ের কড়া নিষেধ ছিল। কুমারী
মেয়েদের নাকি কপালে সিঁদুরের টিপ পড়তে নেই, তাতে অমঙ্গল হয়। তোমার মায়ের এক কথা,
মুসলমান মেয়েদের কখনো সিঁদুর পড়তে নেই। পুরাণকালে অজন্তা, ইলোরা, শকুন্তলা, মেনকা,
দ্রৌপদী ওরা পুরুষদের মন ভোলাতে এমন সব বসন-ভূষণ পড়তো, কপালে টিপ দিত। আমাদের
রক্ষণশীল সমাজে ওসব চলেনা। লোকে আড়ালে নানা কথা বলে, আড় চোখে তাকায়। তোমার মধ্যে
এসব অবশ্য কুসংস্কারের বালাই ছিলনা। তুমি যথেষ্ট উদারমনা ছিলে। তুমি কখনো শাড়ী
পড়লেই কপালে একটা টিপ পড়তে। লাল টিপ ছাড়া অন্য কোন টিপ খুব একটা চোখে পড়েনি। অন্য
টিপ পড়ার ব্যাপারে তোমার মায়ের তেমন আপত্তি ছিলনা শুধু সিঁদুরের টিপ পড়ার ব্যাপারেই
যত অমত। তাই রূপোর কৌটাটা কখনো কোন কাজে লাগেনি।
অনিন্দিতা, মনে আছে- একদিন বান্ধবীর বাসায় যাবার কথা বলে আমাদের বাসায় এসেছিলে।
বেশ সুন্দর একটা শাড়ী পড়েছিলে। বাদামী জমিনের উপর সাদা সাদা বল প্রিন্ট। সাধারণ
সূতী শাড়ী। সোজা আমার ঘরে এসে বললে, “দ্যাখোতো এই শাড়ীতে আমায় কেমন লাগছে? আমি
বললাম, “অনিন্দ্য সুন্দরী”। মা তখন রান্না ঘরে। লক্ষ্য করলাম তোমার কপালে কোন টিপ
নেই। শাড়ী পড়েছো অথচ কপালে টিপ পড়োনি দেখে অবাক হলাম। তোমার কাছে এগিয়ে গেলাম। আশে
পাশে কেউ ছিলনা। সেই সুযোগে তোমার কপালে একটা চুমু এঁকে দিলাম। চুমু দিতেই তুমি
একটু রাগত ভঙ্গিতে বললে- ছিঃ ছিঃ একি করলে তুমি! আমার কপালে যে কলঙ্ক লেপে দিলে!
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম! বললাম- “স্যরি, তোমাকে এতোটাই ভাল লাগছিল যে লোভ সামলাতে
পারলাম না। তোমার কপালে টিপ নেই দেখে ভাবলাম শূন্যস্থানটা পূরণ করে দিই। তোমার
কপালের লাল টিপটা বরাবরই সিগন্যালের লালবাতি হয়ে আমাকে থামিয়ে দেয়। আজ আর কোন বাঁধা
ছিলনা। নাহ্, কোন কলঙ্ক নয়- আমার শুভেচ্ছা ও ভালবাসা তোমার কপালে এঁকে দিলাম। দেখে
নিও তুমি সৌভাগ্যবতী হবে”।
অনিন্দিতা, কতকাল পর সেদিন তোমার সাথে দেখা। তোমার অনেক গল্প আমি লোকের মুখে
শুনেছি। আজ তোমার গাড়ী, বাড়ী, ঐশ্বর্য সবই আছে- আমারতো তেমন কিছু নেই। তোমার কপালে
আজো সেই লাল টিপটা জ্বলজ্বল করছে। তোমার গালে কোন তিল ছিলনা, তবে নাকের ডগায় ছোট্ট
একটা তিল ছিল। আমি অবাক হয়ে তোমাকে দেখতাম। বলতাম, তুমি স্বামী সোহাগী হবে। কী
দারুন ভাগ্য তোমার! তুমি বলতে আমি হিংসুটে, ঈর্ষাপরায়ণ। সত্যিই কী তাই? একদিন তোমার
ঐ কপালে ছোট্ট একটা চুমু এঁকে বলেছিলাম, “তুমি সৌভাগ্যবতী হও”। আজ তুমি সত্যিই
ভাগ্যবতী। স্বামীর সংসারে রাজনন্দিনী হয়ে আছো। তোমার বিয়েতে যেতে পারিনি। কিছু
দিতেও পারিনি। আমার সেই রূপোর কৌটাটা কী আছে? তাতে এক চিলতে সিঁদুর রেখে দিও- মনে
করো সেটাই আমার আর্শীবাদ, আমার নির্মল ভালবাসা। তোমার জীবনের সকল অমঙ্গল ঐ রুপোর
কৌটতে বন্দী থাক। ভাল থেকো তুমি। ইতি-
আনন্দ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন