গল্পঃ * * অ পূ র্ন * * শেষ পর্ব
প্রথম ও ২য় পর্বের পর........................
০৬.
অপূর্ন তো কলকাতা চলে গেলো সে জানতে পারলো না সুমিতের কি হলো কিন্তু যখন দেশে ফিরলো সুমিতের চিন্তাটা মাথায় আবার জাগলো..
অপূর্ন বাসায় ফিরে কদ্দিন ঘরে বসে তন্ময় হয়ে অজানা চিন্তার আকাশে ভেবে ভেবে কাটালো।
কি করবে, মাঝখানে কেটে গেছে দেড়টি বছর।
অপূর্ন বাড়ি ফিরে অন্তত এ টুকু বুঝেছে, সুমিতের ব্যাপারে পরিবারের সবার আগ্রহ আর নেই। তাই কদ্দিন চুপ থেকেছে নিজের মনের ব্যাপারটা যেন প্রকাশ পায়। কিন্তু এভাবে তো থাকা যাবে না এটা ভাবতেই অপূর্ন ’র শরীরটা অসার হয়ে যায়।
পুরোনো বন্ধুরা একে একে বাসায় আসতে লাগলো, তাই পুরোনো স্মৃাতিতে ফিরে যেতে অপূর্ন ’র খুব একটা সময় লাগলো না। তবে মাথাটা যে আর আগের মতো কাজ করে না সেটা বুঝে গেছে’সে। আর মাথাটা মনে রাখার খাতায় খুব কম কাজ করে আজকাল।
এই যেমন সকালে ভাবলো, দুপুরে একটু বাইরে বেড়িয়ে আসবে কিন্তু বিকেলে নিজেকে আধভাঙ্গা ঘুমে আবিস্কার করলো।
তবে স্মৃতি যতই দূর্বল হোক সুমিতের কথা কিন্তু মাথা থেকে গেলো না বরং আস্তে আস্তে ফিরে আসতে লাগলো।
এক বিকেলে সব ঝেড়ে ফেলে অপূর্ন বেড়িয়ে পড়লে।
মাধবীলতা বিল্ডিংটার পাশেই ইতি’রা নতুন বাসা নিয়েছে সেটার উদ্দেশ্যে। পথে যেতে সেই বুক হাউসটার বারান্দার দিকে তাকালো; কিন্তু নেই সেই তেলেভাজাওলা। সেই জায়গাতে দাড়াতেই মনে পড়লো সুমিতের সেই সংলাপ; টাকাটা দিতে হবে না।
অপূর্ন ’র সেই এক কথা টাকা আপনাকে দেবই।
কিন্তু না; পারেনি অপূর্ন টাকাটা দিতে হয়তো পারবেও না।
অপূর্ন সোজা চলে এলো ইতিদের বাসায় কিন্তু গেট খুলেই হতাশ হলো ইতি বাসায় নেই। ওর মা এসে ঘরে নিয়ে বসালেন অপূর্ন ঠিক বুঝতে পেরে গেছে এখন কিছু গা গুলানি কথা বলবে। যে সকল কথা রাস্তায় বেরুলেই আজকাল শুনতে হয়; যারা ওকে চিনতো ওরা তো মুখিয়ে থাকে খুব বিরক্তিকর।
ইতি’র মা বলে উঠলেন তোমার লাবন্যমাখা মুখটার এ,কি হাল ও মনে মনে বলে উঠলো ঝড়ের পরে যা হয় আর,কি। ইতি চলে এলো রিকসা নিয়ে সোজা রেল কলোনি এখানেও সেই এক বিপত্তি সবাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পরিস্থিতি বলে দেয় সুমিতের জীবনটা নষ্ট করে; পোড়ামুখি তোর স্বাদ মিটেনি, আর কার জীবন নষ্ট করতে এসেছিস।
অপূর্ন সোজা সুমিতদের ঘর অভিমুখে গিয়ে থামলো কিন্তু তালা ঝুলছে।
সুমিত কে, এক ঘরে করে দিয়েছিলো সমাজ; কিন্তু ওর বাবা, মা গেল কোথায়? লাল দালানের পাশে একটা মুদি দোকানে এসে অপূর্ন শুধালো আচ্ছা দাদা সুমিতদের ঘরের সবাই কোথায় গেছে বলতে পারেন? দোকানদার বললো তারা তো প্রায় মাস ছয়েক হলো বাসা বদল করে ওপাড়া চলে গেছে। ও সুমিতের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেল কথা আর বেরুল না মুখ থেকে।
০৭.
বিকেল মরে আসছে।
অপূর্ন ঘরে ফিরে এসেছে ওপাড়া যাওয়া যাবে না বাবা ওখানেই থাকে সন্ধ্যের পর। কলেজ গেটের পাশেই একটা জটলা দেখতে পেল কিন্তুঅপূর্ন সেদিকে গেল না আজকাল আগ্রহ জিনিসটা কাজ করে খুব কম। সেই জটলা থেকে শ্যামলা মতো একটা ছেলে এসে বললো আরে, অপূর্ন যে।
অপূর্ন একটু অবাক হয়েছিলো কিন্তু পড়ে একটা ইচ্ছা উড়াউড়ি করলো অপূর্ন ’র চারপাশ কেননা সেই ছেলেটি সুমিতের একমাত্র বন্ধু রবি।
ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করার পর বললো রবি ভাই সুমিত কোথায় আছে বলতে পারেন?
একটা নিরবতা। এক মিনিট পার হয়ে গেল রবি চুপ। ও আবার বললো কি হলে রবিভাই ? অপূর্ন ভাবলো
সুমিত কি তাহলে মরে গেছে ? না,কি সুমিত কে কেউ মেরে ফেলেছে? নাহ্ সুমিত তো জেলখানায় ছিলো; এমন তো হতে পারে না।
রবি বললো সুমিত কে দেখবে চল।
পায়ে পায়ে অপূর্ন রবি’র পিছু হাটছে বুক হাউসটার ঠিক পাশে এসে থামলো রবি ওকে বাইরে রেখে ভেতরে ঢুকলো; কিছুক্ষণ পড় এসে বললো নেই; কাল দেখা হবে।
ও স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো আর যাই হোক সুমিত আছে তাহলে।
ঘরে ফিরে সারারাত বসে ছিলো অপূর্ন । পুরোনো ভাবনা গুলো আবার ওকে উড়ালো আকাশে,বাতাসে। কাল সকালে সুমিত কে পেয়ে কোন কথাটা বলবে? সুমিত কেমন আছো ?
সুমিত আমি এসেছি ?
আমি সেই তোমার পূর্ন ভালবাসার চাঁদ আমি তোমার সেই অপূর্ন ।
অনেক আগে সুমিতের লেখা একটা কবিতা আছে অপূর্ন ’র কাছে; যেটা পড়ে ও ভাবে সত্যি সুমিত তাকে ভালোবাসে ভীষণ ভাবে।
কাল সকালে এই হাত আবার রাখবে হাত সুমিতের সেই হাতে; এবার বাবা,মা কিংবা পরিবারের কেউ আর আটকাতে পারবে না। চলে যাবে দূরে কোথাও।
সকালে ও স্নান সেরে সুমিতের দেয়া শাড়িটা পড়েছে। এ শাড়ি কোনদিন পড়েনি ও। আজ পড়েছে।
বাড়ির বাইরে এসে দেখে রবি দাড়িয়ে। অপূর্ন মনের আঙ্গিনায় পুলকিত হতে হতে পথ মারাচ্ছে। সেই বুক হাউসটার কাছে এসে থেমে গেছে রবি কাল তো এভাবেই থেমে গিয়েছিলো। কিন্তু সুমিত কোথায়?
এই সকালে বাজারে ভীড় নেই। বুক হাউসটাও খালি।
অপূর্ন বললো রবি ভাই কোথায় সুমিত?
রবি বললো দেখতে পারছো না?
অপূর্ন বললো না,তো। পুরোটা পথে দেখবার মতো কেউ নেই শুধু একসাইডে একটা পাগল বসে আছে। রবি হাত উচিঁয়ে বললো তোমার প্রিয় মানুষটাকে চিনতে পারছো না অপূর্ন !!!
না অপূর্ন সেদিন চিনতে পারেনি। অপূর্ন সেদিন মিনিট খানেক স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে ছিলো; কোথায় সুমিত !!!
পাগলটার কাছে গিয়ে দাড়াতেই অপূর্ন অবশেষে চিনতে পেরেছিলো এটাই তার ভালোবাসার জীবন্ত ভাস্কর্য সুমিত। কান্নার আওয়াজে পথের মানুষ ভীড় করে দাড়িয়েছিলো;যেন ম্যাজিক হচ্ছে।
সুমিতের দু হাত জড়িয়ে অপূর্ন কেঁদেছে কিন্তু সুমিত তবুও চিনতে পারেনি ওকে।
পুরো পাগল মুখভর্তি চুলের বাহার। পাগলটা কাঁদেনা ক্ষিদে পেলেও শুধু খাবার চায়। পুরো রাস্তার মানুষ গোল হয়ে দাড়িয়ে। অপূর্ন’র হাত থেকে খাবার নিয়ে খাচ্ছে পাগল সুমিত।
অপূর্ন বলে উঠে,
এই সুমিত আমাকে দেখ আমি তোমার অপূর্ন ?
এই দেখ তোমার শাড়ি পড়ে এসেছি আজ। তুমি না বলেছিলো এই শাড়ি যেদিন পড়বো সেদিন সারাদিন তোমার সাথে ঘুড়তে হবে। আজ আমি সারাদিন ঘুড়বো তোমার হাত ধরে। না সেদির অপূর্ন ’র হাত সুমিত ধরেনি। চিনতেই পারেনি।
০৮.
শ্যামা থেমে গেল।
গল্পটা শেষ।
আমি চোখ মুছলাম। ধূর কি,যে হয়েছে গল্প শেষ করবার পর আমার চোখ থেকেই পানি ঝড়ছে।
আমি ভাঙ্গা গলায় বললাম আচ্ছা; আপনি সুমিত, আর অপূর্ন’র জীবন কাহিনী জানলেন কিভাবে? আপনি ওদের কেউ হন মানে বন্ধু জাতীয়।
শ্যামা ব্যাগটা হাতে উঠিয়ে নিয়ে বললো কি,মনে হয় আপনার?
আমি বললাম প্লিজ বলুন না। না হলে সারারাত ঘুমুতে পারবো না। আর আমার সুমিত কে দেখতে ইচ্ছে করছে আর তার চেয়ে কষ্ট লাগছে অপূর্ন’র জন্য তাকে দেখতে পেলে একটা কথা বলতাম?
শ্যামা বললো কি কথা? আমি বললাম আগে আপনি বলুন আপনার সাথে সুমিতের কি সম্পর্ক?
শ্যামা মাথাটা নিচু করে বললো আমিই সেই অপূর্ন !!
কথাটা কানে যাবার সাথে সাথে ট্রেনটার হুইশেল বেজে উঠলো। গন্তব্যে এসে গেছি শ্যামা নামধারী অপূর্ন হাতে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাড়ালো। আমিও দাড়ালাম ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে ।
অপূর্ন আমার পিছু এসে দাড়ালো
আমি বিস্ময়ের ঘোর ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললাম আপনিই তাহলে সেই গল্পের নায়িকা; আচ্ছা সুমিত এখন কেমন আছে? আর তাছাড়া আপনিই বা কোথায় চলেছেন?
রেল গেটের বাইরে এসে অপূর্ন বললো সুমিত ভালো নেই!! আর আমি যদি এখানে থাকি তাহলে কষ্ট পাবো প্রতিনিয়তই যখনি পথ চলতে সুমিতকে দেখবো তখনই তো কষ্টের আকাশে দগদগে কালো মেঘ ভাসবে।
তাছাড়া আমি থাকলে সুমিত কে ওরা মেরে ফেলবে। আমি তাই দুরে চলে যাচ্ছি পাগল হয়ে ঘুরুক তবুও বেঁচে থাকুক।
আমি আবার বললাম কারা সুমিত কে মেরে ফেলবে ? অপূর্ন বললো কারা আবার আমার বাবা’র লোকেরা।
আর তাছাড়া আমার নামটাই তো অপূর্ন যার নামের মাঝে পূর্নতা নেই সে আর কার জীবনকে পূর্ন করবে বলুন।
আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে; এদিকে অপূর্ন’র রিকসা দাড়িয়ে আছে।
বিদায় নেবার আগে আমার হাতে একটুকরো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো এটা সুমিতের লেখা সেই কবিতাটা যেটা ছাপাতে পারেনি আপনি একটু চেষ্টা করে দেখবেন। আমি হ্যাঁ বলালাম।
জীবন কখনো কখনো এমন হয়...................
হাজার ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেল অপূর্ন আর আমি কবিতাটা পড়তে পড়তে পথ চললাম
কখনো কি ভাবতাম; এতো লোকের ভীড়ে তোমায় পাবো;
ভাবতে পারতাম না।
কখনো কি ভাবতাম; ; এতোটা পথ হেটে যাবো অবলীলায়
ভাবতে পারতাম না।
এখন ভাবতে পারি নির্ভাবনায়; আর আমি একা নই
আমার শূন্য দু’ হাত পরিপূর্ন তোমার ছোয়ায়
কখনো ছেড়োনা হাত,
করো না সংঘাত
আমি যে থাকবো মিশে তোমারই নিশ্বাসে নিশ্বাসে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন