[url=http://www.gulfup.com/?AomQ4i][img]http://www.gulfup.com/G.png[/img][/url]

রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১২

পরকীয়া


পরকীয়া

রাত দুইটা বাজে। এবার উঠতে হবে। ব্রীজ খেলা অনেক হয়েছে। আর ভাল লাগছে না। যদিও তাসের এই পর্ব সারারাতই চলবে। মামুন বিদায় চাইল। বন্ধুরা নাছড় বান্দা। কেউ ছাড়তে চাই না। চাদঁ রাত বলে কথা। সারারাত ক্লাবে হই হুল্লর। আজ আবার একটা ছাগল চুরি করা হয়েছে। রান্না ভাল হয়নি। কেমন একটা বমি বমি লাগছে। মামুন ঢাকায় থাকে। ঈদের সময় শুধু বাড়ি আসা। চাদঁ রাতে পাড়ার এই ক্লাবটির চেহেরায় বদলে যায়। প্রায় সব বন্ধু ই জড়ো হয়। এবার শুধু নয়ন নেই। ডিভি পেয়ে আমেরিকা চলে গেছে। নয়নের উদ্দেশ্যে শোকগাথাঁ লেখা হয়েছে। কাশেম লিখেছে। কবি হিসাবে এই মফস্সলে তার আবার খানিক নাম ডাক আছে। ভোর চারটায় আরেকবার গলা ভেজানোর ব্যবস্থাও আছে। মামুনের মন ক’দিন ধরে এমনিতেই খারাপ। বিয়ের পর রুমা’কে ছাড়া প্রথম ঈদ করছে। মামুন শত প্রলোভন উপেক্ষা করে বেড়িয়ে পড়ল। শরিরটা আসলেই খারাপ করেছে। মাথার ভিতর একটা ভোতাঁ যন্ত্রনা। ক্লাব থেকে বেরিয়ে বাড়ির সর্টকার্ট পথ ধরল। ধানক্ষেতের আল দিয়ে। রাত ভালই হয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলে চার্জ নেই। অনভস্ত্যতায় পথ চলতে একটু কষ্টই হচ্ছে। হঠ্যাৎ করে বমি চলে এসেছে। আর আটকাতে পারল না। ধান ক্ষেতের পাশেই বসে পড়ল। মনে হচ্ছে আর দাড়াতে পারবে না। আশেপাশে কাউকে খোজাঁর চেষ্টা করল। কেউ কি আছে। অন্ধকারে ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এখনো অনেক পথ। একটু পানি পেলে ভাল লাগত। কুলি করা দরকার। ঠিক এসময় নিমাই দা এসে উপস্থিত

: কিরে, মামুন না। কি হয়েছে তোর?
: নিমাই দা। খুব খারাপ লাগছে।
: দাড়া। আমাকে ধরে দাড়া।
: মনে হয় পারব না। একটু পানি খাওয়াতে পারবে।
: পানি নেই। ধর স্প্রাইট খা।
: দেও।
মামুন স্প্রাইট দিয়েই কুলকুচি করল। আরেকবার বমি হয়ে গেল।
: নিমাই দা, আমাকে একটু বাসায় দিয়ে আসবা।
: শোন আমার বাসাতো কাছেই। তুই চল। আগে কিছুক্ষন রেস্ট নিবি।



মামুন বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল। নিমাই দা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের অংকের মাষ্টার। মামুনদের দু-ব্যাচ সিনিয়ার। অসম্ভব ভাল। কিছু মানুষ থাকে উপকার করার জন্য জন্মায় সেই টাইপের। মামুন নিমাই এর হাত ধরে উঠে দাড়াল। দু-জনেই নিরবে এগিয়ে চলছে। গুনগুন করে নিমাই দা কি যেন একটা গাইছে। মামুনের তখন শোনার মত অবস্থা নেই। হঠ্যাৎ নিমাই দা মামুনের হাত শক্ত করে ধরল।
: কি হয়েছে?
: সামনে দেখ।
সামনে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কাফনের কাপড় পড়ে পাচঁটা লাশ পড়ে আছে ধান ক্ষেতের উপর। হালকা নড়ছেও। ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল কেন জানি।
: চল
: কি ওগুলো
: চল না। যেয়ে দেখি।
: যাবা
: দুর গাধা। তুইতো ভয়েই আধমরা হয়ে গেলি।
: আমিতো এমনিতেই আধঁমরা। কিছু দেখলে কিন্তু ফুল মরা হয়ে যাব।
: বকবক করিস না। চল
কিছু দুর যেয়েই ঘটনা পরিস্কার হল। ধান ক্ষেতের উপর কে যেন কাপড় শুকাতে দিয়েছে। সাদা কাপড়। সেগুলোই দূর থেকে লাশের মত লাগছে। দু-দজনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি। নিমাই দা’র গানটা এবার বোঝা যাচ্ছে। নজরুল সংগীত।

শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যদি….

ভুলিও স্মৃতি মম নিশীথ স্বপন সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যদি….



মামুন শুয়ে আছে নিমাই দা’র বাড়িতে। বাসা পর্যন্ত যেতে পারে নি। নিমাই দা’র বাড়ির সামনে আরেকবার বমি। কিছুতেই নিমাই দা ছাড়ল না। একটা এভোমিন পাওয়া গেছে। বৌদিও খুব ভাল। সাক্ষাত প্রতিমা’র মত চেহারা। মামুনের বিছানা গুছিয়ে দিল। বেশি কথা না বাড়িয়ে মামুন চুপচাপ শুয়ে পড়ল। ছোট্ট একটা বাড়ী নিমাই দা দের। তিন রুমের। উপরে টিন। এ বাড়ীতে অনেক সময় কেটেছে মামুনের একটা সময়। বাসায় বোধহয় আর কেউ নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিমাই দা’র একটা ছোট বোন ছিল। রাজশ্রী। মামুন অংক দেখিয়ে দিত সময় সময়। মামুনের সাথে একটা অনৈতিক সম্পর্কও কিভাবে যেন গড়ে উঠেছিল যৌবনের প্রথম বছরে। রাজশ্রীর বয়স তখন কত? 16 বোধহয়। নিমাই দা’র বাসায় আসা যাওয়ার সুবাদে কিভাবে কিভাবে যেন কাছাকাছি চলে এসেছিল। অবশ্য বেশি দূর আর এগোয়নি। শারিরিক তৃপ্তি বলতে যা বোঝায় সেই পর্যন্ত নয়। মামুন ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ে চলে এল। যান্ত্রিক নগড়ে হল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। খুব একটা গ্রামের দিকে যাওয়া পড়ত না। ঈদ পরব বাদে। একবার গিয়ে শোনে বিয়ে হয়ে গেছে। সে অবশ্য অনেক দিন হল। শুনেছে এখন তিন ছেলে মেয়ের মা।

মামুন রাজশ্রীর চেহারাটা মনে করা চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। আর দু-চোখ খোলা রাখা যাচ্ছে না। কখন ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। হঠ্যাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। অদ্ভুত একটা শব্দে। মনে হচ্ছে এ ঘরে কোন মহিলা নামাজ পড়ছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে নামাজ পড়ার সময় যেমন আওয়াজ হয় সেরকম আওয়াজ। মামুন চোখ বন্ধ করে ফেলল। মনে মনে বলার চেষ্টা করল সে ভুল শুনেছে। গাছের শব্দ হতে পারে। কিছুক্ষন পর আর আওয়াজ পাওয়া গেল না। চোখ খুলে আরেক বিষ্ময়। নিমাই দা দের ঘরে টাঙিয়ে রাখা কৃষ্ঞ এর ছবিটা যেন মামুনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মামুন চোখ বন্ধ করে ব্যাখ্যা দ্বার করাবার চেষ্টা করল। দূরের কোন আলো জানলা দিয়ে ছবির উপর পড়ে এমন হতে পারে। ঠিক তাই। নিজের আহাম্মকিতে নিজেই হাসার পালা। ঘুমানো’র চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। একটা’র পর ভুতের গল্প মনে পড়ছে। মামুন রুমা’র কথা মনে করার চেষ্টা করল। ডামাডোলে বেশ কিছু দিন ভুলে ছিল। আজকের এই নির্জনতা কেন জানি উসকে দিল স্মৃতি।

অনেকক্ষন ধরে রোদে দাঁড়িয়ে আছে। ঘামে একাকার। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লাইন ছেড়ে যাওয়া যাবে না। বিডিআর দের একদল রিলিফ দিচ্ছে লা্ইন এদিক ওদিক হলেই লাঠির বাড়ি। মামুন রিলিফ নেওয়ার জন্য লাইনে দাড়ায়নি। পুরো ব্যবস্থাটা সরেজমিনে প্রতক্ষ করছে নিছক কৌতুহলে। অসহায় মানুষদের কষ্ট উপলদ্ধির ব্যর্থ চেষ্টা। ভদ্রলোকের মুখোস পড়ে আতলামী আর কি? মামুনের সঙ্গে কামাল ভাই। একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন ক’দিন ধরে। একটা পত্রিকায় কাজ করেন। তার সঙ্গেই আসা। পরীক্ষা দিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এ সময় দেশ জুড়ে ঝড়ের ভয়াল থাবা। ঘূর্ণিঝড়ে বিধস্ত এলাকা পরির্দশনের কৌতুহল আর কামাল ভাই যাচ্ছে তার সঙ্গি হওয়াতে কৈশর থেকেই রোমান্চ অনুভব করা। কিন্তু রোদের দাপটে আর টিকতে পারল না। সরে আসতে হল। ভরপেট খেয়েও দাড়াতে পারল না আর না খাওয়া লোকগুলো কিভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে আছে ভাবতেই অবাক হতে হয়।গত কয়েকদিন দেখেছে মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম। বেচেঁ থাকা কত কষ্টকর তবু কি আশায় যেন বেঁচে থাকে মানুষ। স্বপ্ন প্রতারিত তবু স্বপ্ন দেখে বারবার। পথের এক কোণে একটি চায়ের দোকান দিয়ে বসেছে এক বুড়ো চাচা। কাষ্টমার নেই বললেই চলে। জনাকয়েক সাংবাদিক আর রিলিফ দিতে আসা মামুনে’র বয়সী কিছু ছেলে মেয়ে আছে। চা খাব। পিরিচে না ঢেলে চা খেতে পারে না সে। একটা মেয়ে খুব কৌতুহল নিয়ে মামুনের ফু দিয়ে চা খাওয়া দেখছে। মামুন তাকে কিছুটা অবাক করে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করল
: ভালো আছেন?
অবাক হয়ে মামুনের দিকে তাকিয়ে সীমাহিন চেষ্টা স্মরন করার। মামুনই আবার কথা বলে উঠল -
: আপনি ঢাকা থেকে আসছেন।
: জি। কিন্তু আপনাকে তো…
: চিনতে পারলেন না। তাই তো। আমিও পারিনি।
চা এর বিল মিটিয়ে সোজা হাটা ধরে মামুন। পিছনের দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে। জানে অবাক বিস্ময়ের এক জোড়া চোখ নিরীক্ষন করছে। সেই প্রথম রুমা’র সাথে দেখা।



মেঘের দিকে তাকিয়ে ছবি কল্পনা করা মামুনের ছোট বেলার অভ্যাস। পাবলিক লাইব্রেরীর চত্তরে বসে সেই চেষ্টায় করছিল। এমন সময় প্রশ্ন -

: কেমন আছেন।
অবাক হবার পালা। সেই মেয়েটি। যেন মামুনকে জব্দ করার জন্যই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।
: আপনি ঢাকাতেই থাকেন।
আগের সেই কথোপকথনের প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা বোধহয়।
: আপনি
: কি চিনতে পারেন নি। আমি কিন্তু ঠিকই চিনেছি।
: আমিও চিনেছি। কিন্তু একটু অবাক হয়েছি আপনাকে দেখে।
: আপনি তো অবাক করে দিতে ভালবাসেন। তা নিজে অবাক হয়ে কেমন লাগছে।

মামুন হাসল। সে হাসিই যেন মামুন আর রুমা’র সম্পর্কটাকে আরও অনেক দূর নিয়ে চলল। পরিচয় থেকে আস্তে আস্তে ভাব ভালবাসায় গড়াল ব্যাপারটা। মনের রঙিন ঘুরি উড়িয়ে দিল এই যান্ত্রিক নগড়ে। সব কোলাহোল ছাড়িয়ে নির্জন নিরিবিলিতে প্রেম করতে করতে একদিন রুমা’র সাথে বিয়ে হয়ে গেল।আসলে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে এমন কিছুই ছিল না দুজনের ভিতর।সে পারিবারিক হোক আর সামাজীক। তাই খুব সহজেই ওরা একে অপরের কাছে আসতে পেরেছিল। বাসর রাতে হৈমন্তীতে পড়া সেই কথাটা নাড়া দিয়ে গেল – “পাইলাম”।


রুমা আর মামুনের সম্পর্কটা বন্ধুর মত। একে বারে তুই সর্ম্পক। ভালোবাসার কমতি পরিলক্ষিত হয়নি কখনো কোথাও। ঢাকা শহরে একটা ছোট্ট নিজস্ব ফ্লাটে থা্কে। সব মিলিয়ে 850 বর্গফুট। একটা কাজের মেয়ে দেশের বাড়ী থেকেই এসেছে। ভালই চলছিল। খুনসুটি ঝগড়া ঝাটি যে একেবারে হত না তা না। তবে সাময়িক। সকাল ৭টার মধ্যে মামুনকে বেড়িয়ে পড়তে হয়। সারাদিন অফিসে থাকে। ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টা। রুমা’র একাক্বিত্ব ঘোচানের চেষ্টার কমতি নেই মামুনে’র। টি.ভি তো আছেই সাথে একটা নেট এর লাইন সহ পি.সি। কিন্তু এই নেট লাইন ই একদিন দুই জনের নিবিড় সর্ম্পকে হঠ্যাৎ কেন যে ফাটল ধরাল তা বুঝে উঠতে পারল না। আসলে দোষটা কার কোথায় কতটুকু সে প্রশ্নে কোনদিনই একমত হতে পারেনি। প্রথম প্রথম নেট এ রুমা কি করে না করে খুব আগ্রহ ভরে মামুনকে দেখাতো। কিন্তু তারপর কোথায় যেন একটা গোপনীয়তা। লুকোচুরি খেলা। কিছু বিশেষ লোকের সাথে আলাপ চারিতায় বারবার মানা করা সত্বেও মামুন আবিষ্কার করে কি নেশায় আড্ডায় বুদ হয়ে থাকে সে। ভয়ঙ্কার কিছু হলেও হতে পারে মামুন পশ্রয় দিতে পারে না।নিজের মনটা’র ভিতর অশুভ চিন্তা বয়ে যায়। নারীর অধিকারের প্রশ্নে বড় বড় বুলি আউরানো এই মামুনই নিজেকে আবিষ্কার করে পৃথিবীর রঙ্গমন্চে অভিনেতা হিসাবে। এক কথা দু কথায় তর্ক। সেখান থেকে কাচেঁর জিনিষ ভাঙা হয়। টি.ভি’র রিমোট বাদ পড়ে না। তবু থামতে চাই না। বহু ব্যবহার করা তর্কের মূর্হতে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরে ঠোটের আলতো স্পর্শ মেখে দিয়া ঠোটের ওষুধটাও ইদানিং আর কাজ করে না। ঝগড়া চলতেই থাকে ভোর রাত অবধি -

: এটা কি হলো?
: ভালোবাসা।
: এ সব ন্যাকামী আমার সাথে আর করবা না।
: আচ্ছা করব না একটু হাস।
: ধ্যাৎ, ছাড় না, ছাই?
: ছাড়ব না।কি করবে?
: উফ। অসহ্য।
রুমা রেগে উঠে চলে যায়। অনেকক্ষন কোন খোজঁ নেই। মামুন পিছু পিছু যেয়ে দেখি সেই নেট। মেজাজ আরও তিরিক্ষি হয়। ভদ্রলোকের ঘরে অনুচ্চারিত কথামালা উচ্চারিত হয়। একদিন সব ভাব ভালবাসাকে অপমান করে গায়ে হাত তুলে ফেলে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রুমা। দুচোখ বেয়ে নেমে আসতে থাকে জল। লজ্জায় সে জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে সামনে থেকে দ্রুত উঠে গিয়ে বেডরুমে ভিতর থেকে দরজায় সিটকিনি দেই। কিংকতর্ব্যবিমুঢ় হয়ে বসে থাকে মামুন।


পরদিন অফিস থেকে ফিরে রুমা’কে আর বাসায় দেখতে পাই না। ফুলির হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে গেছে -
: “চললাম। আমার একাকিত্বকে ঘোচাতে না পেরে সহজাত পুরুষালী স্বভাব দেখিয়েছ। তোমার কাছ থেকে আমার আশা অনেক বেশী ছিল। আর দশ জনের সাথে তোমার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিলে।ভাল থেকো।”
এভাবে মান ভাঙানোর খেলা চলে। কিছু পরোপরকারী আত্বীয় স্বজনের মধ্যস্ততায় আবার শুরু হয় পথ চলা। কিন্তু সময়ের বাকেঁ বাকেঁ ঘটনার পুনঃপুনার্বৃত্তি ঘটতে থাকে। রুমা বাপের বাড়ী যায়। আবার আসে। মামুনের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়। দুজনের ভিতরে গভীর হতাশার কালো মেঘ। ভালাবাসায় বিশ্বাসের অভাব। যেন অপরিচিত দুই যুবক যুবতী এক ঘরে রাত্রি যাপন করছে। কারও কারও পরামর্শে সন্তান নেবার আকাংখা তৈরী হয়। অনেক দূর এগোয়। কিন্তু ভ্রুন বেড়ে ওঠে না। ডাক্তার ঘরে নিত্য যাতায়ত। কোন সুরাহা হয় না। উচ্চ রক্তচাপ। একটু ধর্য্য ধারনের আহবান। মামুন অসন্তুষ্ট। বাব হতে পারবে কিনা সংশয় হয়। রুমা’র মেজাজ অকারনেই খিটখিটে থাকে। মামুনের সাথে নিত্য ঝগড়া সামান্য কারনে। মামুনের হাতে বড় প্রমোশনের হাতছানি। আরও বেশী তটস্থ ক্যারিয়ার গড়তে। প্রায় রাত হতে থাকে ফিরতে। অনেক সময় ইচ্ছাকৃত ভাবেও রাত করে। বাসায় ফিরে ঝগড়ার এক ঘেয়েমী ভাল লাগে না। বরং অফিস কলিগ মিতার সান্নিধ্য সুখকর মনে হয়। কথার পিঠে কথা বলতে ভালই লাগে। মিতা সারাক্ষন মুখ গম্ভীর করে থাকে। কিন্তু থেকে থেকে এমন এমন কথা বলে ওঠে মামুন হেসে গড়াগড়ি। এরকম কত অর্নথক কথাতেই না রুমার সাথে রাতের পর রাত পার হত। আজকাল কথা বলার বিষয়ই খুজেঁ পাওয়া যায় না।
: তোমার প্রমোশনের খবর কি?
: আর প্রমোশন! যেভাবে লোক ছাটাই হচ্ছে চাকরীটা না চলে যায়।
: কেন সে রকম সম্ভাবনা দেখছ নাকি।
: না। এমনি বললাম। তবে অনেক ছাটাই হয়েছে।

রুমা’র শরীরে কথার সাথে সাথে মামুনের হাত খেলা করে। অবাধ্য জন্তুর মত বশ মানতে চাই না আঙ্গুল।
: আহ! বাদ দাও না।
: কেন?
: ভাল লাগছে না। বরং চল বারান্দায় বসি। আজ পূর্ণিমা।
: পূর্ণিমা দেখতে ইচ্ছা করছে না। বরং তোমাকে দেখি।
: ও মাই গড। আমি তো ভুলেই গেছি। আজ মধ্য রাতের পর দেখা যাবে উল্কাবৃষ্টি। এই চলত ওঠ ছাদে যাব।
: এখন উল্কা বৃষ্টি দেখতে যাবে।
: হু
: তুমি যাও। আমার ভাল লাগছে না। ঘুমাবো।

রুমা চলে যায়। মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে মামুন ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর রাতে ঘুম ভাঙে। পাশে রুমা নেই। আবিষ্কার করে নেট এ থাকতে থাকতে কম্পিউটার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকতে গিয়ে কম্পিউটার স্ক্রীনের চ্যাট রুমটার দিকে চোখ যায়। অচেনা মনে হয় রুমাকে। রীতিমত ধাক্কা খেতে হল। রুমা আরেকটি ছেলের সাথে ভালমত জড়িয়ে পড়েছে। ছেলেটির নাম আরজু। সুইডেনে থাকে। কথোপকথনে মামুনের কথাও আছে। আছে সীমাহীন অসুখি হবার কথা। শরীর কেন্দ্রীক অশ্লিল নোংরা বার্তারও চালাচালিও।

8
রুমার সাথে ভয়ঙ্কর রকমের ঝগড়া হয়েছে। মারামারির পর্যায়টা বস্তিকেও হার মানাবে। প্রায় মাস তিন হতে চলল রুমা আর কোন যোগাযোগ রাখে নি। বাপের বাড়ীতেই আছে।মামুনেরও ইচ্ছা হয় নি। একটা মাস একা একায় কাটিয়েছে। কখনো বাসায় কখনো বা বোনের ওখানে। তৃতীয়, চতুর্থ পক্ষের মধ্যস্থতায়ও ঘটনার দফারফা হয় নি। এর মধ্যে মিতা এক ছুটির দিনে বাসায় এসে উপস্থিত। মামুনের ঘর দোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে। এভাবে আরও কয়েকবার বিভিন্ন কারনে। একাকী ঘরে পুরুষ, নারী কখনো নিরাপদ নয়। মহাপুরুষদের প্রসংগ অবশ্য আলাদা। হেরেমে চুরাশি হাজার যুবতী নারীর প্রলোভন উপেক্ষা করে স্বির্দাথ বুদ্ধ হতে পারে। মামুন পারে না। নতুন এক খেলার হাতছানি। যে খেলা রাজশ্রীর সাথে হতো খেলার ছলে অনিশ্চয়তায় বয়সের হাতছানিতে তা এখন পরিনিত মধ্য বয়সে নিশ্চিত কুফল জেনেও। রুমা’ও বেশ আছে। আরজু দেশে ফিরেছে। দেখা সাক্ষাত বেশ হচ্ছে আজকাল। কখনো সিনেপ্লেস কখনো বা আর্ট গ্যালারী।


রুমা মামুনকে ভালবাসত। কিন্তু যে শুদ্ধ আবেগ এর পুজারী ছিল রুমা তার ঘাটতি ছিল মামুনের মধ্যে। বিষয়টা বুঝতে অনেক সময় পার হয়েছে। মামুন গড় পড়তা পুরোনো ছা পোষা মানুষের আধুনিক প্রতিচ্ছবি। প্রেম বলতে শরিরকে বোঝে কিন্তু শরীরে ভাষা পড়তে জানে না। জগতের অসম্ভব অসম্ভব সৌন্দর্যের প্রতি তার কোন ভ্রু-ক্ষেপ নেই। উৎকন্ঠা নেই। কে বলবে এই মানুষটা এক সময় মেঘের ছবি আকঁত। মেঘের সাথে খেলা করত। জীবনের ব্যস্ততায় কবিত্ববোধ এভাবে ধুলায় মিটিয়ে ফেলবে। আগুনের স্পর্শে কেউ হয় খাটি কেউবা কয়লা। ভিতরের মানুষটির আসল পরীক্ষা হয় সময়ের যাতাঁকলে। কিন্তু রুমা তো এভাবে চাই নি। তার স্বপ্ন ছিল, আকাঙ্খা ছিল সেখানে ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। আরজু’র জীবন বোধ আর মামুনের সম্পূর্ণ বিপরীত। মেকী স্বপ্নের ভেলায় আরজু ভাসে না। অনন্তত এতদিনের পরিচয়ে, কিম্বা জীবনের পথ চলায় এতটুকু বুঝতে পেরেছে রুমা। মামুনের সাথে পরিচয়ের আগে কেন আরজু’র সাথে পরিচয় হল না। তার মনের মানুষটি তো সেই। যাকে খুজেঁ ফিরেছে অনর্থক মামুনের প্রতিচ্ছবিতে। এখন একটা কাগজের বাধনে জীবনের বাকী অর্ধেক মাটি করার মানে হয় না। উপভোগে কোন ছাড় নেই। জাগতিক ভাবনায় পেচিয়ে রাখতে আর ভাল লাগে না। তার চেয়ে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনায় উচিত। ভাল হয় মামুনই ডিশিষনটা নিলে।
রুমাকে ওভাবে রেখেই এবার ঈদ করতে এসেছে মামুন। একা। মিতার ব্যাপারেও আগ্রহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রুমা, মিতা কারও ব্যাপারেই কোন স্থির স্বিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। জীবনটা বয়ে বেড়ানোই কেন জানি অসহ্য মনে হচ্ছে। কোন কিছুতেই মন বসে না। একটু পুরনো আড্ডায় এবারের ঈদ করে চাঙ্গা হতে চেয়েছিল। চেষ্টা করলেই কি সব পিছনে ফেলে আসা যায়? পরিমল দা’র ঘর থেকে আযানের ধ্বনি শোনা যায়। ভোর হয়ে আসছে। আরও একটি রাত নির্ঘুম কাটল। আসছে ভবিষ্যতের অনেক প্রশ্নের মিমাংসার দাবী তবু মিটল না।

কোন মন্তব্য নেই: