এইতো আমি
বহু দূর থেকে সমুদ্র জলের প্রবল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে । ঢেউ প্রবাহের একটি গর্জন বার বার কানে এসে আঘাত হানছে সমুদ্রের ঐ অস্থির ঢেউগুলোর মত । কী অস্বাভাবিক তার কণ্ঠস্বর!
প্রবল বাতাসে নিজেকে একটি বায়ুশূন্য বেলুন বলে মনে হয় । ভয় হয়, কখন যে আবার এই হিংস্র বায়ু প্রবাহ আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায় ।
পশ্চিমে আকাশ আর জলের পার্থক্যটা ঠিক ধরতে পারছি না । কখনো মনে হয়, কই না-তো, এখানে কোনই আকাশ নেই, শুধুই সমুদ্র; পরক্ষনেই মনে হয়, কোথায় জল? কোথায় সমুদ্র? পুরটাইতো বিস্তৃত আকাশের একক সম্রাজ্য!
সে যাই হোক, হয়ত আকাশ, নয়তো সমুদ্র, নয়তো এদের মিলনে এসে অপ্রত্যাশিতভাবে যেন এক আগন্তুক নিজের পাওনাটুকু দাবি করে বসল । এই আগুন্তুকের নাম সূর্য । সূর্য এসেছে গোধূলির দাবি নিয়ে । নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা আকাশ আর সমুদ্রের মাঝে । সমুদ্রইবা কেন মেনে নেবে সূর্যের এই একগুঁয়ে দাবি । সমুদ্র তাকে একটু একটু করে নিজের পেটে পুরে নিচ্ছে আপোষহীন ভঙ্গীতে ।
আমার আশেপাশে আর কেউ নেই । সেন্টমার্টিনে একটি পাথর খণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছি । হাল্কা জলের মাঝখানে পাথরটি আমাকে বহন করে অনড় হয়ে আছে । হঠাৎ হঠাৎ দূর থেকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসা ঢেউগুলো পাথর খণ্ডে বাঁধা পেয়ে তীব্র শব্দে কাঁপিয়ে তুলছে আমাকে সহ পুরো পাথরটি । কিছু জল পাথরে ছিটকে এসে প্রতিবারে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভিজিয়ে চলছে ।
আমার নীল রঙের শাড়িটা সমুদ্রের জলে ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে । আমার পায়ের নূপুরগুলো রিং ঝিন শব্দে নেচে উঠছে কখনো কখনো । খুব সেজেছি আজ । ঠিক তুমি যেমনটি চাইতে । এই যে কপালের লাল টিপ!
তুমি বলতে, নীলিমা, নীল শাড়িতে তোমায় অপূর্ব লাগে! মনে হয়, ঐ আকাশ থেকে কিছু নীল এলো বুঝি আমার জন্য!
মনে আছে?
আমি বলতাম, তাহলে আমি কে?
তুমি বলতে, তুমি কেউ না । তুমি আমার মনের আকাশ! আমার নীল রঙের আকাশ! আমার মনের পৃথিবীতে একটি নীল আকাশ আর একটি সমুদ্র আছে । নীল আকাশ আমায় বাঁচার প্রেরণা দেয় । আমায় স্বপ্ন দেখায় । আর ঐ যে সমুদ্র! আমাকে অশরীরীর মত রাত জাগায় । স্বপ্ন দেখে ফেলব ভেবে, রাতে ঘুমোতে দেয় না । সমুদ্র বলে, মৃত্যুই নাকি আমার স্বপ্ন! বেচে থাকা আমার দুর্ভাগ্য! নীল আকাশ ও সমুদ্র একই সাথে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে । আমি বড় কষ্টে আছি নীলিমা! আমি কাকে বেছে নেব, আকাশ না সমুদ্র?
আমি বলতাম, চুপ করতো, এসব কী! তোমার শুধু একটি নীল আকাশ আছে ।
যদি শুধু একটি সমুদ্রই হয়!
কথাটি বলেই তুমি অস্বাভাবিক ভঙ্গীতে হাসতে । আমি বোকার মত তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতাম । এই হাসির অর্থ কতো খুঁজেছি!
তুমি চাইতে, মৃদু বাতাসে আমার চুলগুলো যেন মুক্ত পাখির মত উড়িয়ে দেই । সেই মৃদু বাতাস তুমি প্রান ভরে টেনে নেবে তোমার ফুসফুসে । দূষিত বায়ু নাকি তোমার ভেতরটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে চলে দিনরাত ।
আমি বলতাম, কী-যে অদ্ভুত কথা বলনা তুমি!
দেখো, আমি তোমার সমুদ্রে এসে চুলগুলো উড়িয়ে দিয়েছি । যেন এদের উপর এখন আর কোন দাবি নেই আমার । চুলগুলো যখন মুক্তির আনন্দে বাতাসের সাথে ভেসে চলে তখন নিজেকেও একটি উড়ন্ত পাখি মনে হয় অথবা আকাশের একখণ্ড ছন্নছাড়া মেঘ । কিন্তু কোথাও যেন আটকা পড়ে আছে এই উড়ন্ত পাখিটি কিংবা মেঘপুঞ্জ!
আমি নীল আকাশ হয়ে তোমার সমুদ্রকে বড় হিংসে হত । তোমার বনের এক রাজা হতে ছেয়েছিলাম আমার এক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে; এক বনে দুই রাজা থাকতে নেই ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি সমুদ্রকেই কাছে টেনে নিলে । সমুদ্রের টানে তুমি চলে এলে সুদূর সেন্টমার্টিনে । এক বারও ভাবলে না, তোমার নীল আকাশের কথা । অথচ তোমার নীল আকাশটি, তোমার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে আজ সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে ছুটে এলো ।
এবার নীল আকাশটাও যে সমুদ্র হতে চায়! কিন্তু কোথায় তুমি?
নীলিমার শেষ কথাটি বায়ু তরঙ্গে মিশে দূর দূরান্তে ভেসে চলল । কোথায় তুমি???
সমুদ্রের গর্জন, বায়ু প্রবাহ যেন তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে একটি অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল, এইতো আমি!!!
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন