[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১১

আঁধার প্রেমী


আঁধার প্রেমী

আঁধার প্রেমী
হে অসহিষ্ণু আলো, তুমি আমার প্রিয়তম আঁধারকে এভাবে গ্রাস করোনা। আমার জীবনের ব্যর্থতা লুকাতে কিছুটা আঁধার থাকতেই হয়- তুমি সেই আঁধারটুকু কেড়ে নিওনা। রাত জেগে জেগে যখন আমি নিজের বিষণ্ন মুহূর্তগুলোকে একাকিত্বের সূতোয় বুনতে থাকি তখন মিত্রতা লাভের আশায় জোনাকীরা আলো জ্বেলে আমাকে খুঁজতে আসে। অথচ ওরা জানেনা আমি তখন স্বপনপুরে পক্ষ্মীরাজে চড়ে আমার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো খুঁজছি। এদিকে রাতভর উঠোনে জমা হতে থাকে ঝরা বকুলের স্তূপ। নিজের বলতে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একখানা টিনের চালা আর ছায়াসঙ্গী বলতে উঠোন জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল গাছটা। আমার দাদীর হাতে লাগানো বকুলের চারাগাছটা আজ পরিণত বৃক্ষ। ফুল মৌসুমে গাছটি ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকে। মনে মনে হয়তো সে’ও বৈধব্যের বেশে সাজতে চায়। ঝরা বকুলের কোন দাবীদার নেই। ভোর হতে না হতেই পাড়ার ছোট ছোট মেয়েরা বকুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যায়। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই দৃশ্যটা উপভোগ করি। একটা ছোট্ট মেয়ে আমাকে প্রায়ই বকুলের মালা দিয়ে যায়। ওর দিদি নাকি সুন্দর মালা গাঁথতে জানে। ওর কথা শুনে আমি হাসি। সামান্য ফুলও মানুষের মাঝে নিবিড় বন্ধন রচনা করতে পারে।
বকুলের মালা আমার তেমন পছন্দ নয়। এর কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। যে মালা গাঁথে সেতো আমার দুয়ারে এসে কখনো দাঁড়ায়নি। দাদী নাকি দাদার জন্য বকুলের মালা গাঁথতো। পাশের বাড়ির হরিচরণ কাকা মারা যাবার পর দেয়ালে টাঙ্গানো তাঁর ছবিতে দীর্ঘকাল শুকিয়ে যাওয়া বকুলের মালা ঝুলতে দেখেছি। অথচ দাদার হাতে কখনো বকুলের মালা চোখে পড়েনি। দাদার বকুলপ্রীতির রহস্য আজো অজানা। হয়তো দাদীর প্রতি তার ভালবাসার প্রকাশটাই ছিল ওরকম। দিনের আলোয় তা নিতান্তই অস্পষ্ট।
আমার জোছনা ধোয়া রাতগুলোতে কেউ কখনো কামিনী বা হাসনাহেনার সুবাস ছড়ায়নি, আমার শ্রাবণ রাতের অবিরাম বর্ষণে কেউ কোথাও কদমফুল ফুটতে দেখেনি। আমার বসন্ত দিনগুলোতে কেউ ফুল খোঁপাতে সাজবে বলে বায়না ধরেনি। একবার বর্ষাকালে বাবা আমাকে পেখম তোলা ময়ুরের নাচ দেখাবে বলে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে নিয়ে গেছিল। আমি বাবার হাত ধরে সেই প্রথম ময়ুরের নাচ দেখেছিলাম। মানুষের মন খুশীতে নাকি অমন করেই নাচে। আমার মন আজো ময়ুরী নাচের তৃষ্ণায় কাতর।
একে একে অনেক বসন্ত কেটে গেল। কেটে গেল শীত, গ্রীষ্ম বর্ষাও। শূন্য ভিটে আমি আজো আগলে বসে আছি। দিনের আলোয় আমি ভিটের আশেপাশে হারানো স্বজনের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। আমার স্মৃতিপটে সবকিছুই পরিস্কার হয়ে আসে। এই ভিটে, এই টিনের চালা, এই বকুলগাছ- সবই যেন জ্বলজ্বলে স্মৃতির এক একটি অটল পাহাড়; আমার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় সকাল গড়িয় দুপুর, তারপর সন্ধ্যা। অবশেষে আঁধার নামলেই সব অদৃশ্যমান। আমি তখন নিজের অজান্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। আঁধারকে আপন ভেবে সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করি। অথচ সেই আঁধার কখনোই দীর্ঘস্থায়ী নয়। রাতের জানালা ধরে বেহায়া জোছনাটা কখনো উঁকি দেবার চেষ্টা করলে আমি এক ঝটকায় আবেগের পর্দাটা টেনে ধরি। ভাবনার বেড়াজাল টপকে অনুভূতির শিরশিরে বাতাস যখন হৃদপিন্ডের সবুজ প্রান্তর ছুঁয়ে যেতে চায় আমি তখন বেদনার দিগন্তে একরাশ দীর্ঘশ্বাস জমা করি। আমার চেতনার প্রাঙ্গন প্রায়শই নির্বোধ হাহাকারে গুমরে কাঁদে। আমি নিজের অস্তিত্বকে মিশিয়ে দিই গাঢ় অন্ধকারে। নিজেকে গুটিয়ে রাখি প্রদীপের ছায়ায়। প্রেয়সী রাত আমার নিঃসঙ্গতার দোসর হয়ে আমাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। আর ঠিক তখনি দূরে অস্থির পাখীরা ডানা ঝাপটায়, উঠোনজুড়ে বিরহকাতর বকুলেরা আত্মাহুতি দেয়, সঙ্গপ্রিয় সবুজ ঘাস নিবিড় আলিঙ্গনে শিশিরসিক্ত হয়, নিশাচর প্রাণীরা নিজেদের আস্তানা খুঁজে নেয়- দিগন্তবলয় ভেদ করে সূর্যদেবের উপস্থিতি। রাতের সকল নিস্তব্ধতা থেমে যায়। অসহিষ্ণু আলো এসে এভাবেই আমার অনন্তসঙ্গী রাত্রিকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করে।

কোন মন্তব্য নেই: