রক্তে ভেজা শাড়ি !
কতদিন মাকে দেখি না। ভার্সিটির হলে বসে একা একা ভাবতে থাকে সজীব। পরীক্ষার চাপ
থাকায় গত ঈদেও বাড়িতে যাওয়া হয়নি। আজই পরীক্ষা শেষ হল। কাল বাড়ি যাবে সে তাই আজ
অনেক খুশী, তার মায়ের মমতা মাখা মুখটি যেন তাকে ডাকছে। অনেক দিন পর মায়ের হাতে
রান্না করা খাবার খাবে। হলের পচা বাসি খাবার খেতে মুখে অরুচি এসে গেছে। আজ টিউশনি
থেকে টাকা পাওয়ার কথা। টাকা পেলেই সে মায়ের জন্য একটি শাড়ি কিনবে ঠিক করল।
○•○
সজীব ঢাকা ভার্সিটির রসায়নের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হলে থাকে, তার মা রহিমা বেগম গ্রামে থাকেন।
সজীবের বাবা কবির সাহেব একটু প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী করতেন। তিনি ছিলেন অনেক পরিশ্রমী ও সৎ। আজগর সাহেব উনার নতুন বস। আগের বস চলে যাওয়ার পর আজগর সাহেবকে উনার ডিপার্টমেন্টে নতুন একজন বস নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি আসার পর থেকেই সব ব্যপারে কবির সাহেবের ভুল ধরতে থাকেন। কোম্পানীর এম ডি র কাছে উনার ব্যপারে আজে বাজে কথা বলতে থাকেন। এম ডি কে বলেন কবির সাহেবকে বের করে দিয়ে উনার পরিচিত একজনকে তার জায়গায় বসাতে। যিনি নাকি কবির সাহেবের চেয়েও অনেক দক্ষ। তারপর আজগর সাহেবের কথামত করিম সাহেবকে বের করে দিয়ে সেখানে উনার পরিচিত একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ঐদিন রাতে বাসায় উনার স্ত্রী রহিমা বেগমকে বলেন শরীরটা ভাল লাগছে না। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ার কথাটি বলেননি। তারপর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যান কিন্তু উনার ঐ ঘুম আর ভাঙেনি, ঘুমের ভিতর স্ট্রোক করে তিনি মারা যান। তখন সজীবের বয়স ৫।
○•○
সজীবের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সংসারের হাল তার মা একা ধরে আছেন। তার মা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা।
সজীবের বাবা বেচে থাকার সময় তার মাকে কোন চাকরি করতে দেননি। সজীবকে দেখাশুনা করাই ছিল তার একমাত্র চাকরি। সজীবের বাবা চাননি সজীব কখনো বাবা মা ছেড়ে একা থাকুক। সজীবের বাবা মারা যাওয়ার পর রহিমা বেগম সজীবের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করেননি। উনার বাবা মা বিয়ের চাপ দিতেন দেখে তিনি তার বাবার বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেন। লেখাপড়া জানা থাকার কারণে গ্রামের স্কুলে একটি চাকরি পেয়ে যান।
তিনি অনেক কষ্টে সজীবকে লেখাপড়া করান। সজীবও তার মায়ের কষ্ট বুঝত তাই সে কখনো অন্যায় আবদার করত না, মন দিয়ে লেখাপড়া করে যেত। পরীক্ষার আগে অনেক রাত জেগে পড়ত, যতক্ষণ পড়ত ততক্ষণ তার মা পাশে বসে থাকত। অনেক পড়ালেখা করে সে এস এস সিতে এ+ পায়। কিন্তু এইচ এস সি তে অল্পের জন্য এ+ মিস হয়।
তার মায়ের ইচ্ছা ছিল তাকে ডাক্তারি পড়ানোর কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারপর ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রসায়নের ভর্তি হয়।
ঢাকায় এসে সে তার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠে এবং ভার্সিটির হলে সীট নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। কিছুদিন পর ভার্সিটির হলে একটি সীট পেয়ে সেখানে উঠে পরে এবং ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় দুটি টিউশনিও জোগাড় করে ফেলে।
সে প্রতিদিনই তার মায়ের সাথে কথা বলে। তার মায়ের কাছে মোবাইল নেই, তাদের প্রতিবেশীর কাছে ফোন দিলে তারা তার মায়ের কাছে মোবাইল নিয়ে গেলে তারপর কথা বলতে পারে। সে তার মাকে জানায় সে দুটি টিউশনি পেয়েছে কিন্তু তার মা রাজি নয়। পরে তার যেন পড়াশুনার কোন ক্ষতি না হয় সেই মর্মে তিনি রাজি হন।
টিউশনির প্রথম মাসের টাকা পেয়েই সে তার মায়ের জন্য, একটি মোবাইল ও একটি শাড়ি কিনে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
○•○
ঘড়িতে তিনটা বাজে, সে টিউশনিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে হল থেকে বেড়িয়ে গেল। হল থেকে বেড়িয়েই সে জানতে পারল আগামীকাল হরতাল। বিরোধী দলের মিছিলে পুলিশ হামলা করার প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে প্রধান বিরোধী দল। শুনেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাহলে আজ রাতেই বাড়ি যাবে বলে ঠিক করল। সে তার মাকে ফোন করল।
-মা আমার পরীক্ষা শেষ, আজ রাতেই বাড়ি আসছি।
-কাল হরতাল, আজ আসিস না রাস্তায় যদি কিছু হয়ে যায়। হরতালের পর আয়।
-না মা, আমি আজই আসব।
-তাহলে সাবধানে আসিস বাপ আমার।
শাড়ি কিনে ফেরার পথে সে হরতাল সমর্থনকারীদের মিছিলের ভিতর ঢুকে পড়ে। হঠাৎ শুরু হয় গোলাগোলী সবাই ছুটছে। মিছিল লক্ষ্য করে কারা যেন গুলী ছুড়ছে। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা।
হঠাৎ একটি গুলি এসে তার হৃদপিণ্ড ভেদ করে বেড়িয়ে যায়। তার মুখ থেকে শুধু একটি ধ্বনী শুনা যায় “মা”। মা বলার সাথে সাথে সে পরে যায় রাস্তায়। লাল রক্তে রঙিন হয়ে উঠে কালো রাজপথ। তার রক্তে ভিজে যায় মায়ের জন্য কেনা শাড়ি। শাড়ির বাহারি রঙের আলপনার মাঝে নতুন একটি রঙ যুক্ত হয়ে আলপনাটিকে আরো ফুটিয়ে তুলে।
সজীব তার কথা রাখে, ঐ দিন রাতেই সে তার মায়ের কাছে যায় তবে লাশ হয়ে। সে তার মাকে উপহার দেয় তার বুকের রক্তে ভেজা শাড়ি। এ দেশের ঘৃণ্য রাজনৈতিক সংঘর্ষ তাকে তার মায়ের কাছে জীবিত ফিরতে দেয়নি।
পরদিন পত্রিকায় প্রথম পাতা প্রকাশিত হয় দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র নিহত।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়, তারপর শুরু হয় সজীবের লাশ নিয়ে দুটি দলের মাঝে সৃষ্টি হওয়া ঘৃণ্য দলীয়করণ রাজনীতির গল্প, শুরু হয় সন্তান হারা এক মায়ের গল্প, শুরু হয় একটি স্বপ্নের মৃত্যুর গল্প।
○•○
সজীব ঢাকা ভার্সিটির রসায়নের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হলে থাকে, তার মা রহিমা বেগম গ্রামে থাকেন।
সজীবের বাবা কবির সাহেব একটু প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী করতেন। তিনি ছিলেন অনেক পরিশ্রমী ও সৎ। আজগর সাহেব উনার নতুন বস। আগের বস চলে যাওয়ার পর আজগর সাহেবকে উনার ডিপার্টমেন্টে নতুন একজন বস নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি আসার পর থেকেই সব ব্যপারে কবির সাহেবের ভুল ধরতে থাকেন। কোম্পানীর এম ডি র কাছে উনার ব্যপারে আজে বাজে কথা বলতে থাকেন। এম ডি কে বলেন কবির সাহেবকে বের করে দিয়ে উনার পরিচিত একজনকে তার জায়গায় বসাতে। যিনি নাকি কবির সাহেবের চেয়েও অনেক দক্ষ। তারপর আজগর সাহেবের কথামত করিম সাহেবকে বের করে দিয়ে সেখানে উনার পরিচিত একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ঐদিন রাতে বাসায় উনার স্ত্রী রহিমা বেগমকে বলেন শরীরটা ভাল লাগছে না। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ার কথাটি বলেননি। তারপর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যান কিন্তু উনার ঐ ঘুম আর ভাঙেনি, ঘুমের ভিতর স্ট্রোক করে তিনি মারা যান। তখন সজীবের বয়স ৫।
○•○
সজীবের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সংসারের হাল তার মা একা ধরে আছেন। তার মা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা।
সজীবের বাবা বেচে থাকার সময় তার মাকে কোন চাকরি করতে দেননি। সজীবকে দেখাশুনা করাই ছিল তার একমাত্র চাকরি। সজীবের বাবা চাননি সজীব কখনো বাবা মা ছেড়ে একা থাকুক। সজীবের বাবা মারা যাওয়ার পর রহিমা বেগম সজীবের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করেননি। উনার বাবা মা বিয়ের চাপ দিতেন দেখে তিনি তার বাবার বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেন। লেখাপড়া জানা থাকার কারণে গ্রামের স্কুলে একটি চাকরি পেয়ে যান।
তিনি অনেক কষ্টে সজীবকে লেখাপড়া করান। সজীবও তার মায়ের কষ্ট বুঝত তাই সে কখনো অন্যায় আবদার করত না, মন দিয়ে লেখাপড়া করে যেত। পরীক্ষার আগে অনেক রাত জেগে পড়ত, যতক্ষণ পড়ত ততক্ষণ তার মা পাশে বসে থাকত। অনেক পড়ালেখা করে সে এস এস সিতে এ+ পায়। কিন্তু এইচ এস সি তে অল্পের জন্য এ+ মিস হয়।
তার মায়ের ইচ্ছা ছিল তাকে ডাক্তারি পড়ানোর কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারপর ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রসায়নের ভর্তি হয়।
ঢাকায় এসে সে তার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠে এবং ভার্সিটির হলে সীট নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। কিছুদিন পর ভার্সিটির হলে একটি সীট পেয়ে সেখানে উঠে পরে এবং ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় দুটি টিউশনিও জোগাড় করে ফেলে।
সে প্রতিদিনই তার মায়ের সাথে কথা বলে। তার মায়ের কাছে মোবাইল নেই, তাদের প্রতিবেশীর কাছে ফোন দিলে তারা তার মায়ের কাছে মোবাইল নিয়ে গেলে তারপর কথা বলতে পারে। সে তার মাকে জানায় সে দুটি টিউশনি পেয়েছে কিন্তু তার মা রাজি নয়। পরে তার যেন পড়াশুনার কোন ক্ষতি না হয় সেই মর্মে তিনি রাজি হন।
টিউশনির প্রথম মাসের টাকা পেয়েই সে তার মায়ের জন্য, একটি মোবাইল ও একটি শাড়ি কিনে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
○•○
ঘড়িতে তিনটা বাজে, সে টিউশনিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে হল থেকে বেড়িয়ে গেল। হল থেকে বেড়িয়েই সে জানতে পারল আগামীকাল হরতাল। বিরোধী দলের মিছিলে পুলিশ হামলা করার প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে প্রধান বিরোধী দল। শুনেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাহলে আজ রাতেই বাড়ি যাবে বলে ঠিক করল। সে তার মাকে ফোন করল।
-মা আমার পরীক্ষা শেষ, আজ রাতেই বাড়ি আসছি।
-কাল হরতাল, আজ আসিস না রাস্তায় যদি কিছু হয়ে যায়। হরতালের পর আয়।
-না মা, আমি আজই আসব।
-তাহলে সাবধানে আসিস বাপ আমার।
শাড়ি কিনে ফেরার পথে সে হরতাল সমর্থনকারীদের মিছিলের ভিতর ঢুকে পড়ে। হঠাৎ শুরু হয় গোলাগোলী সবাই ছুটছে। মিছিল লক্ষ্য করে কারা যেন গুলী ছুড়ছে। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা।
হঠাৎ একটি গুলি এসে তার হৃদপিণ্ড ভেদ করে বেড়িয়ে যায়। তার মুখ থেকে শুধু একটি ধ্বনী শুনা যায় “মা”। মা বলার সাথে সাথে সে পরে যায় রাস্তায়। লাল রক্তে রঙিন হয়ে উঠে কালো রাজপথ। তার রক্তে ভিজে যায় মায়ের জন্য কেনা শাড়ি। শাড়ির বাহারি রঙের আলপনার মাঝে নতুন একটি রঙ যুক্ত হয়ে আলপনাটিকে আরো ফুটিয়ে তুলে।
সজীব তার কথা রাখে, ঐ দিন রাতেই সে তার মায়ের কাছে যায় তবে লাশ হয়ে। সে তার মাকে উপহার দেয় তার বুকের রক্তে ভেজা শাড়ি। এ দেশের ঘৃণ্য রাজনৈতিক সংঘর্ষ তাকে তার মায়ের কাছে জীবিত ফিরতে দেয়নি।
পরদিন পত্রিকায় প্রথম পাতা প্রকাশিত হয় দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র নিহত।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়, তারপর শুরু হয় সজীবের লাশ নিয়ে দুটি দলের মাঝে সৃষ্টি হওয়া ঘৃণ্য দলীয়করণ রাজনীতির গল্প, শুরু হয় সন্তান হারা এক মায়ের গল্প, শুরু হয় একটি স্বপ্নের মৃত্যুর গল্প।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন